|
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী
|
|
ক্রিকেট : 'সাহারা' : বাংলাদেশ
15 Mar, 2014
বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দলের পোশাকের ওপর 'সাহারা' নামটি বড় হরফে লেখা থাকে। এত বড় যে তার নিচে ছোট হরফে লেখা 'বাংলাদেশ' ঢাকা পড়ে যায়। মনে হয়, ওটা সাহারার টিম, বাংলাদেশের নয়। ভারতীয় টিমের জার্সিতেও সাহারা। যেদিন এই দুই টিমের খেলা হয়, সেদিন মনে হয় 'এ' টিমের সঙ্গে 'বি' টিমের খেলা হচ্ছে। দেখলে মনটা খারাপ হয়ে যায়। কষ্ট পাই। এই কষ্টের কথা আগেও লিখেছিলাম একটা লেখায়। এই কম্পানি সম্পর্কে অনেক নেতিবাচক কথা কানে এসেছে। আরো অনেকে এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তরুণরা প্রতিবাদ জানিয়ে 'মানববন্ধন' করেছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কিছুই আমলে নেয়নি।
জীবনে দু-চারবার ফুটবলে লাথি মারলেও কখনো ক্রিকেট খেলিনি। এ খেলার বোদ্ধাও নই। অনেকে যেমন ক্রিকেট না খেলেও নানা ক্রিকেটীয় পরিসংখ্যান গড় গড় করে বলে যেতে পারেন, সে যোগ্যতাও আমার নেই। তবু সুযোগ পেলে টিভিতে ক্রিকেট দেখি। বিশেষ করে বাংলাদেশের ছেলেরা যখন কোনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে খেলে, তখন সব কাজ ফেলে রেখে টিভির সামনে বসে পড়ি। দেশের হাজার হাজার মানুষ এভাবেই বাংলাদেশের ক্রিকেট দলকে উৎসাহ জুগিয়ে থাকেন। একটার পর একটা ম্যাচ হারলেও সমর্থনের কমতি নেই। স্টেডিয়াম ভেঙে পড়ছে (আমার স্ত্রীকে দেখেছি, খেলার উত্তেজনাকর মুহূর্তে টিভির সামনে বসে বিড় বিড় করে দোয়া-দরুদ পড়ছেন। বাংলাদেশের কেনো খেলোয়াড় একটু আহত হলে 'হায় হায়' করতে থাকেন, যেন তাঁর নিজের ছেলে ব্যথা পেয়েছে। প্রতিপক্ষ দলের খেলোয়াড়কে গালমন্দ করতে থাকেন। সারা দেশে আরো অনেক মা-বোন এ রকম করে থাকেন, সে দৃশ্য স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে প্রতিনিয়ত দেখা যায়)। আমাদের ক্রিকেট দলটি এভাবেই মানুষের মন জয় করেছে। এ দেশে দলমত-নির্বিশেষে সব মানুষ কোনো কিছুতে এতটা একাট্টা হয়েছে, তেমন দৃষ্টান্ত আর খুঁজে পাই না।
ক্রিকেট : 'সাহারা' : বাংলাদেশ
আজকের দিনে একটি বিশ্বমানের ক্রিকেট দলের জার্সিতে স্থান পাওয়া যেকোনো কম্পানির জন্য বিশাল প্রাপ্তি। দেশীয় কোনো কম্পানিকে কি এই সুযোগটা দেওয়া যেত না? কেউ হয়তো বলবেন, নিলামে ওরা বেশি টাকা দিয়েছে। টাকাটাই কি সব? এই যে সারা দেশের মানুষ দলটাকে এভাবে সমর্থন দিচ্ছে, বিসিবি কি সে জন্য কাউকে টাকা দেয়?
কেবল বিদেশি বলেই নয়, কম্পানি হিসেবেও সাহারার অনেক 'সুনাম'। খোদ ভারত সরকার এই কম্পানিকে নানা অনিয়মের দায়ে অভিযুক্ত করেছে। অনেক অভিযোগের একটি হচ্ছে শেয়ার জালিয়াতি। এ জন্য ভারতীয় সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন তার কাছ থেকে ২০ হাজার কোটি ভারতীয় রুপি ফেরত চেয়েছে। লাখ লাখ খেটে খাওয়া মানুষকে ঠকিয়েছে এই কম্পানি (সেই টাকা দিয়েই আমরা আমাদের ক্রিকেট টিম চালাচ্ছি?)। কাগজে দেখলাম, জালিয়াতির মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট কঠোর অবস্থান নিয়ে এই কম্পানির প্রধানকে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দিয়েছে। ফলে কম্পানির মালিক এখন শ্রীঘরে।
আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে বিদেশি স্পনসর অবশ্যই থাকবে। কিন্তু জাতীয় দলের জার্সির বিষয়টিকে একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে হবে। জাতীয় দল দেশের প্রতিনিধিত্ব করে। তাই তার জার্সিতে দেশি প্রতিষ্ঠানের স্পনসরশিপ থাকাটাই বাঞ্ছনীয় ও শোভন। বিদেশি হলেও যেন কোনো জালিয়াত কম্পানি না হয়; টাকা কিছু কম পাওয়া গেলেও।
ঢাকার চারপাশে 'সাহারা'র চার উপশহর
কয়েক বছর আগে অজ্ঞাত কারণে এই সাহারা বাংলাদেশ সরকারের এতই প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিল যে তাকে ঢাকার চারপাশে চারটি 'উপশহর' নির্মাণের জন্য রাজউক এক লাখ একর জমি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এ এক অদ্ভুত ঘটনা। দুনিয়ার আর কোনো দেশে কখনো এ রকম ঘটনা ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। রাষ্ট্রের রাজধানীকে ঘিরে চার চারটি উপশহরের বেষ্টনী বানাবে বিদেশি কম্পানি!
স্বয়ং রাজউক চেয়ারম্যান সংবাদ সম্মেলন ডেকে সাড়ম্বরে এ সিদ্ধান্তের ঘোষণা দিয়েছিলেন। টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে তা ফলাও করে প্রচার হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীও তাতে গলা মিলিয়েছেন। তাঁরা স্থির করেছিলেন, এই চার 'অত্যাধুনিক উপশহর' তৈরির কাজটি সাহারা কম্পানি এককভাবে করবে। প্রথম পর্যায়ে এ জন্য তাদের মোট এক লাখ একর জমি দেওয়া হলেও প্রয়োজনে আরো জমি দেওয়া হবে। তারাই নগর পরিকল্পনা, জমির উন্নয়ন ও রাস্তাঘাট তৈরি করবে। কী বিশাল কর্মকাণ্ড! প্রতি একরে একটি করে হলেও এক লাখ একরে মোট এক লাখ হাইরাইজ দালান! সাহারা হবে লিজ মূলে সব কিছুর মালিক। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, একত্রে এত জমি পাওয়া কি সম্ভব? রাজউক চেয়ারম্যান বলেন, রাজউকই প্রয়োজনীয় জমি হুকুমদখল করে দেবে। সাংবাদিকরা জানতে চান, জমি হুকুমদখল করার পর তা নিয়ে নানা মামলা-মোকদ্দমার উদ্ভব হবে না? জবাবে রাজউক চেয়ারম্যান জোর দিয়ে বলেন, রাজউক সব ঝামেলা মুক্ত করে সাহারাকে 'নির্ভেজাল' জমি বুঝিয়ে দেবে। এসব কথা সংবাদপত্রের পাতায় ও টেলিভিশনের ফুটেজে ধারণ করা আছে।
কোন যুক্তিতে বা কোন বাধ্যবাধকতায় রাজউক রাজধানীর চারপাশে একটি বিদেশি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে এভাবে সরকারি উদ্যোগে এত বিপুল পরিমাণ জমি 'হুকুমদখল' ও 'ঝামেলামুক্ত' করে বুঝিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তা আদৌ বোধগম্য নয়। ঢাকার চারপাশে চারটি উপশহর যদি নির্মাণ করতেই হয় এবং সে জন্য যদি সরকারই নির্ভেজাল জমি প্রদান করে তাহলে বিদেশি কম্পানিকে ডেকে আনতে হবে কেন? এমন সুবর্ণ সুযোগ পেলে দেশি আবাসন কম্পানিগুলোই তো পড়িমরি করে ছুটে আসবে। তারা তো ঢাকার আশপাশে ডোবানালাও সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে বিক্রি করে ফেলছে। সরকারি সহায়তা ছাড়াই তারা ইতিমধ্যে ঢাকার আয়তন তিন গুণ বাড়িয়ে ফেলেছে। তাদের অনেকের অবস্থান ও মর্যাদা সাহারার চেয়ে খাটো নয়।
ঢাকা শহর ও তার আশপাশে জমির এতই সংকট যে জায়গার অভাবে গোটা শহর উঁচু দালানের জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। জমির দাম এক দশকেই ক্ষেত্রবিশেষে শতগুণ বেড়েছে (রাজউক নিজেই তার বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য জমি হুকুমদখল করার পর ক্ষতিগ্রস্তদের বিকল্প জমি দেওয়ার জন্য জমি খুঁজে পায় না)। সেই অবস্থায় এক লক্ষাধিক একর জমি হুকুমদখল করে বিদেশি কম্পানিকে উপঠৌকন দেওয়ার ঘোষণায় 'ডাল মে কুছ কালা হ্যায়'!
এ রকম কোনো প্রকল্প হাতে নেওয়া হলে তা হতো বাংলাদেশের আবাসন খাতটিকে সম্পূর্ণরূপে বিদেশি নিয়ন্ত্রণে ঠেলে দেওয়া। বিষয়টি জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নের সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িত ছিল। এক লাখ একর জমি অধিগ্রহণ করা ও তা 'ঝামেলামুক্ত' করা চাট্টিখানি কথা নয়। কত মানুষ তাতে বাস্তুহারা হবে, সরকারকে সে জন্য কতটা ধকল সামলাতে হবে, সেদিকে আদৌ দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে বলে মনে হয় না। দেশের জমি কোনো বিদেশি কম্পানিকে লিজ দিয়ে আবাসন ব্যবসা চালাতে দেওয়া আইনসম্মত কি না, সে প্রশ্নটিও বিবেচ্য।
এর বিরুদ্ধে সেদিন বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদ উঠেছিল। প্রতিবাদকারীরা মিছিল করে রাজউক ভবনে গিয়ে স্মারকলিপি পেশ করেছে। তখনকার মতো স্থগিত হলেও প্রকল্পটি আবারও সামনে আসতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। তদবিরকারীরা নাকি আবারও সক্রিয় হয়ে উঠছে।
পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্তদের অপরাধ তাদের ওই সেতুর কনসাল্ট্যান্সির কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য ঘুষ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। সেটি ছিল মাত্র কয়েক হাজার কোটি টাকার কাজ। আর এই উপশহর নির্মাণের সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে সেটি হতো অনেক লাখ কোটি টাকার প্রকল্প।
রাজউক কী কারণে এ রকম একটি তুঘলকি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, কেনই বা তা এমন ঘটা করে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, তার তদন্ত হওয়া আবশ্যক।
কার জমি কাকে দেওয়া হয়
জনগণের আবাসিক সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার বিভিন্ন আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে থাকে। এসব রাষ্ট্রীয় প্রকল্পের জন্য সাধারণ মানুষের জমি নামমাত্র মূল্যে অধিগ্রহণ করা হয়। যে মূল্য বাজারদরের চেয়ে বহুগুণ কম এবং সে টাকা পেতেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কয়েক পাটি জুতা ক্ষয় হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে কয়েক পুরুষ অপেক্ষা করতে হয়। ক্ষতিগ্রস্তদের বিকল্প জমি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে নানা টালবাহানায় তা ঝুলিয়ে রাখা হয়।
সরকারি ভবনাদি বা স্কুল-কলেজ, রাস্তাঘাটের মতো সর্বসাধারণের কল্যাণমুখী স্থাপনার জন্য জমি হুকুমদখল করার ক্ষমতা রাষ্ট্রের আছে ও থাকবে। তবে সে ক্ষেত্রেও যার জমি নেওয়া হচ্ছে, তাকে ক্ষতিপূরণসহ ন্যায্য মূল্য বুঝিয়ে দেওয়ার পর কাজে হাত দেওয়ার রীতি প্রবর্তিত হওয়া উচিত। কারো জমি কেড়ে নিয়ে তাকে পথে বসিয়ে দেওয়া গর্হিত অন্যায়; সামাজিক প্রয়োজনে হলেও। এটা নাগরিকের মৌলিক অধিকারের গুরুতর খেলাপ।
দুর্ভাগ্যবশত রাষ্ট্রের নামে কিংবা সামাজিক প্রয়োজনের কথা বলে এই অন্যায় বরাবরই চলে আসছে। সরকারি বা সামাজিক প্রয়োজনে জমি হুকুমদখল করার পেছনে যুক্তি দাঁড় করানো গেলেও সাধারণ মানুষের জমি হুকুমদখল করে অন্য কাউকে তা ভোগ করতে দেওয়ার পক্ষে কোনো যুক্তি দাঁড় করানো যায় না। স্বেচ্ছাচারিতার এর চেয়ে জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত আর কিছুই হতে পারে না।
প্রক্রিয়াটি অতি পুরনো। সেই পাকিস্তান আমলেই তার শুরু। শুরু হয়েছিল মোহাজের পুনর্বাসন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে। সেই ধারাবাহিকতায় রাজউক, সিডিএ, কেডিএসহ বিভিন্ন নগর উন্নয়ন সংস্থা সরকারি ক্ষমতা ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের বাস্তুভিটা কিংবা চাষের জমি ইচ্ছামতো হুকুমদখল করে নেয়। তারপর সে সব জমি সরকারি টাকায় উন্নয়ন করে প্লট বানিয়ে নামমাত্র মূল্যে বিলি-বণ্টন করা হয়। এই বিলি-বণ্টনের কিছু নিয়মকানুন থাকলেও এটা হচ্ছে ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের খুশি ও হাত করার মোক্ষম অস্ত্র। কোনো সরকারই এই অস্ত্র হাতছাড়া করতে রাজি নয়। এ নিয়ে দুর্নীতি ও অনিয়মেরও কোনো শেষ নেই। ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালীরা এসব প্রকল্পে বিভিন্ন নামে একাধিক প্লট বরাদ্দ করিয়ে নিতে পারে। আর জমির মূল মালিককে পিতৃপুরুষের ভিটা থেকে উচ্ছেদ হয়ে পথে পথে ঘুরতে হয়। এটা গুরুতর অনৈতিক ব্যবস্থা।
আমাদের উচ্চ আদালত বহু বিষয়ে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত রুল ইস্যু করে থাকেন। এই গুরুতর অন্যায় ও অনৈতিকতার দিকে এখনো কারো দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়নি। আইনের লোকরাও এই হরিলুটের অংশ পেয়ে থাকেন। সেটা যেন ন্যায়দণ্ডকে মূক ও বধির না করে।
আবার ক্রিকেট
ক্রিকেট দিয়ে শুরু করেছিলাম। আমরা আবার ক্রিকেটে ফিরে আসি। আমাদের জাতীয় গৌরবের প্রতীক জাতীয় ক্রিকেট টিমের জার্সি থেকে প্রতারণার দায়ে অভিযুক্ত বিদেশি জালিয়াত কম্পানি সাহারার নাম যত শিগগির মুছে ফেলা হয় ততই মঙ্গল।
ভারতের উচ্চ আদালতের ভেতরেই ওই কম্পানির মালিকের মুখে কালো কালি লেপ্টে দিয়েছেন এক ক্ষুব্ধ আইনজীবী। সেই কালি লেপ্টানো জার্সি পরে বিশ্বকাপে খেলতে হচ্ছে আমাদের ছেলেদের!
এই লজ্জা গোটা জাতির।
লেখক : রাজনীতিক, ভূরাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক
(কালের কন্ঠ, ১৫/০৩/২০১৪)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন