কী চমৎকার দেখা গেল : ছোট দারোগা পেটাচ্ছেন ইউএনওকে, বড় মন্ত্রী মাথা ফাটাচ্ছেন উপসহকারী প্রকৌশলীর।
প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় একটি সংবাদের শিরোনাম : ইউএনওকে মারধর/পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করতে ব্যর্থ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। একই পত্রিকার শেষ পৃষ্ঠায় অপর একটি সংবাদের শিরোনাম : বিদ্যুৎ প্রকৌশলীর মাথা ফাটালেন লতিফ সিদ্দিকী। শেষোক্ত সংবাদের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদেই জনাব লতিফ সিদ্দিকীর বিস্তারিত তারিফ উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে : 'ক্ষমতাসীন সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য'। মাননীয় মন্ত্রীর সাম্প্রতিক অনুরূপ অর্জনের নমুনা হিসেবে প্রতিবেদনের শুরুতেই গত ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি যে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়ে একজন আবাসিক চিকিৎসককে বাথরুমে আটকে লাঞ্ছিত করেছিলেন, সে ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে।
'আমরা দুঃখিত, আমরা লজ্জিত আসুন পাল্টাই'
বাথরুমে কিছুক্ষণ আটকে রাখার ঘটনা থেকে সংশ্লিষ্টজনরা পাছে যথোপযুক্ত শিক্ষা না পায়, এবার মাননীয় মন্ত্রী তাই লাঠ্যৌষধি প্রয়োগ করলেন। লাঠির ঘায়ে 'অপরাধী' প্রকৌশলীর মাথা ফেটে রক্ত ঝরেছে। আশা করা যায়, এতে কাজ হবে। তবে দেশের তাবৎ প্রকৌশলী যদি 'রক্ত যখন দিয়েছি আরো দেব' বলে কোনো শপথটপথ করে বসেন, তাহলে কালিহাতীর জনৈক বিদ্যুৎ প্রকৌশলী পূর্ণচন্দ্র পাল মহাশয়ের রক্ত কোথা থেকে যে কোথায় গড়ায় কে জানে! আমি বিজ্ঞ প্রকৌশলী বন্ধুদের অনুরোধ করব, আপনারা আর যাই করুন, হুট করে এমন কিছু করবেন না, যা দেশের স্বার্থবিরোধী হয়। কথাটা বলছি এই জন্য যে সাধারণত দেখা যায় এ ধরনের সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত ঘটনা-দুর্ঘটনার পর ক্ষতিগ্রস্ত গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বসে, যা বৃহত্তর সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়।
তা ছাড়া মাননীয় মন্ত্রীর বক্তব্যও এখনো জানা যায়নি। তিনি হয়তো বলতে পারেন, তিনি তাঁর হস্তধৃত কুসুমাদপি কোমল যষ্টি দ্বারা যেটুকু আঘাত করেছিলেন, তাতে একজন সুস্থদেহী, সবল, স্বাভাবিক গড়ন-গাড়নের মানুষের করোটিতে বড়জোর একটা টোকা লাগতে পারে, মাথা ফেটে রক্ত ঝরে খবরের কাগজে একটা শব্দার্থে ফাটাফাটি সংবাদের জন্ম দেবে, তা তো হতে পারে না। অতএব, একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে দেখা দরকার প্রকৌশলী ভদ্রলোকের করোটি, প্রকৌশলবিদ্যার ভাষায়, সঠিক উপাদান দ্বারা গঠিত ছিল কি না। যেভাবে একটা ব্রিজে ফাটল দেখা দিলে বা ব্রিজটি অকালে ভেঙে পড়লে প্রকৌশলীরা, স্থপতিরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেন ওটাতে সঠিক গুণগত মানসম্পন্ন চুন-বালি-সিমেন্ট-রড ইত্যাদি সঠিক অনুপাতে দেওয়া হয়েছিল কি না।
এখানে আরেকটি 'মারিফতি' প্রসঙ্গের অবতারণা করা খুব একটা অবান্তর হবে বলে মনে হয় না। অন্তত এ থেকে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী কিছুটা মানসিক প্রশান্তি লাভ করতে পারেন। বিষয়টি মাননীয় মন্ত্রীর দৈবশক্তিসংক্রান্ত।
তার আগে আমাদের ছেলেবেলার এক পীর সাহেবের কথা বলে নিই। ওই চরম বদরাগী পীর সাহেবের কাছে লোকে যেত নানাবিধ মানত নিয়ে : কারো রোগমুক্তি, কারো সন্তানলাভ, কারো চাকরিপ্রাপ্তি ইত্যাদি মানত নিয়ে লোকজন যেত তাঁর কাছে। পীর সাহেব সবার কথা শুনতেন, কাউকে কিছু বলতেন না। তবে হঠাৎ হঠাৎ রেগে যেতেন। আর রেগে গিয়ে মানতকারীদের কোনো একজনকে আচ্ছাসে পিটুনি লাগাতেন। হাতে লাঠি থাকলে লাঠি, আর না হয় জুতা-খড়ম-বদনা-পিকদান-চিলুমচি, যা পেতেন তাই দিয়ে দিতেন কয়েক ঘা। ব্যস, ওতেই নাকি কাজ হয়ে যেত। প্রহৃত ব্যক্তি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হলেও উঠে দৌড় লাগাতে পারত, নিঃসন্তান মহিলার কোল আলো করে আসত সন্তান। বেকার, সুইসাইড খেতে চাওয়া যুবকের দারুণ একটা চাকরি জুটে যেত পর দিনই। যাদের ভাগ্যে হুজুরের এই লাঠির বাড়ি, জুতার বাড়ি জুটত না, তারা মন খারাপ করে ফিরে যেত, আর প্রহৃত ব্যক্তি ফিরত মহাখুশি হয়ে নাচতে নাচতে। সম্মানিত সিদ্দিকী বংশের আমাদের মাননীয় মন্ত্রীর লাঠির বাড়ি উপসহকারী প্রকৌশলী মহোদয়ের ভাগ্য যে খুলে দেবে না, তাই বা কে জানে! তেমনি ফেব্রুয়ারি মাসে কিছুক্ষণের জন্য শৌচাগারে আবদ্ধ ডাক্তার সাহেবের নামে, কে বলতে পারে, হয়তো বাকি জীবনের জন্য পাঁচতারা হোটেল বরাদ্দ করে দিয়েছেন বিধিপুরুষ। ফেব্রুয়ারিতে চিকিৎসক, মার্চে প্রকৌশলী, এরপর এপ্রিলে কার পালা? হিসাবমতো তো প্রশাসক অর্থাৎ বিসিএস প্রশাসনের কারো 'কপাল খুলে' যাওয়ার কথা। কিন্তু না, তা বোধ হয় হচ্ছে না। কারণ মার্চ মাসেই একজন উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে (ইউএনও) পিটিয়ে সেই গুরুদায়িত্ব ইতিমধ্যেই পালন করে ফেলেছেন পুলিশের একজন সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই)। সেই সঙ্গে স্বাধীনতার মাসে স্বাধীনতা কত প্রকার ও কী কী, তা উদাহরণসহ বুঝিয়ে দিয়েছেন। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রশাসক সবার পালা ফেব্রুয়ারি-মার্চ দুই মাসে শেষ হয়ে গেছে, এখন তাহলে বোধ হয় কৃষিবিদ প্রস্তুত থাকতে পারেন এপ্রিল মাসের জন্য। কৃষিবিদরা যে যেখানে আছেন সাবধান হয়ে যান। মাঠে ফসল দেখতে যান, আর গবেষণাগারে মাইক্রোস্কোপের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে থাকুন, মাথায় একটি হেলমেট ও পিঠে বড়সড় একটা কুলো বেঁধে নিতে ভুলবেন না।
যেসব কারণে প্রকৌশলী ও প্রশাসক প্রহৃত হয়েছেন, তা পাঠককে একটু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। সংবাদপত্রের ভাষ্যমতে, কালিহাতীতে মাননীয় মন্ত্রীর বাড়িতে ডাক পড়েছিল সেখানকার উপসহকারী প্রকৌশলী পূর্ণচন্দ্র পাল মহাশয়ের। সেখানে যাওয়ার পর কর্তব্যে অবহেলা বা অন্য কোনো কারণে পূর্ণচন্দ্র বাবুকে যে মাননীয় মন্ত্রী তাঁর নামের অর্ধেকটা 'শেডিং' করে পত্রপাঠ অর্ধর্চন্দ্র দিয়ে বিদায় করে দেন, তা নয়। তাহলে হয়েছিলটা কী? লোডশেডিং? প্রশ্নই আসে না। 'বাংলাদেশে কোথাও এখন এক মিনিটের জন্যও লোডশেডিং হয় না।' এটা আমার কথা নয়, এটা মহান জাতীয় সংসদে খোদ দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর উক্তি! (এক দুর্মুখ পরে যখন সংসদের বাইরে প্রশ্ন করল, তাহলে অনেকক্ষণ আগে যে বিদ্যুৎ চলে গেল, এখনো যে ফিরে আসার নামটি নেই, এটা তবে কী? জবাব এলো : এখন লোডশেডিং নেই, অথচ বিএনপি আমলে লোডশেডিং ছিল দিনের মধ্যে ২৫ ঘণ্টা। হ্যাঁ, ২৫ ঘণ্টা। কেমন করে? ২৪ ঘণ্টা লোডশেডিং আর এক ঘণ্টা ফাও। সেই কষ্টের দিনগুলো-রাতগুলোর কথা পাছে আপনারা ভুলে যান সে জন্য এই একটু-আধটু...।) সে রাতে কালিহাতীতে বিদ্যুতের আলো পূর্ণিমার চাঁদের আলোর মতো ছড়িয়ে দিতে বোধ হয় ব্যর্থ হয়েছিলেন নামসর্বস্ব পূর্ণচন্দ্র বাবু, আর সে কারণেই...। তবে এসবই আমাদের অনুমান। ওই ঘটনায় কোনো তদন্ত হয়নি, হবেও না কোনো দিন। ফলে বাংলার মানুষ কোনো দিন জানবে না কী কারণে পূর্ণচন্দ্রবাবুর কপালে অর্ধচন্দ্র না জুটে লাঠির বাড়ি জুটেছিল। তবে এএসআই সাহেবের 'কেসটা' ক্লিয়ার। ইলেকশন ম্যাটেরিয়াল নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁকে 'তাঁর পছন্দমতো' গাড়ি দেওয়া হয়নি। বলুন, এতে কার না রাগ হয়? আর তিনি তো সরকারের একজন 'পদস্থ' কর্মকর্তা, যাঁকে অপদস্থ করার দুঃসাহস দেখিয়েছেন উপজেলার 'ভারবাহী' নির্বাহী কর্মকর্তা। 'বেআদবির' একটা সীমা আছে! 'আমাকে ইউএনও স্যালুটও করেনি'- এটাও যে এএসআই এমদাদ বলেননি এটা তাঁর মহানুভবতা।
২.
আচ্ছা, ঠাট্টা-মস্করা রেখে আসুন তো একটু সিরিয়াস কথাবার্তা বলি। প্রথমেই মাননীয় মন্ত্রী জনাব লতিফ সিদ্দিকীর কাছে প্রশ্ন : ওই উপপ্রকৌশলীটি যদি পূর্ণচন্দ্র পাল না হয়ে আপনার ছেলে লতিফ সিদ্দিকী জুনিয়র হতেন, আর কোনো উপজেলায় কর্মরত অবস্থায় কোনো মন্ত্রীর হাতে লাঠির বাড়ি খেয়ে মাথা ফাটিয়ে হাসপাতালে যেতেন, তাহলে আপনার বা আপনার স্ত্রীর কেমন লাগত? ওই সরকারি কর্মকর্তাটি যে অপরাধই করে থাকুন না কেন, তাঁকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করার অধিকার কোনো মন্ত্রীকে বা অন্য কোনো নাগরিককে কে দিল? বাংলাদেশের সংবিধান? না অন্য কোনো আইন? শারীরিক লাঞ্ছনা ছাড়াও সামাজিকভাবে তাঁকে যে অপমান করলেন, তার ক্ষতিপূরণ কে দেবে? এভাবে কি ডাণ্ডা মেরে বাংলাদেশের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর আনুগত্য, শ্রদ্ধা-ভক্তি-ভালোবাসা আপনারা জোর করে আদায় করতে পারবেন? কোনো সরকার কি কোনো দিন পেরেছিল? ব্রিটিশরা পেরেছিল? পাকিস্তানিরা? আমরা ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি, ডাণ্ডা ব্যবহার করে হাজতরক্ষী হাবিলদার-কনস্টেবলরা, কারারক্ষী সেপাই-সান্ত্রীরা, চোর পেটানো চৌকিদার-দফাদাররা। তাহলে তাদের সঙ্গে একজন মন্ত্রীর আচরণের, দায়িত্ব ও কর্তব্যের পার্থক্য রইল কোথায়?
আরেকটি কথা, যা বলতে পারেন আমার 'পেপ-টক'। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, রাষ্ট্রের যাঁরা কর্ণধার, সমাজের যাঁরা সমাজপতি, তাঁরা এক একজন এক একটি সূর্যের মতো। তাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে দেশের বাগানের অগণিত সূর্যমুখী ফুল। দেশবাসী আশা করে, এসব সূর্যমুখী একদিন সূর্য হয়ে জ্বলে উঠবে। কিন্তু মধ্যগগনে দেদীপ্যমান সূর্যের এমন কাছা-খোলা হাল দেখলে সূর্যমুখী তো আগেই লজ্জায়-ভয়ে-বিস্ময়ে জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। বাংলাদেশ নামক অনুদার গণতান্ত্রিক আকাশের পাঁচ বছরমেয়াদি ইজারাপ্রাপ্ত সূর্যসৈনিকরা কি তাই চান? তাঁরা কি চান তাঁরা চলে গেলে তাঁদের নাতিপুতিরাও ওই লাঠি-সংস্কৃতি আর বাথরুম-কালচারের ধারক-বাহক হয়ে থাকুক?
যে দুটো ঘটনা নিয়ে আজকের লেখা, আমি বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম, সেগুলো নিয়ে কোনো মহল থেকে কোনো উচ্চবাচ্য করল না কেউ। এমনকি কোনো জোরালো প্রতিবাদও করতে দেখা গেল না কাউকে। তা হলে কি আমরা ধরে নেব মারকুটে মন্ত্রী ও দাপুটে দারোগার ভয়ে মারখেকোরা মেরুদণ্ডহীন জেলি ফিশ হয়ে গেছে? নাকি হালুয়া-রুটির চিন্তা ছাড়া আর কিছু মাথায় নেই তাদের? লাঠির বাড়ি খেয়ে পূর্ণচন্দ্র পালের মাথা ফেটেছে ফাটুক, বাড়িটা মারতে গিয়ে স্যার কব্জিতে ব্যথা-ট্যথা পেলেন কি না আগে সেটা দেখ। হায়রে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা, দলীয়করণ তোমাদের আর কত নিচে নামাবে!
একজন এএসআইয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য খোদ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বড় কর্তারা এক সপ্তাহের মধ্যে চার-পাঁচবার লিখিত ও মৌখিক নির্দেশ দিলেন, আর সেই নির্দেশকে কলা দেখালেন পুলিশ কর্মকর্তারা। আর অভিযুক্ত এএসআই কী বললেন শুনুন : 'আমার বিরুদ্ধে কিসের ভিত্তিতে মামলা দেবে? পুলিশের তদন্তে আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।...ইউএনও স্যারের সঙ্গে আমার কিছুই হয়নি, সে আমাকে পরিচয় দেয়নি, তাই আমি চিনতে পারিনি।'
'সে' পরিচয় দেয়নি, এটা তার মস্ত বড় গোস্তাখি হয়েছে মানলাম, কিন্তু 'তাই আমি চিনতে পারিনি' এই স্ববিরোধী কথার অর্থ কী? 'তার' সঙ্গে তো আপনার 'কিছুই হয়নি'। সত্যি সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ! এই জন্যই মুন্সীগঞ্জের আমাদের বিচক্ষণ(!) এসপি হাবিবুর রহমান সাহেব তড়িঘড়ি করে সাত দিনের ছুটিতে চলে গেলেন।
আর ইউনিফর্মধারী এএসআই সাহেব ইউএনওকে যে চিনতে পারেননি এর কারণ বোধ হয় ইউএনওর পরনে কোনো ইউনিফর্ম ছিল না। এ ধরনের বিড়ম্বনা পরিহার করতে প্রশাসন ক্যাডারের জন্যও ইউনিফর্ম বরাদ্দ করার বিষয়টি সরকার বিবেচনা করতে পারে। তাহলে বেচারা এএসআইকে আর বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে না। তবে একই উপজেলায় চাকরিরত ইউএনওকে এএসআই চিনতে পারেননি, কথাটা যেন কেমন ল্যাংড়া ল্যাংড়া শোনাচ্ছে। আর প্রশাসন ক্যাডারের প্রস্তাবিত ইউনিফর্মের রং আপাতত ম্যাড়ম্যাড়ে, ধূসর কিংবা পুরোপুরি বিবর্ণ হওয়া উচিত।
৩.
একজন এএসআইয়ের বিরুদ্ধে তাঁর অপকর্মের জন্য ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ব্যর্থ হয়েছে বলে সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় শিরোনাম হয়েছে। আর অপকর্মটি করা হয়েছে প্রশাসনের ভিত্তি স্তরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাটির বিরুদ্ধে। ডিসি, জেলা জজ, এসপি, সিভিল সার্জন, নির্বাহী প্রকৌশলী- তাঁরা শুধু একজন কর্মকর্তাই নন, মাঠপর্যায়ে তাঁরা ও অন্যান্য বিভাগের তাঁদের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সহকর্মীরা পুরো শাসনব্যবস্থার 'স্টিলফ্রেম', তাঁরা নেই তো উপরি কাঠামোও নেই। তাঁদের কেউ কেউ এক একটি ইনস্টিটিউশন। রাষ্ট্রের স্বার্থে, আর যাই করুন, তাঁদের মনোবল ধ্বংস করবেন না।
সচিবালয়ের যে বহুতল ভবনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবস্থিত, কল্পনা করুন তো সেই ভবনের ভূগর্ভস্থ লৌহনির্মিত কাঠামোটিকে একদিন কোনো জাদুকর মন্ত্রবলে গায়েব করে দিল, তাহলে কী হবে? তখন কি উপরি কাঠামোর বিশালকায় অসংখ্য শক্তিশালী খিলান ও যাবতীয় সুদৃশ্য কারুকার্যখচিত নকশা, রঙের বাহার ইত্যাদি দিয়ে এক মুহূর্ত টিকিয়ে রাখা যাবে ওই বিরাট ভবন? না, যাবে না। আরেকটি রানা প্লাজা হয়ে মন্ত্রী-আমলাসমেত ভবনটি ভূমিশয্যা গ্রহণ করবে। সেই ভিত্তিমূলে কেউ আঘাত হানার পরও যদি সরকার নির্বিকার থাকে, তাহলে রানা প্লাজার মালিক ও সাভারের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসন ও পূর্ত কর্তৃপক্ষ কী দোষ করল?
প্রথম আলোর ভাষায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একজন এএসআই- যিনি পুলিশ প্রশাসনের সর্বনিম্ন স্তরের একজন পাতি কর্মকর্তা- তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে 'ব্যর্থ' হয়েছে। তবে কি তাদের সাফল্য শুধু বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের দমন-পীড়নে? দেশটি নিশ্চয়ই রবার্ট মুগাবের জিম্বাবুয়ে নয়, হাফিজ আল আসাদের সিরিয়াও নয়।
৪.
ইদানীং নারী-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ও নারীকে সমমর্যাদা দেওয়ার দাবিতে জোর ক্যাম্পেইন চালানোর অংশ হিসেবে টিভিতে একটি বিজ্ঞাপনচিত্র ঘন ঘন দেখানো হচ্ছে। বিজ্ঞাপনে দেখা যাচ্ছে দুটি প্ল্যাকার্ড উঁচু করে ধরে দেশের কোনো কোনো বিদগ্ধ পুরুষ বলছেন, 'আমরা দুঃখিত', 'আসুন পাল্টাই'। (বাই দ্য ওয়ে, ওই অতি সম্মানিত ভদ্রলোকদের টিভিতে ওই আত্মস্বীকৃত অপরাধীর ভূমিকায় দেখে প্রথমে আমি চমকে উঠেছিলাম, মুখ দিয়ে বের হয়ে এসেছিল, 'দাও ঠু ব্রুটাস!' পরে বুঝলাম, না, এটা শুধু অভিনয়)।
সরকারি চাকুরেদের পেটানো বউ পেটানো রোগের মতো ছড়িয়ে পড়ার আগে আরেকটি বিজ্ঞাপনচিত্র তৈরি করে টিভিতে প্রচারের প্রস্তাব রাখছি : 'আমরা দুঃখিত, আমরা লজ্জিত, আসুন পাল্টাই'। তবে এতে অভিনয় নয়, প্রকৃত নায়ক-খলনায়করা করজোড়ে অভিজ্ঞতালব্ধ সংলাপ আউড়াবেন, এ প্রস্তাবও থাকল।
লেখক : কবি, সাবেক সচিব
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন