বন্দরনগরী নারায়ণগঞ্জ আবারও ঝড় তুলেছে বহু আলোচিত সাত খুনের লোমহর্ষক ঘটনার মাধ্যমে। এর আগে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল নিরীহ, মেধাবী কিশোর তানভীর ত্বকী হত্যাকাণ্ডের নিষ্ঠুরতার কারণে। ত্বকীকে নিয়ে অনেক কালি ঝরেছে পত্রিকার পাতায়, শোকার্ত কণ্ঠের ভাষায়, ফেসবুকের সহমর্মিতায়। এ ঘটনার বিচার এখনো শেষ হয়নি। প্রতিবাদের রেশ এখনো অক্ষুণ্ন, থেকে থেকে মানববন্ধন চলছে তো চলছেই। এর মধ্যে উল্লিখিত গুম, হত্যার বর্বরতা।
অন্যদিকে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চে নারায়ণগঞ্জ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রচণ্ড ঢেউ তুলেছিল। তাতে সরকার দিনকয়েকের জন্য পিছু হটে এবং এর বদলা নিতে চক্রান্তের আশ্রয় নেয়। ঘটায় পুলিশ হত্যার মতো জঘন্য ঘটনা। আর সেই সূত্রে কারফিউ, ১৪৪ ধারা, গ্রেপ্তার, নির্যাতন। যে পরিবারটি তখন এ সুবাদে খ্যাতি অর্জন করছিল, এখন একাধিক সন্ত্রাসী ঘটনায় তাদের দিকেই জনতার একাংশ অভিযোগের আঙুল তুলেছে। নারায়ণগঞ্জ এভাবে গত ছয় দশক পরিসরে খ্যাতি ও কুখ্যাতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ঘটনার পর থেকে নারায়ণগঞ্জ নিয়ে পত্রিকায় ও টিভিতে যথাক্রমে বিরামহীন লেখা ও সংলাপ চলছে। এর কারণ, গোটা নারায়ণগঞ্জবাসী এখন গুম-খুনের আতঙ্কে প্রহর গুনছে। ভয়ে মানুষ মুখ খুলতে চাইছে না। কিছু বলতে হলেও সাতবার চিন্তা করছে এবং তা সংগত কারণে নিরাপত্তার কথা ভেবে। অবশ্য ত্বকী হত্যার পর মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথা বলেছে, প্রতিবাদ করেছে, সমাবেশ ও মিছিল-স্লোগান তুলেছে।
কিন্তু এই সাত খুনের ঘটনা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মানুষ কথা বলতে, মত প্রকাশ করতে ভয় পাচ্ছে, পাছে তারাও যদি গুম-খুনের শিকার হয়। সাতজন মানুষকে প্রায় একসঙ্গে অতি সহজে অপহরণ ও খুন এবং পরে শীতলক্ষ্যায় তাদের লাশ মানুষের চেতনায় প্রবল আঘাত করেছে। সে কারণে প্রতিক্রিয়া এত তীব্র ও ব্যাপক। অপরাধ কাহিনীর মতোই ঘটনা। এখনো ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ জানা যায়নি। তবে হয়তো জানা যাবে যদি কোনো জজ মিয়া সামনে এসে না দাঁড়ায়। কিংবা প্রশাসনিক অনীহা বাধা সৃষ্টি না করে।
সাত খুনের ঘটনাও কি জনশক্তিকে শিক্ষা দেবে না
নারায়ণগঞ্জ ঘটনার তাৎপর্য শুধু সাত খুনের সংখ্যায়ই সীমাবদ্ধ নয়, সে তাৎপর্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্টতায়, বিশেষ করে চৌকস বাহিনী র্যাবের জনাকয়েক সদস্যের সংশ্লিষ্টতায় এবং প্রশাসনিক উদাসীনতায়। নেপথ্যে রাজনৈতিক অন্তর্দ্বন্দ্ব, ক্ষমতা ও অর্থের বৈনাশিক প্রতিযোগিতা, যেখানে মানুষ আর মানুষ নয়। আর সাধারণ মানুষ অসহায়, নির্ভরহীন প্রবল সন্ত্রাসের প্রেক্ষাপটে।
তাই শুধু নারায়ণগঞ্জে নয়, সারা দেশের মানুষ চরম নিরাপত্তাহীনতা ও জীবন সম্পর্কে অনিশ্চয়তায় ভুগছে। ঘর থেকে বেরোলে সে-মানুষ আর ঘরে ফিরবে কি না তাই নিয়ে অনিশ্চয়তা। আর তা শুরু হয়েছে কিছুদিন আগে থেকে গুম-খুন অবিশ্বাস্য মাত্রায় বেড়ে যাওয়ায়। নিখোঁজ মানুষের লাশ পাওয়া নিয়েও নিশ্চয়তা নেই। কেউ ভাবেনি স্বাধীন বাংলাদেশ এমন গুম-খুন, ক্রসফায়ার, এনকাউন্টারের দেশ হয়ে উঠবে। তাতে জড়িত থাকবে তরুণ ছাত্র গ্রুপ, থাকবে স্বার্থপর শাসক রাজনীতি। আর সেসবে নীরব সমর্থন জানাবে দলীয় বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী কিংবা প্রতিবাদে সোচ্চার হবে না তারা।
লোভ-লালসা, দুর্নীতি, বিত্ত সঞ্চয় হয়ে উঠবে একমাত্র লক্ষ্য। সেখানে থাকবে সংঘাত, নিজ দলের মধ্যেই। দলীয় নেতার হাতে একই বা ভিনদলীয় নেতা খুন। স্বার্থের বেসাতি একমাত্র লক্ষ্য রাজনীতির, তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাজনীতির। এ প্রক্রিয়ার শেষ কোথায়? শেষ দেশের সর্বনাশে, ব্যক্তি-পরিবার ও সমাজের সর্বনাশে। এমনটাই চলছে বাংলাদেশে, রাজনৈতিক দলনির্বিশেষে। আজ একপক্ষ, কাল বা গতকাল প্রতিপক্ষ একই পদক্ষেপে চলছে, চলবে।
মিরপুরবাসী একজন মধ্যবয়সী গাড়িচালককে স্বগতোক্তি করতে শুনি নারায়ণগঞ্জের সাত খুন সম্পর্কে : 'মানুষ এত নিষ্ঠুর হয় কিভাবে? জান নিলে তো জান ফিরে পাওয়া যায় না। টাকার জন্য জান নেওয়া?' যে কথা একজন নিম্নবর্গীয় মানুষ বোঝে তা বোঝে না মধ্য বা উচ্চবর্গীয় মানুষ। কারণ তাদের কাছে ক্ষমতা ও বিত্তবৈভব আর সব কিছুর উর্ধ্বে, যেখানে মানবিক বোধের কোনো স্থান নেই। সেই স্বার্থের টানে ওরা পারে না এমন কোনো কাজ নেই। একজন মানুষের প্রাণ সে ক্ষেত্রে বড় তুচ্ছ জিনিস। একসঙ্গে সাত প্রাণ হলো বলিদান, কোনো বিষয়ই নয়।
এসব উচ্চমার্গীয় তত্ত্বকথা ছেড়ে নারায়ণগঞ্জের রক্তস্নাত নিষ্ঠুর বাস্তবতার প্রসঙ্গে ফেরা যাক। ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর, লাশ ভেসে ওঠার পর নারায়ণগঞ্জবাসী অধিকাংশ মানুষের ক্ষুব্ধ চেতনায় যে উপলব্ধি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হলো, এ নগর রাজনৈতিক স্বার্থের ও নৈরাজ্যের টানে এক অভিশপ্ত অঞ্চল। রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে, স্বার্থের দ্বন্দ্বে মুখ বুজে থাকা তথা নীরবতা বা সব কিছু মেনে নেওয়াই জান বাঁচানোর বড় উপায়। অন্যথায় প্রাণের বিনিময়ে শাস্তি ভোগ। আর সর্বোচ্চ উদ্বেগ ঘণ্টা বাজাতে থাকে যখন রক্ষককে দেখা যায় ভক্ষকের ভূমিকা নিতে।
ঘটনার শুরু থেকে এমন অভিযোগই উঠে এসেছে। কেউ বিশ্বাস করেছে, কেউ করেনি। প্রশাসনের ভূমিকা প্রথম দিকে এ ক্ষেত্রে অনেকটা অস্পষ্ট, ধোঁয়াটে। এ অনিশ্চয়তার সুযোগে সন্দেহভাজন মূল আসামি নির্বিবাদে পলাতক। একটি দৈনিকে খবর : পলাতক নূর হোসেন কলকাতায়। আরেকটি দৈনিকে খবর : 'চাঁদাবাজির টাকা যাচ্ছে নূর হোসেনের কাছে'। সে খবরে আরো বলা হয়েছে : 'নারায়ণগঞ্জে ৭ খুনের ঘটনায় দু-তিন দিন বন্ধ থাকার পর সহযোগীরা পুরোদমে নেমেছে চাঁদাবাজিতে।'
সে ক্ষেত্রে আমাদের প্রশ্ন : কী করছে প্রশাসন, কী করছে গোয়েন্দা-পুলিশ বা স্পেশাল ব্রাঞ্চ? চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা বাইরে কেন? তাদের কর্মকাণ্ড অর্থাৎ চাঁদাবাজি বন্ধ করা কি একেবারেই অসম্ভব? পূর্বোক্ত প্রতিবেদনে এমন কথাও লেখা হয়েছে : 'আতঙ্কের নাম নূর হোসেন'। যে কথা সাধারণ মানুষ জানে, সেই সূত্রে সাংবাদিকেরও জানা, সে তথ্য পুলিশ প্রশাসন জানে না? এটা কি কখনো হয়?
গণশুনানির ব্যবস্থা প্রশাসনের তরফ থেকে একটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- ওই মহা আতঙ্কবাজের বিরুদ্ধে কে সত্য কথা বলবে সাহস করে, কার ঘাড়ে ক'টা মাথা? তবু কেউ কেউ মুখ খুলছেন। কিন্তু তাঁরা কি আস্ত মাথা নিয়ে নিজ বাড়িতে ফিরতে পারবেন পরিবারের সদস্যদের কাছে, বা এ মুহূর্তে চাপের মুখে পারলেও কদিন পর ঘোলা পানি স্থির হলে, পরিস্থিতি শান্ত হলে সেই মানুষটি কি ঘর থেকে বের হলে গায়েব হয়ে যাবেন না এমন নিশ্চয়তা কোথায়? ঠিক এ কথাটি বলেছেন সিদ্ধিরগঞ্জে গণশুনানিতে আসা একজন সাধারণ মানুষ। একজন সাংবাদিকের কাছে সংগোপনে।
এ অবস্থার অবসান ঘটানো কি প্রশাসনের পক্ষে একান্তই অসম্ভব। অসম্ভব হবে না যদি শর্ষের মধ্যে ভূতের আশ্রয় গোটা প্রশাসনকে দূষিত না করে। র্যাবের বিরুদ্ধে, পুলিশের বিরুদ্ধে যে প্রচণ্ড ক্ষোভ ও ক্রোধ লক্ষ করা যাচ্ছে তাতে করেই বোধ হয় র্যাব ভেঙে দেওয়ার কথাও বলা হচ্ছে। এ অমানবিক বর্বরতায় তো র্যাবের জনাকয়েক সদস্য যুক্ত বলে ধারণা, সবাই তো আর দায়ী নন, তাহলে কেন র্যাব ভেঙে দেওয়া? বরং দরকার এর সংশোধন, প্রশিক্ষণ। তবে আমাদের মনে হয় বড় দরকার আদর্শগত, নীতিগত প্রশিক্ষণ, শৃঙ্খলাবোধের জন্য প্রশিক্ষণ।
ইতিমধ্যে গ্রেপ্তারকৃত র্যাবের তিন অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদও শুরু হয়েছে। কিন্তু শুধু নিরপেক্ষ নারায়ণগঞ্জবাসীই নন, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সাধারণ মানুষের আশঙ্কা (যা প্রকাশ পাচ্ছে কাগজে মুদ্রিত মতামতে) বিশেষ বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা হওয়ার সুবাদে অভিযুক্ত তিনজনের শুনানি, জিজ্ঞাসাবাদ কি যথাযথভাবে সম্পন্ন হবে, নাকি সেখানেও রাজনৈতিক সুবিধাবাদ কাজ করবে? এ সম্বন্ধে শেষ কথা বলার সময় এখনো আসেনি।
তবু ভোরের অবস্থা দেখে দিনটা কেমন যাবে তা আন্দাজ করার প্রবাদ থেকেই মানুষের আশঙ্কা, হতাশা। আশঙ্কা তাদের গ্রেপ্তারে অনেকটা সময় নেওয়া এবং তা আইনি প্রক্রিয়ার উপলক্ষে; আশঙ্কা মূল আসামির পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাওয়ার মতো একাধিক ঘটনা। আসলে বড় সমস্যা হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর রাজনৈতিক প্রভাব। সে ক্ষেত্রে বাহিনীর যেমন দোষ, তেমনি দোষ রাজনৈতিক দল ও প্রশাসনের। এ ঘোরচক্কর থেকে বাংলাদেশকে রেহাই পেতে হবে। এ সমস্যা চলে আসছে পাকিস্তানি আমল থেকে।
দেশে আজ যে গুম-হত্যা, অপহরণ, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতার ঘাটতি, এর কোনোটাই হঠাৎ আকাশ থেকে পড়া নয়। এর পূর্বচরিত্র ও ধারাবাহিকতা রয়েছে। এ ঘনঘটা কখনো বাড়ে, কখনো কমে রাজনৈতিক আবহাওয়ার অনুকূলে বা প্রতিকূলে। মানুষ ক্ষোভ জানিয়েই ক্ষান্ত হয়, এখানেই যত সমস্যা। ক্ষোভের-ক্রোধের যদি সংঘবদ্ধ বিস্ফোরণ ঘটত, তাহলে হয়তো অন্যায়-অনাচারের এতটা বাড়াবাড়ি ঘটত না। দেখা দিত না শর্ষের মধ্যে ভূত। পরোক্ষে এর দায় জনসাধারণের অর্থাৎ আমাদেরও। অন্যায়-অনাচার প্রতিরোধে আমরাও সংঘবদ্ধ, শক্তিমান প্রতিবাদ জানাতে পারছি না। এটাই এখন দেশের জন্য বড় সমস্যা।
লেখক : কবি, গবেষক ও ভাষাসৈনিক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন