এর আগের একটি লেখায় পরিবারতন্ত্র নিয়ে কিছু বিরূপ মন্তব্য পড়ে কেউ একজন বললেন, 'তাহলে কি আপনারা পরিবারব্যবস্থার বিরুদ্ধে?' শুনে হতাশ ও বিব্রত হয়েছি। তবে কি আমার লেখালেখি এমনই অস্পষ্ট থাকে যে পাঠকের মনে এমন বিপরীত ধারণা জন্ম নিতে পারে!
সে জন্য 'পরিবারতন্ত্র' আর 'পরিবারব্যবস্থা' যে এক জিনিস নয়, সেটা প্রথমেই স্পষ্ট হওয়া দরকার। 'পরিবার' হচ্ছে মানবসমাজের প্রাথমিক ভিত্তি (basic unit)। মানবসভ্যতার প্রথম সোপান। পারিবারিক জীবনের নিয়ম-শৃঙ্খলার বিস্তৃতিতেই মানবসমাজ বিস্তৃত হয়ে ধাপে ধাপে বৃহত্তর বিশ্বসমাজে পৌঁছতে পেরেছে। পশ্চিমা দুনিয়া পরিবারকে পাশ কাটিয়ে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের জয়গান এত বেশি গেয়ে ফেলেছে যে এখন পিছু হটার আপ্রাণ চেষ্টা করে গলদঘর্ম হচ্ছে।
আবার 'পরিবারতন্ত্র' এবং 'পারিবারিক ঐতিহ্য' যে এক নয়, সে বিষয়টিও মনে রাখতে হবে। কারো পছন্দ হোক বা না হোক, 'পারিবারিক ঐতিহ্য' থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যায় না। সেটা বিধিপ্রদত্ত। যেমন- কেউ যদি অপরূপা সুন্দরী বা সুঠাম দেহের অধিকারী হয়, সে জন্য তাকে দোষ দেওয়া যায় না। তেমনি কোনো ব্যক্তি যদি তার পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে সমাজে কিছু বাড়তি মর্যাদা পেয়ে যায়, সেটাও দোষের হতে পারে না (মর্যাদাবান পরিবারের ঐতিহ্য সমাজকেও কমবেশি আলোকিত করে।)।
ডাক্তারের ছেলে ডাক্তার হলে সেটা 'পরিবারতন্ত্র' হয় না, কারণ ডাক্তারের ছেলেকে ডাক্তারি পড়ে তবেই ডাক্তার হতে হয়। অতীতে কবিরাজের ছেলেরা কবিরাজ হয়েছে পিতার 'স্কুলে' পাঠ গ্রহণ করে। পারিবারিক ঐতিহ্য এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক অবদান রেখেছে। রাজনীতিবিদদের সন্তানও সেই সুবিধা পায়। পরিবারের রাজনৈতিক ঐতিহ্য তাকে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রাখে। সেটা মেনেই নিতে হয়। কিন্তু রাজার ছেলে যখন 'যুবরাজ' হয়, অতঃপর একদিন ঝুপ করে সিংহাসনে বসে পড়ে, সে ক্ষেত্রে যোগ্যতা-দক্ষতার প্রশ্ন তোলার কিছু থাকে না। উত্তরাধিকারসূত্রেই সিংহাসন তার প্রাপ্য হয় এবং প্রায়শ তা অপাত্রে অর্পিত হয়।
'পরিবারতন্ত্র' বনাম 'পারিবারিক ঐতিহ্য'
আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে এখন সেই ধারা প্রবর্তনের প্রয়াস চলছে বলে অনেকের অভিযোগ। রাজদরবারের রাজপুরুষরা যেমন রাজার শিশুসন্তানকে কুর্নিশ করে, পীরের বর্ষীয়ান মুরিদরা যেভাবে পীর সাহেবের নাবালক পুত্রের পদচুম্বন করে, অনেকটা সেভাবেই যেন আমাদের জাতীয় রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে এখন নেতৃত্ব নির্ধারিত হচ্ছে পারিবারিক উত্তরাধিকারসূত্রে। এমনকি বৈবাহিকসূত্রে।
নেহরু পরিবারের দুষ্ট দৃষ্টান্ত
'পরিবারতন্ত্রে'র কথা উঠলেই তার সপক্ষে ভারতের নেহরু পরিবারের দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হয়। এর আগে এক আলোচনায় উল্লেখ করেছিলাম, নেহরু পরিবার হচ্ছে এ ক্ষেত্রে একটি 'দুষ্ট দৃষ্টান্ত'। বস্তুত এই পরিবারটি ভারতের ঐতিহ্যবাহী কংগ্রেস দলটিকে তার গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত করে পরিবারতন্ত্রের দুষ্টচক্রে আবদ্ধ করে বিদুষকের দলে পরিণত করেছে। যার প্রভাব পড়েছে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে। আমাদের দেশেও। নেহরু পরিবার এখন আমাদের জাতীয় রাজনীতির দুই প্রধান দলের সামনে মডেল হয়ে বিরাজ করছে।
দলের সিনিয়র নেতারা, উকিল-ব্যারিস্টার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-উপাচার্য, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী- সবাই সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যুবরাজদের আশীর্বাদ ভিক্ষা করেন। রাজা যেভাবে তাঁর দরবারে আগত আমির-ওমরাহদের নানা উপঢৌকন প্রদান করেন, উপঢৌকন হাতে নিয়ে তাঁরা যেভাবে কুর্নিশ করতে করতে পিছু হটে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন, আমাদের রাজনীতির দরবারেও সেভাবে করুণাপ্রত্যাশী বয়োজ্যেষ্ঠ রাজনীতিক, পুরস্কারপ্রত্যাশী জ্ঞানী-গুণী-বুদ্ধিজীবী, সুবিধাপ্রত্যাশী ছাত্র-শিক্ষক-ভাইস চ্যান্সেলর, শিল্পী-সাহিত্যিক, নট-নটী, অর্থ-বিত্তপ্রত্যাশী ধনিক-বণিক- সবাই নিত্যদিন সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত হচ্ছেন। মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্রেও বোধ হয় কিছুটা শালীনতা-ভব্যতা ছিল, কিছুটা আত্মাভিমান ছিল- এখানে যা দৃশ্যমান নয়।
ভারতের রাজনীতিতে নেহরু পরিবারের মাদকাসক্তি এখন কিছুটা ফিকে হয়ে এসেছে। কিন্তু কংগ্রেস নামক দলটির নেতারা নিজেরাই এখন তাকে ধরে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। নেহরু পরিবারের ছাতার নিচে আশ্রয় নিয়ে তাঁরা ভোটের মাঠের বৈরী উত্তাপ থেকে আত্মরক্ষা করতে চাইছেন। ফলে ভারতীয় রাজনীতি থেকে পরিবারতন্ত্র যাই যাই করেও যেতে পারছে না।
আমাদের জাতীয় রাজনীতিতেও প্রায় একইভাবে আমাদের দুই প্রয়াত নেতার স্মৃতিকে ঘিরে 'পরিবারতন্ত্র' মাথা তুলেছে। লক্ষ করার বিষয়, শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়া সামনে এসেছেন পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণে, 'পরিবারতন্ত্রে'র ধারক হিসেবে নয়। কারণ দুজনের কেউই জোর করে বা উত্তরাধিকারসূত্রে ক্ষমতায় চেপে বসেননি। তাঁদের পিতা বা স্বামী তাঁদের রাজনীতিতে যুক্ত করেননি। ব্যক্তিগতভাবে দুজনই প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে অনাগ্রহী ছিলেন। দলের অন্যরা অনেকটা নিজেদের প্রয়োজনে তাঁদের নেতৃত্বে আসীন করেছেন।
আগেই উল্লেখ করেছি, ক্ষমতার রাজনীতিতে ক্ষমতাসীনদের পরিবারের লোকজন স্বাভাবিক নিয়মেই কিছু বাড়তি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। মার্গারেট থ্যাচার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে একবার হঠাৎ করে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে রাষ্ট্রীয় সফরে গেলে তা নিয়ে বেশ সমালোচনা হয়। সমালোচকরা খুঁজে বের করেছিলেন যে মিসেস থ্যাচারের ওই রাষ্ট্রীয় সফরের কোনো রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন ছিল না। তাঁর পুত্রের জন্য একটা ব্যবসার তদবির করতেই তিনি সেই সফরের আয়োজন করেন। সে রকম ছোটখাটো ব্যাপার আমরা দেখেও না দেখার ভান করতে পারি। তা না হলে ঠগ্ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু ক্ষমতা চিরায়ত করার লক্ষ্যে ক্ষমতার চারপাশে পরিবারকেন্দ্রিক বলয় তৈরি করা এবং রাষ্ট্রক্ষমতায় স্বীয় অধস্তন পুরুষদের অধিষ্ঠান নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে দলকে সেভাবে বিন্যস্ত করার যে অপসংস্কৃতির চর্চা শুরু হয়েছে, তার চেয়ে বড় রাজনৈতিক অনাচার আর কিছুই হতে পারে না।
কেবল যে রাজনীতির শীর্ষপর্যায়ে এই অপসংস্কৃতির চর্চা হচ্ছে তা-ই নয়, ওপর থেকে নিচের দিকে প্রায় সর্বস্তরেই এখন প্রায় একই পরিস্থিতি লক্ষ করা যায়। যেন মধ্যযুগীয় সামন্তবাদ ফিরে আসছে। ফলে ক্ষমতাসীনদের পরিবারের বাইরে অন্যান্য পরিবারের সন্তানদের রাজনৈতিক নেতৃত্বে উঠে আসা ক্রমেই কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে।
দলের ভেতরে গণতন্ত্র
গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ, বিশেষত গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে গণতন্ত্র চর্চার বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। যে দলের ভেতরে গণতন্ত্র নেই, সে দল ক্ষমতায় গিয়ে গণতন্ত্রের চর্চা করবে কিভাবে?
এখন আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোতে সব স্তরের নেতৃত্ব নির্ধারিত হয় কেন্দ্রীয় দপ্তরে। যেকোনো সময় যেকোনো পর্যায়ে দলীয় নেতৃত্ব বদল হয়ে যায়। কাগজে একটা প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দলের সহাসচিব বদলে ফেলা যায়। বিএনপি এই কাজটি অন্তত পাঁচবার করেছে। দলটির সঙ্গে আমার দূরত্ব সৃষ্টির সূচনা এ থেকেই। সর্বশেষ এই সেদিন জাতীয় পার্টির দীর্ঘদিনের মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারকে তাঁর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কী কারণে এই কাজটি করেছেন, তা বলেননি। বলার প্রয়োজনও নেই। কারণ তিনি আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন, 'আমি যত দিন আছি, আমিই দলের চেয়ারম্যান। আমার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।'
কেবল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদই নন, দু-একটি ছাড়া সব দলেই নেতৃত্ব নির্ধারণ বা পরিবর্তনে কোনো গণতান্ত্রিক রীতি-পদ্ধতি অনুসৃত হয় না। সে জন্যই আমাদের গণতন্ত্র এভাবে পদে পদে হোঁচট খাচ্ছে। নেতা নির্বাচনে কোনো গণতান্ত্রিক রীতি না থাকায় কেউ একবার দলপতি হয়ে যেতে পারলে তিনি আজীবন দলপতি থাকছেন। এই আজীবন দলপতি যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন, তখন তিনি স্বভাবতই মনে করবেন যে তাঁকেই আজীবন রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকতে হবে। অতএব সব কিছু তিনি সেভাবেই সাজাতে থাকেন। রাষ্ট্র হয়ে পড়ে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তি। এই ব্যক্তিগত সম্পত্তির উত্তরাধিকারীও তিনি স্থির করে ফেলেন। স্বভাবতই সে ক্ষেত্রে নেতার পুত্র-কন্যা-জায়া সর্বাগ্রে থাকেন।
বিএনপির নবরূপায়ণ
বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া তাঁর পুত্র তারেক রহমানকে তাঁর উত্তরসূরি এবং উত্তরাধিকারী মনোনীত করেছেন। সেভাবেই তাঁর দলকে তিনি ঢেলে সাজাচ্ছেন। সেভাবেই তাঁর দলের বর্ষীয়ান নেতারাও কথা বলছেন। জ্ঞানীজনেরা বইপত্রও লিখতে শুরু করেছেন।
তারেক রহমানের সৌভাগ্য যে তিনি জিয়াউর রহমানের পুত্র। জিয়াউর রহমান আমাদের জাতীয় জীবনে নিত্যদিন আলোচিত একটি নাম (নিবেদিতপ্রাণ রাষ্ট্রপরিচালক ও প্রশাসক হিসেবে আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত আর কেউ তাঁর সমকক্ষতা দেখাতে পারেননি। আওয়ামী লীগের বন্ধুদের ভ্রু-কুঁচকানো কিংবা খালেদা জিয়া ও তাঁর সঙ্গীদের অন্যায় আচরণে ভয়ানকভাবে সংক্ষুব্ধ হয়েও আমি এই বক্তব্যে অটল থাকব।)। তারেক তাঁর পিতার সেই সুনাম কাজে লাগানোর চেষ্টা করলে তাতে দোষের কিছু নেই। যে কারণেই হোক, দীর্ঘদিন যাবৎ তিনি বিদেশে আছেন। বিদেশে থেকে পড়াশোনা করে সগৌরবে দেশে ফিরে জাতীয় রাজনীতিতে অবদান রাখতে চাইলে সেই সুযোগ বরাবরই থাকবে। কিন্তু যৌক্তিক-অযৌক্তিক কথাবার্তা বলে কেবলই বিতর্ক সৃষ্টি বা চমক সৃষ্টি করার সস্তা রাজনীতি হিতে-বিপরীত ঘটায়। সেটা শোভনও নয়।
আমাদের রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, বিভিন্ন পর্যায়ে ক্ষমতার হাতবদল এবং বিভিন্ন সরকারের নানা কার্যক্রম নিয়ে অনেক প্রশ্ন বিদ্যমান। অনেক কিছু নিয়েই বিতর্ক হতে পারে। অনেক বিতর্কেরই কোনো সমাপ্তি নেই। যাঁরা দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে চান, ভবিষ্যতে জাতিকে নেতৃত্ব দিতে চান- তাঁদের পেছনের দিকে নয়, সামনের দিকেই তাকাতে হবে। ইতিহাসের বিচার ইতিহাসই করবে। বিতর্ক কেবল নতুন বিতর্কেরই জন্ম দেবে, কোনো সমাধান এনে দেবে না।
বিভাজন নয়, প্রয়োজন সংহতি
আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গন আজ মারাত্মকভাবে বিভাজিত। এই বিভাজনের নিশ্চয়ই কার্যকারণ আছে। কিন্তু বিভাজনের রেখাগুলোকে আরো প্রশস্ত না করে, সব বিভাজন অতিক্রম করে জাতিকে একসূত্রে গাঁথার প্রচেষ্টা আবশ্যক। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা পরস্পরের প্রতি সচরাচর যে ধরনের ভাষা ব্যবহার করেন, তা বহু ক্ষেত্রেই শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে যায়। রাজনৈতিক মতবিরোধকে খিস্তি-খেউড়ের পর্যায়ে নিয়ে তাঁরা নিজেরা নিজেদেরই ছোট করছেন।
বাংলাদেশের দুটি বড় দল জাতীয় রাজনীতির মাঠ দখল করে আছে। দুই দলই তাদের প্রয়াত নেতার নামকীর্তন এবং প্রতিপক্ষ দলের নেতার চরিত্র হননকেই তাদের রাজনীতির প্রধান হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছে। ২০০৭-০৮ সালে, কথিত এক-এগারোর সময়, রব উঠেছিল- 'মাইনাস টু' করতে হবে। 'মাইনাস টু' মানে দুই দলের দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে বিদায় করা এবং উভয় দলকে ভেঙে চুরমার করা। অনেকেই তাতে উৎসাহ জুগিয়েছেন। দুই দলেরই অনেক শীর্ষ নেতা সেই 'প্রকল্পে' শরিক ছিলেন। আমার দুর্ভাগ্য, আমি তাতে একমত হতে পারিনি। সেদিনের ক্ষমতাধরদের বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম যে- 'ইচ্ছা করলেই কোনো ঐতিহ্যবাহী দলকে রাতারাতি মুছে ফেলা বা মাইনাস করা যায় না। আইয়ুব-ইয়াহিয়া পারেননি। এরশাদ সাহেব পারেননি। ওটা সম্ভব নয়। এক-এগারোর নায়করা সে জন্য আমার প্রতি নাখোশ হয়েছেন। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের 'জরুরি অবস্থা' ঘোষণা বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে একটি বিরাট পটপরিবর্তনের মাইলফলক। এই পদক্ষেপ নেওয়া না হলে ২২ জানুয়ারির ঘোষিত একদলীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশ ভয়ংকর রকমের রক্তক্ষয়ী সংঘাতে নিমজ্জিত হতো। বলা হয়, রাষ্ট্রপতি সেদিনের কিছু উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তার চাপের মুখেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যে কারণেই তিনি সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকুন না কেন, সেই সিদ্ধান্তটি দেশকে ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে বাঁচিয়েছে।
সেদিন জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার পর যে নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, সেই সরকার আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে পরিবর্তন আনার কথা বলেছে। দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের মূলোচ্ছেদ করে নির্বাচনের জন্য সমতল ক্ষেত্র তৈরির কথা বলেছে। দ্রুততম সময়ে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্পন্ন করে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলেছে। এসব প্রতিশ্রুতি তাঁদের নজিরবিহীন জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল।
দেশের সাধারণ মানুষের মতো আমিও সেসব প্রতিশ্রুতিতে ভীষণভাবে আকৃষ্ট ও অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। দুর্ভাগ্য, আমাদের দুই বড় দলের মতোই কথিত 'এক-এগারো'র নায়কদেরও লক্ষ্য ছিল একচ্ছত্র ক্ষমতা। সব স্বৈরশাসকই সে পথে এগোতে চায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে না। সেবারও হয়নি। এখনো হবে না বলেই আমার দৃঢ়বিশ্বাস।
হাজারো সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একটি বৃহৎ ও বহুমাত্রিক মানবগোষ্ঠীর পরিচালনায় সংসদীয় গণতন্ত্রের চেয়ে অধিকতর উপযোগী কোনো শাসনব্যবস্থা এখনো উদ্ভাবিত হয়নি। অর সে জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন মত ও পথের সুসংগঠিত ও সুপরিচালিত রাজনৈতিক দলের গঠনমূলক কার্যক্রম।
এক-এগারোর শক্তিমান পুরুষদের তা বোঝাতে পারিনি। আজকের এই যুযুধান 'দ্বিদলীয় রাজত্বে'র রাজপুরুষদেরও বোঝানো যাবে বলে মনে হয় না।
শেষ কথা : 'মাদক' ও 'পরিবারতন্ত্র'কে 'না' বলুন
সমাজকর্মীদের জনপ্রিয় স্লোগান : 'মাদককে না বলুন'। মনে হয় স্লোগানটা একটু সম্প্রসারিত করার সময় এসেছে। এখন বলা দরকার, 'মাদক ও পরিবারতন্ত্রকে না বলুন'।
দুইয়ের মধ্যে অনেক মিল। দুটোই অনাচার। দুটোই আরোপিত ও সংক্রামক। দুটোই রীতিবিনাশী ও সমাজবিধ্বংসী। তবে শেষেরটার বিনাশী ও বিধ্বংসী ক্ষমতা অনেক বেশি। কারণ মাদক মূলত ব্যক্তিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। সমাজও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে সেটা তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়। অন্যদিকে 'পরিবারতন্ত্র' সরাসরি বিনাশ করে রাজনৈতিক সংস্কৃতির মৌল ভিত্তি, পরিণামে বিধ্বস্ত হয় গোটা জাতি, রাষ্ট্রযন্ত্র এবং গণতন্ত্র।
লেখক : ভূরাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন