মূল পেশা ব্যবসা, রাজনীতিটা হাতিয়ার
09 Mar, 2014
অতীতে আমাদের দেশে রাজনীতিতে পেশাজীবীদের প্রাধান্য ছিল। এ পেশাজীবীদের মধ্যে রাজনীতিতে সর্বাধিক সংখ্যকের আগমন ঘটত আইন পেশা থেকে। অতীতে যারা রাজনীতি করতেন, তারা মানবসেবার মহান ব্রত নিয়ে নিঃস্বার্থভাবে দেশ ও জনগণের মঙ্গল ও কল্যাণ করে যেতেন। জনগণের যে কোনো বিপদে এবং দেশের যে কোনো বিপর্যয়ে রাজনীতিকদের সর্বাগ্রে পাশে পাওয়া যেত। অতীতে রাজনীতিকদের বেশিরভাগেরই কোনো ধরনের দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকত না এবং ভোগের চেয়ে ত্যাগই তাদের কাছে বড় ছিল। রাজনীতিকদের চরিত্রের সে ঔজ্জ্বল্য ও মহত্ত্ব আজকের রাজনীতিকদের অধিকাংশেরই বদনে মলিনতায় আচ্ছন্ন। এ দেশের রাজনীতিকদের চরিত্রে কলুষতার ছোঁয়া ব্যাপকভাবে লাগে, যখন বিগত শতকের ষাটের দশকে আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্রের নামে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের অবসান ঘটিয়ে চেয়ারম্যানদের ভোটে এমপি নির্বাচনের বিধান করেন। সে সময় চেয়ারম্যানদের ভোট ক্রয়ে যে অর্থের প্রয়োজন হতো তার জোগান দেয়া হতো কেন্দ্রীয়ভাবে।
অতীতে রাজনীতিতে নগণ্যসংখ্যক ব্যবসায়ীকে সক্রিয় দেখা যেত। তারা নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা আছে এমন সব দল ও রাজনীতিকদের অর্থ দ্বারা সাহায্য করতেন এবং বিনিময়ে রাজনীতিকদের কাছ থেকে ব্যবসার প্রসারে আনুকূল্য লাভে সচেষ্ট থাকতেন। কালের বিবর্তনে ব্যবসায়ী রাজনীতিকদের উপলব্ধিতে আসে- অর্থ যদি দিতেই হয় তাহলে কেন্দ্রীয়ভাবে দল অথবা দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে দেবেন, আর এর বিনিময়ে প্রত্যাশা হল এমপি আর ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে মন্ত্রী। তারা আরও অনুধাবন করলেন, মন্ত্রী বা এমপি পদ ব্যবসায়ে স্বল্প সময় যে সফলতা দেয়, দেশের অন্য কোনো ব্যবসা তা দিতে পারে না।
স্বাধীনতার পর ১৯৯৬ সালে তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুলসংখ্যক ব্যবসায়ীর এমপি ও মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ হয়। এর মাধ্যমে রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের অনুপ্রবেশের ধারা সৃষ্টি হয়। এ ধারা এখনও অব্যাহত আছে এবং প্রতিটি সংসদ নির্বাচনে দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের ব্যবসায়ী-কাম-এমপির সংখ্যা বেড়ে চলেছে।
ব্যবসায়ীরা এখন রাজনীতির ব্যাপারে রাজনীতিকদের চেয়ে অধিক আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। সমভাবে এমপি পদের প্রভাব ও ক্ষমতা ব্যবসায় সফলতাসহ বিভিন্ন খাত থেকে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের অবারিত সুযোগ উন্মোচিত করায় এখন আর দলীয় এমপিরা নীতি-নৈতিকতার তেমন একটা ধার ধারেন না। তবে এ কথাও মানতে হবে, এখনও কতিপয় দলীয় এমপি এ ধরনের পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত রয়েছেন।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এ একজন প্রার্থীর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একটি আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে নির্বাচনী ব্যয়ের যে সর্বোচ্চ সীমা দেয়া আছে তা হল ২৫ লাখ টাকা। ২৫ লাখ টাকার এ সীমারেখাটি নির্বাচনের কিছুদিন আগে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে সংশোধনীর মাধ্যমে ১৫ লাখ টাকা থেকে বর্ধিত করা হয়। সর্বোচ্চ ব্যয়ের ১৫ লাখ টাকার সীমারেখাটি দেয়া হয় ২০০৮-এর সংশোধনীর মাধ্যমে এবং এর আগে সীমারেখাটি ছিল ৩ লাখ টাকা, আর প্রথম নির্বাচনকালীন এ সীমারেখা ছিল ১ লাখ টাকা।
বিগত দু’যুগেরও বেশি সময় ধরে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল দুটি থেকে যারা নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হচ্ছেন, তাদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নির্বাচন কমিশন নির্ধারিত ২৫ লাখ টাকা দিয়ে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের সামান্য ব্যয়ও নির্বাহ হয় না। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় তা অকল্পনীয়। আর তাই অর্থ ব্যয়ের ক্ষমতা না থাকার কারণে অনেক ত্যাগী রাজনীতিক দলীয় এমপি মনোনয়ন লাভে বঞ্চিত হন। আবার এমন ত্যাগী রাজনীতিক রয়েছেন, যারা অর্থ ব্যয়ের ক্ষমতা না থাকার কারণে মনোনয়ন প্রত্যাশী হন না। এ ধরনের একাধিক উদাহরণ দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের ক্ষেত্রেই রয়েছে। ২০০১-এর ৮ম সংসদ নির্বাচনে দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীর অর্থের ক্ষমতার কাছে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি দলের একটির অঙ্গসংগঠনের সভাপতিকে মনোনয়নবঞ্চিত করা হয়েছিল। যদিও নির্বাচনের পর তাকে উপদেষ্টা পদ দিয়ে ক্ষতি নিরসন ও ক্ষোভ মেটানোর প্রয়াস নেয়া হয়েছিল। কিন্তু তা সব সময় সবার ক্ষেত্রে হয়ে ওঠে না। অপর এক প্রতিদ্বন্দ্বী দলের জেলা সভাপতি এবং একাধিক নীতিবান রাজনীতিক শুধু অর্থ ব্যয়ের অক্ষমতার কারণে মনোনয়ন লাভে বঞ্চিত হয়েছেন এবং এ আক্ষেপে দুঃখ ও অপমানে নিজেদের রাজনীতি থেকে নিবৃত্ত রেখে চলেছেন।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে দলের বিজয় নিশ্চিত করার জন্য পঞ্চম সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত কেন্দ্রীয়ভাবে প্রার্থীদের অর্থ দিয়ে সহায়তার নিয়ম চালু রেখেছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের ক্ষেত্রে দলের সহায়তার অর্থের পরিমাণ প্রার্থীভেদে কম-বেশি হলেও সে অর্থ কোনো প্রার্থীর ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন নির্ধারিত অর্থ ব্যয়ের পরিমাণ থেকে সচরাচর কম হয় না।
এমন অনেক প্রার্থী আছেন, যারা নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা নেই বুঝতে পেরে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে দল থেকে প্রাপ্ত অর্থের সামান্য পরিমাণ নির্বাচনী কাজে ব্যয় করে বাকি অর্থ নিজ কাজে ব্যয় করেছেন। এমনই একজন প্রার্থী নির্বাচনে তার পরাজয় আঁচ করতে পেরে দল থেকে প্রাপ্ত অর্থ নির্বাচনী কাজে ব্যয় না করে নিজের গ্রামের বাড়িতে বিল্ডিং তৈরির কাজে ব্যয় করেছেন। সে সময় থেকে তার নামের আগে চিরস্থায়ীভাবে ‘বিল্ডিং’ শব্দটি যুক্ত হয়ে গেছে। এখন আর তার নাম এ শব্দ ছাড়া লোকমুখে উচ্চারিত হয় না।
আবার এমন অনেক প্রার্থী আছেন, যাদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, নির্বাচনে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় তার চেয়ে বেশি অর্থ তথাকথিত শুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে পেয়ে যাচ্ছেন। এমন একজন প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য দল ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে যে অর্থ পেয়েছিলেন, তার অর্ধেকেরও কম ব্যয় করে তিনি নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে সফলতা পেয়েছিলেন। এ প্রার্থী সেই নির্বাচনে এমপি হওয়ার সুবাদে প্রতিমন্ত্রীর পদও পেয়েছিলেন। এ প্রার্থীর নিজ মুখ থেকে শোনা গেছে, নির্বাচনে দল ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ তাকে শুধু এমপি ও মন্ত্রী পদই দেয়নি, এর বাড়তি তার যে প্রায় কোটি টাকার কাছাকাছি গৃহনির্মাণ ঋণ ছিল তা পরিশোধের অর্থের জোগানও দিয়েছে।
একজন প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের ক্ষেত্রে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়- এ-সংক্রান্ত প্রকৃত তথ্য সম্প্রতি বর্তমান সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ও সরকারদলীয় চিফ হুইপ ফিরোজ সাহেবের ‘নগদ অর্থ দ্বারা সম্মানিত করা’র উক্তি থেকে অনুধাবন করা যায়।
সত্য কথা বলা অনেক সময় ব্যক্তি ও দলের জন্য বিব্রতকর হওয়ার কারণে অনেকে সত্য এড়িয়ে চলেন। সত্য বলার জন্য জনাব ফিরোজ ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। এজন্য অন্যরা তার সমালোচনা করলেও আমি তা করব না, বরং সত্য বলার জন্য তার প্রশংসাই করব। অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, দশম সংসদ নির্বাচনে তো ফিরোজ সাহেব বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন, তবে কেন তিনি ক্রেস্টের পরিবর্তে ক্যাশ চাইলেন? এ বিষয়ে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞদের মতামত হল, একজন ঝানু রাজনীতিক হিসেবে ফিরোজ সাহেব ঠিকই উপলব্ধি করতে পেরেছেন, অচিরেই তাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে অবতীর্ণ হতে হবে। আর তাই সে নির্বাচনের ব্যয় নির্বাহে আগাম অর্থ সংগ্রহের জন্য এ ব্যবস্থা। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে একজন প্রার্র্থীকে অবিশ্বাস্য অংকের ন্যূনতম ২০ কোটি টাকার বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়, এ কথাটি স্বীকার করার সৎ সাহস অনেকেরই নেই। আর স্বীকার করলে বিড়ম্বনায় যে পড়তে হবে না সে নিশ্চয়তা কোথায়? উল্লেখ্য, একজন প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয় যদি নির্বাচনী আইনে দেয়া ২৫ লাখ টাকার সীমারেখা অতিক্রম করে, সেক্ষেত্রে এটি একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। তাই সীমারেখা অতিক্রম করলেও প্রত্যেক প্রার্থী নিজেদের বিচারের প্রক্রিয়া থেকে বাঁচানোর তাগিদে নির্বাচনী ব্যয় সংক্রান্ত যে বিবরণী নির্বাচন কমিশনে দাখিল করেন তা বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন। এ সত্যটি নির্বাচন কমিশন এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সবার জানা থাকলেও নির্বাচনে বিজয়ী ও বিজিত উভয় দল অকল্পনীয় পরিমাণ অতিরিক্ত ব্যয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিধায় কেউ বিষয়টি নিয়ে কখনও বাড়াবাড়ি করেন না।
দশম সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকালীন বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা যে হলফনামা দাখিল করেছেন, তা অবলোকনে দেখা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ হলফনামাগুলোর সম্পদ বিবরণীর সঙ্গে নবম সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকালীন যে সম্পদ বিবরণী দাখিল করা হয়েছিল তার ব্যবধান এত বেশি যে, এ পরিমাণ সম্পদের সংস্থান ৫ বছরের মধ্যে কোনা ব্যবসা থেকে আসতে পারে, এমনটি ভাবা যায় না।
বর্তমানে বড় দু’দলের এমপিদের অধিকাংশের রাজনীতি বহির্ভূত মূল পেশা অন্য যা কিছুই হোক না কেন, তারা বিভিন্ন ধরনের ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাছাড়া অধিকাংশ এমপির ক্ষেত্রে জনশ্র“তি রয়েছে যে, স্কুল ও কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি হিসেবে শিক্ষক নিয়োগ, ছাত্রভর্তি, বিভিন্ন বিভাগে চাকরি দেয়া, উন্নয়ন বরাদ্দের অর্থের ভাগ, টেন্ডার থেকে প্রাপ্ত কমিশন, ভূমি দখল ইত্যাদি থেকে যে অর্থ পাওয়া যায়, তার পরিমাণ অনেক।
তবে এখনও প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দু’দলের এমপি ও মন্ত্রীদের মধ্যে কতিপয় ত্যাগী ও নিবেদিতপ্রাণ নেতা রয়েছেন, যারা এ ধরনের কালিমা থেকে মুক্ত। নাম উল্লেখ করলে তারা দলের অন্যদের ঈর্ষার পাত্র হবেন, সে বিবেচনায় আপাতত তাদের নাম নাইবা বললাম।
ঢাকা মহানগরের উত্তর-পশ্চিম দিকের নির্বাচনী এলাকা থেকে নবম ও দশম উভয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী জনৈক এমপির দুর্নীতির তথ্য একটি টেলিভিশন চ্যানেলে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। এ তথ্য থেকে জানা যায়, জোরপূর্বক সরকারি ও বেসরকারি ভূমি দখল এবং বেসরকারি ভূমি মালিকদের পাওনা লক্ষ-কোটি টাকা পরিশোধ না করেও তিনি ভাবলেষহীন। টেলিভিশনে প্রচারিত ধারাবাহিকটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে তার মতো অনেক এমপি জড়িত।
এমপি পদের ক্ষমতা ও প্রভাব- এ দুয়ের মাধ্যমে যে অঢেল সম্পদের মালিক হওয়া যায়- এ উপলব্ধিই ব্যবসায়ী শ্রেণীকে রাজনীতিতে প্রলুব্ধ করছে।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন