জানেন, আমি কে? কোমরে দুহাত রেখে সিনেমার নায়কের মতো 'পোজ' দিয়ে জিজ্ঞেস করে ২৫-২৬ বছরের যুবকটি।
ডাক্তার এবার চোখ তুলে তাকায় তার দিকে, বলে, না, জানি না। জানার দরকারও নেই আমার। আপনি এই রোগীর সঙ্গী হিসেবে এসেছেন বুঝতে পারছি। আপনারা এখন দয়া করে বাইরে যান। আপনাদের সিরিয়াল আসলে ভেতরে আসবেন।
কী বললেন, বেরিয়ে যাব? তার মানে আপনি আমার রোগীকে দেখবেন না? সাহস তো কম নয় আপনার। এই কাইন্যা, আমি কে একটু বলে দে তো এই মিয়াকে। ঘাড়টা একটু কাত করে যুবকটি চোখ দিয়ে ইশারা করে সঙ্গীকে। সঙ্গী বছর বিশেকের এক দুশমন চেহারার ছোকরা। সে বলে, ভাইজান, এই মিয়া আপনারে চিনে না এইটা কেমুন কথা। আপনি এই উপজেলার দুরমুশ পার্টির ছভাপতি আর আপনারে চিনে না। কন তো এখ্খুনি উঠাইয়া লইয়া যাই এই ডাকতর ছাব রে।
বেলা তখন প্রায় আড়াইটা। সকাল থেকে দুহাতে রোগী সামলাতে সামলাতে বেচারা তরুণ মেডিক্যাল অফিসারের চেহারা তখন তেজপাতা। বহু কষ্টে রাগ সামলে সে বলল, দেখুন, যে রোগীকে আমি দেখছি তাকে এক্ষুনি ভর্তি করে স্যালাইন না দিলে টেকানো কঠিন হবে। আপনারা প্লিজ বাইরে গিয়ে একটু অপেক্ষা করুন। এই বলে ডাক্তার তাকাল দুরমুশ পার্টির রোগীর দিকে। বছর চল্লিশেকের রোগীর চোখ-মুখ লাল, নাক দিয়ে পানি পড়ছে। একটা চাদর জড়ানো গায়ে। ডাক্তার বলল, উনার তো সম্ভবত ফ্লু হয়েছে, নিশ্চয়ই হাই টেম্পারেচারও আছে। আপনারা একটু অপেক্ষা করুন। ঘাবড়াবেন না। আমি ভালো করে দেখেটেখে ওষুধ দিয়ে দেব।
ব্যস, এটুকুই যথেষ্ট। একটা অশ্লীল গালি দিয়ে ডাক্তারের কলার চেপে ধরল নেতা। ...এর পরেরটুকু পরদিন দেশবাসী খবরের কাগজে পড়ল : হইচই-চিৎকার শুনে হাসপাতালের অন্যান্য ডাক্তার, ওয়ার্ডবয়, কর্মচারী ছুটে এলো। দুরমুশ পার্টির অন্য যারা বাইরে দাঁড়িয়েছিল তারাও চাবি দেওয়া পুতুলের মতো সক্রিয় হয়ে উঠল। রেজাল্ট : সেই তরুণ মেডিক্যাল অফিসার এখন নিকটবর্তী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বেডে মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় শুয়ে আছে। হাসপাতালের অন্য ডাক্তার-কর্মচারী কয়েকজনকেও প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে হয়েছে।
আর দুরমুশ পার্টির লোকজন ধর ধর আওয়াজের ভেতর তাদের রোগী নিয়ে হাওয়া হয়ে গেছে। সংবাদ পেয়ে স্থানীয় সংবাদকর্মীরা ছুটে এসেছিল ক্যামেরা-ট্যামেরাসহ। হাসপাতালের ডাক্তার-স্টাফদের রোষের মুখে পড়ে বেচারারা অহেতুক লাঞ্ছিত হলো তাদের হাতে। ক্যামেরা ভাঙল দুজনের।
(২)
ওপরের চিত্রটি কাল্পনিক বটে, আবার ঠিক কাল্পনিকও নয়। মোটামুটি এভাবেই আজকাল ডাক্তাররা আকসারই প্রহৃত হচ্ছেন, আক্রান্ত হচ্ছেন দায়িত্ব পালনরত সাংবাদিকরা। আর যদি কোনোভাবে খবর রটে যায়, ডাক্তারের অবহেলার কারণে কোনো রোগী মারা গেছে, তাহলে তো আর কথাই নেই। মুহূর্তে হাসপাতাল হয়ে যায় কুরুক্ষেত্র। দিবাবসানে দেখা যায়, এ পক্ষে এতজন, ও পক্ষে অতজন আহত, হাসপাতালের আসবাবপত্র, দামি যন্ত্রপাতি ভেঙে চুরমার। এমনকি রাস্তার চলমান যানবাহনেও আগুন। আর এই ডামাডোলের ভেতর মুমূর্ষু দু-চারজন রোগীর 'সিরিয়াল' আসার আগেই পরপারে যাত্রা।
এই দৃশ্য ইদানীং প্রায়ই দেখা যাচ্ছে। শুধু মফস্বলে নয়, রাজধানীর বড় বড় হাসপাতাল কিংবা বিভাগীয় শহরগুলোর হাসপাতালেও। মানুষ যে কী প্রকার অসহিষ্ণু ও উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়েছে, তা এসব ঘটনা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। কথায় কথায় ধমকা-ধমকি, হাতাহাতি, এমনকি মাথা ফাটানো আজকাল যেন ডালভাত। আর লক্ষ করে দেখুন, ঝগড়াঝাঁটির গ্রামারও আজকাল কেমন 'ডিজিটাল' হয়ে গেছে। শুরু হতে না হতেই একেবারে সমে পৌঁছে যায়। সা... বলতে না বলতেই একেবারে নি...। আমরা যে কী পরিমাণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছি, আমাদের সময় যে কত কম, এ যেন তারই প্রতিচ্ছবি। আমরা যেন সবাই একটা গরম তাওয়ার ওপর বসে আছি। কিছু একটা ঘটার আগেই আমাদের মেজাজ শরিফ খইয়ের মতো ফুটুস করে ফেটে যায়। একজন রোগী মারা গেলে সে আসলে কেন মারা গেল, মৃত্যুটা সত্যি ডাক্তারের অবহেলার জন্য, না অন্য কোনো কারণে হয়েছে, তা অনেক সময় একটু ভেবে দেখতেও নারাজ রোগীর স্বজনেরা। আর এর মধ্যে যদি অন্য কোনো ডাক্তার বা নার্স সামান্য নুনের ছিটা দিয়ে দেন, তাহলে তো আর কথাই নেই। যে ডাক্তারের রোগী মারা গেছে তার সঙ্গে হয়তো স্বগোত্রীয় আরেক ডাক্তারের কিংবা কোনো সেবিকার কোনো কারণে ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপড়েন আছে, এই সুযোগে সেই ডাক্তার বা সেবিকা দিল একটু আঙুল চালিয়ে : আরে, এই ইনজেকশনটা তো আরো ঘণ্টাখানেক আগে দেওয়া উচিত ছিল, অথবা, অমুক অ্যান্টিবায়োটিক তো আজকাল আর দেওয়া হয় না, বললেন সেই সহকর্মী ডাক্তার। কিংবা নার্স আস্তে করে একটা মিহিদানা তথ্য দিয়ে বসলেন, স্যার তো তখন ক্যান্টিনে বসে টিভি দেখতে দেখতে চা খাচ্ছিলেন। ব্যস, রোগীর স্বজনদের বারুদে সঙ্গে সঙ্গে আগুন।
(৩)
আসলে সমাজের সর্বস্তরে এখন পেশিশক্তির দাপট এত বেড়ে গেছে যে অফিস-আদালত-ব্যাংক-হাসপাতাল-কলকারখানা- সবখানে মাসলম্যানদের হুংকারে সাধারণ শান্তিপ্রিয় মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। সাধারণ নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত বা দরিদ্র শ্রেণির মানুষ ভয়ে হোক আর ভালোবাসায় হোক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তারা জানে আইন ভঙ্গ করলে তাদের কোমরে দড়ি পড়তে এক মুহূর্ত বিলম্ব হবে না। ফলে তারা সব ব্যাপারে- তা তহশিল অফিসে জমির খাজনা দেওয়াই হোক বা ব্যাংক লোনের সামান্য কটি টাকা পরিশোধ করাই হোক, বাড়ির সীমানা বেড়া দেওয়াই হোক অথবা জমির আল তোলাই হোক- হুঁশিয়ার থাকে যেন উল্টাসিধা কিছু না হয়ে যায়। তারা হাসপাতালে সেই সাতসকালে গিয়ে ওখানকার কর্মচারীর নির্দেশমতো লাইন ধরে নামধাম লেখায়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকে 'সিরিয়ালের' অপেক্ষায়। বেলা বাড়লে যখন খিদে পায়, তখন কোঁচড়ের চিঁড়া-মুড়ি দিয়ে ক্ষুণ্নিবারণ করে একটু পানির জন্য ঘুরে আসে হাসপাতাল চত্বর। তারপর যখন ডাক আসে তখন আল্লাহর শুকুর গুজার করে গিয়ে হাজির হয় ডাক্তার নামক পরম আরাধ্য মানুষটির কাছে। তখন তার সে কী সংকোচ, সে কী লজ্জা! বিনয়ে যেন গলে যাবে সেই আজন্ম ব্রীড়াবনত ভীত চকিত গ্রামীণ ব্যক্তিটি। শহরের ডাক্তার তাকে দেখছেন, তার সঙ্গে কথা বলছেন এ যেন তার স্বপ্নের অতীত। আর সেই ডাক্তার যদি একটু মিষ্টি করে কথা বলেন, হাসেন, একটু বরাভয় দিয়ে বলেন, ইনশা আল্লাহ, শিগগিরই সেরে উঠবেন আপনি, তাহলে তো সে, এমনকি ক্যান্সার রোগী হলেও চোখ-মুখের এমন ভাব করে ওই মুহূর্তে, যেন সে তখনি ভালো হয়ে গেছে। এত সহজ-সরল আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ।
আর 'হেই মিয়া, জানেন আমি কে' ধরনের কেউ যখন হাসপাতালে পাদুকাধূলি দেন তখন ডাক্তার-নার্স থেকে শুরু করে হাসপাতালের কুত্তা-বিলাই (হ্যাঁ, আর কোথাও না পেলে হাসপাতালে এদের দর্শন পাবেনই!) পর্যন্ত জেনে যায়, রোগী কত প্রকার ও কী কী। এরা বা এদের সঙ্গী ব্যক্তিটি হয় নিজেই দুরমুশ পার্টি বা ওই ধরনের কোনো ভয়ংকর গোষ্ঠীর পালের গোদা, অথবা স্থানীয় কোনো হোমরা-চোমরার টেন্ডল। পয়সার গরমে মাঘ মাসের শীতেও এদের শরীর দিয়ে ঘাম বের হয়। এলাকাবাসী উচ্চ-নীচ, ছোট-বড় সকলকেই এদের খাজনা দিয়ে চলতে হয়। এদের এক পকেটে থানা-তহশিল, আরেক পকেটে কোর্ট-কাচারি। খোঁজ নিলে দেখা যাবে এদের দাদা-পরদাদারা সারা জীবন এলাকার মানি লোকদের বাড়িতে মনিষ খাটত। আর বাপ ভ্যানগাড়ি চালাতে চালাতে একদিন নেমে পড়ে মাদকের ব্যবসায়। তারপর করোট ফেরাতে না ফেরাতে চৌদেওয়ারি বাড়ি আর আলিশান দালান।
তবে ইদানীং দাপট প্রদর্শন বেশির ভাগই হয় দলীয় ভিত্তিতে। যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে তাদের জেলা-উপজেলা পর্যায়ের মহামহিম আতিনেতা-পাতিনেতাদের শ্রীল শ্রীযুক্ত পেশিমানবদের পাঁচ-সাতজনের ছোট ছোট গ্রুপ হাসপাতালের রোগী ভর্তি, স্কুলের অটো প্রমোশন, প্রকৌশল দপ্তরের টেন্ডার ইত্যাদি সামাল দিয়ে থাকে। দূরে থেকে ওদের আসতে দেখলেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার হৃৎকম্পন শুরু হয়ে যায়। কেউ আইনের দোহাই দিয়ে বাধা দিতে গেলে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা, ক্ষেত্রবিশেষে দূরে কোথাও কোনো পাণ্ডববর্জিত কোকাফ অঞ্চলে বদলি। এসব কারণে মাঠ পর্যায়ের বেশির ভাগ কর্মচারী দাঁতে দাঁত পিষে বিনা প্রতিবাদে কোনো রকমে সময়টা পার করে দিতে চান। অনেক অন্যায়-অবিচার-অপমান দেখেও না দেখার ভান করেন।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এসব কর্মকর্তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাদের সহকর্মীদের এ ধরনের বিড়ম্বনার ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন। তাঁদের ভাবটা হলো, এসব উটকো ঝামেলা যার সেই তা 'ফেস' করুক। যদি পারে তো ভালোই, না পারলে দুলাইন লিখে দেবো : এই অফিসারটি একেবারে ট্যাক্টলেস, পরিস্থিতি বুঝে চলতে জানেন না। মাঠ প্রশাসনের জন্য তিনি সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত।
এই মিয়া, জানেন আমি কে?
(৪)
ডাক্তারদের ব্যাপারে অনেকটা ঢালাওভাবে দোষারোপ করা হয়, তাঁরা মনোযোগ দিয়ে রোগী দেখেন না, অনেক সময় রোগীকে ভালোভাবে পরীক্ষা না করেই ব্যবস্থাপত্র লিখে দেন, ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর সঙ্গে গোপন আঁতাতের কারণে রোগীকে অহেতুক এই টেস্ট-সেই টেস্ট করতে পাঠান, দরিদ্র অশিক্ষিত রোগীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন ইত্যাদি। এসব অভিযোগ আজকালকার অতি স্মার্ট নব্য চিকিৎসকদের বিরুদ্ধেই বেশি শোনা যায়। এগুলো সবটাই যে ভিত্তিহীন, অমূলক তা নয়। কেন, কী কারণে একজন ডাক্তার এমন আচরণ করে থাকেন তা সংশ্লিষ্ট ডাক্তারকে 'স্টাডি' করলেই বোঝা যাবে। অবশ্য এটা ঠিক, দাতব্য চিকিৎসালয়গুলোতে প্রায়শই এ ধরনের কৃষ্ণ মেষের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। তবে বেশির ভাগ ডাক্তারই একজন রোগীকে তাঁর আপনজন মনে করে তার রোগ সারানোর জন্য সনিষ্ঠ শ্রম দিয়ে থাকেন। একজন ডাক্তার যখন নাওয়া-খাওয়া ভুলে সকাল থেকে বিরতিহীনভাবে শখানেক রোগীকে চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকেন, পরিবার-পরিজনের কথা ভুলে গভীর রাত পর্যন্ত একজন মুমূর্ষু রোগীর শয্যাপাশে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন, রাত-বিরেতে ছুটে যান একজন প্রসূতির প্রসবকালীন জটিলতা নিরসনের ব্যবস্থা করতে, তখন সমাজ সেটা মনে রাখে না; অথচ দায়িত্ব পালনে পান থেকে চুন খসলেই তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যায়।
সম্প্রতি একজন অভিমানী ডাক্তারের এ ধরনের ক্ষোভের কথা শুনে আমি যে উপমাটি দিয়ে তাকে বিষয়টি বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম সেটি বোধ হয় এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। উপবন ট্রেনটি রোজ রাতে ঢাকা থেকে রওনা হয়ে পরদিন সকালে সিলেট পৌঁছায়। এটা কোনো খবরই নয়, এর কোনো 'নিউজ ভ্যালু' নেই, কারণ ট্রেনটি সময়মতো পৌঁছাবে এটাই নিয়ম, এটাই সবার প্রত্যাশা। কিন্তু কোনো দিন যদি খোদা-না-খাস্তা পথে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যায়, আর ট্রেনটি পরদিন সকালে সিলেট না পৌঁছে দুপুর গড়িয়ে বিকেল বা রাতে পৌঁছে বা আদৌ পৌঁছাতে না পারে, তবে সেটাই হবে নিউজ। সেদিন চারদিকে হইচই পড়ে যাবে। শুরু হবে, কার দোষে দুর্ঘটনা ঘটল, কে দায়ী এসব খোঁজাখুঁজি। তেমনি হিপোক্রেটিসের শপথবাক্য পাঠ করা চিকিৎসক তাঁর রোগীকে সেবা প্রদানের জন্য- তা সে রোগী রাজা ভোজই হোন আর গঙ্গারাম তেলীই হোন- দিবা-রাত্রির যেকোনো সময়, যেকোনো অবস্থায় ছুটে যাবেন, এটাই মানুষের চিরকালের প্রত্যাশা। জীবনের শুরুতে এটাই ছিল সেই চিকিৎসকের ওয়াদা। এর ব্যত্যয় হলেই গোলমাল বেধে যায়। রোগীর অন্তিম মুহূর্তে ডাক্তার রোগীর পাশে আর ডাক্তার নন, তিনি হয়ে যান রোগীর পিতা, তার মাতা, তার প্রিয়তম স্বামী বা প্রিয়তমা স্ত্রী, প্রাণপ্রিয় সন্তান। রোগী তার মুমূর্ষ চোখের অলৌকিক আলোয় ডাক্তারের ভেতর তখন অবলোকন করে জান্নাত থেকে নেমে আসা একজন জ্যোতির্ময় ফেরেশতাকে। আর করুণ দৃষ্টি মেলে সে অন্তিম আকুতি জানায়, হে ডাক্তার, আমাকে বাঁচিয়ে তুলুন, আমি মরতে চাই না, আমি বাঁচতে চাই। এই আকুতি আর কাউকে নয়, একমাত্র ডাক্তারকেই জানায় সে।
'হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।' কারণ একদিন মরতে হবে সবাইকে। 'কল্লু নাফ্সিন যা-ইকাতুল মাউত' (প্রত্যেক প্রাণীই মৃত্যুর আস্বাদ গ্রহণ করবে) : আল-কুরআন। মৃত্যু অমোঘ, অবধারিত, অবশ্যম্ভাবী। একদিন সবাইকে চলে যেতে হবে। কিন্তু সেটা ঠিক কবে, কখন কেউ বলতে পারে না। সেই যে একটা পুরনো দিনের গান আছে না : একদিন ফিরে যাব চলে/এ ঘর শূন্য করে, বাঁধন ছিন্ন করে...। ব্যস, শুধু এটুকুই জানা। এর বেশি নয়। তবে কেন হাসপাতালে কোনো প্রিয়জনের মৃত্যু নিয়ে এত হইচই, এত আন্দোলন?
ঢাকা শহরের আরমানিটোলায় কালের সাক্ষী আর্মেনিয়ান গির্জা দেখতে গিয়েছিলাম এক বন্ধুর সঙ্গে আজ থেকে ১৫ বছর আগে। সেখানে অযত্নে-অবহেলায় পড়ে থাকা কবরগুলোর একটির ওপর শিলালিপি ছিল এ রকম : মিসেস মেরী ক্যামিল্লারি, মৃত্যু ২৫.১১.১৮৭৩, ২৭ বছর বয়সে। তার নিচে উৎকীর্ণ করা দুটি লাইন : উইপ নট ফর মি, লেমেন্ট নো মোর/আই এ্যাম নট লস্ট, বাট গন বিফোর। বাংলা করলে বোধ হয় এমনি একটা কিছু হবে : আমার জন্য ফেলো না চোখের জল, করো না বিলাপ/আমি তো হারিয়ে যাইনি, শুধু চলে গেলাম, তোমাদের একটু আগে, এই আর কি। ... এটাই সত্য, সব কথার শেষ কথা এটাই। যাঁরা হাসপাতালে স্বজনের মৃত্যুতে ভেঙে পড়েন, প্রহার করতে উদ্যত হন চিকিৎসককে, তাঁরা একটু ভেবে দেখবেন কি, এক শ একচল্লিশ বছর আগে এই জনপদে মিসেস ক্যামিল্লারি বলে এক তরুণী গৃহবধূ কী সুন্দর চিরায়ত এক বাণী লিখে রেখে গেছেন মহাকালের তমময় শিলাখণ্ডে।
(৫)
বাংলাদেশের মতো একটি দরিদ্র জনাকীর্ণ দেশে কিরূপ সীমাবদ্ধতার মধ্যে একজন ডাক্তারকে দায়িত্ব পালন করতে হয় তা আমরা সবাই জানি। দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক অনুন্নয়ন ও বঞ্চনা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, খাদ্যাভাব ও অপুষ্টি, নোংরা ও বিপর্যস্ত পরিবেশ ইত্যাদির কারণে এ দেশে রোগবালাইয়ের প্রাদুর্ভাব বেশি। সেই তুলনায় চিকিৎসাব্যবস্থা নিতান্তই অপ্রতুল। রোগী-চিকিৎসক অনুপাত অত্যন্ত নৈরাশ্যজনক। উন্নত বিশ্বে একজন ডাক্তার যেখানে নির্ধারিত সময়ে ধীরে ধীরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ১০-১২ জন আউটডোর রোগী দেখলেই চলে, বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালের একজন ডাক্তারকে সেখানে দেখতে হয় দশ গুণ বেশি রোগী। ডাক্তারের এই সংখ্যাল্পতার সঙ্গে আছে বেডের স্বল্পতা, নোংরা দুর্গন্ধময় পরিবেশ, ওষুধপত্রের দুষ্প্রাপ্যতা, সেবাগ্রহণকারীদের উচ্ছৃঙ্খল আচরণ- সব মিলিয়ে আর যাই হোক, কাজের পরিবেশ কিছুতেই অনুকূল বা 'স্বাস্থ্যকর' বলা যায় না। এ অবস্থায় একজন ডাক্তারের পক্ষে মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করা নিঃসন্দেহে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে তরুণ অনভিজ্ঞ ডাক্তারদের পক্ষে। এদের অনেকেই আবার ইন্টার্নি অর্থাৎ শিক্ষানবিশ। এদের কলেজজীবনের উদ্দামতার রেশ এখনো কাটেনি বলা যায়। সেই সঙ্গে যদি থাকে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা, তাহলে নানাবিধ সমস্যা দেখা দেওয়াই স্বাভাবিক। আর সাম্প্রতিককালে হচ্ছেও তাই।
এখানে আমাদের তরুণ ডাক্তারদের একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। চিকিৎসাশাস্ত্র কি শুধু রোগনির্ণয়, ব্যবস্থাপত্র প্রদান, অস্ত্রোপচার, এটা খাবেন, ওটা খাবেন না, নাকি এর চেয়েও বেশি কিছু? আপনার কাছে চিকিৎসার জন্য যে ব্যক্তি আসে, সে একজন অসুস্থ মানুষ, সে শুধু শারীরিকভাবে অশক্ত নয়, মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত। তার কথাবার্তা ধরে নিতে পারেন হবে অসংলগ্ন, অস্পষ্ট এবং কণ্ঠ ক্ষীণ। সে হতে পারে উদ্ভ্রান্ত। আবার বাহ্যত হয়তো এসবের কিছুই না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে মানুষটি হয়তো শেষ হয়ে যাচ্ছে দুশ্চিন্তায়, টেনশনে, আতঙ্কে। তার কথা এবং শুধু তার কথাটি বিবেচনা করে আপনার অসহিষ্ণুতা, বিরক্তি, ক্রোধ কি আপনি সংবরণ করবেন না? রোগীর চিকিৎসা করা মানেই তো চিকিৎসকের ধৈর্যের পরীক্ষা দেওয়া। একজন শিক্ষানবিশ নবীন চিকিৎসক- যাঁকে আমি মজা করে বলি, 'আ ডক্টর আন্ডার কনস্ট্রাকশন'- অবশ্যই স্মরণ রাখবেন, তাঁর তো কেবল যাত্রা শুরু হলো, অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে তাঁকে যেতে হবে অনেক দূর। সেই চলার পথের পাথেয় কী হবে আর কী হবে না, সেই তরুণ তো তা জেনে নিতে পারেন তাঁর শ্রদ্ধেয় সিনিয়রদের কাছ থেকে। তাঁরা নিশ্চয়ই তাঁকে বলবেন না রোগী বা তাঁর সহচরের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে কিংবা একজন সাংবাদিকের ওপর চড়াও হতে। এ প্রসঙ্গে আশা করি আর আলোচনার প্রয়োজন নেই। কারণ নবীন-প্রবীণ ডাক্তাররা সবাই মেধাবী, আকলমন্দ মানুষ। আর 'আকলমন্দ কে লিয়ে ইশারাই কাফি হ্যায়' বলে একটা কথা আছে।
আর 'মোরে চ্যানো, মোর বাবায় ছ্যালো ছকিদার' টাইপের যারা এখন সমাজটাকে জ্বালিয়ে মারছে তাদের এই সমাজই অচিরে শায়েস্তা করবে বলে আমি এখনো বিশ্বাস করি। তবে বড় বড় হাসপাতালে না হলেও মফস্বলের হাসপাতালগুলোতে এসব উৎপাত অনেকটা বন্ধ হতে পারে যদি ওই সব প্রতিষ্ঠানে শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত নাগরিক কমিটিগুলোকে সক্রিয় করা হয়। ওই সব কমিটির সদস্যরা যদি মাঝে মাঝে একটু-আধটু নসিহত করে সংশ্লিষ্টদের বোঝান যে হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো স্থানে মাস্তানি বন্ধ না করলে এগুলো উঠে যেতে পারে। কারণ, আফটার অল মাস্তানি প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য নিশ্চয়ই সরকার এসব প্রতিষ্ঠানে প্রতিবছর কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ ব্যয় করছে না। আর তা ছাড়া যেসব ডাক্তার তাদের এলাকায় এসেছেন চাকরি করতে তাঁরা তো তাদের মেহমান। তাঁদের দেখভাল করা তো তাদের নৈতিক দায়িত্ব। তাদের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে ডাক্তাররা হাসপাতাল ছেড়ে চলে গেলে একদিন হয়তো হাসপাতালটি উঠেই যাবে। তখন আম-ছালা দুটোই যাবে।
আর আসলে ডাক্তার বা অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, যাঁরা একটি এলাকায় চাকরি করতে আসেন, তাঁরা আসলে কারা? তাঁরা তো এ দেশেরই সন্তান, তাঁরা তো কোনো ভিন দেশ থেকে আসেননি। আপনি যদি তাঁদের অপমানিত, লাঞ্ছিত করেন, তাহলে অন্য আরেক জেলা বা উপজেলায় আপনার ছেলে বা মেয়ে, ভাই বা ভাতিজাও তো একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে। তখন?
লেখক : সাবেক সচিব, কবি
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন