দেশের জনপ্রিয় সংবাদভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল ৭১-এ একটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা শুরু করেছি সম্প্রতি। সকাল ৮টা থেকে ৯টা, এই এক ঘণ্টা ব্রেকফাস্ট-শো ধরনের এই অনুষ্ঠানটি অনেকেই দেখেন বলে ধরে নিচ্ছি। কারণ, অনেকেই ব্যক্তিগত-ভাবে কিংবা সোশ্যাল মিডিয়াতে যোগাযোগ করে এ বিষয়ে জানিয়েছেন। যেহেতু সকাল এবং দিন শুরুর অনুষ্ঠান, সেহেতু খুব ভারি রাজনৈতিক কিছু নিয়ে কথা বলাটা কেমন যেন মনে হয়, তাই প্রযোজক এবং অনুষ্ঠান বিষয়ক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীগণ এই অনুষ্ঠানটিকে সবকিছুর মিশেলে একটু হালকা-পাতলা করার চেষ্টা করেছেন। যে কারণে স্টুডিওতে একজন সেলিব্রিটি অতিথিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়ে থাকে বিশেষ করে যারা রাজনীতির বাইরে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে সুনাম অর্জন করেছেন। কিন্তু গত এক মাস ধরে এই অনুষ্ঠানটি চলছে, এমন কোন দিন খুঁজে পাইনি যেদিন আমরা দেশের কোন ইতিবাচক খবর নিয়ে আলোচনা করতে পেরেছি। বিগত এক মাসের অর্ধেকটাই গেছে নারায়ণগঞ্জের ৭ খুন এবং তার পূর্র্বাপর নিয়ে আলোচনায়। আর এক মাসের প্রতিটি অনুষ্ঠানেই আলোচিত বিষয়ের অন্যতম ছিল ভারতের নির্বাচন। স্বাভাবিকভাবেই এই দুটো বিষয় প্রতিদিনই নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষিত হয়েছে, কিন্তু এর বাইরে বিশেষ কোন আলোচনা ওঠানো সম্ভব হয়নি যা নিয়ে কি সাধারণ মানুষ, কি উপস্থিত অতিথি, কি টেলিসংযোগে যোগ দেয়া দেশের বিশিষ্ট সম্পাদকদের কেউ আলোচনা করতে পারেন। বার বার চেষ্টা করেও আমি নিজে পারিনি আলোচনার মোড় ঘোরাতে, অথচ, অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে এই দিনের শুরুতে খানিকটা স্বস্তিতে রাখা।
এই ব্যক্তিগত আখ্যান নিয়ে আলোচনা করতে চাইনি কিন্তু এ জন্য এখানে ওঠালাম যে, আজকাল আমরা আসলে প্রতিনিয়তই পরিচালিত হচ্ছি ঘটে যাওয়া ঘটনা দ্বারা। আমাদের চারদিকে প্রতিদিন ঘটছে অসংখ্য ঘটনা, তার সবই যে গণমাধ্যমে উঠে আসছে তা নয়, কিন্তু যা উঠে আসছে তা যে খুব একটা স্বস্তিদায়ক কিংবা ইতিবাচক নয়, সেটি বোঝানোর জন্যই এই ব্যক্তিগত ঘটনার উল্লেখ। এর বাইরে আমন্ত্রিত অতিথির সঙ্গে আলাপচারিতায় আমাদের যে বিষয়টি প্রায়শই উঠে এসেছে তাহলো, এই শহুরে জীবনের ব্যস্ততা, সৃষ্টিশীলতার অনুপস্থিতি এবং সর্বোপরি বিনোদন বলতে যে আমাদের সামনে আর কোন পদার্থ নেই, এগুলোই বার বার ঘুরে-ফিরে এসেছে। এক ধরনের ক্ষোভ চারদিকে, এক ধরনের অপ্রাপ্তি। সোশ্যাল মিডিয়াতে ব্যক্তি মানুষের স্ট্যাটাসগুলো যদি বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে দেখা যাবে যে, মানুষ প্রথমে রাজনীতিকে, তারপর সরকারকে, তারপর সিস্টেমকে, তারপর ব্যক্তি মানুষকে দোষারোপ করছে। উন্নত অনেক দেশেই সোশ্যাল মিডিয়ায় দেয়া স্ট্যাটাস নিয়ে গবেষণা চলছে বিশেষ করে এর থেকে রাষ্ট্রের ভূমিকা বিশ্লেষণে সমাজবিজ্ঞানীরা উপকরণ সংগ্রহ করছেন বলে জানা যায়। কিন্তু এদেশে এখনও এ বিষয়ে কোন গবেষণা হয়েছে বলে জানা যায় না। অথচ কেউ যদি একটু বিশ্লেষণী দৃষ্টি নিয়ে লক্ষ্য করেন তাহলে দেখতে পাবেন যে, সাধারণ মানুষ, তা সমাজের যে অবস্থান থেকেই আসুন না কেন, নিজস্ব বক্তব্য রয়েছে, দেশের পরিস্থিতি, সরকার, সমাজ এবং নানা অসঙ্গতি নিয়ে। এমনকি গণমাধ্যম নিয়েও সোশ্যাল মিডিয়াতে কম আলোচনা হয় না। সামান্য অসঙ্গতি বা ভুল-ভ্রান্তিও মানুষের দৃষ্টি এড়ায় না। এটা ভাল কি খারাপ সে বিশ্লেষণে না গিয়ে একথাটি জোর দিয়েই বলা যায় যে, মানুষের সচেতনতার বিষয়টি সোশ্যাল মিডিয়া আসলে অনেক বেশি স্পষ্ট করে দিয়েছে। আমার নিজস্ব ফেইস বুক দেয়ালেও দেখতে পাই যে, মানুষ ক্রমশ অস্থির থেকে অস্থিরতর হয়ে উঠছে। এটা কেবল অপ্রাপ্তি থেকে নয়, বরং সমষ্টির ভেতর দানা বাঁধছে নানা ধরনের ক্ষোভ এবং অসহায়তা। রাজনীতি নিয়ে প্রত্যেকেরই রয়েছে নিজস্ব বক্তব্য এবং রাজনীতিবিদগণও তাদের প্রতিদিনের কর্মকাণ্ডের জন্য সমালোচিত হচ্ছে নিয়মিত। বয়সভেদে, সামাজিক স্তরভেদে বক্তব্যের তারতম্য ঘটলেও মূল সুরটি কিন্তু খুব যে আনন্দদায়ক, তা নয়, বরং বেশ হতাশারই। বিগত এক মাসের টেলিভিশন অনুষ্ঠানে অনেকবার আলোচিত বিষয়ের একটি হচ্ছে, এদেশের মানুষের মধ্যে সব দোষ সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের সিস্টেমের বাইরে রাখার প্রবণতা। কথায় কথায় আমরা সরকারকে দোষারোপ করে থাকি, প্রশাসনকে অথর্ব বলে গাল দিয়ে নিজেরা নিরাপদ থাকতে চাই। প্রত্যেক অতিথিই একথাটি জোর দিয়েই বলেছেন যে, সরকারের কিংবা প্রশাসনের দায়িত্বের সঙ্গে ব্যক্তি মানুষের দায়িত্ব কিছুই কম নয়। বিশেষ করে সরকার একটি ধারণা মাত্র, যা অবয়ব পেয়ে থাকে মানুষের অংশগ্রহণেই। একই মানুষ মন্ত্রী হওয়ার আগে সাধারণ থাকলে মন্ত্রিত্ব গ্রহণের পর তিনি কেবল ‘সরকার’ হয়ে যান কী জাদুবলে? একই কথা প্রযোজ্য প্রশাসনের ক্ষেত্রেও। প্রশাসন তো আর স্বয়ম্ভু নয় যে, নিজে নিজেই চলতে পারে! প্রশাসন চালান দেশের সাধারণ নাগরিকের ভেতর থেকেই উঠে আসা মানুষেরা। কিন্তু প্রশাসনে ঢোকা মাত্রই তিনি কেমন করে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন সাধারণ থেকে এই প্রশ্নটি কিন্তু বহু পুরনো এবং এখনও সমানভাবেই আলোচ্য। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী এবং বিঘ্ন সৃষ্টিকারী দু’পক্ষই মানুষ, তারা গরু-মহিষ কিংবা অন্য কোন বোবা জন্তু নয়, তাহলে এক পক্ষ যদি আইন ভঙ্গ করে তাহলে আরেক পক্ষ কেবলই আইন রক্ষা করে যাবে এবং তাদের ভেতর আইন ভাঙ্গার প্রবণতা দেখা যাবে না, তা আশা করাটা নিঃসন্দেহে দুরাশাই। কারণ, দু’পক্ষই সমস্ত মানবীয় গুণাবলী নিয়ে আইন রক্ষা এবং বিঘ্ন সৃষ্টি করার কাজটি করছেন। প্রশ্ন হলো, এই চক্কর থেকে বেরুনোর পথটা কি? কে ঠিক করে দেবে সে পথ? কে আবার? রাষ্ট্র? রাষ্ট্র কী করবে? রাষ্ট্র আইন করবে। আইন কে বানায়? মানুষ। আইনের প্রয়োগ ঘটায় কে? মানুষ। আইন ভাঙ্গে কে? মানুষ। আবার সেই চক্রের ভেতরই ঢুকে যাচ্ছি আমরা। এই চক্রব্যূহ ভাঙ্গার উপায় কি এখনও বেরোয়নি? অবশ্যই বেরিয়েছে, নইলে আমরা কথায় কথায় বিদেশী রাষ্ট্রের উদাহরণ টানি কেন? আমাদের সামনে উদাহরণ রয়েছে, প্রয়োগ রয়েছে, কেবল আমরা সেগুলো হয় এড়িয়ে যাই, নয় ভুলে যাই।
যেমন ধরুন, একজন অসৎ ব্যবসায়ী মাছে ফরমালিন নামক বিষ মেশালো। হয়ত বুদ্ধিমানের মতো তার বাড়িতে যে মাছগুলো খাওয়া হবে সেগুলোতে ফরমালিন মেশালো না কারণ তার প্রিয় সন্তান সে মাছ খাবে বলে তার মনের ভেতর ভয় হলো। কিন্তু মাছ তো আর কাঁচা খাওয়া যাবে না। মাছের জন্য তাকে মসলা কিনতে হবে, কিনতে হবে তরিতরকারি। মসলা কিংবা তরি-তরকারির ভেতরও তো অন্য ব্যবসায়ী বেশি মুনাফার জন্য ইতোমধ্যেই বিষ মিশিয়ে বসে আছেন। তাহলে? তার মানে হচ্ছে, আমরা ঢুকে পড়েছি একটি বিষের শেকলে এবং এই শেকল আর কোন প্রাণীর নয়, মানুষের। যে ডালে বসে আছি সে ডালটিই কাটার মতো এরকম বোকা প্রাণী বোধ করি আর কেউ নেই। পাখিরা গাছে বাসা করে কিন্তু কোন পাখি কোনদিন গাছটিকে মেরে ফেলার চেষ্টা করে না। কিন্তু মানুষ করছে, নিজের সন্তানকে মারার পথ সুগম করে রেখেছে মানুষই এবং তা জেনে-বুঝেই। এখানে সরকারের দায় কতটুকু? আর আবারও সেই পুরনো কথাই চলে আসছে, সরকারও তো চলছে মানুষের দ্বারাই!!
অনেকেই এই নিজের ক্ষতি করার প্রবণতাকে ব্যাখ্যা করতে চান লোভ দিয়ে কিংবা টিকে থাকার লড়াই দিয়ে। আসলে কি তাই? আমরা কি কেবল লোভের বশবর্তী হয়েই অনায়াসে নিজের ক্ষতি করে যাচ্ছি? কিংবা টিকে থাকার জন্যই কেবল নেমেছি এই ভয়ঙ্কর খেলায়? আমার নিজস্ব ব্যাখ্যাটি একটু ভিন্ন। আমার মনে হয়, আমরা একই সঙ্গে স্বার্থপর হয়েছি, লোভী হয়েছি এবং বাঁধা পড়ে আছি ‘আমিত্ববাদের’ নিগড়ে। ‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম’- প্রবাদটি বাংলা ভাষায় প্রায়শই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তার মানে হচ্ছে আমার বেঁচে থাকার প্রয়োজনে বাকিদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়ায় কোন অসঙ্গতি নেই। সমষ্টি থেকে আমরা ক্রমশ ছুটে যাচ্ছি।
অনেক সমাজবিজ্ঞানীই ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন যে, ধনতন্ত্র মানেই আমিত্ববাদ। একার ভাল থাকা, একার টিকে থাকা। কিন্তু সমাজতন্ত্রও টিকল কই? বহুজনকে একত্বীকরণ করে রাখার চেষ্টাও ব্যর্থ হলো কিংবা তাকে জোর করে করানো হলো সে বিতর্কে না যাই, কিন্তু আজকে আমাদের চারপাশে তাকালে কি নিজের চোখেই অসঙ্গতি ধরা পড়ে না? নাকি আমরা সে দৃষ্টিভঙ্গিই হারিয়ে ফেলেছি? মানুষ নিজেকে, সমাজকে, রাষ্ট্রকে শুদ্ধ করার জন্য প্রবল বুদ্ধি খাটিয়ে ধর্মকে এনেছে এ পৃথিবীতে, কিন্তু ধর্মের এতকাল বয়স পেরুনোর পরও তো পৃথিবীতে কাক্সিক্ষত শান্তি এনে দিতে পারেনি। বরং এখন ধর্মগুলো একে অন্যের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে গিয়ে সেই পুরনো রক্তপাতের ধারাতেই ফিরে গেছে। এই যে বার বার আমাদের পেছনে ফিরে যাওয়া তাকে হয়ত অনেকেই নিয়তি বলে মেনে নেবেন কিন্তু সামনের দিনগুলোর কথা কি একবারও আমরা ভাবব না? রাষ্ট্রের ওপর, কিছু মানুষের ওপর দোষ চাপিয়ে নিজেরা নিজেদের রক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা করতে গিয়ে ক্রমশ শেষ হবো? শিকার হবো? আমরা পশ্চিমকে দোষ দেই এই পথে আমাদের টেনে আনার জন্য, আমরা ক্যাপিটালিজমকে আঘাত করি কিন্তু নিজেরা তার থেকে এক চুলও নড়তে পারি না। ব্যক্তিপ্রেম যদি পশ্চিমের শিক্ষা হয় তাহলে সমষ্টিকে নিরাপদে রাখার শিক্ষাও পশ্চিম আমাদের দিতে চেয়েছে, কিন্তু আমরা নিয়েছি কি?
প্রতি সপ্তাহেই রাজনীতি কিংবা রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে লিখি কিন্তু আজকে লিখতে বসে মনে হলো, আমরা যে ভয়ঙ্কর বিনোদনহীন, স্বার্থপর সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি তা নিয়ে কিছু লেখা প্রয়োজন। জানি না, এতে কাজ হবে কি-না, কিন্তু কাজ যে হতেই হবে সে দিব্যিই বা কে দিলো? একমাত্র খাবার ছাড়া নিজেকে আমি কিছু দিচ্ছি না- এই ভাবনা, তা রীতিমতো আতঙ্কের, কিন্তু যে খাবারটা খাচ্ছি তাও তো সেই বিষের শেকল থেকে আসা। তবে কী ভাবে ঘটবে আমার মনের মুক্তির? মোহ থেকে, লোভ থেকে, রিরংসা থেকে আমায় উদ্ধার করবে কোন্ শক্তি? আত্মশক্তির সে ক্ষমতা আসবে তো? আশাবাদী হতে ইচ্ছে করে খুউব, সব সময়ই।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন