|
আহমদ রফিক
|
|
জামায়াত নিষিদ্ধ করা প্রসঙ্গে কিছু পরামর্শ
20 Feb, 2014
একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতায় জ্বালানি যোগ করেছিল জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ ও অনুরূপ পাকিস্তানবাদী কিছু দল; সেই সঙ্গে বিহারি নামীয় জনগোষ্ঠী। তাদের বর্বরতার সহিংস রূপ চরিত্র বিচারে পাকিস্তানি সেনাদের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। প্রভেদ ব্যাপকতায়। এবং প্রভেদ জামায়াত ও রাজাকারদের জাতিচরিত্র বিচারে। এদের বড়সড় অংশ বাঙালি হয়েও নির্মমভাবে বাঙালি হত্যা এবং নারী নির্যাতনের বর্বরতায় নিজেদের কলংকিত করেছিল। তারা অবশ্য তাদের স্বদেশ পাকিস্তান রক্ষার দায় পালনের জন্য এসব কর্মকাণ্ডে যোগ দেয়, এমনই ছিল তাদের যুক্তি। কিন্তু জাতিসংঘ নির্দিষ্ট বা আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের প্রশ্নে নিরীহ মানুষ হত্যা ও নারী নির্যাতন কোনো যুক্তিতে পার পায় না। সে হিসেবে তারা অপরাধী, যুদ্ধাপরাধী না হলেও মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনার দায়ে তাদের অপরাধ বিচারযোগ্য, প্রমাণিত হলে শাস্তিযোগ্য।
দীর্ঘ সময় পরে হলেও বাংলাদেশ সরকার একাত্তরের ঘাতকদের বিচার শুরু করে। দীর্ঘ সময়ের প্রক্রিয়ায় জনাকয়েক অপরাধীর শাস্তির রায়ও দেওয়া হয়। অন্তত একজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। প্রধান অপরাধীদের অধিকাংশই জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতা, বাদবাকি দু-একজন মুসলিম লীগ ও বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতা, যারা অবশেষ রায়ের অপেক্ষায়।
আর এ বিষয়কে কেন্দ্র করে জামায়াত-শিবির সহিংসতার যে তাণ্ডব চালায়, তাতে মানুষ পোড়ে, পুলিশ মরে, বাস-ট্রাক ও ট্রেনের বগি পোড়ে, পরিবহন বন্ধ হয়ে জনজীবনে দুর্যোগ নেমে আসে এবং এক ধরনের অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। পেট্রলবোমায় অগি্নদগ্ধ নিরীহ মানুষের যন্ত্রণাকাতর আর্তনাদে হাসপাতালের 'বার্ন ইউনিটে'র কক্ষে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।
এ নাশকতা ও সহিংসতার দায় প্রসঙ্গে বিএনপি আপাত নীরবতা পালন করলেও বিএনপিপ্রধানসহ শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কেউ ওই আগুনে পোড়া সাধারণ মানুষের যন্ত্রণার অংশীদার হতে হাসপাতালে যাননি। উল্টো দায় চাপাতে চেয়েছেন সরকারের ওপর, যা যুক্তিবিচারে খুব একটা গ্রহণযোগ্য নয়। জননেতা বা জননেত্রীদের জনযন্ত্রণা নিয়ে মাথা না ঘামানোর রাজনীতি বিস্ময়কর সন্দেহ নেই। অথচ তাঁদের মতে, তাঁরা যা করেন তা সবই জনস্বার্থে করে থাকেন।
একাত্তরের ঘাতকদের বিচার এবং তার প্রতিক্রিয়া, এরপর একতরফা নির্বাচন নিয়ে যে ধরনের ব্যাপক সহিংসতা দেশব্যাপী ঘটেছে, তা গণতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে খাপ খায় না। যেকোনো বিষয় নিয়ে সরকারি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নিরীহ পথচারী বা বাসযাত্রী হত্যার মাধ্যমে নৈরাজ্য সৃষ্টি যুক্তির ধোপে টেকে না, গণতান্ত্রিক বিধিবিধান তাতে সায় দেয় না। কিন্তু এই অনৈতিক কাজ ১৮ দলীয় জোটের হাতে ঘটেছে, যদিও বলা হয়ে থাকে যে এর মূল কারিগর জামায়াত-শিবিরের ক্যাডার বাহিনী, পেছনে অন্য যারাই থাকুক না কেন।
ঘটনাবলি এতটাই সহিংস, এতটাই নির্মম যে তা সাধারণ মানুষের মধ্যে আলোড়ন তৈরি করে। সিটি করপোরেশনের নির্বাচন উপলক্ষে বিএনপির পক্ষে যে অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়েছিল তা হাওয়ায় উড়ে যায়। রাজনৈতিক বিচক্ষণতার অভাব, জনস্বার্থবিরোধী কার্যকলাপের জের মেটাতে হয় বিরূপতার মাসুল গুনে। পশ্চিমা কূটনীতির সমর্থন সত্ত্বেও নিজ মাটিতে বিএনপিকে পিছু হটতে হয়। হয় প্রধানত জামায়াত-শিবিরের রক্ত ঝরানো সহিংসতার দায় মেটাতে।
এর মধ্যে সমাজের অন্য অংশে মানবতাবিরোধী তৎপরতার কারণে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, তা নানা দাবিতে প্রকাশ পায়। তার মধ্যে একটি বড় দাবি, একাত্তরের ঘাতক জামায়াত-শিবিরের সাম্প্রতিক সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হোক। তবে এ বিষয়ে দেখা যাচ্ছে নানাজনের নানা মত। পত্রিকার কলামে, টিভির টক শোতে বা অন্য মাধ্যমেও জোর মতামত প্রকাশ পাচ্ছে এবং তা দাবির পক্ষে ও বিপক্ষে।
এমন মতামতও সে ক্ষেত্রে প্রকাশ পেয়েছে যে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হলে তারা মরিয়া হয়ে উঠবে, বেপরোয়া সহিংসতার আগুন ছড়িয়ে দেবে দেশময় অথবা আত্মগোপন করে ব্যাপক সহিংস কর্মকাণ্ড শুরু করে দিতে পারে। সরকারের পক্ষে তখন সহজ হবে না ওই সহিংসতার সফল মোকাবিলা করা, যেমন দেখা গেছে কয়েক মাস আগেকার ঘটনায়, যখন পুলিশ-বিজিবি পর্যন্ত পিছিয়ে পড়েছে। ওদের অধিকৃত বিশেষ বিশেষ এলাকা মুক্ত করতে সশস্ত্র বাহিনীর সাহায্য নিতে হচ্ছে। তবু সে কাজে পুরো সফলতা অর্জন খুব সহজ হয়ে উঠছে না।
এমন সব শুভ, অশুভ সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করেই বোধ হয় সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তে সময় নিচ্ছে। সন্দেহ নেই, এ সমস্যা নিরসনে শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের তারুণ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। জনমত গঠনের মাধ্যমে ওই কাজে সহায়ক শক্তি গড়ে তুলতে পারে। জনগণকে যখন সব শক্তির উৎস হিসেবে মানা হয়, তখন এ কথাও সত্য যে সেই জনমতই জামায়াত নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে শেষ সিদ্ধান্ত নিতে, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সরকারকে সাহায্য করতে পারে। তা না হলে সরকার এককভাবে এ কাজে অগ্রসর হলে বহির্বিশ্বের মতামত সরকারের বিপক্ষে যেতে পারে এমন সম্ভাবনা যথেষ্ট।
প্রসঙ্গত জামায়াত সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনায় রাখা দরকার। বিস্ময়কর যে যারা ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের বিরোধী, তারা কিভাবে জামায়াতের মতো উগ্র ধর্মীয় রাজনীতির সংগঠনের প্রতি নমনীয় হতে পারে? হ্যাঁ পারে, যখন রাজনৈতিক স্বার্থ তাদের পক্ষে যায়। এর নেপথ্যে রয়েছে পাকিস্তান-মার্কিন রাজনৈতিক-রাষ্ট্রনৈতিক স্বার্থ, যে স্বার্থের টানে তারা একাত্তরে পাকিস্তানের পক্ষে বাঙালিবিরোধী ভূমিকা নিয়েছিল। আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিবেচনায় গড়ে উঠেছিল পাকিস্তানের পক্ষে চীন-মার্কিন ঐক্য। সম্প্রতি ঘাতকদের বিচার নিয়ে পাকিস্তান-মার্কিন প্রতিক্রিয়া লক্ষ করার মতো।
সম্ভবত এসব কারণও বাংলাদেশ সরকারকে তথা আওয়ামী লীগকে জামায়াত নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে অগ্রচারীর ভূমিকা নিতে বাধা দিচ্ছে। সেই সঙ্গে আরো একটি বিষয় বিবেচ্য। বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে তিরিশ শতাংশেরও কিছু বেশি জনসমর্থন পেয়ে থাকে, যা নির্বাচনে পরিস্ফুট এবং এ সংখ্যা অগ্রাহ্য করার মতো নয়। আর জামায়াত সেই বিএনপির ঘনিষ্ঠ জোটসঙ্গী। জামায়াতেরও কিছুসংখ্যক ভোট সমর্থন তথা জনসমর্থন রয়েছে।
তার চেয়েও বড় বিষয়, তারা সমাজে যথেষ্ট অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করে আছে। ব্যাংক, বীমা, হাসপাতাল, শিক্ষায়তন, অনুসন্ধানী পরীক্ষাগার থেকে শুরু করে কোথায় নেই জামায়াত? বলতে হয়, সর্বত্র বিরাজমান। এমনকি কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের দখলে। সামরিক বাহিনীতে সে প্রভাব নিতান্ত কম নয়। শিল্পোদ্যোগেই বা কম কিসে তারা। প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে তারা তো একাই ক্ষমতায় যেতে পারে।
না, তা পারে না। কারণ ক্ষমতায় যাওয়ার সংসদীয় সিঁড়িটা তৈরি করে থাকে জনমত, জনসমর্থন। সেখানে জামায়াত অনেকটা পিছিয়ে। বিএনপির জনসমর্থন নিয়ে তারা ক্ষমতার ভাগ পেয়েছে। বিএনপির মোটা দাগের ভোটব্যাংক তাদের সংসদীয় ক্ষমতার উৎস। এ এক দুর্বোধ্য মনস্তত্ত্ব- বাঙালি মুসলমান ভোটারদের যে ধর্মনিষ্ঠ হয়েও জামায়াতের ধর্মীয় রাজনীতির প্রতি তাদের আকর্ষণ নেই। কিন্তু আছে মধ্যপন্থী বিএনপির প্রতি। অবশ্য এর মধ্যে ভারতবিরোধিতার কারণও যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে থাকে।
এমন এক পরিস্থিতিতে যুক্তিহীনভাবে বিএনপি জামায়াতের সমর্থন ধরে রাখতে চাইছে, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকার চাইছে তাদের বিচ্ছিন্ন করতে; কিন্তু জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে নয়। কূটরাজনীতির এ খেলায় আওয়ামী লীগ সামান্য মাত্রায় হলেও এগিয়ে। অবস্থাদৃষ্টে সেক্যুলার শক্তির উচিত জামায়াতের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক বয়কটের গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা। যেমন অর্থনৈতিক, তেমনি সামাজিক বয়কট। অর্থাৎ জামায়াতের কোনো প্রকার অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না হওয়া, চিকিৎসাসেবা না নেওয়া, এমনকি বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে বিযুক্ত থাকা।
এ আন্দোলন যথাযথভাবে গড়ে তুলতে পারলে জামায়াত সমাজে কোণঠাসা হতে বাধ্য। এ পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারে শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ। তাদের শক্তি ব্যবহার করতে পারে জামায়াতকে একঘরে করার কাজে। এর ফলে সরকারের পক্ষে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার কাজ সহজ হতে পারে। তবে সন্দেহ নেই, এ কাজ শ্রমসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ; কিন্তু অসম্ভব নয়। শাহবাগ মঞ্চ অবশ্য এ সম্পর্কে জোরালো গণ-আন্দোলন ও শক্তি তৈরি করতে পারে।
এর ফলে বাংলাদেশে রাজনীতির নব মেরুকরণের প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। হয়তো বা বিএনপি একপর্যায়ে জামায়াত থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাইতে পারে। সে ক্ষেত্রে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা সঠিক বলে মনে হয় না। জামায়াত সম্পর্কে এ ধরনের বাস্তববাদী কর্মসূচি নিয়ে রাজনীতিসচেতন মানুষের তৎপর হওয়া দরকার। তাহলেই হয়তো জামায়াত নিষিদ্ধকরণের কাজ সহজ হয়ে উঠবে।
লেখক : গবেষক ও ভাষাসৈনিক
(কালের কণ্ঠ, ২০/০২/২০১৪)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন