সংসদ সদস্যরা সাংবিধানিক পদধারী। অপরাপর সাংবিধানিক পদধারীর মতো শপথ গ্রহণ ছাড়া তারা কার্যভার গ্রহণ করেন না। এ বিষয়ে সংবিধানের অনুচ্ছেদ নম্বর ১৪৮(৩)-এ উল্লেখ রয়েছে : এ সংবিধানের অধীন যে ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তির পক্ষে কার্যভার গ্রহণের পূর্বে শপথ গ্রহণ আবশ্যক, সে ক্ষেত্রে শপথ গ্রহণের অব্যবহিত পর তিনি কার্যভার গ্রহণ করেছেন বলে গণ্য হবে। একজন সংসদ সদস্য শপথ গ্রহণ করাকালীন যে বাক্যগুলো পাঠ করেন তার সঙ্গে অন্যান্য সাংবিধানিক পদধারীর পঠিত বাক্যগুলোর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, উচ্চ আদালতের একজন বিচারককে শপথ গ্রহণ করাকালীন অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি ব্যক্ত করতে হয়, তিনি বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করবেন। কিন্তু একজন সংসদ সদস্যকে সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করাকালীন উপরোক্ত বাক্যটি উচ্চারণ করতে হয় না। শপথের বাক্যগুলোর মধ্যে পার্থক্যের মূল কারণ হল- একজন সংসদ সদস্য শপথ গ্রহণ করাকালীন যদি ব্যক্ত করেন, তিনি বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করবেন- সেক্ষেত্রে তার পক্ষে সংযোজন, বিয়োজন ও প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে সংবিধান ও আইনে শপথ গ্রহণ করাকালীন যে বিধানাবলি ছিল তা থেকে ভিন্নতর অবস্থান গ্রহণের সুযোগ থাকে না। অর্থাৎ শপথ গ্রহণ করাকালীন বিদ্যমান সংবিধান ও আইনের যে কোনো সংশোধনী কার্যক্রমে একজন সংসদ সদস্যের অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ থাকে না।
একটি সাধারণ নির্বাচনের পর সংসদ সদস্যদের শপথ বিষয়ে যে বিধান অনুসৃত হয় সে সম্পর্কে সংবিধানের ১৪৮(২ক) অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে : ১২৩ অনুচ্ছেদের (৩) দফার অধীন অনুষ্ঠিত সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপিত হওয়ার তারিখ হতে পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে এ সংবিধানের অধীন এতদউদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা তদউদ্দেশ্যে অনুরূপ ব্যক্তি কর্তৃক নির্ধারিত অন্য কোনো ব্যক্তি যে কোনো কারণে নির্বাচিত সদস্যদের শপথ পাঠ পরিচালনা করতে ব্যর্থ হলে বা না করলে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এর পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে উক্ত শপথ পাঠ পরিচালনা করবেন, যেন এ সংবিধানের অধীন তিনি এর জন্য নির্দিষ্ট ব্যক্তি।
সংবিধানে উপরোক্ত বিধানটি চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে সন্নিবেশিত হয় এবং উক্ত সংশোধনীর আগে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর কতদিনের মধ্যে সংসদ সদস্যরা শপথ গ্রহণ করবেন সে বিষয়ে সংবিধান নিশ্চুপ ছিল।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী-পরবর্তী সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন বিষয়ে যে বিধান করা হয়েছে তা হল- মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে এবং মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। উপরোক্ত বিধান দুটি অনুচ্ছেদ নম্বর ১২৩(৩)-এর (ক) ও (খ) হিসেবে বর্ণিত রয়েছে। এ দফাটিতে শর্তাংশ দিয়ে বলা হয়েছে যে, (ক) উপদফা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিগণ উক্ত উপদফায় উল্লিখিত মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সংসদ সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহণ করবেন না।
দশম সংসদ নির্বাচনটি সংবিধানের ১২৩(৩)(ক)-এর বিধান অনুসরণে গত ৫ জানুয়ারি ২০১৪ অনুষ্ঠিত হয়েছে। নবম সংসদের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২৬ জানুয়ারি ২০০৯। সংবিধানের অনুচ্ছেদ নম্বর ৭২(৩)-এর বিধান অনুযায়ী প্রথম বৈঠকের তারিখ থেকে ৫ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর আগামী ২৪ জানুয়ারি ২০১৪ নবম সংসদ আপনাআপনি ভেঙে যাবে।
দশম সংসদের নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নির্বাচিত হওয়া সংক্রান্ত গেজেট বিজ্ঞপ্তি নির্বাচন কমিশন ৮ জানুয়ারি ২০১৪ প্রকাশ করেছে এবং প্রকাশ-পরবর্তী সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় দশম সংসদে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ ৯ জানুয়ারি ২০১৪ অনুষ্ঠিত হয়। স্পষ্টত নবম সংসদ বহাল থাকাকালীন দশম সংসদের জন্য নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণে সংবিধানের অনুচ্ছেদ নম্বর ১২৩(৩)(ক)-এর শর্তাংশের ব্যত্যয় ঘটেছে। এ ব্যত্যয়ের ফলে দেখা যাচ্ছে ৯ জানুয়ারি ২০১৪ থেকে ২৪ জানুয়ারি ২০১৪ পর্যন্ত জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যের প্রতিটি আসনের বিপরীতে দু’জন করে সংসদ সদস্য রয়েছেন। আইন অনুযায়ী এ সময়কালে প্রতিটি আসনের বিপরীতে দু’জন সংসদ সদস্যের মধ্যে বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধাদি পাওয়ার অধিকারী কে হবেন সে প্রশ্নটির উত্তর না পাওয়া গেলেও পৃথিবীর কোনো দেশে একই সংসদীয় আসনে একই সময়ে একাধিক ব্যক্তি নির্বাচিত হওয়া-পরবর্তী পদে বহাল থাকার নজির নেই।
সংবিধান বিষয়ে অভিজ্ঞ এমন অনেকে ধারণা ব্যক্ত করেছেন যে, একান্তই যদি নবম সংসদের মেয়াদ অবসানের আগে দশম সংসদের জন্য নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণের আবশ্যকতা দেখা দিত, সেক্ষেত্রে নবম সংসদ ভেঙে দিয়ে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা যুক্তিযুক্ত ছিল। কিন্তু তাদের এ বক্তব্য সংবিধানের অনুচ্ছেদ নম্বর ৫৭(২) বিবেচনায় নিলে প্রতীয়মান হয়, প্রধানমন্ত্রী যতক্ষণ সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন, ততক্ষণ পর্যন্ত তার পক্ষে রাষ্ট্রপতিকে সংসদ ভেঙে দেয়ার পরামর্শ দানের সুযোগ অনুপস্থিত।
দশম সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ-পরবর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ১২ জানুয়ারি ২০১৪ অপরাহ্নে নতুন মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। স্পষ্টত নতুন মন্ত্রিসভা এমন এক সময় শপথ নিচ্ছে যখন আগের সংসদ ও আগের মন্ত্রিসভা কার্যকর।
প্রধানমন্ত্রীর পদ কখন শূন্য হবে সে বিষয়ে সংবিধানে বলা হয়েছে : প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতির নিকট পদত্যাগপত্র প্রদান করলে অথবা সংসদ সদস্য না থাকলে অথবা সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন না হলে তার পদ শূন্য হবে, তবে তার উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তিনি স্বীয় পদে বহাল থাকবেন। এ ক্ষেত্রে তার মন্ত্রিসভার অপরাপর সদস্যরাও তাদের উত্তরাধিকারীগণ কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্ব-স্ব পদে বহাল থাকবেন।
আমাদের দেশে এর আগে কখনও সংসদ বহাল থাকাবস্থায় দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। নির্বাচন-পরবর্তী দেখা গেল প্রধানমন্ত্রীর দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হওয়ায় তার উত্তরাধিকারী তিনি স্বয়ং। এ ক্ষেত্রে তাকে পদত্যাগ করে নাকি পদে বহাল থেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করতে হবে সে বিষয়ে সংবিধান স্পষ্ট নয়। তবে অনেকের অভিমত, দশম সংসদের সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি যেহেতু নতুনভাবে শপথ নিয়েছেন সে কারণে পুনঃ প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ-পরবর্তী তার শপথ গ্রহণের আবশ্যকতা রয়েছে। আবার অনেকের অভিমত, নবম ও দশম উভয় সংসদের সংসদ সদস্যদের আস্থাভাজন হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের প্রয়োজন নেই। আর সে কারণে একটি সংসদ অবলুপ্ত হওয়ার আগে অপর সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যের আস্থাভাজন হিসেবে শপথ গ্রহণ না করাই শ্রেয়। এমনও অভিমত রয়েছে, যদি বলা হয় নবম সংসদের সংসদ সদস্যদের আস্থাভাজন থাকাবস্থায় পদত্যাগ করে দশম সংসদের সংসদ সদস্যদের আস্থাভাজন হিসেবে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ লাভের জন্য পদত্যাগ করেছেন, সেক্ষেত্রে বলতে হবে তা অবশ্যই নবম সংসদের মেয়াদ অবসানের পর হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল।
এর আগে অনুষ্ঠিত রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট- এ চারটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পর দেখা গেছে, আগে নির্বাচিত সিটি মেয়রদের মেয়াদ অবসান না হওয়ার কারণে মেয়াদ অবসান পূর্ববর্তী তাদের শপথ অনুষ্ঠিত হয়নি। এ কারণে এ চারজন সিটি মেয়রের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান নির্বাচিত হওয়ার ৬ মাসাধিককাল পর অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং তাদের শপথ বাক্য পাঠ করিয়েছিলেন। এ বিষয়ে আইন বিশ্লেষকদের বক্তব্য, শপথ বিষয়ে নবনির্বাচিত সিটি মেয়রদের ক্ষেত্রে যে বিধান অনুসৃত হয়েছে, সংসদ সদস্যের ক্ষেত্রে এর ভিন্নতর কোনো বিধান অনুসরণের সুযোগ আছে কি? আর এ বিষয়ে সংবিধানের অনুচ্ছেদ নম্বর ১২৩(৩)(ক)-এর শর্তাংশ যখন সুস্পষ্ট, তখন এর বিপরীতে অন্য যে কোনো ধরনের অবস্থান গ্রহণের সুযোগ কতটুকু?
একটি সংসদ বহাল থাকাবস্থায় অপর সংসদের জন্য নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ তথা কার্যভার গ্রহণ বিষয়ে সংবিধানের অনুচ্ছেদ নম্বর ১২৩(৩)(ক)-এর শর্তাংশ, ৭২(৩), ১৪৮(২ক) ও (৩)-এর সম্মিলিত অধ্যয়নে প্রতীয়মান হয়, আগের সংসদের মেয়াদ অবসান ছাড়া এ ধরনের শপথ গ্রহণ সংবিধান অনুমোদন করে না। আর শপথ গ্রহণ যখন সংবিধান দ্বারা অননুমোদিত তখন আগের সংসদের মেয়াদ থাকাবস্থায় পদত্যাগ করে বা পদত্যাগ ছাড়া নতুন মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের সুযোগ আছে কি-না, ভবিষ্যতে যে কোনো বিতর্ক পরিহারের জন্য এ প্রশ্নটির সুরাহা জরুরি ছিল।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ; সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন