সংলাপ! সংলাপ! দুই বছর আগে থেকেই শুরু হয়েছে 'সংলাপ' নিয়ে সংলাপ। সরকারি দল, বিরোধী দল, ছোট-বড় সব দল-উপদল, সবার মুখেই এক কথা- 'সংলাপ' ছাড়া কোনো গতি নেই। 'দুই দল' ও 'দুই নেত্রী' সংলাপে বসলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি- সবাই তা চেয়েছেন। অতঃপর বিদেশি কূটনীতিকরাও সে কথা বলেছেন। জাতিসংঘের দূত একেবারে সরেজমিনে এসে 'সংলাপ' আয়োজনের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন।
কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। আমাদের দুই জোট, দুই নেত্রীর 'চারি চক্ষুর মিলন' হলো না। ১৫৮টি প্রাণের বিনিময়ে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত হয়েছে দশম জাতীয় সংসদ, একগাদা প্রশ্নের জন্ম দিয়ে।
প্রসঙ্গ : তত্ত্বাবধায়ক সরকার
নির্বাচনের আগে মূল বিবাদ ছিল নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে। সরকার পক্ষ সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করায় বিরোধী পক্ষ তা পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলন চালিয়েছে। সরকার পক্ষ অনির্বাচিতদের হাতে ক্ষমতা দিতে চায় না। যেকোনো অবস্থায় 'সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা' অটুট রাখতে চায়। দুই বিবদমান পক্ষের সমঝোতার জন্য নানা প্রস্তাবনা উঠে এসেছে। এই কলামেও আমরা সে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি।
সমঝোতার ভিত্তি হিসেবে আমরা প্রস্তাব করেছিলাম বিদায়ী সংসদের সদস্যদের মধ্য থেকে 'যাঁরা নির্বাচন করবেন না' তেমন ১০ জনকে বেছে নিয়ে একটা 'জাতীয় সরকার' গঠন করা হোক। তাতে সরকার পক্ষ থেকে পাঁচজন ও বিরোধী পক্ষ থেকে পাঁচজন থাকবেন। এই ১০ জনের মধ্য থেকে একজন প্রধানমন্ত্রী হবেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল থেকে প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দল থেকে স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন মন্ত্রী নিয়োগ দিয়ে মন্ত্রণালয় বণ্টনে ভারসাম্য রক্ষা করা যেতে পারে।
এ ব্যবস্থায় দুই দিক রক্ষা হয়। এতে 'সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা' অক্ষুণ্ন থাকে এবং অনির্বাচিতদের হাতে ক্ষমতা দিতে হয় না। সরকার পক্ষের সেই ইচ্ছা পূরণ হয়। অন্যদিকে বিরোধী পক্ষের 'নির্দলীয়-নিরপেক্ষ' 'তত্ত্বাবধায়ক' সরকারের দাবিও পূরণ হয়। 'জাতীয় সরকার' দলীয় সরকার হয় না। আবার মন্ত্রিসভায় দুই পক্ষের সমানসংখ্যক সদস্য থাকলে ও মন্ত্রীরা কেউ নির্বাচন না করলে বা নির্বাচনী প্রচারণায় না গেলে তার চেয়ে অধিক 'নিরপেক্ষ' সরকার কী হতে পারে? অনেকে বলেন, আমাদের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা এত বেশি যে যে দল থেকে প্রধানমন্ত্রী হবেন, সব কিছু তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। পার্লামেন্টারি রীতি অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দল থেকে প্রধানমন্ত্রী হওয়াই বিধেয়। তবে নির্বাচনকালীন সরকারের কর্মপরিধি এমনভাবে সীমিত করা যেতে পারে, যাতে এই সময়ে প্রধানমন্ত্রী এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। এ ধরনের একটি ব্যবস্থাকে স্থায়ী সাংবিধানিক ব্যবস্থা হিসেবেই গ্রহণ করা যেতে পারে।
১৯৯৫ সালের শেষদিকে তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলে এ রকম একটি ব্যবস্থা প্রবর্তনের আহ্বান জানিয়েছিলাম। তিনি খুবই ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর দল রাজি হয়নি। ফলে ১৫ ফেব্রুয়ারির একদলীয় নির্বাচন। তারপর যা হওয়ার তাই হয়েছে। বিরোধী দলের চাপের মুখে পদত্যাগ। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন। অতঃপর নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়।
আমার বিবেচনায় ভবিষ্যতেও সব পক্ষের অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হলে এ রকম একটি ব্যবস্থার কথাই ভাবতে হবে। এর কোনো বিকল্প দেখি না। সরকার পক্ষ সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার কথা বলে ও ইউরোপীয় গণতন্ত্রের দৃষ্টান্ত দিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের পক্ষে যত যুক্তিই তুলে ধরুক না কেন, অন্যদের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ বর্তমান পর্যায়ে আমাদের দেশে কোনো ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে, তা কেউ বিশ্বাস করতে পারেন না। অন্যদিকে বিরোধী দলকেও বাস্তবতা মেনে নিয়ে কিছু ছাড় দিয়েই সমঝোতায় যেতে হবে।
এখন বিরোধীরা বলছেন, এ সরকার 'অবৈধ'। তাঁদের দাবি, অবিলম্বে আবার নির্বাচন চাই। অন্যদিকে সরকারি দল এই সরকারের বৈধতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন শুনতে নারাজ। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, জনগণ তাঁদের পাঁচ বছরের জন্যই ম্যান্ডেট দিয়েছে। অতএব, তাঁদের এই সরকার পাঁচ বছরই ক্ষমতায় থাকবে। অবশ্য যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, 'আমরা পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকব, তেমন বাগাড়ম্বর করা ঠিক নয়। এ সরকার কত দিন ক্ষমতায় থাকবে সেটা জনগণই ঠিক করবে।'
এদিকে বিশিষ্টজনদের অনেকে বলছেন, 'এই নির্বাচন বৈধ নয়, অবৈধও নয়'! (তাহলে কী?)
এর মধ্য দিয়ে আমাদের বর্তমান 'নির্বাচন পদ্ধতি' ও 'নির্বাচন ব্যবস্থাপনা'র যে অসম্পূর্ণতা ও সীমাবদ্ধতা ফুটে উঠছে, সেদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে।
ক্ষমতাসীন থাকার সুবিধা
ক্ষমতাসীনরা যত বেশি দিন সম্ভব ক্ষমতায় থাকতে চাইবেন, সেটা অস্বাভাবিক নয়। নির্বাচন নিয়ে যত প্রশ্নই থাকুক, এই সরকার চালকের আসনটিতে বসে পড়েছে। জোর করে বসে পড়লেও এখন তাকেই এই গাড়ি চালাতে হবে; গন্তব্য কোথায় তা অনিশ্চিত হলেও। পথে চালক বদলানোর প্রয়োজন হতে পারে, তাই বলে গাড়িটা তো থামিয়ে রাখা যাবে না। তাহলে যে সবকিছু থেমে যাবে- রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন, জনজীবন।
এখানেই ক্ষমতাসীনদের সুবিধা। এ কারণেই সামরিক স্বৈরতন্ত্রকেও মেনে নিতে হয়। পরে 'ইনডেমনিটি' দিয়ে আইনসিদ্ধ করে নিতে হয়। আইনবিদরা সে ব্যবস্থা করেই রেখেছেন। 'de jure' নয় তো 'de facto'। 'আইনসিদ্ধ' না হলেও 'বাস্তবতাসিদ্ধ'। যেমন হয়েছিল আশির দশকে।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সামরিক শাসন জারি করে রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। তার মাত্র কয়েক মাস আগে সাত্তার সাহেব একটি শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তাঁর সময় ব্যাংক ধর্মঘটে সারা দেশ অচল হয়ে পড়ে। সেই গুরুতর পরিস্থিতি অত্যন্ত কঠোর হস্তে মোকাবিলা করে তিনি প্রশংসিত হন। তেমনি এক পরিস্থিতিতে সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা মাথায় সামরিক শাসন জারি করা হয়। দেশের সংবিধান স্থগিত করে 'স্বৈরাচারে'র যাত্রা শুরু হয়।
সামরিক শাসন জারির পর এরশাদ সাহেব আমাকে জেলে পুরেছিলেন। তিনি কেন এই কাজটি করেছিলেন, তা এখনো বুঝতে পারিনি। এ দেশের স্বাধীনতার জন্য ছাত্রজীবনে কয়েক দফায় সাড়ে তিন বছর পাকিস্তানি শাসকদের কারাগারে থাকতে হয়েছে। সে জন্য দুঃখ হয় না। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে এরশাদ সাহেবের জেলে যেতে হবে, তা কল্পনায় ছিল না। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তাঁর তখনকার ডান হাত হিসেবে বিবেচিত জেনারেল চিশ্তী আমাকে কফি খাওয়ার দাওয়াত দিয়েছিলেন। আমাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানালে তিনি বলেছেন, 'না না, আপনার ধন্যবাদ জানানোর কিছু নেই, আমরাই দুঃখিত। আপনাকে অনেক কষ্ট পেতে হয়েছে।' তারপর তিনি তাঁদের '১৮ দফা কর্মসূচি'র কাগজপত্র হাতে তুলে দিয়ে বলেছেন, এগুলো দেখবেন? আপনাদের ১৯ দফার চেয়ে খুব তফাত নেই। এ নিয়ে 'চিফ' আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান। সাচ্চা ভদ্রলোকের মতো কথা। তবে ক্ষমতাসীনরা যখন 'গাজর' পরিবেশন করেন, তখন তাতে 'লাঠি'র আভাস অস্পষ্ট থাকে না। ইংরেজিতে যাকে বলে 'carrot and stick together'। অতঃপর সরকারি দলে যোগ দেওয়ার জন্য প্রত্যক্ষে-পরোক্ষে দেশি ও বিদেশি চাপের মুখে আমাকে দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল।
আমি বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলাম অনেক স্বপ্ন নিয়ে। যেসব রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার তাড়নায় যৌবনের সুন্দরতম দিনগুলো কারাগারে-আন্ডারগ্রাউন্ডে চরম কষ্টকর জীবনে নিঃশেষ করেছি, সেই স্বপ্নগুলোর বাস্তবায়নে কাজ করতে পারব বলে আশা করেছিলাম। 'মেজর জিয়া'র সঙ্গে আমার পরিচয় ভারতের আগরতলায়, ১৯৭১ সালে। 'রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানে'র সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনায় মনে হয়েছিল তাঁর ক্ষমতায় আসার ব্যাপারটা যেভাবেই ঘটে থাকুক না কেন, তিনি দেশটাকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে চেষ্টা করছেন। তাঁর মর্মান্তিক মৃত্যু ও পরবর্তীকালের বিএনপি নেতৃত্বের ভিন্নতর অবস্থানের কারণে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। সেখান থেকেও সরে আসতে হয়েছে। সে আলোচনায় যেতে চাই না।
এরশাদ সাহেব ৯ বছর রাষ্ট্রক্ষমতাকে যদৃচ্ছ ব্যবহার করে খোদার ওপর খোদকারী করেছেন। এই ভদ্রলোক আমাদের জাতীয় রাজনীতির আঙিনায় এসেছেন অনেকটা 'Bull in a china shop' হয়ে। এর বাংলা তর্জমা হতে পারে 'চিনামাটির দোকানে মত্ত ষাঁড়'। ৯ বছরে সব নিয়ম-রীতি, রাজনীতির মাঠের সব ধারাবাহিকতা ভেঙে তছনছ করে রেখে গেছেন। আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে 'প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি'র উদ্বোধন তাঁর হাতেই।
তবে এরশাদ সাহেবের এবারকার কর্মকাণ্ড সব কিছু ছাড়িয়ে গেছে। সারা পৃথিবীতে রাজনীতি নিয়ে এমন কাণ্ড আর কোথায়ও কখনো হয়েছে বলে জানা নেই। আমাদের 'দুই নেত্রী' ও 'দুই জোট' ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এরশাদ সাহেবকে নিয়ে যে রঙ্গ-তামাশা করেছেন তার দৃষ্টান্তই বা কোথায় পাওয়া যাবে?
রাজনীতির দুষ্টচক্র এত কিছুর পরও অব্যাহত থাকে। সময়ের বাস্তবতা মেনে নিতে বাধ্য হয়ে ইতিহাসের চাকা গড়িয়ে চলে। ১৯৮২ সালে এরশাদ সাহেবকে মেনে নিতে আমরা বাধ্য হয়েছিলাম। এবারও এই নির্বাচন ও নির্বাচনোত্তর সরকারকে মেনে নিয়েই নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।
জোটের রাজনীতি : ভোটের রাজনীতি
বিরোধী দলনেত্রী 'সংলাপ' চেয়েছেন। সরকার পক্ষে এখন একটু তেজিভাব। তারা নানা শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। বলছে, জামায়াতকে ছাড়তে হবে। সন্ত্রাস বন্ধ করতে হবে, ইত্যাদি।
আমাদের 'দুই জোটে'র রাজনীতি এ ক্ষেত্রে অভিন্ন। তাদের সঙ্গে হাত মেলালে সাত খুন মাফ, না মেলালে 'দেশদ্রোহী'। ১৯৯৬ সালে জামায়াতের সঙ্গে হাত মেলাতে সমস্যা হয়নি আওয়ামী লীগের। এবারও শোনা যায়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে একটা সমঝোতা হয়েই গিয়েছিল। কিন্তু জোটের শরিকদের একাংশ তা আগেভাগে টের পেয়ে যায়। সে কারণেই নাকি 'জাগরণ'। অতঃপর পিছু হটা!
আর অন্য জোটের তো কথাই নেই। জামায়াতের কাঁধে সওয়ার হতে গিয়ে এখন কাঁধের ওপর 'সিন্দাবাদের দৈত্য'। যেদিকে যেতে বলে সেদিকেই যেতে হয়। ১৯ জানুয়ারি সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়ার জন্মদিনের সভায় জামায়াত উপস্থিত হয়নি। এটা কি সরকার পক্ষের চাপের কাছে নতি স্বীকার? বিএনপি কি এ প্রশ্নে কোনো নীতিগত অবস্থান নিতে চলেছে? এসব স্পষ্ট নয়।
তবে এটা এখন পরিষ্কার যে আশু প্রাপ্তির প্রত্যাশায় জামায়াতকে জোটে নিয়ে বিএনপি স্বল্পকালীন রাজনীতিতে কিছুটা লাভবান হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু তা করতে গিয়ে দলটি তার 'রাজনৈতিক আত্মা'কে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। স্বেচ্ছামৃত্যু।
জোটবদ্ধ জামায়াত এখন বিএনপির গলার ফাঁস হয়েছে। জামায়াতের জন্যও তা নানা জটিলতা ডেকে এনেছে। দলের কয়েকজন এমপি মন্ত্রী হয়েছেন বটে, কিন্তু দলটির আদর্শিক ও কৌশলগত অবস্থান চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই ২০০০ সালে একটা নিবন্ধে জামায়াত ও বিএনপির জোটবদ্ধ হওয়ার প্রশ্নে দ্বিমত প্রকাশ করেছিলাম। দৈনিক 'মানবজমিন' পত্রিকায় সেটি ছাপা হয়েছিল কয়েক কিস্তিতে- 'বিএনপি কোন পথে?' শিরোনামে (যার মাসুল আমাকে দিতে হয়েছে)।
'নিষিদ্ধ' করা নয়, 'মোকাবিলা' করতে হবে
ষাটের দশকে ও একাত্তরে যেসব দল প্রত্যক্ষভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর সেবাদাস হয়ে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল, তাদের সেই একই নামে দল করতে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। রাষ্ট্রপতি জিয়া আমাদের ঘাড়ে অহেতুক সেই ঝামেলা চাপিয়ে দিয়ে গেছেন।
জামায়াতে ইসলামীকে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠছে। সেটা হিতে-বিপরীত হবে বলেই মনে হয়। কারণ এই দলটির শেকড় এখন নানা দিকে প্রসারিত হয়েছে। এখন তাকে রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। সংগঠিত দল নিষিদ্ধ করা হলে তার পরিণাম সাধারণত শুভ হয় না। মধ্যপ্রাচ্য, ভারত, পাকিস্তান থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। প্রকাশ্য রাজনীতিকে আন্ডারগ্রাউন্ডে পাঠিয়ে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। গ্রহণ-বর্জনের দায়ভার জনগণের ওপর ছেড়ে দেওয়াই উত্তম। চূড়ান্ত বিচারে জনগণ কখনই ভুল করে না।
এই 'বিদেশ-ভজনে'র শেষ কোথায়?
আমাদের 'দুই নেত্রী', 'দুই জোট' যেন বিদেশের চোখে নিজ দেশকে দেখতে ও দেখাতে প্রাণান্ত পরিশ্রম করছেন। যেন বিদেশিরাই দূরে বসে সব কিছু পরিষ্কার দেখছে, আমরা সবাই অন্ধ ও নির্বোধ। কিছুই দেখছি না, কিছুই বুঝতে পারছি না।
আমাদের 'বিদেশ-ভজা' মিডিয়ার সংবাদ পরিবেশনের ধরনটাও লক্ষ করার মতো। আমাদের চোখের সামনে যে নির্বাচন হয়েছে, সে নির্বাচন নিয়ে যে খেলাধুলা হয়েছে, তার খবর বিদেশিদের জবানিতে শুনতে হবে কেন? আমাদের ঘরের খবর দেশি মিডিয়ার চেয়ে বিদেশি মিডিয়া কিভাবে বেশি বেশি জানতে পারে?
এভাবে কথায় কথায় বিদেশিদের দরজায় ধরনা দিতে হবে কেন? ১৫ কোটি মানুষের দেশে যাঁরা নেতা হবেন বা হতে চান, নিজ দেশের সমস্যা সম্পর্কে তাঁরাই তো বেশি জানবেন। আমাদের সমস্যা ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা, সেক্রেটারি জেনারেল বান কি মুন, কিংবা প্রেসিডেন্ট ওবামা 'আমাদের চেয়েও বেশি' বুঝবেন কেন?
১৯৮৩ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৫ দল ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৭ দলের ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পাঁচ দফা দাবিনামার ভিত্তিতে। শুরু হয়েছিল সামরিক আইন প্রত্যাহারের দাবিতে ২২ দলের যুগপৎ আন্দোলন। সে দিনের প্রেক্ষাপটে এই দুই মেরুর সম্মিলন অবিশ্বাস্যই ছিল। কিন্তু তা সম্ভব হয়েছিল। যার বিজয় ঘটেছিল নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারের পতন ও সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে। সে জন্য বিদেশিদের ডাকতে হয়নি।
শেষ কথা
এখন জাতির সামনে ইস্যু হচ্ছে, কবে আমরা একটি গ্লানিকর নির্বাচনের গ্লানিময় পরিণতি থেকে মুক্ত হতে পারব। কবে আবার যথার্থ জনপ্রতিনিধিত্বমূলক একটি সরকার নিয়ে বিশ্বসভায় সভ্য জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব।
দুই নেত্রী বা দুই জোটের 'সংলাপ' জরুরি নয়, 'সিদ্ধান্ত' জরুরি। কারণ পূর্বাহ্নে সিদ্ধান্ত না হলে সংলাপ থেকে কিছুই বের হয়ে আসবে না। ১৯৯৫ সালেও সংলাপে বসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ঘোষণা আসেনি। সে দিনের সরকার পরিস্থিতির আলোকে নিজ থেকেই তারা ঘোষণা দিয়েছিল বা দিতে বাধ্য হয়েছিল। এবারও ক্ষমতাসীনরা চাইলে একটি 'গ্রহণযোগ্য' পদক্ষেপ নিয়ে একতরফাভাবেই এই বিরোধের সমাপ্তি টানতে পারেন।
এখন প্রয়োজন সদিচ্ছা। প্রথমত, নির্বাচনকে যথার্থ নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করার সদিচ্ছা এবং দ্বিতীয়ত, সেই নির্বাচনের রায় হৃষ্টচিত্তে মেনে নেওয়ার সদিচ্ছা। এই 'দুই সদিচ্ছা' সব পক্ষে জাগ্রত হলে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বিলম্ব হবে না। নিমেষেই সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে।
কেবল 'অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে'র রূপরেখাই নয়, এযাবৎকালের অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের নির্বাচন ও ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় আরো যেসব জটিলতা ইতিমধ্যে চিহ্নিত হয়েছে, সবকিছুরই থোক সমাধানের দিকে যাওয়ার সুযোগ উপস্থিত হয়েছে।
লেখক : রাজনীতিক, ভূ-রাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক
(কালের কণ্ঠ, ০১/০২/২০১৪)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন