|
ড. সা'দত হুসাইন
|
|
নগরীতে ভিভিআইপিদের চলাচলের জন্য হেলিকপ্টার ব্যবহার করা সমীচীন হবে
19 Apr, 2014
আমি এখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের খুব কাছে এয়ারপোর্ট রোডে গাড়িতে বসে আছি। প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে গাড়িটি এক জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আরো কতক্ষণ এমনিভাবে এখানে গাড়িটিকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, সে সম্পর্কে ঠিক কিছু বলা যাচ্ছে না। এমনভাবে এক জায়গায় আটকে থাকা আজকাল প্রায় রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় এ চিন্তায় মনটা রোজ খিঁচড়ে থাকে। কখন গিয়ে কর্মস্থলে পৌঁছব, কোথায় যে আটকে থাকব, তার কিছুই জানি না। শুধু এটুকু নিশ্চিত যে কর্মস্থলে পৌঁছতে অনেক লম্বা সময় লাগবে, রাস্তায় মাঝেমধ্যেই গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকবে এবং ভেতরে অসহায় অবস্থায় বসে আমরা নিজেদের ও কর্তৃপক্ষকে অভিশাপ দিতে থাকব।
আমার গাড়ির পেছনে এতক্ষণে হয়তো পাঁচ কিলোমিটার ট্রাফিক জ্যামের সৃষ্টি হয়েছে। শেষ মাথা বোধ হয় কুড়িল ফ্লাইওভারের গোড়ায় গিয়ে ঠেকেছে। গাড়ির সংখ্যা নিশ্চয়ই কয়েক হাজারের মতো হবে। এদের বেশির ভাগই সরকারি-বেসরকারি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী কিংবা তাঁদের সেবার গ্রাহক। এয়ারপোর্ট রোডটি বর্তমানে উত্তর-দক্ষিণে চলাচলের মূল পথ। তেজগাঁওয়ের রাস্তায় ফ্লাইওভারের কাজ চলছে বিধায় রাস্তাটি একেবারে সরু হয়ে গেছে। ফলে উত্তরের লোকজন ও যানবাহন এখন সে রাস্তায় খুব একটা চলে না। উত্তর-দক্ষিণের প্রায় সব গাড়ি এয়ারপোর্ট বা ভিআইপি রোড হয়ে চলাচল করে। এখানে যানবাহন চলাচল বাধাগ্রস্ত হওয়ার অর্থ হচ্ছে উত্তর ও দক্ষিণের ঢাকা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া। সকালবেলা উত্তরের লোকজন দক্ষিণ বা সেন্ট্রাল ঢাকার অফিস-আদালত, দোকানপাট ও ব্যবসায়প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশে রওনা হয়; বিকেলে তারা কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফেরে। গুলশান, বনানী, উত্তরায় কিছু ব্যবসায়প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর স্থানান্তরিত হলেও জনস্রোতের মূলধারা প্রায় আগের মতোই রয়ে গেছে। উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত মহাসড়কটিকে রাজধানী ঢাকার অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের জীবনরেখা (খরভব ষরহব) বললে অত্যুক্তি হবে না।
নগরীতে ভিভিআইপিদের চলাচলের জন্য হেলিকপ্টার ব্যবহার করা সমীচীন হবে
সেই রাস্তার ওপর আমরা হাজার হাজার লোক, লক্ষাধিক বলা যেতে পারে, অসহায় অবস্থায় প্রাইভেট বা পাবলিক যানবাহনে দুর্বিষহ উদ্বেগ-অস্থিরতা নিয়ে কপাল চাপড়াচ্ছি। আমার নিজের কথা বলি। আমি যাব একটি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে ক্লাস নিতে। রাস্তায় জ্যাম হতে পারে, এ আশঙ্কায় স্বাভাবিক সময়ের এক ঘণ্টা আগে বাসা থেকে বেরিয়েছি। কিন্তু এখন মনে হলো, তাতেও কোনো লাভ হবে না। এই একটি জায়গাতেই হয়তো ৪০-৪৫ মিনিট বসে থাকতে হবে। তারপর আরো সিগন্যাল রয়েছে। প্রতিটিতে ১০-১৫ মিনিট বসে থাকতে হবে। এর মধ্যে ক্লাসের সময় শুরু হয়ে যাবে। প্রশিক্ষণার্থীরা অধীর আগ্রহে বসে থাকবে। কোর্স ডিরেক্টর নানাভাবে তাদের অস্থিরতা দূর করার চেষ্টা করবেন। শেষ পর্যন্ত হয়তো কয়েক মিনিট পর হন্তদন্ত হয়ে আমি ক্লাসে ঢুকব। দুঃখ প্রকাশ করব আর মাফ চাইব। প্রশিক্ষণার্থীরা ভদ্রতা করে চুপ থাকবে। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। প্রশিক্ষণ সময়ের যে অংশটুকু হারিয়ে গেল, তা আর কোনো দিন ফিরে পাওয়া যাবে না। এটি জাতীয় ক্ষতি। অর্থনীতির পরিভাষায় একে বলা হয়ে থাকে 'ডেড ওয়েট লস'। আমার মতো লক্ষাধিক যাত্রীকে এ ধরনের 'ডেড ওয়েট লস' গুনতে হবে, যার পরিমাণ শুনলে বাইরের জগতের অনেকেই আঁতকে উঠবে।
অবশেষে বুঝতে পারলাম, এখন দেশি-বিদেশি কোনো ভিভিআইপি আমাদের অতিক্রম করে বিপরীত দিকে যাবেন। সাইরেন বাজিয়ে দুজন রাইডার চলে গেল। তারপর সিপাহি-সান্ত্রী, নানা রকমের গাড়ি, মাঝের কোনো গাড়িতে ভিভিআইপি। পুরো মোটরকেড যাওয়ার মিনিট কয়েক পর আমরা মুক্তি পেলাম। গাড়ি চলতে শুরু করল। এরপর খুব একটা ঝামেলা হয়নি, কারণ সামনের রাস্তা আগেই যানমুক্ত করা হয়েছিল।
ভিভিআইপিদের চলাচলের কারণে আগেও অনেকবার রাস্তায় আটকে পড়েছিলাম। তবে এবারের আটকে পড়ার সময় অনেক বেশি লম্বা ছিল। কারণ জানতে সময়ও লেগেছে তুলনামূলকভাবে বেশি। 'রোড ক্লিয়ার' রাখার নামে দেশি-বিদেশি ভিভিআইপির চলাচলের আগে, চলাচলের সময় ও চলাচলের বেশ কয়েক মিনিট পর্যন্ত রাস্তার উভয় দিকের যান চলাচল বন্ধ রাখার ফলে দীর্ঘ সময় ধরে চলাচলে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়। তার ফলাফল তো এখন সবার জানা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিদেশি ক্রিকেট দল, এমনকি বিজিবির (অধুনালুপ্ত বিডিআর) আলোচনার জন্য আগত ডিজি, বিএসএফের চলাচলের সময় 'রোড ক্লিয়ার' করতে গিয়ে হাজার হাজার যানবাহনকে কোনো জায়গায় ঠায় দাঁড় করে রাখা হয়েছে। অনেক সময় দেখেছি, ফুটপাতের ওপর দিয়ে চলা মানুষকেও দাঁড় হয়ে থাকতে বলা হয়েছে, তাও আবার উল্টো দিকে মুখ করে। প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন যখন ঢাকায় এসেছিলেন, তখন অনেক রাস্তায় যান চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সাধারণ মানুষের ভোগান্তির সীমা ছিল না। প্রেসিডেন্টের যে সফর হতে পারত ঢাকাবাসীর জন্য একটি বিরাট উৎসব-আনন্দের ব্যাপার, রাস্তাঘাটে চলা বন্ধ করে দেওয়ায় তা হয়েছে একটি দুর্ভোগের অনুশীলন। মাঝেমধ্যেই এমনটি ঘটে। আমরা বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে অনেক সময় আনন্দ উৎসবকেও দুঃখ, বেদনা, দুর্ভোগের কারণ বানিয়ে ফেলতে পারি।
এর মধ্যে যোগ হয়েছে কয়েকটি বড় সংগঠনের সামনের মহাসড়কে চলাচলে বাধানিষেধ আরোপ। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, নৌবাহিনী সদর দপ্তরের সামনে এয়ারপোর্ট রোড বা ভিআইপি সড়ক। এটি দেশের উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর মূল সংযোগ সড়ক। প্রতিদিন হাজার হাজার যানবাহন ও লাখ লাখ যাত্রী এ পথে চলাচল করে। নৌ সদর দপ্তরে সরাসরি প্রবেশের সুবিধার্থে গেটের সামনে ডিভাইডারটি কাটা রয়েছে। একটি-দুটি গাড়ি ঢোকার প্রয়োজন দেখা দিলেই উত্তর থেকে দক্ষিণের এই মহাসড়কটি একজন নৌ সদস্যের প্রত্যক্ষ সহায়তায় ট্রাফিক পুলিশ বন্ধ করে দেয়। ফলে হাজার হাজার গাড়ি আটকা পড়ে। ট্রাফিক জ্যাম প্রায় উড়াল সড়ক (ফ্লাইওভার) পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হয়। কোনো কোনো সময় একনাগাড়ে ৮-১০ মিনিট দক্ষিণমুখী যানগুলো আটকে থাকে। একজন-দুজন অফিসারের গাড়ি সদর দপ্তরে ঢোকার সুবিধার্থে কেন মহাসড়কের ওপর হাজার হাজার গাড়ি আটকে রাখা হবে, তা বোধগম্য নয়। সচিবালয়ের সামনের সড়ক ওসমান গনি রোডেও একই ঘটনা ঘটে। একটি বা দুটি গাড়ি রাস্তার অপর পাশ থেকে সচিবালয়ে ঢোকার জন্য পশ্চিম থেকে পূর্বে যাওয়া অর্থাৎ গুলিস্তান, মতিঝিলের পথে যাওয়া শত শত গাড়ি আটকে রাখা হয় বহু সময় ধরে। মধ্যে ডিএমপি সদর দপ্তরের গেটেও এভাবে গাড়ি আটকে রাখা হতো। সাম্প্রতিককালে এই রীতি বাতিল করা হয়েছে। আশা করা যায়, এই ক্ষতিকর রীতি পুনরায় চালু করা হবে না।
নগরীতে ভিভিআইপিদের চলাচলকালে নিরাপত্তা প্রদান ও সাধারণ মানুষের সুবিধা-অসুবিধার ব্যালান্স করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। বর্তমানে গুলশান-বনানী থেকে সচিবালয় বা মতিঝিলে যেতে ১০টির অধিক সিগন্যাল অতিক্রম করতে হয়, যার ফলে শুধু সিগন্যাল বাতিতেই দেড় ঘণ্টার অধিক সময় ব্যয় করতে হয়। কর্মস্থলে পৌঁছতে দুই ঘণ্টা কিংবা মাঝেমধ্যে তারও অধিক সময় লেগে যায়। এরপর যদি দেশি-বিদেশি ভিভিআইপি কিংবা এজাতীয় কোনো ব্যক্তি বা দলের মুভমেন্টের জন্য অপ্রত্যাশিত জায়গায় আধা ঘণ্টা থেকে ৪৫ মিনিট বসে থাকতে হয়, তাহলে কর্মস্থলে বারবার মাফ চাওয়া অথবা খিটখিটে মেজাজে সময় কাটানো ছাড়া আর উপায় থাকে না। আমার পরিচিত দু-একজন চালাক ব্যক্তি গাড়িতে চাদর-বালিশ নিয়ে শোয়ার ব্যবস্থা করে নিয়েছে। কিছুক্ষণ গাড়িতে ঘুমিয়ে নিতে পারলে একদিকে যেমন দীর্ঘ সময় চলার ক্লান্তি প্রশমিত হয়, অন্যদিকে বিনা কাজে সময় নষ্ট হওয়ার বিরক্তি থেকে কিছুটা রক্ষা পাওয়া যায়। একজন কর্মনিষ্ঠ লোকের কাছে বিনা কাজে সময় কাটানোর মতো কষ্টকর ব্যাপার খুব কমই আছে।
এ সমস্যার আংশিক সমাধানের লক্ষ্যে নগরীতে দেশি-বিদেশি ভিভিআইপিদের চলাচলের জন্য হেলিকপ্টার ব্যবহার করা যেতে পারে। ভিভিআইপিরা নগরীর কয়েকটি নির্দিষ্ট জায়গায় চলাফেরা করেন। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে তাঁদের সেসব জায়গায় হেলিকপ্টারে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। তাতে বিশাল মোটরকেডের প্রয়োজন হবে না। ভিভিআইপি ও রাস্তায় চলাচলকারী যাত্রীসাধারণের সময় সাশ্রয় হবে। বিশেষ করে যাত্রীদের দুর্ভোগ ও বিরক্তি অনেক কম হবে। মানুষের ক্ষোভ ও হতাশা কম হওয়ায় ভিভিআইপিদের জনপ্রিয়তা বাড়বে বৈ কমবে না। আজকাল বেসরকারি খাতের কর্তাব্যক্তিরা সময় সাশ্রয়ের লক্ষ্যে নগরীর আশপাশে তাঁদের উৎপাদনকেন্দ্রে যেতে হেলিকপ্টার ব্যবহার করেন। এটি এখন গ্রহণযোগ্য রীতিতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। নগরীতে চলাচলে ভিভিআইপিদের জন্য অন্তত পরীক্ষামূলকভাবে হলেও হেলিকপ্টার সার্ভিস প্রবর্তন করা যেতে পারে।
উচ্চতর প্রযুক্তি ব্যবহার করে যদি আমরা ভিভিআইপি ও নাগরিকদের কষ্ট লাঘব করতে পারি তাহলে কার্যকরভাবে সেই প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য যথাযথ প্রচেষ্টা গ্রহণ যৌক্তিক হবে। এতে কিছু প্রারম্ভিক খরচের প্রয়োজন হবে। তবে পদ্ধতিটি একবার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে সেই খরচ নিতান্ত নগণ্য বলে বিবেচিত হবে বলে বিশ্বাস করি। আমরা এ লক্ষ্যে প্রস্তুতি গ্রহণ ও পরীক্ষামূলক কাজ শুরু করতে পারি।
লেখক : সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন