|
অলিউল্লাহ নোমান
|
|
বিকাশমান গণতন্ত্রে শীতলক্ষ্যায় ডুবন্ত মানবাধিকার
08 May, 2014
গত সপ্তাহ জুড়ে নারায়ণগঞ্জে ৭ খুন নিয়ে তোলপাড় চলছে। অপহরণের পর খুন। শীতলক্ষ্যায় ভেসে ওঠা লাশ। খুনের সঙ্গে খোদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জড়িত থাকার অভিযোগ। র্যাব-১১ এর কমান্ডিং অফিসারের চাকরিচ্যুতি। সবকিছু যেন এলোমেলো করে দিচ্ছে। র্যাবের কমান্ডিং অফিসারসহ ৩ জনকে চাকরিচ্যুতির সংবাদ এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো ৬ কোটি টাকা নিয়ে খুন করা হয় ৭ জনকে। এই র্যাব কর্মকর্তা হলেন এক মন্ত্রীর মেয়ের জামাতা। তার বিরুদ্ধে অনেক খুনের অভিযোগ রয়েছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে তার দাপটে কাঁপত পুরো প্রশাসন। নারায়ণগঞ্জ থেকে লক্ষ্মীপুর গিয়ে বিরোধী নেতাদের খুনের নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। জামায়াতে ইসলামির এক নেতাকে বাড়ির ছাদে গুলি করে হত্যার ইঙ্গিতও ছিল তার প্রতি। গ্রামে একটি প্রবাদ শুনতাম। পাপে বাপকেও ছাড়ে না। মুরব্বিরা বলতেন পাপ বালেগ হলে একদিন ধরা পড়তে হয়। জানি না ওই র্যাব কর্মকর্তার পাপ বালেগ হয়েছে, নাকি এখনও কুরুবুলব্লুগ।
কুরুবুব্লুগ শব্দটা নতুন লাগতে পারে। আসলেও নতুন। তখন ছিল রমজান মাস। গ্রামের মসজিদে চলছে খতমে তারাবির প্রস্তুতি। বয়সে তরুণ একজন হাফেজ সাহেব তারাবারি নামাজের জন্য ইমাম নির্ধারণ হলেন। একদল মানুষের আপত্তি। বললেন, ওই হাফেজ সাহেব এখনও বালেগ হয়নি। তাই তার পেছনে নামাজ হবে না। কিছু মুরব্বি ফতোয়া দিলেন। বললেন, বালেগ না হলেও তিনি কুরুবুলব্লুগ। তার পেছনে নামাজ হবে। আরবি দুটি শব্দ মিলিয়ে এই উচ্চারণটি করা হয়। শব্দ দুটি হচ্ছে ‘কারিবুল বলুগ’। যার বাংলা তরজমা হচ্ছে বালেগের কাছাকাছি।
গ্রামের প্রবীণ মুরব্বিরা আরবি উচ্চারণটিকে সঠিকভাবে না বলতে পেরে বলেছেন কুরুবুলব্লুগ। সবাই তখন বোঝে নিয়েছেন আসলে তারা কি বলতে চেয়েছিলেন। নারায়ণগঞ্জের র্যাবের সিও সাহেবের পাপও কতটা বালেগ হয়েছে সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে আপাতত লক্ষণে দেখা যাচ্ছে বালেগ না হলেও কুরুবুব্লুগ হয়েছে। এই খুনাখুনি নিয়ে দেশজুড়ে যখন তোলপাড় চলছে, সরকারের তথ্যমন্ত্রী তখন বললেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিকাশমান। শীতলক্ষ্যায় যখন ডুবন্ত মানবাধিকার, হাসানুল হক ইনু সাহেবের ফতোয়া হচ্ছে বাংলাদেশ হচ্ছে বিকাশমান গণতন্ত্রের দেশ।
১৯৭২ থেকে ৭৫ সালে ছিলেন চরম আওয়ামী বিরোধী। হালে শেখ হাসিনার চেয়েও বড় আওয়ামী লীগার। শেখ মুজিবুর রহমানের লেলিয়ে দেয়া রক্ষিবাহিনীর গুলিতে আহত হয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ তার নেতৃত্বাধীন মিছিলে গুলি চালিয়েছিল রক্ষিবাহনী। সেদিন শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ষিবাহিনীর গুলিতে জাসদের ৫০ জন কর্মী নিহত হয়েছিল। আহত হয়েছিলেন শেখ হাসিনার তথ্যমন্ত্রী হাসানুল ইনুসহ অনেকে। ভোটারবিহীন সংসদ নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচনে ভোট ডাকাতির উদাহরণ, দিনদুপুরে মানুষ ধরে নিয়ে খুন করে লাশ গায়েব, বিরোধী দলের প্রতি চরম অত্যাচার যদি গণতন্ত্র বিকাশের লক্ষণ হয় তবে বলার কিছু নেই। গণতন্ত্রের জনকরা বেঁচে থাকলে ইনু সাহেবের এই কথায় হয়ত লজ্জাই পেতেন। নতুবা গণতন্ত্রের নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণ করতেন তারা।
৩ মে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বক্তব্যে রাখেন হাসানুল হক ইনু। তার বক্তব্যের পরপরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন জনের স্ট্যাটাসে বিষয়টি উঠে আসে। হাসানুল হক ইনুকে যদি এখন প্রশ্ন করা হয় সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান কি গণতন্ত্রের বিকাশের নমুনা! কাউকে রাস্তা বা বাড়ি থেকে সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ধরে নেয়ার পর গুম করা করা, রাস্তা থেকে গাড়িসহ অপহরণ করা, গুমের পর হত্যা করা লাশ নদীতে তলিয়ে দেয়া যদি গণতন্ত্রকে বিকশিত করে, ৭২ থেকে ৭৫ সালে বিরোধিতা করেছিলেন কেন!
শেখ মুুজিবুর রহমানের শাসনের বিরোধিতা করতে হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে গণবাহিনী অনেক হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে তখন। তিনি নিজেও একজন খুনি। কেউ কেউ বলেন বর্তমান অবস্থা শেখ মুজিবের দুঃশাসনকেও হার মানায়। আর হাসানুল হক ইনু এখন ঠিক উল্টা জায়গায় অবস্থান করছেন। তখন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান দিয়ে গণবাহিনীর নেতৃত্বে মুজিববাদিদের খুন করতেন। এখন ভোটার বিহীন নির্বাচনের নামে তামাশার মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে সরকারি যন্ত্র ব্যবহার করে জাতীয়তাবাদীদের খুন করছেন। খুনিদের কাজই হলো খুন করা। খুনেই তাদের আনন্দ।
তবে ১৯৭২ থেকে ৭৫ সালে ইন্ডিয়া এতটা আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি। তখন সরাসরি বলতে পারেনি ট্রানজিটের কথা। এখন সরাসরি বলা হয় সম্পর্ক উন্নয়নে পিজিকেল ট্রানজিট দরকার। অর্থাত্ বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করতে দিতে হবে ইন্ডিয়াকে। এটা হলো গণতন্ত্রের বিকাশ এবং ইন্ডিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের নমুনা। বাংলাদেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য সবই নিয়ন্ত্রণ করছে ইন্ডিয়া। পররাষ্ট্রনীতি কি হবে, কার সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে, আর কার সঙ্গে থাকবে না, সেটাও নির্ধারণ হচ্ছে ইন্ডিয়ার সিদ্ধান্তে। জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে ইন্ডিয়ার স্বার্থে বিশ্ব ট্রেড ফেয়ারে দুবাইয়ের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে বাংলাদেশ। এতে দুবাই, সংযুক্ত আরব আমিরাতে এখন আর বাংলাদেশীদের ভিসা মেলে না। শ্রমিক নেয়া তো দূরের কথা, এমনকি ভ্রমণ ভিসা দেয়াও বন্ধ করেছে দুবাই। এটা হচ্ছে ছোট একটি উদাহরণ মাত্র। ইন্ডিয়ার স্বার্থ রক্ষা করতে বাংলাদেশ হারাচ্ছে প্রকৃত বন্ধুদের। হারাচ্ছে শ্রমবাজার। সর্বশেষ পঙ্কজ শরণ বাবু ভূমি ব্যবহারের সুযোগটাকে সম্পর্ক উন্নয়নের মাপকাটি হিসেবে বর্ণনা করলেন। ইন্ডিয়া আর কত উন্নয়ন চায় সম্পর্কের! এটা নিয়ে হয়ত একটি গবেষণা হতে পারে।
ইন্ডিয়ার সরাসরি হস্তক্ষেপ এবং প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ৫ জানুয়ারির নির্বাচন হলো। সারা দুনিয়া বলেছে সব দলের অংশ গ্রহণের নির্বাচনের কথা। আর ইন্ডিয়াই একমাত্র দেশ যারা বলেছেন প্রধান বিরোধী দলকে বাইরে রেখে নির্বাচনের কথা। যার প্রমাণ হচ্ছে পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংয়ের বাংলাদেশ সফর এবং এরশাদের বক্তব্য। সুজাতার সঙ্গে সাক্ষাতের পর এরশাদ গণমাধ্যমে প্রদত্ত প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছিলেন সেই বিষয়টি। সুজাতা এরশাদকে বলেছিলেন নির্বাচনে না গেলে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসবে। অর্থাত্ সুজাতা সিংদের কৌশলী ভূমিকায় বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখা হয়। তারা জানত ১৮ দলীয় জোট নির্বাচনে আসলে আওয়ামী-বাম জোট ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। এতে ইন্ডিয়ার আধিপত্য খর্ব হওয়ার আশঙ্কায় আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখতে মরিয়া ছিল সুজাতারা। এখন আবার সম্পর্কের আরও উন্নয়নের কথা শোনানো হচ্ছে। ৩ মে বাংলাদেশে নিযুক্ত ইন্ডিয়ান হাই কমিশনার পঙ্কজ শরণ বলেছেন সম্পর্ক উন্নয়নে দরকার পিজিকেল ট্রানজিট। একই দিনে ভিন্ন এক আলোচনা সভায় হাসানুল হক ইনু বলেছেন বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন বিকাশমান।
গত সপ্তাহজুড়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুলসহ ৭ জনকে অপহরণের ঘটনায় তোলপাড় চলছে। তাদের পরিবার একদিকে সৌভাগ্যবান। অন্তত লাশটি পেয়েছেন। অনেক পরিবার জানেন না গুম হওয়ার পর আপনজনের পরিণতি কি হয়েছে। পথ চেয়ে বসে আছেন অনেক বাবা, সন্তানের অপেক্ষায় রয়েছেন অনেক মা। প্রিয় স্বামীর অপেক্ষায় আছেন স্ত্রী। বাবার অপেক্ষায় আছে সন্তান। ইনু সাহেবদের বিকাশমান গণতন্ত্রে অন্তত পাঁচ শতাধিক পরিবার এখন শুধু আপনজের অপেক্ষায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ধরে নেয়ার পর আর খোঁজ মিলছে না।
নারায়ণগঞ্জে লাশ উদ্ধারের আগে থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের বাণী শোনা যাচ্ছে। বড় দুই দলের শীর্ষ নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনাও পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সরাসরি বললেন গুম, খুনের সঙ্গে বিএনপি জড়িত। বেশ ভালো কথা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব হলো জড়িতদের ধরা। তিনি যেহেতু জানেন বিএনপি জড়িত ধরলেই পারেন। প্রধানমন্ত্রীর হাতে রাষ্ট্রযন্ত্রের সব মেশিনারি। কিন্তু দেখা গেল আওয়ামী লীগের এক নেতার বাসায় লোক দেখানো তল্লাশি চালিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ ৭ খুনের সঙ্গে জড়িত হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতা কাউন্সিলর নূর হোসেনের নাম উঠে এসেছে। নজরুলের শ্বশুর গণমাধ্যমে সাক্ষাত্কার দিয়ে বলেছেন র্যাব ৬ কোটি টাকার বিনিময়ে এই খুন করেছে। টাকা দিয়েছে নূর হোসেন। প্রশ্ন হচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রধানমন্ত্রী যদি জানেন বিরোধী দল জড়িত, র্যাব সিও তারেক সাহেবকে অপসারণ করা হলো কেন!
পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, যেই নেতার বাসায় তল্লাশি চালানো হয়েছে। অথচ ৭ জন অপহরণের পর ৩ দিন প্রকাশ্যেই ছিলেন নূর হোসেন। লাশ উদ্ধারের পর মামলায় তার নাম জড়িয়ে পড়ে। এছাড়া লোক মুখে ছড়িয়ে পড়ে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি। মামলা হওয়ার পর তিনি আড়াল হয়ে গেলেন। এটাও শোনা যায় প্রধানমন্ত্রীর খুবই কাছের একজনের বাসায় লুকিয়ে ছিলেন এই ব্যক্তিটি। হাসানুল হক ইনু সাহেবের গণতন্ত্র বিকাশের এই হলো নমুনা। প্রতিদিন খালেবিলে লাশ পাওয়া, বিরোধী দলের নেতাদের ধরে নিয়ে হত্যার পর ক্রসফায়ারের গল্প প্রচার করা যদি গণতন্ত্রের বিকাশের নমুনা হয়, ফ্যাসিবাদের সংজ্ঞায়ও পরিবর্তন দরকার।
ভিন্নমতের গণমাধ্যম বন্ধ করে দেয়া, বিনা বিচারে পত্রিকার সম্পাদককে কারাগারে আটক রাখা, পত্রিকা সম্পাদকের বিরুদ্ধে গাড়ি ভাংচুরের মামলা দিয়ে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করাই হচ্ছে গণতন্ত্র বিকাশের ইঙ্গিত! রাতের আঁধারে টেলিভিশন চ্যানেলের সম্প্রচার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া আর যাই হোক গণতন্ত্র বিকাশেরই ইঙ্গিত বহন করে। আর ইনু সাহেবদের বিকাশমান গণতন্ত্রে সুপ্রিমকোর্ট থেকে শুরু করে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের ভূমিকার কথা নাইবা বললাম।
লেখক : দৈনিক আমার দেশ-এর বিশেষ প্রতিনিধি, বর্তমানে যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন