সম্পদ আহরণ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। সম্পদ আয়ের উৎস হতে পারে, আবার ভোগের বস্তু হিসেবে সরাসরি ব্যবহৃত হতে পারে। ভোগ-উপভোগ সাধারণ মানুষের জন্য বেঁচে থাকার এক মহা উপকরণ। 'ভোগের একটা আনন্দ আছে, সাময়িক নিবৃত্তি শেষ নয়, ভোগের ইচ্ছা বারবার ফিরে আসে। ভোগের ইচ্ছা নানা মোড়কে সাজানো; এ মোড়ক কখনো গানের, কখনো কান্নার, বিরহ কিংবা কোমল অনুভবের।' ভোগবাদী মানুষের কাছে ভোগানন্দের নতুন নতুন অভিজ্ঞতা জীবন থেকে পাওয়া এক মহা পুরস্কার। 'রূপ-রস, গন্ধ-স্বাদের অভিজ্ঞতায় আপনত্বের গভীরতা অনুভব করা।'
সম্পদ আহরণের একটি প্রকৃষ্ট পন্থা হচ্ছে ক্ষমতায় অধিষ্ঠান। ক্ষমতা মানে হচ্ছে, মানুষ ও বৈষয়িক উপাদানসমূহের ওপর নিয়ন্ত্রণের সামর্থ্য। ব্যক্তির স্থাবর-অস্থাবর ও আর্থিক সম্পদ এবং আইনগত অবস্থান তাকে ক্ষমতায়িত করে। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে তার মান-সম্মান, প্রভাব, শক্তি-সামর্থ্য বেড়ে যায়। এর সঙ্গে বেড়ে যায় তার সম্পদ আহরণ ও আয় বাড়ানোর সুযোগ-সুবিধা। সম্পদ, আয় ও ক্ষমতা একটি ফিরতি চক্রের (Feedback loop) সৃষ্টি করে। এই চক্রের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় ব্যক্তির সম্পদ একটানা বেড়ে চলে।
সম্পদ বাড়ানোর প্রক্রিয়াকে পৃথিবীর সব দেশেই আইনি-বেআইনি, নৈতিক-অনৈতিক পরিচয়ে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এ ধরনের বিভাজনপ্রক্রিয়া দেশ ও সমাজনির্দিষ্ট; এক দেশে বা এক সমাজে যা আইনি, অন্য দেশ বা সমাজে তা হয়তো বা বেআইনি। নৈতিকতার বিষয়টি তুলনামূলকভাবে বিশ্বজনীন হলেও বিভিন্ন সমাজের মধ্যে এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। তবে নিজ দেশের আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বা সামাজিক মূল্যবোধের পরিপন্থী কাজ করে যে ব্যক্তি নিজের পক্ষে সুবিধা নেয়, নিজের সম্পদ বাড়ায়, তাকে সমাজের লোক ভালো চোখে দেখে না। দেশের আইন অনুযায়ী সে দোষী, শাস্তি পাওয়ার উপযোগী। সহজ পরিচয়ে তাকে দুর্নীতিবাজ বলা হয়। লোকে তাকে মনে মনে ঘৃণা করে।
যারা অন্যায়ভাবে আয়-রোজগার করে বা সম্পদ আহরণ করে, তাদের আমাদের দেশে দুর্নীতিবাজ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যদিও দুর্নীতিবাজের সর্বগ্রাহ্য ধারণা নিয়ে বোদ্ধা মহলে কিছু মতানৈক্য পরিলক্ষিত হয়। দুর্নীতিবাজরা এই মতানৈক্যের সুযোগ নিয়ে সমাজে নিজেদের গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে চালিয়ে দিতে চেষ্টা করে। সমাজবিশ্লেষক হিসেবে আমি দুর্নীতিকে নিম্নরূপে সংজ্ঞায়িত করেছি : কোনো ব্যক্তি তার রাষ্ট্রীয়, সাংগঠনিক বা সামাজিক অবস্থান ব্যবহার করে যদি আইন, নিয়মবিধি- যার বিরুদ্ধে তিনি প্রকাশ্যে কোনো বক্তব্য, বিবৃতি রাখেননি- ভঙ্গ করে (এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে) নিজের বা আত্মীয়স্বজনের জন্য আর্থিক বা বৈষয়িক সুবিধা গ্রহণ করেন তবে তিনি দুর্নীতি করেছেন, এমনটি বলা যৌক্তিক হবে। শুধু আইন ভাঙার কারণে বা আইনের বাইরে গিয়ে নিজে কোনো সুবিধা না নিয়ে বঞ্চিত, অবহেলিত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা দিলে তাঁর সে কাজকে দুর্নীতিমূলক কাজ বলা যাবে না। মনের মধ্যে কোনো অশুভ উদ্দেশ্য না থাকলে নিজের অবস্থান ব্যবহার করে নগণ্য সুবিধা নেওয়াকে দুর্নীতি হিসেবে চিহ্নিত করা সমীচীন হবে না।
মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সুউচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের সম্পদ আহরণের যেসব কাহিনী সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, তা জেনে দেশের আপামর জনসাধারণ স্তম্ভিত হয়ে গেছে। রাজনীতিবিদদের আয়-ব্যয় সম্পর্কে অনেক রসাত্মক গল্প আমরা শুনেছি। সাধারণ মানুষ এ ব্যাপারে কিছুটা নমনীয় মনোভাব পোষণ করে। কিন্তু এবার সম্পদ আহরণের যে চিত্র আমরা দেখেছি, তা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। মন্ত্রীদের বার্ষিক আয়ের মূল উৎস হওয়ার কথা বেতন-ভাতা ও সরকার থেকে প্রাপ্য অন্য আইনানুগ সুবিধাদি, যার পরিমাণ বছরে ২০ লাখ টাকার কাছাকাছি। এ ছাড়া সঞ্চয়, শেয়ার বা অন্যান্য বিনিয়োগ ও বাড়ি ভাড়া থেকে কিছু বাড়তি আয় থাকতে পারে। আগে থেকে সম্পদশালী কিছু মন্ত্রী, পদস্থ ব্যক্তি কিংবা সংসদ সদস্য। এর পরিমাণ বড় জোর তিন-চার কোটি টাকা হতে পারে, তবে সে ক্ষেত্রে বার্ষিক আয়কর দিতে হবে কমপক্ষে কোটি টাকা। এ পরিমাণ আয়কর দিলে ট্যাক্স ভিআইপি হিসেবে তাঁদের নাম পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার কথা। আমরা সে ধরনের কিছু দেখিনি। অথচ হলফনামায় সম্পদ বিবরণীতে যা দেখেছি, তাতে মনে হয়েছে, অনেক মন্ত্রী, মহারথীর সম্পদের পরিমাণ ১০-২০ কোটি টাকা তো ছাড়িয়ে যাবে, ১০০ কোটি টাকাও ছাড়িয়ে যাওয়া বিচিত্র হবে না। এক সৌভাগ্যবান প্রতিমন্ত্রীর ২০ একর জমি বৃদ্ধি পেয়ে দুই হাজার ৮৬৫ একর হয়েছে। এ বৃদ্ধি রীতিমতো অলৌকিক মনে হয়, তবু আমাদের বিশ্বাস করতে হচ্ছে। বাংলাদেশের আইনে এক ব্যক্তি বা পরিবার এত জমির মালিক হতে পারে কি না, তাও খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। উদ্যোগ, উদ্যম ও বৈষয়িক বুদ্ধির ঘাটতির কারণে গরিব মানুষের উন্নতি না হলেও আমাদের মন্ত্রী-এমপিরা যে উদ্যোগী, বুদ্ধিমান ও করিতকর্মা, তার প্রমাণ আমরা হাতেনাতে পেয়েছি।
উদ্বেগের বিষয় হলো, এ সম্পদের বৃহদাংশ দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে বলে নাদান সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে। ভিআইপিদের একাংশের নামে আগেই বদনাম ছিল যে তাঁরা দুর্নীতির মাধ্যমে অঢেল অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন। তাঁদেরকে লোকজন সেভাবেই দেখে, দুর্নীতিবাজ জানা সত্ত্বেও তাদের ভোট দেয়; এমপি, মন্ত্রী বানায়। ভোটারদের দৃষ্টিভঙ্গি হলো 'পাপকে ঘৃণা কর, পাপীকে নয়।' তাঁদের সংখ্যা বেশি নয় বলে এত দিন সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল; সে জন্য সাধারণ্যে এ নিয়ে বড় রকমের হৈচৈ হয়নি। এবার মানুষ দেখতে পেয়েছে যে উচ্চপদে আসীন প্রায় সব ব্যক্তিই মাত্র কয়েক বছরে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। তাদের বিশ্বাস ভঙ্গ করে দেশের সম্পদ তথা তাদেরই সম্পদ লুটপাট করে নিয়ে গেছেন। মনে হচ্ছে, একটি সিন্ডিকেট আলাপ-আলোচনা ও নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে সুচারুরূপে এ কাজটি সম্পন্ন করেছে। অবশেষে একে অপরের পিঠ চাপড়ে সম্পদ আহরণের উৎসব পালন করেছে। কেউ তাদের বাধা দিয়েছে বা তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোর আওয়াজ তুলেছে বলে মনে হয় না।
এবারের সম্পদ লুটপাটকারীদের মধ্যে এমন লোকজন রয়েছে, যাদের ব্যাপারে আগে কোনো সময় লুটপাটের অভিযোগ শোনা যায়নি। এলাকার ভোটার ও সাধারণ বাসিন্দারা তাদের সজ্জন হিসেবে জানত। ক্ষমতা পাওয়ার পর মানুষগুলো কেমন যেন বদলে গেল! আইনানুগ যে পারিতোষিক পাওয়া যায়, তাতে তাদের মন ভরে না, যদিও এর পরিমাণ আনুমানিক মাসে দেড় থেকে পৌনে দুই লাখ টাকা। এর সঙ্গে ডিউটি ফ্রি গাড়ি ও অন্যান্য বাড়তি সুবিধা তো রয়েছেই। অনুপার্জিত আয়ের অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ তাদের উতলা করে তোলে। 'দিবস-রজনী' তারা যেন সেই আয়ের 'আশায়' থাকে। বাড়তি সেই আয় না এলে মেজাজ খিটমিটে হয়ে যায়, শরীর ম্যাজম্যাজ করে, কাজকর্মে মন বসে না। দুর্নীতির স্বাদ না পেলে ক্ষমতার সালুন নিতান্তই পানসে হয়ে যায়। এ কাজে উৎসাহ-উসকানি দেওয়ার লোকের খুব একটা অভাব হয় না। পরিবারের সদস্যবৃন্দ, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, এমনকি ময়-মুরবি্ব অনেকেই এ ধরনের অন্যায়-অনৈতিক কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন জোগায়। একে আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের মধ্যে স্ববিরোধিতা অথবা এর অবক্ষয় বলা যেতে পারে। যারা তাদের মনে মনে ঘৃণা করে, তারাও প্রকাশ্যে কিছু বলে না।
দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য রাষ্ট্রীয় ও যে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে, এ ক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতা সচেতন নাগরিকদের হতাশ করেছে। বিশেষ করে দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো একটি বিশাল সংস্থার অগোচরে কিভাবে এই মারাত্মক দুর্নীতি ঘটল, তা সাধারণ পাঠকের বোধগম্য হবে না। ব্যক্তি পর্যায়ে অন্যায়ভাবে সম্পদ সংগ্রহের সম্পর্কে খোঁজখবর রাখা, গোপনে তথ্য সংগ্রহ করা, তদন্তের মাধ্যমে দুর্নীতির অবস্থান নির্ণয় ও দুর্নীতিবাজকে শনাক্তকরণ এ সংস্থার প্রধান উপজীব্য। দুর্নীতিমূলক কাজের অগ্রিম আভাস পর্যবেক্ষণ-পর্যালোচনা করে অথবা দুর্নীতির প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নিয়ে দুর্নীতিকে অঙ্কুরে চাপের মুখে রাখতে পারলে দুর্নীতিযুক্ত কর্মকাণ্ডগুলো এত বড় মহীরুহে রূপান্তরিত হতে পারে না। দুর্নীতির বীজ অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয় অথবা ছোট গাছ থাকা অবস্থায় মাটিতে নুয়ে পড়ে, ডালপালা গজানোর সুযোগ পায় না। দুর্নীতি দমন কমিশন ও মিডিয়াসহ সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর এ ব্যাপারে আরো তৎপর হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। তাদের সাংগঠনিক কাঠামো ও কর্মপদ্ধতির আমূল পরিবর্তন ছাড়া এ ব্যাপারে সংস্থাগুলোকে কার্যকর করা সম্ভব হবে না।
দুর্নীতির ব্যাপারে আমাদের মানসিকতা পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে। এ দেশের মানুষ আগে দুর্নীতিবাজদের প্রকাশ্যে ঘৃণা করত; ঘৃণা তাদের চোখেমুখে ফুটে উঠত। গত কয়েক দশকে আমরা যেন দুর্নীতির সঙ্গে আপস করে ফেলেছি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঘৃণার চেয়ে ক্ষমতার প্রতি আকর্ষণ প্রবলতর হয়ে পড়েছে। দুর্নীতিবাজ ক্ষমতাধর হলে আমরা অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য তার প্রতি ঝুঁকে পড়ছি। তাকে সুযোগ মতো প্রশংসা করছি।
ফলে দুর্নীতিবাজ উৎসাহিত বোধ করছে। এই প্রবণতার রাস টেনে ধরতে হবে। সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে দুর্নীতিকে পেছনে টেনে আনতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্লোগান ও দৃশ্যমান কর্মকাণ্ড আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি হতে পারে। এ বাস্তবতা হয়তো বা বেশি দূরে নয়। মানুষের ধারণা ও মানসিকতা পরিবর্তন সময়সাপেক্ষ। তবে একটি ঘটনা, একটি ধাক্কা কোনো কোনো সময় হঠাৎ করেই মানুষের মনে আলোড়ন তুলতে পারে, তার মনোভাব আমূল বদলে দিতে পারে। মন্ত্রী, এমপিদের দুর্নীতির খবর এ দেশের জন্য হতে পারে তেমনি একটি ঘটনা।
লেখক : সাবেক সচিব, পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন