তার সাথে আমার কোনো পরিচয় ছিল না ইতিপূর্বে। সেদিনই প্রথম দেখা হলো। তখন মুনাজাত করছিলাম। নারায়ণগঞ্জের এমপি নজরুল ইসলাম বাবুর ছেলের জন্মদিনের অনুষ্ঠান ছিল সেদিন। জাতীয় সংসদের মেম্বারস কাব প্রাঙ্গণে বিরাট আয়োজন। হাজার দশেক লোকের ভূরিভোজের আগে ছেলের জন্য মুনাজাত করার সময় হলে আমার বন্ধ বাবু এমপি বললেন Ñ হুজুর লাগবে না; রনি করুক। আমি আল্লাহর দরবারে হাত তুলে বন্ধুপুত্রের জন্য অন্তর থেকে দোয়া করছিলাম। মঞ্চে তখন শ’ খানেক লোক আর সামনে হাজার পাঁচেক। পেছন থেকে কে যেন বলে উঠলÑ বাহ, ভারি সুন্দর তো, চালিয়ে যান Ñ উইকেট পড়বে না। মুনাজাত শেষে ডান দিকে তাকিয়ে দেখি, শামীম ওসমান। তিনি এগিয়ে এলেন এবং করমর্দন করলেন। এরপর আমাদের বহুবার কথা হয়েছে এবং বহু প্রসঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আজ আর সেই প্রসঙ্গে যাবো নাÑ বলব অন্য কথা।
নারায়ণগঞ্জের সাথে আমার আত্মীয়তা, ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক বহু দিনের। আমার চাচাতো ভাই বিয়ে করেছেন সেখানকার সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী পরিবারে। সেই সুবাদে ওই শহরের প্রায় সব বড় ব্যবসায়ীকেই চিনি বা চিনতাম। রাজনৈতিক লোকদের চিনতে শুরু করেছি এমপি হওয়ার পর। জেলার সব এমপির সাথেই আমার ছিল দহরম মহরম। এর বাইরে বিএনপির নেতাদের চিনি নানা কারণে। অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার এবং আমি গত ১০ বছর একই বিল্ডিংয়ে অফিস করি। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর নারায়ণগঞ্জের ডিসি হন শামসুর রহমান, যিনি আমার নির্বাচনী এলাকার মানুষ। এরপর হলেন Ñ মনোজ বাবু। খুবই ভালো সম্পর্ক ছিল আমাদের মধ্যে। বিশেষ করে তার মেয়ের কারণে। আমার মেয়ে নন্দিতা এবং মনোজ বাবুর মেয়ে মন্দিরা একই কাসে পড়ে ভিকারুননিসায়। আর এমপি নজরুলকে চিনি সেই ১৯৮৮ সাল থেকে। নজরুল এবং আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এফ রহমান হলে একসাথে থাকতাম ছাত্রজীবনে। এত কথাবার্তা বা গালগল্পের একটাই অর্থ Ñ নারায়ণগঞ্জ সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা অন্য সব কলামলেখকদের মতো নয়; হয়তো একটু ভিন্ন প্রকৃতির কিংবা ভিন্ন মাত্রার।
এবার নারায়ণগঞ্জের সাতটি চাঞ্চল্যকর গুম এবং পরে গুম করা লোকদের গলিত লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভেসে ওঠার আগে ও পরে সব মানুষের সন্দেহের তীর ছিল শামীম ওসমানের দিকে। মানুষজন সন্দেহ করছিল এবং তাকেসহ তার পরিবারকে ভর্ৎসনা করছিল। শামীম শত চেষ্টা করেও মানুষের মনে কোনো স্থান পাচ্ছিলেন না। তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, আচরণ এবং উল্টাপাল্টা কথাবার্তা শুনে মানুষের সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়। অতীত থেকে আজ অবধি শামীম ওসমান এবং তার পরিবারের প্রতি স্থানীয় জনগণ তো বটেই, বলা যায় দেশবাসী বিুব্ধ। মূলত বিরূপ প্রচার প্রপাগান্ডা, দলীয় হাইকমান্ডের একেক সময় একেক নীতি Ñ কখনো দ্বিমুখী আবার কখনো ত্রিমুখী নীতি এবং শামীম ওসমানের চোপা এবং হাত ঝোলানোর অভ্যাসের কারণে তার ইমেজের বারোটা বেজে গেছে। আর বাকি ইমেজ নষ্ট হয়েছে তার কর্মকাণ্ডের জন্য। বাংলাদেশে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী সব সময়ই নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবারের অন্ধভক্ত ছিলেন। সেই বঙ্গবীরই লিখলেন Ñ এবার নারায়ণগঞ্জ গিয়ে সদ্য প্রয়াত জাতীয় পার্টির এমপি নাসিম ওসমান সম্পর্কে একটি শব্দ উচ্চারণ করতে সাহস পেলাম না জনরোষের ভয়ে!
শামীম ওসমান যখন দেখলেন, জনমত ও জনরোষ দিন দিন তার বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে এবং তাতে ঘি ঢালছেন তারই প্রতিদ্বন্দ্বী মেয়র আইভি; তখনই দুঃসাহসী কাজটি করে ফেললেন। নিহত ব্যক্তির শ্বশুরকে দিয়ে বোমাটি ফাটালেন কিন্তু তার আগে নিজের জীবন হুমকির মুখে Ñ এই মর্মে থানায় জিডি করে রাখলেন। দেশবাসী নতুন করে ঠাট্টা মশকারা শুরু করল। তারা বললÑ যমের আবার মৃত্যু ভয়! নারায়ণগঞ্জে শামীম ওসমানের জীবন হুমকির মুখে! লোকজন যখন ঠাট্টা মশকারা করছিল, তখন আমার মনে হয়েছিল শামীম ওসমানের জিডি করার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। কেননা অতীতে যতবারই তার সাথে কথা বলেছি, তাতে কোনোবারই তাকে বোকা বলে মনে হয়নি। মানুষ নাকি বেশি লম্বা তার মোটাতাজা হলে স্বভাবগতভাবেই বেআক্কেল হিসেবে পয়দা হয়। সে ক্ষেত্রে শামীম ওসমান সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম এবং ব্যতিক্রম তার ভাইয়েরাও!
কাজেই শামীম যখন জিডি করলেন, তখন ধরে নিলাম তিনি শক্ত কিছু একটা করতে যাচ্ছেন। তিনি সেটা করলেনও। বোমা ফাটালেন র্যাবের বিরুদ্ধে। র্যাবের তিনজন কর্তা, একজন মন্ত্রীর ছেলে এবং বঙ্গবন্ধুর আত্মীয় এক প্রভাবশালী এমপির ছেলেকে জড়িয়ে অভিযোগ উত্থাপন করালেন Ñ ছয় কোটি টাকা ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে র্যাব এই নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। র্যাবের কর্তাব্যক্তিরা কোন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা লেনদেন করেছেন, এই তথ্যও ফাঁস করে দেন খুন হওয়া প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদ চেয়ারম্যান। প্রথমে সবাই ধারণা করল, শহীদ চেয়ারম্যান হয়তো শামীম ওসমানের বিরুদ্ধ লোক। কিন্তু অচিরেই সবাই টের পেলেন যে, শামীম ওসমানের ভরসা আশ্রয় এবং পৃষ্ঠপোষকতায় নিহতের পরিবার র্যাবের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পেরেছে। রাতারাতি দৃশ্যপট উল্টে গেল। সারা দেশের মানুষ র্যাবের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগল। সব শ্রেণীপেশার মানুষ ধিক্কার জানাতে আরম্ভ করল এবং এই প্রথমবারের মতো সুশীলসমাজ মানববন্ধনের জন্য রাস্তায় নেমে এলো। ক্ষমতাসীন দল প্রমাদ গুনল। র্যাবের অভিযুক্ত কর্মকর্তাসহ অনেককে প্রথমে বদলি এবং পরে তিন কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হলো।
ক্ষমতাসীন দল পুলিশ ও বেসামরিক প্রশাসনেও ব্যাপক রদবদল করল। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হলো না। বরং জনরোষ বাড়ছে দিন দিন। মানুষ সরকারি দলকে বিশ্বাস ও আস্থায় আনতে পারছে না। নানারকম সন্দেহ। অমূলক কথাবার্তা ও গুজবে প্রতিদিন বাংলাদেশের আকাশ বাতাস ভারী হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, নারায়ণগঞ্জের নিহত হওয়া সাত হতভাগ্য ব্যক্তির মৃত্যুকালীন আর্তচিৎকার এবং তাদের রক্ত জমিনে জিবরাইল ও আজরাইলের কান্না হিসেবে বাংলার ঐতিহাসিক অশনি সঙ্কেতরূপে আবির্ভূত হয়েছে। অনেকে বলছেন, এমনটিতো হওয়ার কথা ছিল না। আমি বলছি, এমনটিই হওয়ার কথায় আমরা যদি সতর্ক না হই এবং তওবা করে সঠিক পথে ফিরে না আসি, তবে আগামী দিনে পরিস্থিতি হবে আরো ভয়াবহ।
প্রথমে নারায়ণগঞ্জে ক্ষমতাসীন দলের ভ্রান্ত রাজনীতি নিয়ে কিছু কথা বলে নিই। তারপর বলি বর্তমান সমস্যার কারণÑ করণীয় এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে। ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ শাসনামলে শামীম ওসমান বিভিন্ন কারণে বিতর্কিত ও নিন্দিত ব্যক্তিতে পরিণত হন। বিএনপির পুরোটা শাসনামল এবং পরবর্তী ১/১১-এর আমলে তিনি ছিলেন বিদেশে। তার কথাবার্তা শুনলে মনে হয়, দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং বিদেশী কোনো কোনো সংস্থার লোকজনের সাথে তার ভালো সম্পর্ক ছিল এবং আছে। ইতিপূর্বে তিনি নারায়ণগঞ্জসহ ঢাকা শহরের পেশিশক্তির রাজনীতির একজন ধারক ছিলেন Ñ এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ২০০৯ সালের সরকারের তিনি কিছুই ছিলেন না; বরং পদে পদে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হচ্ছিলেন। এ নিয়ে তার ব্যক্তিগত হতাশা ও ক্ষোভের অন্ত ছিল না। তিনি পুনরায় আলোচনায় আসেন ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনের প্রাক্কালে। শেখ হাসিনা আন্তরিকভাবেই চেয়েছিলেন, শামীম ওসমান পাস করে আসুক। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। জিতে যান আইভী। ফলে শামীম পুনরায় বেকায়দায় পড়েন। নারায়ণগঞ্জের রাজনীতি নিয়ে গত ১২ বছর ধরে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছে। সেখানকার সদর আসনটিতে কাকে মনোনয়ন দেয়া হবে কিংবা দলে শামীম ওসমানের প্রাধান্য থাকবে কি থাকবে না Ñ এ নিয়েই সিদ্ধান্তহীনতা। একেক নেতার একেক ধরনের কূটকৌশল ইত্যাদি কারণে শামীম ওসমান যেমন ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন, তেমনি স্থানীয় আওয়ামী লীগে দেখা দিয়েছে চরম ভ্রাতৃঘাতী বিরোধ। কোনো বিরোধী দল বা জামায়াত-শিবির-হুজির দরকার নেই। নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের জীবননাশের জন্য নিজ দলের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাই-ব্রাদারই যথেষ্ট। এরই ধারাবাহিকতায় সাতটি খুনের নির্মম ঘটনা ঘটল।
এখন প্রশ্ন হলো, এই ঘটনায় র্যাব জড়াল কিভাবে এবং কেন? থানা পুলিশ বা বেসামরিক প্রশাসন কি অভিযুক্ত র্যাব কর্মকর্তাদের কুকর্মের ভাগ পেত? এসব কর্মের সাথে শামীম ওসমান কতটুকু জড়িত? ইত্যাদি আলোচনার আগে র্যাব নিয়ে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি বলে নেই। প্রথমেই বলতে চাই, আমি র্যাব বিলুপ্ত করার পক্ষে নই। দেশের অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বদনামের তুলনায় এখনো র্যাবের সুনাম অনেক বেশি। র্যাবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কর্নেল জিয়া আমার সহপাঠী হওয়ার কারণে বাহিনীটির কর্মকাণ্ড সম্পর্কে যেমন কিছুটা ধারণা আছে, তেমনি জিয়ার সুবাদে আরো অনেক র্যাব কর্তাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। আমার পরিচিতজনদের কাউকেই মদ-মেয়ে, জুয়া কিংবা ঘুষ দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ত হতে দেখিনি। অন্য দিকে জিয়া কোনো দিন ছাত্রলীগ বা অন্য কোনো রাজনীতি করত না। আবার বর্তমান সরকারের প্রভাবশালী লোকজনের সাথেও তার কোনো দহরম মহরম নেই। ন্যায্য হলে সে সবার কথাই শোনে আবার অন্যায্য হলে কারো কথাই শোনে না। আমি বলছি মন্ত্রী-এমপিদের কথা। এর বাইরে প্রধানমন্ত্রী বা তার বাহিনীপ্রধানের কথা সে কিভাবে সমীহ করে, তা আমার জানা নেই। কাজেই নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় র্যাবের নাম আসায় আমি ব্যক্তিগতভাবে হোঁচট খেয়েছি। আমার মনে হয়, র্যাবের সৎ কর্মকর্তারাও মারাত্মকভাবে অপমানিত হয়েছেন সতীর্থদের কুকর্মের কারণে। কাজেই বাহিনীটির সার্বিক অস্তিত্ব ও সুনাম অুণœ রাখার স্বার্থে দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা হওয়া দরকার। আর প্রক্রিয়ায় এমন কিছু ঘটতে পারে যার ফলে আগামী দিনে ক্ষমতাসীনেরা হয়তো আরো বিপদে পড়তে পারেন। এ দেশের সচেতন মহল বেশ ভালো করেই জানে, র্যাব ও পুলিশের মধ্যে মারাত্মক দ্বন্দ্ব রয়েছে। তেমনি পুলিশ সদর দফতর ও মন্ত্রণালয়ের দ্বন্দ্ব কারো অজানা নয়। বিভিন্ন ক্যাডার সার্ভিসের আন্তঃবিরোধ, বিচার বিভাগ, দুদক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দূরত্ব দিন দিন বাড়ছে। এসব পুরনো ও ক্রমবর্ধমান সমস্যার আগুনে পেট্রল ঢালছে বিভিন্ন আসনে ক্ষমতাসীনদের দলবাজি, অবৈধ নিয়োগ, অযোগ্য লোকদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব প্রদান, অনৈতিক পদোন্নতি আর স্বজনপ্রীতির নির্লজ্জ প্রবণতা। বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিসের কাফন হয়েছিল সেদিন, যেদিন জনতার মঞ্চের নায়কেরা সরকার কর্তৃক পুরস্কৃত হয়ছিলেন। কেউ যদি বলেন, কাফন তো হয় মরার পর। তা হলে সিভিল সার্ভিস মরল কবে? আমি বলব, স্বাধীনতার পরপরই মরেছিল। যখন পাকিস্তানের অনুগত এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী সিএসপিদের স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসনে যোগদানের সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল, তখন থেকে শুরু হয়েছে ‘মরণ’। কাফন-কাফনের পর কবর রচনা এবং সবশেষে চল্লিশা। গত পাঁচ জানুয়ারির ভোটারবিহীন সংসদ নির্বাচনের প্রধান সাহায্যকারী হিসেবে এ দেশের সিভিল সার্ভিস তাদের কবর রচনা করেছিল আর নারায়ণগঞ্জের ট্র্যাজেডির মাধ্যমে চল্লিশা বা চেহলাম পালন করছে।
এবার নারায়ণগঞ্জ প্রসঙ্গে আসি। হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। তাই দায়দায়িত্ব অবশ্যই রাজনৈতিক নেতৃত্বের। অন্য দিকে র্যাব বা প্রশাসনের অন্য যাদের নাম আসছে, তারা সবাই রাজনৈতিক পরিচয়ে পরিচিত এবং রাজনৈতিক প্রভাবে কর্মস্থলে নিয়োগপ্রাপ্ত। ফলে স্থানীয় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের দুষ্কর্মের হাতিয়ার হতে ওদের কোনো লজ্জা লাগেনি। এতবড় হত্যাকাণ্ডের পেছনে ব্যয়কৃত বিপুল অর্থও তারা আয় করেছিল অবৈধভাবে এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে। দুর্ভাগ্য, সৌভাগ্যক্রমে নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিরা ধরা পড়েছে। কিন্তু ধরা পড়েনি, এমন উদাহরণ এ দেশে রয়েছে অনেক।
দেশের বর্তমান অবস্থা নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীরা খুবই চিন্তিত। চার দিকেই কেমন যেন এক উত্তপ্ত ও অস্থির অবস্থা বিরাজ করছে। এমনতরো অবস্থায় অনাকাক্সি ঘটনা ঘটতে পারে যেকোনো সময়। অর্থাৎ এ ধরনের পরিস্থিতিতে দেশ-সমাজ-রাষ্ট্র কোনো বাঁধাধরা নিয়ম বা নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্যে চলতে পারে না। ফলে সকালে এক সিদ্ধান্ত হয় তো বিকেলে অন্য একটা। একজন একটি কাজের অনুমোদন দেন তো অন্যজন হুট করে নিষিদ্ধ করেন। সবখানেই এক ধরনের হঠকারী অবস্থা বিরাজ করে। ফলে মানুষের মন থাকে দুঃখভারাক্রান্ত, সমাজে কেউ কাউকে ছাড় দেয় না। অপমান ও অসম্মান করাই হয়ে ওঠে ক্ষমতাসীনদের প্রধান পেশা এবং নেশা। আর এ অবস্থায় মানুষ একজন আরেকজনের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। কথায় কথায় যাকে-তাকে সন্দেহ করা শুরু করে। একসময় ভীরু কাপুরুষের মতো একা একা গোস্বায় ফোঁস ফোঁস করতে থাকে, ঠিক যেন গোখরা সাপের মতো। আপনারা অবাক হবেন Ñ সাপের কোনো চোখ নেই, কান নেই এবং বেশির ভাগ ফণা তোলা সাপের বিষও নেই। তার পরও অকারণে কেবল সন্দেহের বশবর্তী হয়ে সাপগুলো ফণা তুলে ফোঁসফাঁস করতে থাকে। যারা ভীত লোক তারা তো সেসব ফোঁসফাঁসের শব্দ শুনেই চিৎপটাংÑ দাঁতে দাঁত লাগিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। অজ্ঞান অবস্থায় অনেকে আবার কাপড়চোপড়ও নষ্ট করে ফেলে। বেশির ভাগ লোকই তো মারা যায়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, সাপের কামড়ে মৃত লোকদের শতকরা ৯০ জনই মারা যায় হার্ট অ্যাটাকে। অর্থাৎ ফণা তোলা বিষহীন সাপ কামড় দিয়েছে বা দিতে উদ্যত হয়েছে এই দৃশ্য দেখামাত্রই তিনি চিৎপটাং হয়ে হার্ট অ্যাটাকের শিকার হয়েছেন।
নারায়ণগঞ্জের ট্র্যাজেডির ঐতিহাসিক অশনি সঙ্কেত ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। অভিযুক্ত র্যাব কর্তাদের গ্রেফতার করা হবে এবং রিমান্ডে নেয়া হবে। হয় সিআইডি, নয় ডিবি পুলিশের কাস্টডিতে রিমান্ড হবে। রিমান্ডে এমন সব কাক্সিত অধ্যায় বের হয়ে আসবে, যাতে র্যাবের অস্তিত্ব নিয়েই টানাটানি শুরু ----। র্যাব বলবে, এটা চক্রান্ত। রিমান্ডের নামে জোর করে মনগড়া স্বীকারোক্তি আদায় করে র্যাবকে জনসম্মুখে হেয় করা হচ্ছে। ফলে র্যাব-পুলিশের পুরনো বিরোধ মারাত্মক আকার ধারণ করবে। একে ---চেষ্টা করবে পুলিশকে অন্যকে ফেলার জন্য এবং এসব কর্মকাণ্ডের কোনো একসময় যদি শামীম ওসমানের আশঙ্কা বাস্তবায়ন হয়ে যায়, তাহলে দেশবাসী বোধহয় খুব একটা অবাক হবেন না। অন্য দিকে অভিযুক্ত র্যাব কর্মকর্তার শ্বশুর এবং ‘মহাত্মা’ দীপু চৌধুরীর আব্বা তার সাম্প্রতিক কথাবার্তা, আঙুলের নড়াচড়া এবং ঠোঁট, ভ্রƒ ও জিহ্বার কর্মকুশলতার কারণে বেশ ঝামেলায় আছেন। তাকে বোধহয় বিদায় নিতেই হবে। অন্য দিকে নিরাপত্তার জন্য হলেও শামীম ওসমানকে হয় জেলে, নয় বিদেশে যেতে হবে। এতে করে নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমানপন্থীদের ওপর হয়তো বা দুর্যোগ নেমে আসবে। আবার তিনি যদি বাইরে থাকেন, তবে অজানা আশঙ্কা সর্বদা তাকে তাড়া করবে। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের অবস্থা হবে Ñ শাঁখের করাতের মতো।
একটি রাজনৈতিক সরকারের ক্ষমতার উৎস হলো জনগণ। তাদের বন্ধু হলো, তাদেরই প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলো আর ভিত্তি হলো জনগণের প্রতি বিশ্বাস। বর্তমান ক্ষমতাসীনেরা জনগণকে বিশ্বাস করে না। নিজেদের সর্বোচ্চ শক্তি ব্যয় করে তারা বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে। তারা এসব করেছেন রাষ্ট্রের প্রশাসনযন্ত্রকে ব্যবহার করে। ফলে যা হওয়ার হচ্ছে। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা মনে করছেন, আমরাই তোমাকে ক্ষমতায় বসিয়েছি। ফলে তারা আর আগের মতো আনুগত্য দেখতে না-ও চাইতে পারেন। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সব সময় স্নায়বিক চাপে রাখা হবে হয়তো। এ সময় সবচেয়ে মারাত্মক হয়ে দেখা দেবে Ñ ইন্টার সার্ভিস পলিটিক্স। একটি সংস্থা বলবে আমরা না হলে কিছুই হতো না। অন্যটি বলবে, অসম্ভব! থানা পুলিশের সাহায্য ছাড়া কেউ কি কোনো কিছু করতে পেরেছে কোনো কালে? আমলারা বলবেন বোকারা বলে কী! আমরাই তো ছিলাম রিটার্নিং অফিসার। ভোট গণনা-কারচুপি, ফলাফল ঘোষণা, গেজেট নোটিফিকেশন Ñ সবই তো আমরা করেছি। কাজেই আমরাই সব। রাজনৈতিক নেতৃত্বের এসব বিরোধ নিষ্পত্তির কোনো নৈতিক যোগ্যতা থাকবে না। তারা পুতুল হয়ে সুতোর টানে কেবল রচনা করবেন পুতুলনাচের ইতিকথা।
নারায়ণগঞ্জের সাত খুনকে অস্থির সমাজের বর্জ্য বা ময়লা হিসেবেই দেখছেন সমাজবিজ্ঞানীরা। কোনো তরল পদার্থ গরম হলে ময়লাগুলো ওপরে ভেসে ওঠে। আর ঠাণ্ডার সময় ময়লা থাকে নিচে। ঘোর বর্ষায় যদি বন্যা হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তবে বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই ঘোলা পানি প্রবাহিত হওয়া শুরু হয়। সমাজ যদি অস্থির হয়, তবে মন্দ ও কুৎসিৎ ঘটনাগুলো শিরোনাম হয়ে ওঠে। শান্তির সময় শিরোনাম হয় সৃষ্টিশীল মহৎ কর্মগুলো। কবিরা সুন্দর সুন্দর কবিতা রচনা করেন। সুরকার সৃষ্টি করেন অমর সুরলহরী। প্রকৃতি তার শীতল বাতাস, ফুল ও ফল দিয়ে সৃষ্টিশীল মানুষদের ঔদার্যকে বাড়িয়ে দেন বহু গুণে। অন্য দিকে দুর্যোগ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে সবকিছু উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। টগবগিয়ে ফুটতে থাকে সবকিছু। সমাজের সব গোপন ও কুৎসিত বিষয় চলে আসে প্রকাশ্যে। মানুষ দিনের কাজ করে রাতে এবং রাতের কাজ করে দিনে। যে কাজ করা দরকার গোপনে, তা করে প্রকাশ্যে আর যা করা দরকার প্রকাশ্যে, তা করে গোপনে। এবার দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে আপনিই বলুন Ñআমরা কোন দিকে যাচ্ছি?
(নয়া দিগন্ত)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন