মোদির প্রধানমন্ত্রিত্ব : লাভ না ক্ষতি?
16 May, 2014
২০১৪ সালে ভারতের যে নির্বাচন, সেখানে এবার দুটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। এক, কংগ্রেস ভালো করছে না- এটা বিভিন্ন জরিপের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি। জরিপগুলো কংগ্রেসের নির্বাচনে বড় জয় না পাওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছে। যেমন পরিবারতন্ত্র ও দুর্নীতি। এটা ছাড়া দ্বিতীয় মেয়াদে মনমোহন সিং, না সোনিয়া গান্ধী, নাকি রাহুল গান্ধী- কে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা অর্জন করবেন, এ নিয়ে একটা দোলাচল পরিস্থিতি নজরে আসছে। ফলে ভারতের সাধারণ মানুষের মধ্যে এটা নিয়ে এক ধরনের দোদুল্যমানতা লক্ষ করা গেছে। দুই, বিভিন্ন আলোচনা, জরিপে বিজেপি ভালো করবে বলে প্রকাশ করা হচ্ছে। ভারতের মিডিয়াগুলোতেও বিজেপিকে নিয়ে এক ধরনের উচ্ছ্বাস আমরা দেখতে পাচ্ছি। নরেন্দ্র মোদির যে ইমেজ দেখা যাচ্ছে, তার একটা মূল কারণ মোদি নিজেই। সেখানে একটা বড় উদাহরণ হয়ে আছে গুজরাট। গুজরাটে তিনি উন্নয়নের যে ধারা দেখিয়েছেন, সেখানে অনেকে আশা করছে, এবার মোদি নির্বাচিত হলে সারা ভারতে এমন উন্নয়নের জোয়ার বইবে। ভারত তার দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক মন্দা থেকে মুক্তি পাবে। মুক্ত হবে বাণিজ্যের নানা দিক।
মোদির প্রধানমন্ত্রিত্ব : লাভ না ক্ষতি?
নরেন্দ্র মোদির এই ইমেজের পেছনে কয়েকটি কারণ আছে। প্রথমত, অবশ্যই তিনি নিজে। তিনি একটি ব্যক্তি, ব্র্যান্ড হিসেবে করপোরেট সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছেন। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অন্যান্য বিষয় যেমন বিজ্ঞাপন, মিডিয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে নিজেকে তুলে ধরার জন্য সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করে কাজ করেছেন। দ্বিতীয়ত, মোদি-আলোচনার আরেকটি বড় বিষয় সাম্প্রদায়িকতা। গুজরাটের রায়টের ঘটনায় সেখানে হাজার হাজার মামলা রয়ে গেছে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এখানে এখনো প্রশ্ন রয়ে গেছে, এবার বিজেপি ক্ষমতায় এলে আবার আগের সেই অবস্থা ফিরে আসবে কি না! শুধু এই অনিশ্চয়তাকেই ঘিরে অনেকে শঙ্কার মধ্যেও আছেন। বিষয়টিকে অনেকে মূল্যায়ন করছেন এভাবে যে ভারত যেভাবে গঠিত হয়েছে, সেখানে একক সম্প্রদায়, ধর্ম- এসব গুরুত্বপূর্ণ নয়। নানা ধর্ম, জাতি, পাহাড়ি কিংবা আদিবাসী- সব নিয়েই ভারত গঠিত। সুতরাং সেখানে কেউ যদি একক ধর্মের কথা বলে রাজনীতি করতে চায়, সেটা ততখানি সুবিধাজনক বলে মনে হয় না। যতক্ষণ না আমরা নির্বাচনের ফলাফল জানতে পারছি, ততক্ষণ পর্যন্ত এই অনিশ্চয়তা থেকেই যাবে।
আজকে যে ফল প্রকাশিত হচ্ছে, সেখানে বিজেপি যদি ২০০ বা এর বেশি আসন পায়, তাহলে সেখানে এক ধরনের হিসাব। আর যদি ২০০-এর কম আসন পায় তাহলে অন্য ধরনের হিসাব-নিকাশ হবে। একক সরকার গঠন করতে বিজেপিকে ২৭২টি আসন পেতে হবে। তারা যদি এককভাবে ২০০ আসন পায়, তাহলে অন্য ছোট পার্টি বা জোটের সঙ্গে অ্যালায়েন্স করে আর বাকি আসন নিয়ে নিতে পারবে। তখন সেখানে বিজেপির একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হবে। সরকারের মধ্যে স্থিতিশীলতা আসবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, সাম্প্রদায়িকতার জায়গা থেকে আমরা তাঁকে সমালোচনা করলেও তিনি যদি শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে পার্লামেন্টে আসতে পারেন, তাহলে হয়তো তাঁর আগের অবস্থান পরিবর্তনের চেষ্টা করবেন। সেখানে তিনি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবেন। নিজেকে সর্বভারতীয় অবস্থান থেকে দেখতে চেষ্টা করবেন।
আমরা এরই মধ্যে দেখেছি, নরেন্দ্র মোদির কারণে পশ্চিমা দেশগুলোতে টেনশন শুরু হয়ে গেছে। যদিও তারা আবার এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, যিনিই প্রধানমন্ত্রী হোন, তাঁর সঙ্গেই তারা কাজ করবে। মোদিকে ভিসা দেওয়ার ব্যাপারেও তারা একমত হয়েছে এখন। আসলে মোদিকে ভিসা না দেওয়ার পেছনে কারণ ছিল হিটলারকে নিয়ে মোদির কথা বলা, হিটলারের গুণগান গাওয়া। সেখানেই তাদের আপত্তি ছিল। মোদি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে একটা শক্তিশালী অ্যালায়েন্স গড়ে তোলার চেষ্টা করবেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তারা একটা মিডটার্ম ইলেকশনের দিকে যাওয়ারও চেষ্টা করতে পারে। এদিকে চীনের ব্যাপারে তাদের ভেতরে ভেতরে ভালো ধরনের সমঝোতা হয়েছে, যেটা সবার জন্যই ভালো বলে মনে হয়। এসব বিষয় আসলে নির্ভর করবে যদি বিজেপি ২০০-এর ওপরে আসন পেয়ে ক্ষমতায় যেতে পারে তাহলেই। যদি ২০০-এর কম আসন পায়, তবে তাকে বড় দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতায় যেতে হবে। জয়ললিতা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ আরো যাঁরা আছেন, তাঁদের নিয়ে সরকার গঠনে মোদি কতখানি নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারবেন, সেটা তখন একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। তখন একটা নড়বড়ে সরকার হবে। হয়তো পরিস্থিতি খারাপ হলে আবার মিডটার্ম নির্বাচনও হতে পারে। আর এটা এবার বিজেপির জন্যও কঠিন চ্যালেঞ্জ। কারণ এবার যদি সে তার ইমেজ প্রতিষ্ঠা করতে না পারে তবে আগামী ২০ বছরেও আর তা পারবে না। তাই ক্ষমতায় এলে সে পুরনো ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার সব চেষ্টা করবে বলেই মনে হয়।
আর ২০০ বা তার চেয়ে বেশি আসন পেলে একটা শঙ্কাও থেকে যায়। যেমন এত দিন পর্যন্ত যাদের, অর্থাৎ তৃণমূল পর্যায় থেকে যাদের তিনি লালন করেছেন, তাদের একটা সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা আছে। তারাও তো ক্ষমতা পেলে সেটা বাস্তবায়ন করতে চাইবে। তখন মোদির অবস্থা কী হবে? তিনি কি তাদের নিবৃত্ত করতে পারবেন? নাকি যাদের এত দিন প্রশ্রয় দিয়েছেন, তাদের ফেলে দেবেন? এই শঙ্কা থেকেই যায়। যেটা আমাদের ভাবায়। তবে মোদির জন্য যেটাই হোক না কেন, সেখানে মোদিকে নিজেকে নতুন করে দাঁড় করাতে হবে। পুরনোকে বিদায় করে নতুন করে সাজাতে হবে সব কিছু।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন