সংবিধান একটি দেশের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে নাগরিক অধিকারের রক্ষাকবচ। একটি দেশ সংবিধান অনুযায়ী পরিচালিত হলে নাগরিক অধিকার বিঘিœত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। সংবিধান দেশের গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়। আর এ নিশ্চয়তাকে অর্থবহ করতে প্রয়োজন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকারসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধিরা নির্ধারিত সময়ের জন্য সরকার বা স্থানীয় সরকারসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করে থাকেন। এ নির্ধারিত সময়ে জনপ্রতিনিধিরা সরকার এবং সংসদ ও স্থানীয় সরকারসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সফলতা দেখাতে পারলে এক দিকে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, অপর দিকে তাদের পুনর্নির্বাচনের সম্ভাবনা উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে। কিন্তু অতীতের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে দেখা যায়, যতবারই অন্তর্বর্তী বা তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ততবারই অব্যবহিত পূর্ববর্তী সরকার পরাভূত হয়েছে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ব্যর্থতায়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন- পূর্ববর্তী ক্ষমতাসীন সরকার বিরোধী দলের দাবিকে অযৌক্তিক বলে আখ্যা দিয়ে সাংবিধানিক শাসনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছিল। অনুরূপ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল-পরবর্তী ক্ষমতাসীন সরকারও সাংবিধানিক শাসনের কথাই বলে আসছে। আদতে ক্ষমতাসীন সরকার সব সময় ‘সাংবিধানিক’ শাসনের দোহাই দিলেও সংবিধান অনুযায়ী যে দেশ পরিচালিত হয়নি, তা অতীতের ঘটনাপ্রবাহের প্রতি আলোকপাত করলে স্পষ্টভাবেই প্রতিভাত।
অন্তর্বর্তী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক, এ বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকলেও এ ব্যবস্থাটির প্রতি বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমানুষের সমর্থন রয়েছে। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সাংবিধানিক না অসাংবিধানিক, এ বিতর্কে না গিয়ে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের দাবিকে ক্ষমতাসীন বিএনপি সাংবিধানিক রূপ দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্থায়ী ব্যবস্থা করেছিল। যদিও উচ্চ আদালতের রায়কে উপলক্ষ হিসেবে দেখিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাটি বাতিল করা হয়েছে, কিন্তু রায়ের বক্তব্য অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার অসাংবিধানিক হয়ে থাকলে কেন রায়ের পর্যবেক্ষণে পরবর্তী দু’টি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে মর্মে অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে? দেশের ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতার কথা চিন্তা করেই সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী আনা হয়েছিল এবং ত্রয়োদশ সংশোধনী-পরবর্তীকালে সাংবিধানিকভাবে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত দু’টি নির্বাচনের নিরপেক্ষতার বিষয়ে বিজিত দল প্রশ্ন উত্থাপন করলেও তা যে তুলনামূলক বিচারে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের চেয়ে অনেক পরিচ্ছন্ন ছিল, এ বিষয়ে দেশের সচেতন জনমানুষের মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী-পূর্ববর্তী সংবিধানের প্রস্তাবনা এবং ৮, ৪৮ ও ৫৬ নম্বর অনুচ্ছেদ ব্যতীত অন্য কোনো অনুচ্ছেদের সংশোধনীর ক্ষেত্রে সংসদের মোট সদস্যসংখ্যার অন্যূন দু-তৃতীয়াংশের সমর্থন আবশ্যক ছিল। আর প্রস্তাবনা, অনুচ্ছেদ নম্বর ৮, ৪৮ ও ৫৬ এর ক্ষেত্রে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার দু-তৃতীয়াংশের সমর্থন পেলেও এরপর গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের সমর্থন প্রয়োজন ছিল। পঞ্চদশ সংশোধনী দ্বারা গণভোটের বিধান বিলোপ করে সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথম ভাগের সব অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয় ভাগের সব অনুচ্ছেদ, নবম-ক ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদগুলোর বিধানাবলিসাপেক্ষে তৃতীয় ভাগের সব অনুচ্ছেদ এবং একাদশ ভাগের ১৫০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামোসংক্রান্ত অনুচ্ছেদের বিধানাবলি সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোনো পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য করা হয়।
সংবিধানের চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ ভাগ যথাক্রমে নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগসংক্রান্ত। এ তিনটি ভাগের সাথে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো সম্পর্কযুক্ত। পঞ্চদশ সংশোধনী-পরবর্তী সময়ে সংবিধান সংশোধন বিষয়ে গণভোটের প্রথা রহিত করে যে শর্তারোপ করা হয়েছে তাতে প্রতীয়মান হয় Ñ বর্তমানে যে সরকার পদ্ধতি রয়েছে, তা সংশোধনের অযোগ্য।
বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাসে এবারই প্রথম একটি সংসদের মেয়াদ অবসানের অব্যবহিত আগে দলীয় সরকারের অধীনে সাংবিধানিক পন্থায় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সপক্ষে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব দীর্ঘ দিন ধরে বলে আসছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা নির্বাচন পরিচালনা এবং স্বল্পতম সময়ের জন্য দেশ শাসিত হলেও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ক্ষুণœ হয়। কিছুতেই অনির্বাচিত ব্যক্তিদের হাতে এক মুহূর্তের জন্য দেশ শাসনের ভার অর্পিত হোক এটা তিনি মেনে না নিতে পারার কারণেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অবসান ঘটিয়েছেন, আপাতদৃষ্টে তা প্রতীয়মান হলেও বাস্তবে কি অনির্বাচিত ব্যক্তিদের শাসন থেকে জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকারসংক্রান্ত সব প্রতিষ্ঠান মুক্ত হতে পেরেছে?
তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই দলীয় সরকারের অধীনে দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, শুধু এ বিবেচনায় একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন, প্রহসনমূলক ও নগণ্য ভোটার উপস্থিতির নির্বাচনকে কি গ্রহণযোগ্য বলা যায়? আর যদি গ্রহণযোগ্য বলা না যায়, তবে কেন দলীয় সরকারের অধীনে এরূপ ভোটারবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাহানা? বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে জোর দিয়ে বলা হয়েছে, তার শাসনামলে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। আর তাই তার অধীনে দশম সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে নাÑ এমনটি ধারণা করার কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু বাস্তবে আমরা যদি দশম সংসদ নির্বাচনের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের প্রতি আলোকপাত করি, তাতে দেখা যায় জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচনের জন্য উন্মুক্ত জাতীয় সংসদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৩টির প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন এবং অবশিষ্ট ১৪৭টি আসনে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাতে ভোটার উপস্থিতির বিষয়টি বিবেচনায় নিলে এটিকে কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক নির্বাচন হিসেবে আখ্যা দেয়ার অবকাশ নেই। তাই সাংবিধানিক শাসন ব্যাহত হবে, এ অজুহাতে ক্ষমতাসীন দলীয় সরকার যদি সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে ব্যর্থ হয়, তবে কি সে নির্বাচন এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের অভাব পূরণ করতে পেরেছে? অনুরূপভাবে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব যখন রাষ্ট্র পরিচালনায় এক মুহূর্তের জন্যও অনির্বাচিত ব্যক্তিদের শাসন মেনে নিতে পারছেন না, তখন কি করে তিনি দীর্ঘ দিন ধরে জনআকাক্সক্ষার বিপরীতে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দ্বিখণ্ডিত করে প্রশাসক দ্বারা শাসনকার্য চালিয়ে যাচ্ছেন? জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে কেন এ ভিন্নধর্মী অবস্থান? আর উভয় অবস্থানই যে একপেশে, মনগড়া এবং নিজ হীন স্বার্থচরিতার্থে নেয়া হয়েছে, তা বোধকরি স্বাভাবিক বুদ্ধিজ্ঞানসম্পন্ন কারো না বোঝার কথা নয়।
আইনের শাসন সাংবিধানিক শাসনের সমার্থক। আইনের শাসন অনুসৃত হলে সরকারের প্রতিটি বিভাগে জ্যেষ্ঠতা, দক্ষতা, যোগ্যতা, সততা ও মেধার ভিত্তিতে উৎকৃষ্টদের মূল্যায়নের মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত হয়। কিন্তু অতীতে এর ব্যত্যয় ঘটলেও বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর যেভাবে ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে, এ নজির শুধু আমাদের দেশ কেন, পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই।
সরকারের যেকোনো বিভাগে শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হলে যথাযথ কারণ ব্যতিরেকে জ্যেষ্ঠকে অতিক্রান্ত করে কনিষ্ঠকে মূল্যায়নের কোনো সুযোগ নেই। অতীতে এ ধরনের অতিক্রমণে ঘটনা খুব কমই ঘটেছে। কিন্তু বর্তমানে এত ব্যাপকহারে ঘটছে যে, প্রতিটি বিভাগেরই আদেশের শৃঙ্খল (Chain of Command) ভেঙে পড়ে দলবাজদের দৌরাত্ম্যে সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ এবং প্রকৃত দক্ষ, যোগ্য ও উৎকৃষ্টদের আত্মসম্মান নিয়ে চাকরিতে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।
জনমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগ ও বিচারকদের ভূমিকা অনন্য। বিচারকেরা যেমন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সদাসর্বদা সচেষ্ট থাকেন, ঠিক তেমন বিচারকেরাও আশা পোষণ করেন, তাদের অধিকার রক্ষায় কর্তৃপক্ষ সমভাবে সচেষ্ট থাকবে। কিন্তু যখন দেখা যায় জ্যেষ্ঠ ও উৎকৃষ্টদের সততা, দক্ষতা, মেধা ও যোগ্যতাকে অবমূল্যায়ন করে দলীয় বিবেচনায় নিকৃষ্ট ও অযোগ্যকে দেশের ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক পদে বসানো হয়েছে, তখন কী করে বলি Ñ আইনের শাসন ও সাংবিধানিক শাসনের ধারাবাহিকতায় এ কাজগুলো করা হয়েছে? সংবিধান ও আইনের যে বিধানাবলি রয়েছে, নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে দলমত নির্বিশেষে তা সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলে দেশে আইনের শাসন, সাংবিধানিক শাসন, গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিকশিত হবে। স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রতিটি সরকারই আইনের শাসন, সাংবিধানিক শাসন, গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখার কথা বলেছে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা কতটুকু করেছে তার হিসাব নিতে গেলে দেখা যায়, আইনের শাসন, সাংবিধানিক শাসন, গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়গুলো দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে যেভাবে লিপিবদ্ধ আছে, তা থেকে খুব একটা অগ্রসর হতে পারেনি। তাই সাংবিধানিক শাসন, আইনের শাসন, গণতন্ত্র এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়ে দীর্ঘ দিন ধরে মিথ্যাচারের সংস্কৃতির লালন করায় আমাদের অগ্রযাত্রা যেভাবে প্রতিটি সরকার দ্বারা ব্যাহত হয়েছে তা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে সম্মুখপানে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সফলতা কি কখনো আসবেÑ এ কথাটি ভেবে দেশবাসী উদ্বিগ্ন।
সাবেক জজ, সংবিধান ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন