|
ড. সা'দত হুসাইন
|
|
ভেজালের প্রাবল্যে কলুষিত হচ্ছে সোনাদানা মানুষ ও 'আমার দেশের মাটি'
03 May, 2014
খবরের শিরোনামটি পড়ে আঁতকে উঠলাম। 'মাছ ব্যবসায়ী যখন সার্জন। ড্রিল মেশিনে ছিদ্র করা হয় রোগীর পা। অ্যানেসথেসিয়া দেন এসএসসি পাস হাসপাতাল মালিক।' এমন খবরে সব পাঠকই আতঙ্কিত হবেন। আরো আতঙ্কিত ও বিস্মিত হওয়ার কারণ হচ্ছে যে ঘটনাটি খোদ রাজধানীতে সোহরাওয়ার্দী ও পঙ্গু হাসপাতাল কমপ্লেক্সের অতি সন্নিকটে মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের একটি বাড়িতে ঘটেছে। পাঠকের সুবিধার্থে পুরো খবরটি উদ্ধৃত করছি। 'পাঁচ বছর আগে খুলনায় ইলিশ মাছ বিক্রি করলেও রতন কৃষ্ণ এখন রীতিমতো অর্থপেডিকস সার্জন। দেয়াল ফুটো করার ড্রিল মেশিন দিয়ে হামেশাই ছিদ্র করেন রোগীর হাড়, কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। মাত্র অষ্টম শ্রেণি পাস রতন কৃষ্ণ দীর্ঘদিন ধরে এ কাজ করে আসছেন। এসএসসি পাস হাসপাতালের মালিক পাইক বাবু। অপারেশনের আগে রোগীকে অ্যানেসথেসিয়া দেন।' (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৩ এপ্রিল ২০১৪)।
অবশেষে অর্থোপেডিকসের মতো জটিল চিকিৎসা বিষয়ে দুই নম্বরি ভেজাল ডাক্তারের আবির্ভাব ঘটেছে। পত্রপত্রিকা-টেলিভিশন খুললেই ভেজালের দৌরাত্ম্য চোখে পড়ে। প্রথাগতভাবে ভেজালের সমস্যাটি পণ্যের মধ্যে সীমিত ছিল। ফলমূল, মাছ-গোশত, মাখন-দুধ, তেল-চিনিতে ভেজাল মেশানোর কথা অনেক বছর থেকে শুনে আসছি। সোনায় খাদ থাকে, এটাও আমাদের জানা। স্বর্ণকাররা মায়ের অলংকারও চুরি করে অর্থাৎ অলংকারে খাদ মেশায়- এ কথা বহু বছর আগে থেকেই বাংলায় প্রবাদবাক্য হিসেবে চলে আসছে। তবে খাদের পরিমাণ এত কম যে এ নিয়ে লোকে খুব একটা মাথা ঘামায় না। এবার দেখলাম, মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিদেশি তথা আন্তর্জাতিক বন্ধুদের দেওয়া স্বর্ণের ক্রেস্টের ৮০ শতাংশ ভেজাল। লজ্জায় আমাদের মাথা হেঁট হয়ে গেছে। আমাদের রাষ্ট্রীয় পদক অবশেষে দুই নম্বরি হয়ে গেল। আমরা তাহলে যাব কোথায়? সাত দিনের মধ্যে প্রাথমিক তদন্ত শেষ করে সরাসরি জড়িত স্বর্ণকার ও ঠিকাদার থেকে শুরু করে মূল দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী-কর্মকর্তাকে দৃশ্যমান শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন। তাদের কী ধরনের শাস্তি দেওয়া হয়েছে, তা ব্যাপকভাবে দেশের সাধারণ মানুষকে জানানো আবশ্যকীয়। তেমনটি হয়েছে বলে মনে হয় না। সম্প্রতি সংসদীয় কমিটি এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করার ঘোষণা দিয়েছে। সে কমিটি কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে কি না তা দেখার জন্য আমরা অপেক্ষা করতে পারি। খাঁটি সোনার ক্রেস্ট দেখার ইচ্ছা বোধহয় আপাতত আমাদের অপূর্ণ রয়ে গেল। এতে বড় অসুবিধা হলো যে বিশ্বব্যাপী আমাদের দেশটি দুই নম্বরি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেল।
ভেজালের প্রাবল্যে কলুষিত হচ্ছে সোনাদানা মানুষ ও 'আমার দেশের মাটি'
চারদিকে দেখছি দুই নম্বরি দলিলপত্র, মানুষজন, এমনকি পদ-পদবির ছড়াছড়ি। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আর্থিক লাভের ওপর অতিমাত্রায় গুরুত্ব দিয়ে অবশেষে ডিগ্রির সনদ বিক্রিকেই তাদের মূল উপজীব্য হিসেবে গ্রহণ করেছে বলে শোনা যায়। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি পাওয়া শিক্ষার্থীরা তাদের বিষয়ের ওপর কোনো কিছু জানে, এমনটি দেশের জ্ঞানী-গুণী লোক অনেকেই বিশ্বাস করেন না। তারা আদৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল কি না তাতে সন্দেহ রয়েছে। চাকরিপ্রার্থীদের যোগ্যতা যাচাইকল্পে গঠিত মৌখিক পরীক্ষার বোর্ডে যাঁরা সদস্য হিসেবে উপস্থিত থাকেন তাঁরা নির্দ্বিধায় এ দুঃখজনক অবস্থার কথা স্বীকার করবেন। যদি শিক্ষার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা ও শিক্ষাস্তর উত্তরণের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ইস্যুকৃত ডিগ্রির সনদপত্রকে বিশ্বাস করা না যায়, তবে একে চরম দুর্ভাগ্য হিসেবে ধরে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। পত্রিকান্তরে দেখা যায়, কোনো এক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত এক শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র ভুয়া, জাল। সে শিক্ষক নাকি অবশেষে পদত্যাগপত্র দাখিল করে পালিয়ে গেছেন। উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বাছাই বোর্ডকে, যেখানে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও উপস্থিত ছিলেন, ফাঁকি দিয়ে দুই নম্বরি সনদপত্রের ভিত্তিতে কী করে এই প্রার্থী একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে চাকরি পেলেন, তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়।
মুক্তিযোদ্ধার দুই নম্বরি সনদের কথা আমরা দীর্ঘদিন থেকে শুনে আসছি। এই সনদপত্র ব্যবহার করে অনেকেই চাকরি পাওয়া থেকে শুরু করে নানা সুবিধা গ্রহণ করেছে। প্রত্যেক নতুন সরকার এসে পূর্বতন সরকার কর্তৃক ইস্যুকৃত মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটের একাংশ বাতিল ঘোষণা করেছে এবং নতুন নিয়মে সঠিক সার্টিফিকেট ইস্যু করার কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বারবার নীতি পরিবর্তনের কারণে দুই নম্বরি সনদপত্র ইস্যুর সুযোগ ও সংখ্যা বেড়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের অবসরগ্রহণের বয়সসীমা বাড়ানোর ঘোষণার পর সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। অভিযোগ উঠেছে, সাধারণ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সচিব, যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারাও মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সার্টিফিকেট উপস্থাপন করে বাড়তি সময় চাকরি করার প্রয়াস পেয়েছেন। ধরা পড়ার কারণে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কিছু বাড়তি সময় চাকরি করার লোভে যদি সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা মুক্তিযোদ্ধার দুই নম্বরি সনদপত্র সংগ্রহ করে সরকারের কাছে তা উপস্থাপন করেন, তবে সমাজ কত নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ছে, তা চিন্তা করে শুধু দুঃখ পেতে হয়।
দেশে সবচেয়ে বেশি দুই নম্বরি কাগজের সংখ্যা পরিবহন সেক্টরে। এক পরিসংখ্যানে দেখেছি, দেশের ৫০ শতাংশেরও বেশি ড্রাইভিং লাইসেন্স ভুয়া; অর্থাৎ দুই নম্বরি। যদি ভুয়া লাইসেন্স দিয়ে ৫০ শতাংশেরও বেশি ড্রাইভার রাস্তায় চলাচল করতে পারে, তবে এত কষ্ট, ঝক্কিঝামেলা, আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে যথার্থ (এক নম্বর) ড্রাইভিং লাইসেন্স সংগ্রহ করার প্রণোদনা ড্রাইভার কোথা থেকে পাবে? এমন পদ্ধতি কর্তৃপক্ষ কেন ব্যবহার করবে, যেখানে অর্ধেকেরও বেশি ড্রাইভার ভুয়া লাইসেন্স ব্যবহার করে পার পেয়ে যাবে? গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট, রোড ট্যাক্সের ক্ষেত্রেও প্রায় একই অবস্থা বিদ্যমান। এখানেও ভুয়া কাগজপত্রের ছড়াছড়ি।
পাসপোর্ট ও বহির্গমন সংক্রান্ত কাগজপত্রের ক্ষেত্রে জালজালিয়াতি রীতিমতো আনুষ্ঠানিক পর্যায়ে উত্তরণ লাভ করেছে। 'গলাকাটা পাসপোর্ট' একটি বহুল উচ্চারিত শব্দপুঞ্জ। বৈদেশিক কর্মসংস্থানের অজুহাতে এই দুই নম্বরি কাজটি ক্ষেত্রবিশেষে রাষ্ট্রীয় সমর্থন পেয়েছে। এ ধরনের অনৈতিক কাজ চূড়ান্ত বিশ্লেষণে জাতীয় স্বার্থের কতটা অনুকূল হয়ে থাকে, তাতে সন্দেহ করার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। এখন শোনা যাচ্ছে, জাতীয় পরিচয়পত্রও ব্যাপক হারে জাল করা হচ্ছে। এটি একটি মারাত্মক ব্যাপার। দুই নম্বরি জাতীয় পরিচয়পত্র যদি সহজলভ্য হয়, তাহলে দেশের শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে। জাতি হিসেবে আমরা ভয়ানক বিপর্যয়ের মুখে পড়ব।
অতিসম্প্রতি যে সমস্যাটি ভয়ংকর রূপে দেখা দিয়েছে তা হলো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন স্থান থেকে নাগরিকদেরকে অপহরণ। এসব জঘন্য অপহরণকারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষ করে র্যাব ও ডিবির সদস্য সেজে, তাদের মতো ভাবভঙ্গি করে, তাদের ব্যবহৃত গাড়িসদৃশ বাহন ব্যবহার করে, মাঝেমধ্যে তাদের মতো পোশাক পরে লোকজনকে তাদের বাড়িঘর কিংবা অন্য কোনো স্থান থেকে গাড়িতে তুলে নেয়। তাদের মধ্যে নগণ্যসংখ্যক ব্যক্তি ফিরে এলেও বাকিদের হয়তো আর ফিরে পাওয়া যায় না বা পরে তাদের লাশ পাওয়া যায়। যারা ফেরত আসে, তাদের অনেককেই বড় অঙ্কের মুক্তিপণ দিতে হয়। ফিরে এসে তারা চুপ থাকে; কোনো অর্থবহ তথ্য দেয় না। এখানে সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হচ্ছে, এসব দুর্বৃত্ত দুই নম্বরি নকল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে নিজেদের চালিয়ে দিচ্ছে। এতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটছে, নৈরাজ্যের সৃষ্টি হচ্ছে এবং একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সম্পর্কে জনমনে আস্থার সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। এ অবস্থা দেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এই দুই নম্বরি নকল বাহিনীর সদস্যদের তৎপরতা কঠোর হস্তে দমন করে জনমনে আস্থা ফিরিয়ে আনা এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা সরকারের অন্যতম প্রধান কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ প্রসঙ্গে জেলখানাগুলোতে বিরাজমান নৈরাজ্যের কথা বলা প্রসঙ্গিক মনে করছি। পত্রিকার খবরে জানা গেছে, একজন সন্ত্রাসীর কাছে প্রায় তিন লাখ ভারতীয় রুপি পাওয়া গেছে। খবরটি সত্য বলেই মনে হয়েছে। তবে কি জেলখানাগুলোও দুই নম্বরি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে? এগুলোকে কি সত্যিকার অর্থে জেলখানা বলা যায়? আমাদের সব কিছুই কি দুই নম্বরি হয়ে যাচ্ছে? দেশের কোনো উচ্চতর প্রতিষ্ঠান কি এই অপকলাকারদের কাছে দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজ করছে?
ফলমূল, খাবারদাবার, টাকাপয়সা, সোনাদানা থেকে শুরু করে কৌশলী-প্রকৌশলী, শিক্ষক-প্রশিক্ষক, ডাক্তার-গবেষক, র্যাব-পুলিশের দুই নম্বরি-নকল সংস্করণ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তাদের একমাত্র প্রাপ্য হচ্ছে যথোপযুক্ত শাস্তি। কর্তৃপক্ষ ও জনগণ আন্তরিকভাবে সজাগ ও প্রতিরোধে বদ্ধপরিকর হলে দুই নম্বরি দ্রব্য ও মানুষের ছড়াছড়ি সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দৃঢ় সিদ্ধান্ত, কার্যকর তৎপরতা ও জনসাধারণের সজাগ দৃষ্টির কারণে ১০০, ৫০০ ও এক হাজার টাকার নোটগুলোর নকল সংস্করণ লক্ষণীয়ভাবে কমে এসেছে। কর্তৃপক্ষ ও জনগণের যৌথ প্রয়াসে অন্যান্য ক্ষেত্রের দুই নম্বরির উৎপাত প্রান্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনা বাস্তবিক পক্ষে সম্ভব হবে।
লেখক : সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন