সময় পেলেই আমি রাজপ্রাসাদের পশ্চিম বেদিতে উঠে হেলে পড়া সূর্যের অস্তগামী হওয়ার দৃশ্য দেখিÑ নিতান্ত বিড়াল হলেও প্রকৃতির প্রতিদিনকার দু’টি অদ্ভুত দৃশ্য আমাকে চমকিত করে। একটি হলো সূর্যোদয় এবং অন্যটি সূর্যাস্ত। মাত্র ১২ ঘণ্টার ব্যবধানে প্রকৃতির এত বড় পরিবর্তন দেখে আমি প্রায়ই অস্থির হয়ে পড়ি। প্রকৃতি নিয়ে আমার এত ভাবনার মূল কারণ হলো আমার বাসস্থান, অর্থাৎ রাজপ্রাসাদের অন্য বাসিন্দাদের হম্বিতম্বি এবং রাজপুরীতে আগত অভ্যাগতদের ভাবসাব, ক্রিয়াকলাপ ও সংভং দেখে আমি প্রায়ই ভাবি আচ্ছা! আমি কি জীবিত নাকি মৃত! কিংবা আমি কি বাস্তবিকই সব কিছু দেখছি নাকি স্বপ্ন দেখছি! আজ আমি আমার জীবনের কিছু চমকপ্রদ ইতিবৃত্ত আপনাদেরকে শোনাব।
মূল কাহিনীতে যাওয়ার আগে বলে নিই আমার পরিচয়। আমার নাম মিনিÑ এটি আমার মালিকের দেয়া নাম। আমার জন্ম শীতের দেশে। মালিকের ইচ্ছায় ক্রীতদাস হয়ে আমি নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে বাস করছি। আসমান ও জমিনের মালিক শীতের কবল থেকে বাঁচার জন্য আমার শরীরে বড় বড় লোম দিয়েছেন। আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, পাকস্থলী এবং খাদ্যাভ্যাস মূলত শীতের সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকার জন্য বানানো হয়েছিল; কিন্তু আসমানের মালিকের দাস-দাসীদের ইচ্ছায় আমি নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের বাসিন্দা হয়ে বড়ই মুসিবতে আছি। এই দেশের আবহাওয়া আমার ভালো লাগে নাÑ লোকজনের অদ্ভুত কর্মকাণ্ড আমার কাছে বড়ই অসহ্য এবং খাবারদাবার একদম হজম হয় না; কিন্তু আমার তো কিছু করার নেই বা বলারও ক্ষমতা নেই। কারণ আমি যে পশুÑ আমি যে ক্রীতদাস বা ক্রীতদাসী।
আমি শুধু আমার নাম বললাম এবং ইচ্ছে করেই বললাম না আমি কি পুরুষ বিড়াল না নারী বিড়াল। আপনাদের দেশে পুরুষ বিড়াল কে বলে হোলো বিলাই আর মেয়েদেরকে বলে মেনি বিলাই। দুটো উপাধিই আমার ভারি অপছন্দ, শুনলেই গা জ্বালা করে। কোনো কোনো এলাকায় বলে মর্দা এবং মাদি বিলাই! উফ! যত্তসব অসভ্য শব্দ! আমি কিন্তু নিজের লিঙ্গ পরিচয় প্রকাশ করলাম না মানুষ্য সমাজের লিঙ্গ নিয়ে অতি বাড়াবাড়ির কারণে। নারীবাদীরা বলবেÑ দেখো বিড়ালের কত্ত বড় সাহস! আমাদের গোত্রভুক্ত হতে চায়। অন্য দিকে পুরুষেরা বলবে হায়! এ দেশের যে কী হলোÑ একটা বিলাই আবার পুরুষ হতে চায়। যা হোক নারী-পুরুষের এত্তসব টিটকারি-ফিটকারি আমি একদম পাত্তা দিই না। কারণ আমার বর্তমান অবস্থার কারণে কত রথী-মহারথীরা যে আমার মনোরঞ্জনের জন্য কত কিছু করে তা যদি বলি তবে অনেকের মানসম্মান নিয়ে টানাটানি লাগবে।
আজ যেহেতু নিজের আত্মকাহিনী বলতে বসেছি, সেহেতু কিছু কথা তো বলতেই হবে। আগে নিজের একান্ত ব্যক্তিগত কিছু কথা বলে নিই। আমার গায়ের রঙ অনেকটা বাঘের মতো, বলতে পারেন কটা রঙের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মতো এত উজ্জ্বল নয়। আবার হায়েনা কিংবা ছাগলের মতো বিবর্ণও নয়। আমার মালিক আমাকে নিজ হাতে গোসল করান নিয়মিত শ্যাম্পু, সাবান ও স্যাভলন দিয়ে। তারপর ড্রায়ার দিয়ে আমার ঘন ও বাহারি লোম শুকিয়ে ল্যাভেন্ডার মেখে দেন। মাঝে মধ্যে চিরুনি দিয়ে আমার লোমগুলো আঁচড়িয়ে দেন। আঁচড়াতে আঁচড়াতে তিনি দুষ্টুমি করে আমার মোচগুলোতে টান মারেনÑ আর আমি লজ্জায় মিউ মিউ করে উঠি অনেকটা নতুন জামাই বা নতুন বউয়ের মতো। আমার এই সলজ্জ মিউ মিউ ডাক শুনে আমার মালিক ভারি আনন্দ পান। তার প্রিয় এক বান্ধবী তাকে প্রায়ই বলেনÑ আচ্ছা, মিনিকে নিয়ে তুমি এত মাতামাতি করো কেন। আমার মালিক বিরাট এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেনÑ ও তুমি বুঝবে না। আমার মালিকের দীর্ঘশ্বাসের অর্থ তার বান্ধবী না বুঝলেও আমি কিন্তু বঝি! আর সেই কাহিনীই ধীরে ধীরে আপনাদেরকে জানাব।
আগেই বলেছিÑ শীতের দেশে আমার জন্ম। আমাকে যখন এ দেশে আনা হয় তখন আমার পূর্বতন মালিক খুব ভালো করে বলে দিয়েছিলÑ আমি কী খাই, কখন ঘুমাই, কখন বাথরুমে যাই ইত্যাদি সব কিছু। আমার মালিক আমার জন্য আগে থেকে আগের মালিকের কথামতো সব কিছু ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। আমি রাজপ্রাসাদে ঢুকে তো অবাকÑ এত বড় বাড়ি আমি জীবনে দেখিনি। আমি বেশি অবাক হয়ে গেলাম আমার বেডরুমটি দেখে। বেশ বড়সড় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কামরা। আমার মতো কয়েক শ’ বিড়াল থাকতে পারবে। কামরার ওয়ালে নানারকম ছবি এঁকে রাখা হয়েছে আমার মনোরঞ্জনের জন্য। বিড়াল, বাঘ, ইঁদুর, তেলাপোকা, শিয়াল, কুকুর, সিংহ, মহিষ, গন্ডার, হরিণসহ নানা পশুপাখি ও পোকামাকড়ের ছবি। আমার শোয়ার জন্য রয়েছে সুন্দর একটি খাট। একটি দোলনা রয়েছে অবসরে দোল খাওয়ার জন্য। টেলিভিশন রয়েছে, যেখানে বিড়ালদের উপযোগী কার্টুন দেখানো হয় সব সময়। এ ছাড়া রুমের মধ্যে রয়েছে নানারকম খেলার সামগ্রী। খুশিতে আমার মন নেচে উঠল। এরপর ঢুকলাম বাথরুমে। ওরে বাবাÑ এ তো দেখছি এলাহি কাণ্ড। জ্যাফুজিসহ বাথটাব। রয়েছে স্টিমবাথের ব্যবস্থা। ছোট একটি টেলিভিশনও রয়েছে বাথরুমে। টয়লেটের স্থানে গিয়ে দেখলাম অটোমেটিক ফাশ সংবলিত কোহলার ব্র্যান্ডের একটি হাই কমোড এবং লো প্যান বসানো রয়েছে সেখানে। আমার মালিকের রুচিবোধ ও আভিজাত্য দেখে আমি যারপরনাই প্রীত হলাম।
আগে আমার ঠিকানা ছিল ডেনমার্কের রাজধানী কোপেন হেগেনের একটি পশুপাখির দোকান। সেখানে আমার জীবন ছিল নিতান্ত সাদামাটা। সারা দিন খাঁচায় বন্দী থাকতাম এবং সময়মতো খাবার খেতাম, মলত্যাগ করতাম এবং ঘুমাতাম। কিন্তু নতুন বাসস্থানে এসে আমি তো রীতিমতো ভিরমি খাওয়ার পর্যায়ে পৌঁছলাম। আমি নিজেকে আর বিড়াল না ভেবে প্রাসাদের অন্য বাসিন্দাদের মতো রাজা-মহারাজা কিংবা রানী-মহারানী ভাবতে শুরু করলাম। আমি সারা প্রাসাদ লেজ উঁচিয়ে ঘুরে বেড়াই আর মনের আনন্দে মিউ মিউ করে ডাকি। আমার মালিকের কাছে যারা স্বার্থ লাভের জন্য আসে তারা অতি অল্প সময়ের মধ্যেই আমার গুরুত্ব অনুধাবন করে ফেলল। তারা কুশলী, আমাকে যদি কেউ আদর করে কিংবা কোলে তুলে চুমো দেয়Ñ তাহলে আমার মালিক ভারি খুশি হন। আমাকে সেবাদানকারী বা আদরযতœকারী বা সোহাগকারী/কারিনী অতি দ্রুত আমার মালিকের কৃপা লাভের যোগ্যতা অর্জন করে ফেলে এমন কথা জানাজানি হতেই আমার কদর বেড়ে গেল সর্বমহলে।
রাজপ্রাসাদের বাসিন্দা এবং অভ্যাগতদের যতœ-আত্তি এবং সীমাহীন পাত্তা লাভের কারণে আমার মধ্যে এক ধরনের ভাবসাব চলে এলো। আমি বিড়াল হয়েও বাঘের মতো হেলেদুলে চলতে শুরু করলাম। আচার-আচরণে এমন একটি অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুললাম, যেন লোকজন আমাকে অধিক মাত্রায় সমীহ করতে থাকে। হলোও তাইÑ আমি যখন তখন আমার মালিকের নিকট চলে যেতে পারি। তিনি হয়তো রাজপুরুষ এবং রাজমহিলাদের সাথে বৈঠকে ব্যস্ত থাকেন; কিন্তু তাতে কী? আমি কখনোসখনো সেসব বৈঠকে ঢুকে পড়ি। আমার মালিকের খাদেম-খাদেমারা চেয়ার ছেড়ে আমাকে ধরতে আসে। কেউ কেউ কোলে তুলে নেয়। ওয়া ওয়া মিনিÑ কেউ কেউ মিনি ইত্যাদি অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ উচ্চারণ করে আমাকে আদর করে। আমার গলা, ঘাড় ইত্যাদি জায়গায় হাত বুলিয়ে দেয়। কেউ কেউ চুমোও দেয়। তারপর পকেট থেকে সুন্দর সুন্দর চকোলেট বের করে আমাকে খেতে দেয়। আমি অত্যন্ত রাজসিক বিনয়ের সাথে সেসব উপহার গ্রহণ করি এবং কামরা থেকে বের হয়ে আসি।
আমার শরীর স্বাস্থ্যের জন্য উপযুক্ত খাবার হলো ক্যাটফুড। বিড়ালদের জন্য তৈরি করা বিশেষ পুষ্টিকর খাবার; বলতে পারেন বৈজ্ঞানিকভাবে তৈরি করা সুষম খাদ্য। রাজপ্রাসাদে এসে কানাঘুষা শুনলাম এখানকার বুয়া, দারোয়ান, মালী, ঝাড়–দার এবং বাবুর্চিরা আমার সমালোচনা করছে। তারা বলছে, কী এমন লাট সাহেব বিড়াল রে বাবাÑ এসি করা রুমে ঘুমায়, ক্যাটফুড খায়, আবার চকোলেট খায়, দোলনায় দোল খায়, টিভি দেখেÑ ঢং দেখে আর বাঁচিনে। মনে হয় একটা আছাড় দিয়ে বিলাইডার পেটের ময়লা বাইর করে ফেলি। ওদের কথা শুনে আমার হাত-পা কাঁপতে লাগল। ওরা আরো বললÑ আমাদের দেশী বিড়াল কত ভালোÑ মাছের কাঁটা খায়। ফেলে দেয়া পচা মাছ, ইঁদুর, তেলাপোকা ইত্যাদি খেয়েও তারা দিব্যি বেঁচে থাকে। এসব কথা শোনার পর আমি তৃতীয় শ্রেণীর ওইসব লোকজন থেকে দূরে অবস্থান করতে থাকলাম।
রাজপ্রাসাদের বাসিন্দাদের অতিরিক্ত আদর-আপ্যায়নে আমার শরীরে মেদ জমে গেল। আমি বেশ মোটাসোটা হয়ে গেলাম। তাদের অনুরোধে আমি ক্যাটফুড ছেড়ে চকোলেট, পোলাও-কোর্মা, কালিয়া-কোপ্তা, জর্দা, ফিরনি ইত্যাদি খাওয়া শুরু করলাম। ফলে আমার পেটে গণ্ডগোল দেখা দিলো। বেশির ভাগ সময় আমি কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগতে আরম্ভ করলাম। সারা দিন পেটের মধ্যে ভুটভুট করে। ফলে ঘনঘন বায়ুত্যাগ না করলে আমি অস্থিরতা ও অস্বস্তিতে ভুগতে থাকি। আমি যেহেতু মানুষের খাবার খেতাম, তাই আমার বিষ্ঠা এবং বায়ুত্যাগের দুর্গন্ধ মনুষ্য সমাজের মতোই ছিল।
একদিনের ঘটনা মনে হলে এখনো হাসিতে আমার দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। সেই দিনের পর বহুবার আমি অপকর্মটি করেছি। প্রতিবারই একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে আমি মজা লুটি; কিন্তু প্রথম দিনের স্মৃতি আমি কোনো দিন ভুলতে পারব না। সে দিন ছিল রোববার। আমার মালিকের কামরায় ৩০-৪০ জন রাজপুরুষ আর রাজমহিলার বৈঠক চলছিল। অভ্যাসমতো আমি সেখানে ঢুকে পড়লাম। অনেকে আমার দিকে তাকাল বটে; কিন্তু চেয়ার ছেড়ে উঠে কেউ কোলে নিলো না। সম্ভবত সবাই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় ব্যস্ত ছিল। আমিও বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নিলাম। কাউকে বিরক্ত না করে কামরাটির মধ্যে চুপচাপ পায়চারি করতে থাকলাম। আর তখনই ঘটল দুর্ঘটনাটি। হঠাৎ করেই অসাবধানতাবশত ভরা মজলিসে দু-তিনবার আমার বায়ুত্যাগের ঘটনা ঘটে গেল। অন্যান্য দিনের তুলনায় আমার কোষ্ঠকাঠিন্যের পরিমাণ বেশি হওয়ায় সে দিন দুর্গন্ধ ছড়াল ব্যাপকভাবে। কী করা উচিত বুঝতে না পেরে আমি নেহায়েত ভদ্রলোকের মতো বসে থাকলাম।
আমার কৃত অপকর্মের দুর্গন্ধ সারা কামরায় ছড়িয়ে পড়ল। উপস্থিত ভদ্রমহিলা ও মহোদয়গণ ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারল না যেÑ একটি বিড়াল অপকর্মটি করেছে। তারা বরং প্রত্যেকেই মহাবিরক্ত হয়ে একে অপরের দিকে তাকাতে লাগল। ভদ্রতাবশত কেউ কাউকে মুখফুটে কিছু বলল না; কিন্তু সবাই সবাইকে সন্দেহ করতে থাকল। বেশি সন্দেহ হলো টাক মাথাওয়ালা লোকদের ওপর। যাদের পেটে মারাত্মক গণ্ডগোল থাকে তাদের নাকি মাথায় টাক পড়ে যায়। এসব লোকের মেজাজও থাকে ভীষণ গরম এবং মুখেও থাকে দুর্গন্ধ। টাকপড়া লোকদের মধ্যে একজনের প্রতি সবার সন্দেহ হলো সবচেয়ে বেশি। লোকটি খাটোখুটো ফর্সা প্রকৃতির। মুখমণ্ডল লম্বাটেÑ সারা মাথায় টাকÑ কেবল চোয়ালে লম্বা জুলফি রয়েছে। আগে দেশের সবচেয়ে পবিত্র অঙ্গনের দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে সে করেনি এহেন অপকর্ম নেইÑ ইদানীং তার দায়িত্ব অবশ্য অন্য ক্ষেত্রে।
সারা দেশের লোকজন লোকটিকে ঘৃণা করে। আমার মালিকের দরবারের লোকজনও তাকে ঘৃণা করে। তার পরও লোকটি বেহায়ার মতো লেগে থাকে। মালিক সব কিছু জানেন এবং বোঝেন; কিন্তু অবস্থার কারণে কঠোর হতে পারেন না। তিনি জানেনÑ লোকটিকে যদি বের করে দেন তবে বিুব্ধ জনতা তাকে পিঠিয়ে মেরে ফেলবে। লোকটিকে সবাই কাগু বলে ডাকে। আমার সাথে তার একটি মজার ঘটনা আছে। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। তার আগে বলে নিই সেইদিনকার ঘটনা। সবার সন্দেহের দৃষ্টি পড়ল কাগুর ওপর। লোকজন মিটিমিটি হাসছে এবং মহাবিরক্ত হয়ে কাগুর দিকে তাকাচ্ছেÑ আর কাগু নির্বিকারচিত্তে পা দুলিয়ে দুলিয়ে আমার মালিকের দিকে তাকিয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। হঠাৎ করেই আমার মালিক অদ্ভুত এক কথা বলে বসলেন। তিনি বললেনÑ কি গো ভামরুল কাগু! এত গন্ধ আসছে কোত্থেকে। কামটা করল কে। আর যায় কোথায়। মুহূর্তের মধ্যে শুরু হলো দমফাটানো হাসি। আমারও ভীষণ হাসি পেল। সুযোগ বুঝে হাসতে হাসতে আমি রুম থেকে বের হয়ে গেলাম।
অতিরিক্ত হাসার কারণে আমার পেটে চিন চিন ব্যথা শুরু হলো। আমি ওয়াশরুমে গেলাম এবং মুহূর্তের মধ্যে আমার সব কিছু কিয়ার হয়ে গেল। আমি বুঝলাম হাসি-তামাশা এবং অনাবিল আনন্দ দেহের কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। রাজপ্রাসাদের বাসিন্দা হিসেবে প্রতিনিয়ত অনেক কিছুই দেখিÑ কখনো চক্রান্ত, কখনো প্রহসন আবার কখনো মুনাফেকি। আমার মালিকের সামনে বসে লোকজন এক ধরনের কথা বলে। আবার পেছনে গিয়ে ঠিক উল্টোটা। স্বার্থে মিললে সবাই এক। আবার স্বার্থে সামান্য একটু আঘাত লাগলেই গোখরা সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করে ওঠে; কিন্তু ওই ফোঁস ফোঁস পর্যন্তই। কারণ দংশন করার সাহস কিংবা হিম্মত ওদের নেই। ওরা ওদের লিঙ্গপরিচয় হারিয়ে সবাই একই জাতি হয়েছে। ওরা এখন আর কেউ নারী কিংবা পুরুষ নয়। ওরা মুসলমান কিংবা হিন্দুও নয়Ñ ওরা দালাল, ওরা স্বার্থপর। ওরা চক্রান্তকারী, চাপাবাজ, ওরা বেঈমান এবং মুনাফেক। তাই তো ওদের ইজ্জতের দিকে তাকিয়ে আমি আমার লিঙ্গপরিচয় প্রকাশ করলাম না। কারণ ওদের পোলাও-কোর্মা, চকোলেট-বিরিয়ানি খেতে খেতে আমি কি আদৌ বিড়াল আছি না অন্য কোনো জানোয়ার হয়ে গেছিÑ এই নিয়ে ইদানীং আমার মনে ঘোরতর সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
কাগুর সাথে আমার একটি ব্যক্তিগত ঘটনার কথা বলছিলাম। আগেই বলেছি, উল্টাপাল্টা খাবার খেয়ে আমার কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিয়েছে। আমার নিয়মিত জলত্যাগেও সমস্যা হচ্ছে। আগের মতো একসাথে জলত্যাগ হয় না। বরং বুড়ো মানুষের মতো ফোঁটা ফোঁটা করে দিনে ১০-১২ বার কর্মটি করতে হয়। একবার মনে হলোÑ হয়তো ডায়াবেটিস হয়েছে। পরীক্ষা করে দেখলামÑ শরীরে ডায়াবেটিস নেই। মূলত কোষ্ঠকাঠিন্য থেকেই জলত্যাগ সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। আপনারা হয়তো একটি বিড়ালের মুখে জলত্যাগের মতো প্রমিত বাংলার ব্যবহার দেখে বিস্মিত হচ্ছেন। আপনাদের দেশে জলত্যাগকে সাধারণত প্রস্রাব বলা হয়। গ্রামবাংলায় বলে মুত। দু’টি শব্দই ভদ্রসমাজে বলা যায় না। অনেকে অশ্লীল ও অশ্রাব্য বলে বিষয়টি এড়িয়ে যায়। আমি অবশ্য অন্য কারণে প্রমিত বাংলার চর্চা করছি। আমার চার পাশে সবাই দিবারাত্রি এত বেশি অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করে সে ক্ষেত্রে বিড়াল হলেও আমার মনে হচ্ছে এই অশ্লীলতা থেকে বের হওয়া উচিত। তাই তো গু-মুতের মতো শব্দ বাদ দিয়ে বলছি বিষ্ঠা, জলত্যাগ ইত্যাদি।
যা বলছিলামÑ নিজের জলত্যাগের সমস্যার কারণে মাঝে মধ্যে নিজের অজান্তে দু-চার ফোঁটা বের হয়ে যায় বিভিন্ন জায়গা-বেজায়গায়। একবার এক রাজপুরুষ আমাকে সোহাগ করে কোলে নিলো। তার কোলের ওপর বসে আমি আরাম নিচ্ছিলাম আর উনি আমার শরীরের জায়গা-বেজায়গায় হাত বুলিয়ে আদর করছিলেন। আবেশে আমার ঘুম চলে আসছিল। হঠাৎ টের পেলামÑ কাজ হয়ে গেছে! বোধহয় কয়েক ফোঁটা জলত্যাগ ঘটে গেছে। আমি ভারি ভয় পেলাম। আবার লজ্জাও পেলাম; কিন্তু আশ্চর্য আমাকে আদর-সোহাগকারী লোকটি টেরই পেল না। ফলে কিছুক্ষণ পর কর্মটির জন্য আমি বেশ আনন্দিত ও আরাম বোধ করতে থাকলাম। মনুষ্য কোলে বসে ওম ওম শরীরে জলত্যাগের যে কী আনন্দÑ তা কেবল সেই বুঝতে পারবে যে কিনা কর্মটি করার সুযোগ লাভ করেছে।
এই ঘটনার পর থেকে আমার নফস বড়ই দুষ্টুমি আরম্ভ করল। কারণ একমাত্র আমার মালিক ছাড়া সেই আমাকে কোলে নিত এবং আদর-সোহাগ করত; আমি সুযোগমতো তার কোলে দু-চার ফোঁটা জলত্যাগ করতাম। তারা এ যাবৎকালে কেউ আমার কুকর্মটি শনাক্ত করতে পারেনি। আমার মাঝে মধ্যে সন্দেহ হতোÑ হায় আল্লাহ। এদের কি নাক নেই! এরা কি ঘ্রাণ নেয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে! তো একদিন ভামরুল কাগু আমাকে কোলে তুলে নিলো। তারপর পকেট থেকে একটি চকোলেট বের করে আমাকে খাওয়াল। প্রাসাদের মধ্যে একটি পদ্মপুকুর রয়েছে। কাগু আমাকে নিয়ে পদ্মপুকুরের ঘাটে বসল। তখন সময়টা ছিল বসন্তকালের পড়ন্ত বিকেল। মৃদুমন্দ বাতাসে আমার ঘন ও রেশমি লোমগুলো উড়ছিল আর সেখান থেকে ল্যাভেন্ডারের সুগন্ধ বের হচ্ছিল। কাগু বারবার মাথা নুইয়ে আমার লোমের ঘ্রাণ শুঁকছিল। এ সময় আমি খুব ভালো করে তার কেশহীন চকচকে টাকমাথা দেখার সুযোগ পাচ্ছিলাম। আমার বড়ই আফসোস হচ্ছিল কাগুর জন্য। কারণ এত সুন্দর বাতাসÑ অথচ সেই বাতাসে উড়ানোর মতো কাগুর মাথার একটি চুলও নেইÑ আহারে বেচারা।
আমার ভাবনা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না, বরং মনে হলোÑ বিকেলের এই মনোরম পরিবেশে আমি কাগুর কোলে অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু বেশি করে জলত্যাগ করি; কিন্তু হঠাৎ করেই একটি ভাবনা মনে আসতেই আমার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। আমার মনে হলোÑ আচ্ছা, সাধারণ মানুষ লোকটিকে এত ঘৃণা করে কেন? রাজপ্রাসাদের সবাই কেন তাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করে। একদিন আমি আড়ালে দাঁড়িয়ে প্রাসাদের একজন ভালো মানুষের আক্ষেপ শুনছিলামÑ তিনি বলছিলেন, লোকটিকে রাস্তা থেকে তুলে এনে আমার মালিক দায়িত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছিলেন এবং সবচেয়ে পবিত্রতম স্থানের ভার অর্পণ করেছিলেন। দায়িত্ব পাওয়ার সাথে সাথে লোকটি রাতারাতি বদলে যায়। ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়ম, জুলুম, জাহেলি, মিথ্যাচার, অনাচার, ব্যভিচারÑ এমন কোনো কুকর্ম নেই, যা সে করেনি। সারা শহরের রঙ্গবাসর বাসিন্দারা তার মনোরঞ্জনের জন্য সব কিছু করেছে। লোকটি নাকি ভিনদেশে গিয়েও নিয়মিত আকাম-কুকাম করে আসে।
লোকটি সম্পর্কে এসব কথা মনে আসতেই ঘৃণায় আমার সারা শরীর রি রি করে উঠল। আমার পেট থেকে তার দেয়া চকোলেট বের হয়ে আসতে চাইলো। আমি নিজেকে সংযত করে বমি রোধ করলাম। কারণ লোকটির শরীরে বমি করতেও আমার রুচিতে বাধছিল। আমি সিদ্ধান্ত নিলামÑ অনেকের কোলে জলত্যাগ করলেও এই লোকটির কোলে আমি এ কাজটি করব না। ওর শরীর আমার জলত্যাগেরও উপযুক্ত জায়গা নয়। আমি লাফ দিয়ে ওর কোল থেকে নেমে পড়লাম এবং আমার বেডরুমের দিকে এগোতে থাকলাম। একবারও পেছনে ফিরে তাকালাম না।
জীবনের বহু দম ফাটানো অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। রাজপ্রাসাদের একজন বাসিন্দা হিসেবে যা দেখেছি কিংবা যা শুনেছি অথবা যা বুঝেছি তার চৌম্বক অংশগুলো আগামী দিনে আপনাদেরকে শোনাব, যদি আপনারা এই অধম বিড়ালের মুখ থেকে সেসব কাহিনী শুনতে চান।
(নয়া দিগন্ত, ১৮/০৩/২০১৪)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন