বিফলতাকে সফলতা দিয়ে ঢেকে দিতে হবে
27 Apr, 2014
আমাদের দেশে সুদীর্ঘকাল রাষ্ট্রের শীর্ষ নির্বাহী পদে আসীন হয়ে যে দু’মহিলা দায়িত্ব পালনের বিরল সম্মান লাভ করে আসছেন, তারা হলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও শহীদ জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী খালেদা জিয়া। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার জন্ম রাজনৈতিক পরিবারে। তিনি ছোটবেলা থেকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন থাকলেও সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করবেন এটি কখনও তার ভাবনায় ছিল না। শহীদ জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী খালেদা জিয়ার জন্ম ব্যবসায়িক পরিবারে। তার স্বামীর সামরিক কর্মকর্তা থেকে রাজনীতিক হিসেবে আবির্ভাব ঘটলেও তার সহধর্মিণীকে কখনও দলের কাণ্ডারি হিসেবে হাল ধরে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে হবে এমনটি তার ভাবনায়ও ছিল না। উভয়ের নিয়তি তাদের রাজনীতিতে নিয়ে এসেছে এবং দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের শীর্ষ আসনে সমাসীন ঘটিয়েছে। নিজ নিজ দলে উভয়ের নেতৃত্ব অটুট।
উভয় মহিলার রাজনীতিতে আগমন আকস্মিক। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দিবাগত রাতে বিপথগামী সামরিক কর্মকর্তাদের দ্বারা বঙ্গবন্ধু তার দু’কন্যা ছাড়া সপরিবারে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের নিজ বাসভবনে নিহত না হলে শেখ হাসিনার যে রাজনীতিক হিসেবে জনসম্মুখে আগমনের কারণ উদ্ভব হতো না, তা অনেকটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। অনুরূপভাবে ১৯৮১ সালের ৩০ মে দিবাগত রাতে কিছু বিপথগামী সামরিক কর্মকর্তা দ্বারা জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে নিহত না হলে পরবর্তী সময়ে তার সহধর্মিণীর যে রাজনীতিতে বিজড়িত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না, তাও অনেকটা নিশ্চিত ধরে নেয়া যায়।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে রাজনীতিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে উভয় দলে যে দু’ব্যক্তিত্বের অবদান অপরিসীম তারা হলেন- ড. কামাল হোসেন ও ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী। বঙ্গবন্ধু ও জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলকে যোগ্য নেতৃত্বের সন্ধানে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের সম্মুখীন হতে হয়। উপরোক্ত দু’ব্যক্তিত্বের নিজ নিজ দলের শীর্ষ পদে আসীন হওয়ার ব্যাপারে ঐকান্তিক মনোবাঞ্ছনা ছিল। তারা উভয়ে দলের শীর্ষ নেতৃত্বে আসীন হতে ব্যর্থ হলে প্রতিদ্বন্দ্বী অপর সর্বোচ্চ পদপ্রার্থীদের কোণঠাসা করার মানসে দলের ভাঙন রোধ এবং ঐক্যের প্রতীক হিসেবে শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এবং খালেদা জিয়াকে বিএনপির রাজনীতিতে নিয়ে আসেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, তাদের উভয়ের নিজ নিজ অবদানের জন্য নিজ নিজ দলে সম্মানজনক ও সুদৃঢ় অবস্থান থাকার কথা থাকলেও তা দূরের কথা- প্রাপ্য মর্যাদা না পাওয়ায় উভয়কে ক্ষোভ, দুঃখ ও অভিমানে দল ত্যাগ করতে হয়। দল ত্যাগের পর তারা উভয়ে দুটি পৃথক দল গড়ে তুললেও তা জাতীয় রাজনীতিতে তেমন ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেনি। তাদের উভয়ের ব্যর্থতা এবং অপরাপর রাজনীতিকদের ব্যর্থতা থেকে ধারণা পাওয়া যায়, এখনও এ দেশের মানুষ বড় দুটি দল অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে তৃতীয় কোনো দলকে এবং উভয় দলের শীর্ষ নেতৃত্বে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার পরিবর্তে অন্য কাউকে দেখতে স্বস্তিবোধ করছেন না।
শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া দল ও সরকারের শীর্ষ নির্বাহী পদে যে দীর্ঘ সময় আসীন থেকে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন, দেশের অন্য কোনো রাজনীতিক এমনকি বঙ্গবন্ধু ও শহীদ জিয়াউর রহমানের ভাগ্যেও এ অনন্য সুযোগ ঘটেনি। তারা উভয়ে দল ও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে সৎ, দক্ষ, ত্যাগী ও দেশপ্রেমিক নেতা এবং আমলার সাহায্য ও সহযোগিতা পেলে নির্দ্বিধায় বলা যায় সফলতার সম্ভাবনা অনেক উজ্জ্বল হতো। এর বিপরীতে অসৎ, অদক্ষ, স্বার্থপর ও দেশপ্রেম বিবর্জিতদের যদি পাশে ঠাঁই দেয়া হয়, সেক্ষেত্রে দুর্র্নামের ভাগিদার হয়ে জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা যে বহুলাংশে কমে যাবে, তা ঘটনাপ্রবাহ অবলোকনে অনুমিত হয়। তারা উভয়ে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যতটুকু সফল, দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পূর্বঅভিজ্ঞতার কারণে আরও বেশি সফল হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবচিত্র ভিন্ন।
৯০’র গণআন্দোলনে সামরিক শাসক এরশাদের বিদায়ের পর বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার নবঅধ্যায়ের সূচনা হলে জাতীয় সংসদের চারটি নির্বাচনে উভয় দল দু’বার বিজয়ী হলেও কোনো দল পরপর দুবার জয়লাভ করতে পারেনি। দ্বিতীয়বার বিজয়ী না হওয়ার পেছনের কারণ হল, জনআকাক্সক্ষা ও জনপ্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থতাসহ ব্যাপক অনিয়ম এবং দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হওয়ার পরও অনেকটা নির্লিপ্ততায় আবদ্ধ থাকা।
অতীতে দেখা গেছে, ব্যাপক জনপ্রিয়তা নিয়ে বিএনপি ক্ষমতাসীন হলেও প্রথম মেয়াদে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ফলাফল এবং দ্বিতীয় মেয়াদে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ফলাফল তাদের প্রতিকূলে যায়। ঠিক একই চিত্র দেখা গেছে আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও। আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় মেয়াদে দু-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতাসীন হলেও চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট ও বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ফলাফল তাদের প্রতিকূলে যায়। একমাত্র রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ফলাফল আওয়ামী লীগের অনুকূলে গেলেও সে নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে। অপরদিকে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী জোটের শরিক দল জাতীয় পার্টির তিনজন প্রার্থী নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হওয়ায় নিশ্চিত বিজয়টি তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়।
এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার অবস্থান দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোরতর হলে তাদের পক্ষে দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া অনেকটা সহজতর হতো। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের উভয়কে আমরা ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোরতর হতে দেখিনি।
আওয়ামী লীগের বিগত শাসনামলে শেয়ারবাজার, পদ্মা সেতু, কুইক রেন্টাল, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, টেলিযোগাযোগ, রেল, হলমার্ক, ডেসটিনি, নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতির কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এ থেকে উত্তরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থতা আওয়ামী লীগের গ্রহণযোগ্যতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যার খানিকটা উপলব্ধি করা গেছে গত বছর অনুষ্ঠিত কয়েকটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ফলাফলে। আর অবশিষ্টটুকু বোধ করি বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হলে উপলব্ধি করা যেত ।
যে কোনো সরকারের বিতর্কিত কার্যকলাপের কারণে জনমত বিপক্ষে চলে গেলে ক্ষমতা, প্রভাব ও টাকা কোনোটিই ফলদায়ক হয় না। কোনো দেশ ও সমাজেই জনমত স্থিতিশীল নয়। বিপর্যয় এড়ানোর একমাত্র উপায় হল অতীত ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভুল পথ পরিহার করে সঠিক পথ চলা। কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা মেলে, উভয় নেত্রীর কেউই ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় অতীত ব্যর্থতাকে গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবনে সচেষ্ট হননি। তাদের উভয়কে সচেষ্ট হতে দেখা গেছে ক্ষমতা থেকে বিদায়ের পর।
আমাদের প্রশাসনের কতিপয় শীর্ষ কর্মকর্তা নিজ নিরপেক্ষ অবস্থান বিসর্জন দিয়ে দলীয় রাজনীতিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এ ধরনের দলীয়করণ দেশের ভবিষ্যতের জন্য শুভ নয়। এ দলীয়করণের কারণে সৎ, দক্ষ ও মেধাবীরা কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। এ অবস্থা আমরা অবলোকন করছি ২০০১ সালে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে, যা অদ্যাবধি অব্যাহত আছে।
সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনে সততা, জ্যেষ্ঠতা, দক্ষতা, মেধা প্রভৃতির মূল্যায়নে নিয়োগ ও পদোন্নতি কার্যকর করা হলে সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় যে কোনো ধরনের বিফলতার আশংকা কমে যায়। আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কিন্তু তারপরও বিদ্যমান সম্পদের সঠিক ও যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন ও সফলতার সুযোগ আছে। আমাদের বড় দুটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনী ইশতেহারে যেসব প্রতিশ্র“তি দিয়ে বিজয় লাভ করে ক্ষমতাসীন হয়, তা বাস্তবায়ন করতে না পারার মধ্যে পরবর্তীকালে নির্বাচনে তাদের পরাজয়ের বীজ রোপিত হয়। তাই প্রশ্ন, যে প্রতিশ্র“তি পূরণ সম্ভব নয়, তা দিয়ে জনগণের সঙ্গে কেন এ তামাশা?
আমাদের উভয় নেত্রী পদে আসীন থাকাকালীন চাটুকারদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকায় দলের ত্যাগী, পরীক্ষিত ও সফল নেতাদের সঙ্গে তাদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এ দূরত্ব সূচারুরূপে দল ও সরকার উভয় পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এ চাটুকারদের মধ্যে দলীয় পদধারী ছাড়াও সামরিক ও বেসামরিক পদধারীদের দেখা যায়। এদের সবার কাছে দল ও দলের নেত্রীর ভবিষ্যতের চেয়ে নিজের ভবিষ্যৎ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এরা এক মেয়াদের পূর্ণ সময় একজন প্রধানমন্ত্রীর সাহচর্যে থাকতে পারলে যে পরিমাণ বিত্তবৈভবের মালিক হতে দেখা যায়, তাতে অনুমিত হয় এদের আগামী দু’-তিন প্রজন্মের আর পেছন ফিরে তাকানোর দরকার হয় না। আমাদের উভয় নেত্রী পদে থাকাকালীন যে কোনো কারণেই হোক এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সক্ষম হননি। পরবর্তীকালে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতাসীন হলে এদের বাদ দেয়া হলেও নতুনভাবে যাদের আবির্ভাব ঘটে উভয়ের চরিত্রে তেমন একটা পার্থক্য পরিলক্ষিত না হওয়ায় এ পরিবর্তন গুণগত ফল প্রদানে ব্যর্থ হয়।
আমাদের উভয় নেত্রী সার্বিকভাবে দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর হতে না পারায় এবং সরকারের উচ্চপদে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সৎ, দক্ষ, যোগ্য ও মেধাবীদের ঠাঁই না দেয়ায় তারা বিরোধী দলে থাকাকালীন সফল আর ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় বিফল। এ ধারা চলতে থাকলে যে লক্ষ্য নিয়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছিল, তা অর্জন সম্ভব হবে না। তাই তাদের ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতার বাইরে উভয় অবস্থায় দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে অভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করে বিফলতাকে সফলতার আচ্ছাদনে ঢেকে দিতে হবে।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন