ছাত্রজীবনের প্রায় শেষভাগে ঋত্বিক ঘটকের 'মেঘে ঢাকা তারা' ছবিটি দেখেছিলাম। ঢাকার শিক্ষিত সমাজে ছবিটি বড় রকমের সাড়া জাগিয়েছিল। ছবির নায়িকার (সুপ্রিয়া) করুণ আর্তি- 'দাদা, আমি বাঁচতে চাই' আজও কানে বাজে। মুহূর্তের জন্য হলেও উদাস হয়ে ভাবি, জীবন কী, জগৎ কী, জীবনের সঙ্গে জগতের কী সম্পর্ক। মৃত্যু এত করুণ কেন? এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর পাইনি। তবে নির্দ্বিধায় মনে হয়েছে, একমাত্র জালেম, হত্যাকারী ও পাপিষ্ঠ ছাড়া সব মানুষের মৃত্যুই দুঃখজনক, বেদনাবহ; এমনকি বয়োবৃদ্ধের মৃত্যুও। আর কোনো হত্যাই আমি সহজে গ্রহণ করতে পারি না; যুদ্ধ ক্ষেত্রের হত্যাও নয়।
প্রাণিজীবনের সবচেয়ে প্রিয়তম ও মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে তার প্রাণ। প্রাণের অবসানে প্রাণী হয়ে যায় একটি নিঃসাড় জড় পদার্থ। মানুষের ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে একটি নরকঙ্কাল। পৃথিবীর সব সমাজে, সব ধর্মে মানুষের প্রাণ ধারণের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। একইভাবে কতিপয় ব্যতিক্রমধর্মী চিহ্নিত ক্ষেত্র ছাড়া বাকি সব ক্ষেত্রে প্রাণ সংহারকে জঘন্যতম অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রায় সব দেশের শাসনতন্ত্রে জীবন ও সম্পদ রক্ষার অধিকারকে মৌলিক নাগরিক অধিকার হিসেবে সর্বোচ্চ স্থান দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানেও নাগরিকের জীবন ও সম্পদ রক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, জীবন ধারণের অত্যাবশ্যকীয় উপাদানসমূহ প্রাপ্তির অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
জীবন যখন বিপন্ন সব কিছুই নগণ্য
দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতার পর নাগরিকের জীবন ও সম্পদের অধিকার বাংলাদেশে কখনো যথাযথভাবে সুরক্ষা পায়নি। বাস্তব অবস্থা সংবিধানে বিধৃত আদর্শ অবস্থা থেকে ভিন্নরূপ। নাগরিকের জীবনকে সর্বোচ্চ স্থান দেওয়া হয়নি, তার সম্পদকে তো নয়ই। বরং দেখা গেছে, নাগরিকের জীবন ও সম্পদকে প্রায় সর্বনিম্ন গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয়। দরিদ্র নাগরিক, সাধারণ নাগরিক, অসহায় নাগরিক হলে তো কথাই নেই। তাদের জীবনের কোনো দাম নেই, তাদের সম্পদ ভোগের অধিকার অতীব সীমিত। তাদের নিজের সম্পদও লুটেরা দুর্বৃত্তদের নির্বিঘ্নে ভোগের উপকরণ।
বাংলাদেশের নাগরিকের জীবনের গুরুত্ব ও মূল্য সম্পর্কে একটি গল্প প্রচলিত আছে। কোনো এক জাহাজের খোলা জায়গায় তিনটি দেশের নাগরিক গল্প করছিল। এর মধ্যে বাংলাদেশের দুজন যাত্রী ছিল। একপর্যায়ে বাহাদুরি দেখানোর পালা এসে যায়। এ সময় তারা জাহাজের রেলিংয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। পশ্চিমা দেশের নাগরিক বলে, হাতে পরা ঘড়িটি তার কাছে এমন কিছু বড় জিনিস নয়। এই বলে সে হাতের দামি ঘড়িটি সাগরে ছুড়ে মারে এবং নিজের বাহাদুরিতে গর্ব অনুভব করে। তার বাহাদুরিকে খর্ব করে জাপানি যাত্রী তার হাতের ক্যামেরাটি সাগরে ফেলে দিয়ে বলে এসব দামি জিনিসে তাদের কোনো আসক্তি নেই, খুব সহজেই এসব সামগ্রী তারা বিসর্জন দিতে পারে। বাংলাদেশি যাত্রী তখন নিজের বাহাদুরি দেখানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েছে। তার কাছে সাগরে ফেলে দেওয়া যায় এমন কোনো উল্লেখযোগ্য দামি সামগ্রী নেই। অথচ বাহাদুরি তাকে দেখাতে হবে। কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব না করে সে তার পাশে দাঁড়ানো স্বদেশি নাগরিককে জোরে ধাক্কা দিয়ে সাগরে ফেলে দিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। বলতে লাগল, আমাদের দেশের এ ধরনের লোককে বিসর্জন দেওয়া কোনো ব্যাপারই নয়। কোটি কোটি নাগরিকের মধ্যে এ রকম কয়েকজনকে মেরে ফেললে তাতে দেশের কিছু আসে-যায় না। কথাটি আজ বাস্তব অর্থে সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমরা দেখছি শুধু লাশের মিছিল। স্বাভাবিক মৃত্যু আমাদের দুঃখ দেয়; মৃত ব্যক্তি আর ফিরে আসে না। চিরতরে হারিয়ে যায়। প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম মনে করে শেষ পর্যন্ত মানুষ তা মেনে নেয়। কিন্তু আমরা তো দেখছি ঝড়, ঝঞ্ঝা, বন্যা, মহামারি, সড়ক দুর্ঘটনা, লঞ্চডুবিতে প্রাণ হারানো অসংখ্য লাশ। যাদের বাঁচার কথা ছিল, অল্প বয়সে যারা জীবনকে আঁকড়ে থাকতে চেয়েছিল, তাদের চলে যেতে হলো, হারিয়ে যেতে হলো। গাঁয়ের মানুষটি বাজ পড়ে মারা গেল, সাগরের টানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রটি অতলান্তে চলে গেল, বন্য হাতির পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে পাহাড়ি জনপদের মেয়েটি প্রাণ হারাল। এসব মৃত্যু আমাদের দুঃখ-বেদনা শত গুণ বাড়িয়ে দেয়। তবু আল্লাহর ইচ্ছা, প্রকৃতির রোষ বলে আমরা এসব মৃত্যুকেও মেনে নিতে চেষ্টা করি। কিন্তু কোনো ধরনের বিচার ছাড়া, যুদ্ধাবস্থায় জাতীয় পর্যায়ে ঘোষিত সিদ্ধান্ত ছাড়া হত্যাকারী মানুষের হাতে নিরপরাধ নিরস্ত্র মানুষের মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। ডজনে ডজনে মানুষ খুন হয়েছে। গুম হয়েছে আরো কয়েক হাজার মানুষ। এমন অবস্থা যেকোনো মানুষকে সংক্ষুব্ধ করে।
দূর অতীতের গুম-খুন নিয়ে আজকের কলামে আলোচনা করতে যাচ্ছি না, এ আলোচনা দীর্ঘ হবে, যার জন্য কলামে স্থানসংকুলান হবে না। আমি অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া খুনগুলোর 'পলিটিক্যাল সোশিওলজির' মধ্যে আলোচনা সীমিত রাখতে চেষ্টা করব। অতীতে মানুষ খুন করা ছিল হাতে গোনা নগণ্যসংখ্যক দুর্বৃত্তের মূল পেশা। সদলবলে দস্যুতা ছাড়াও তারা ভাড়ায় খাটত। তবে বড় মাপের নামিদামি সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিকে তারা খুন করতে সাহস করত না। থানা-পুলিশ তাদের চিনত এবং মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে থানা, জেল, হাজতে তাদের জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটে যেত। প্রথম জীবনে বেপরোয়া দুর্ধর্ষ থাকলেও প্রৌঢ়ত্বের শেষভাগে ও বার্ধক্যে তারা স্তিমিত ও অনেকটা নির্জীব হয়ে যেত। সামাজিকভাবে তারা ঘৃণ্য, অপাঙক্তেয় ও পদ-পদবিহীন অবদমিত সদস্য হিসেবে কালাতিপাত করত। সহায়সম্পদ তেমন একটা ছিল না বললেই চলে। থাকলেও লোকজন নেহাত ঘৃণার চোখে সে সম্পদের দিকে তাকাত। গত দু-তিন দশকে এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। অর্থ ও বৈষয়িক সম্পদের প্রভাব সমাজকে গ্রাস করেছে। দৃশ্যমানভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান ঘটেছে, ভোগ ও সম্পদ আহরণ যাদের জীবনের মূল উপজীব্য। নৈতিক ও আদর্শিক বিবেচনার পরিসর মারাত্মকভাবে সংকুচিত হয়ে আসছে।
এ সুযোগে খুনি, দাঙ্গাবাজ, লুটেরা, দুর্বৃত্তরা নিজেদের পরিসরে সমাজপতি হয়ে গেছে। এরশাদ সিকদার, নূর হোসেন, তরিকুল, পিচ্চি হান্নান সবারই উত্থানের কাহিনী প্রায় একই। কয়েক বছর পর তারা হয়তো সংসদ সদস্য হয়ে যেত। এমন কয়েকজন যে সংসদ সদস্য হয়নি, তেমনটি বলা যাবে না। আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটেছে। বিয়েশাদির মাধ্যমে দুর্বৃত্তরা দেশের প্রশাসনিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ অন্যান্য অঙ্গ সংস্থায় ঢুকে পড়েছে। সে সংস্থাগুলোকে তারা আংশিক হলেও কলুষিত ও দুর্বৃত্তায়িত করছে। জনবল, ধনবল ও পেশিবলে বলীয়ান হয়ে তারা দেশের মূল ক্ষমতাচক্রকে ঘিরে ধরেছে। ফলে এমন এক জটিল শক্তিকাঠামোর সৃষ্টি হয়েছে, যাকে কার্যকরভাবে ভেঙে ফেলা এখন একটি দুঃসাহসিক ও দুঃসাধ্য কাজ। মূল শক্তিবলয়ের সমর্থন-সহযোগিতায় দুর্বৃত্তরা আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কুরে কুরে খাচ্ছে।
অবস্থা এখন এমন হয়েছে যে নিরীহ সাধারণ নাগরিকদের জীবন বিপন্ন। তারা ভালো কাজ করার সময় ও উদ্যোগ পাচ্ছে না। স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকা ও স্বাভাবিক মৃত্যু আশা করতে পারাই যেন তাদের জীবনের পরম পাওয়া। অন্য সব কিছু তাদের কাছে নগণ্য। তাদের জীবন ও জীবনের মৌলিক অধিকারগুলো কিভাবে রক্ষা করা যায়, সে চিন্তায় তারা সতত উদ্বিগ্ন। এর ফলে দেশে বিনিয়োগ ও সৃষ্টিশীল কর্ম ভয়ংকরভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
ভাবতে দুঃখ লাগলেও এ কথা সত্য, এ দেশ বীরের দেশ, বলির দেশ। বলিখেলা, হোলিখেলা, জারি, সারি, যাত্রাপালা, ষাঁড়ের লড়াই, ঘোড়দৌড়, নৌকাবাইচ, ভাটিয়ালি-ভাওয়াইয়া, বাউলসংগীত, মরমিগান, ঈদের চাঁদ, পিঠাপুলি, বারো মাসে তেরো পার্বণ- এগুলো নিয়ে ছিল আমাদের সীমিত সম্পদের সুখীসমাজ। আমাদের নেতা-নেত্রীরা ছিলেন সীমিত আয়ের সংগ্রামী মানুষ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মজলুম, ত্যাগী, প্রতিবাদী সত্তা। মত-পথের পার্থক্য থাকলেও তাঁরা প্রায় সবাই ছিল কোনো না কোনোভাবে আদর্শ-আশ্রয়ী। আমাদের শক্তিমান পড়শির 'রোল মডেল' ছিলেন দিদার বলির মতো লোক, যাঁরা শক্তির কসরত দেখিয়ে মানুষকে নির্মল আনন্দ দিয়েছেন, কিন্তু খুনখারাবিতে জড়িয়ে পড়েননি। বর্তমানের মধ্যবিত্ত ও 'কমপ্রাডর' বুর্জোয়া প্রভাবিত সমাজের খুনখারাবির সংস্কৃতি থেকে আমরা সীমিত সম্পদের সেই নিষ্কলুষ, নির্দোষ সুখসমৃদ্ধ ঐতিহ্যে ফিরে যেতে পারব কি না সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আমাদের দেশের এলাকাভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতিতে (Constituency Based Electoral System)গুম-খুন-দাঙ্গা একটি অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গ হিসেবে বারবার ফিরে আসবে। সম্পদের মোহ ও আর্থিক লাভের উদগ্র তাড়না গুম-খুনের সংস্কৃতিকে স্থায়ী রূপ দেবে বলেই আপাতত মনে হচ্ছে। নাগরিকের প্রতিবাদী সত্তার বিস্ফোরণ ঘটলে এ ধারণা ভুল প্রমাণিত হতে পারে।
লেখক : সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন