মীরজাফর-লেন্দুপরা চিরদিনের জন্য অভিশপ্ত
04 Jan, 2014
ভারতবর্ষের এক বিস্তৃত অঞ্চল বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার শাসনভার লাভ করেছিলেন নবাব আলীবর্দী খার দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলা। সিরাজউদ্দৌলা আলীবর্দী খার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নবাব পদে আসীন হয়ে শাসন ক্ষমতা লাভ তার অপর কন্যা ও দৌহিত্রদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তাই শাসনভার লাভের আগে যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল, তা শাসনভার গ্রহণ পরবর্তী অব্যাহত থাকে। এরই সুযোগ নেয় ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির চতুর করণিক কাইভ। কাইভ তার কার্যসিদ্ধিতে সহযোগী হিসেবে পান মীরজাফর, জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, রায়দুর্লভ ও ঘষেটি বেগমকে। ইতিহাসে যদিও বিশ্বাসঘাতক হিসেবে মীরজাফরের নামটি সবার আগে, কিন্তু অন্যদের বিশ্বাসঘাতকতা সমরূপ বললে অত্যুক্তি হবে না। অনুরূপ সিকিমের স্বাধীনতা ভারতের হাতে তুলে দেয়ার ক্ষেত্রে লেন্দুপ দর্জির সহযোগী হিসেবে সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেসের (এসএনসি) শীর্ষ নেতৃত্বের ন্যূনপক্ষে দু-তিনজনের নাম চলে এলেও লেন্দুপ নামটির কাছে অন্যান্য নাম ম্লান হয়ে যায়, ঠিক যেমনটি ঘটেছে মীরজাফরের ক্ষেত্রে।
আমাদের বাংলাদেশে ও বাংলা সাহিত্যে মীরজাফর নামটি বিশ্বাসঘাতকের প্রতিশব্দ বা সমার্থক শব্দ হিসেবে ঠাঁই করে নিয়েছে। মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতা ও ষড়যন্ত্রে বাংলার স্বাধীনতা ইংরেজদের হাতে সমর্পণ পরবর্তী অদ্যাবধি মীরজাফর বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিচ্ছবি হিসেবে চিহ্নিত। বিশ্বাসঘাতকতা পরবর্তী মীরজাফর স্বল্প সময়ের জন্য বাংলার মসনদে আরোহণ করে আত্মতৃপ্তি লাভ করলেও অচিরেই তার ও তার ছেলের করুণভাবে জীবনের যবনিকাপাত ঘটলে সে আত্মতৃপ্তি চিরদিনের জন্য তার পরিবারের সদস্য ও অনুরাগীদের কাছে আত্মজ্বালা হিসেবে দেখা দেয়।
হিমালয়ের দক্ষিণ কোলঘেঁষে পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত পাশাপাশি অবস্থিত তিনটি দেশ বংশানুক্রমিকভাবে কয়েক শতক ধরে রাজার মাধ্যমে শাসিত ছিল। এ তিনটি দেশের দু’টি দেশ নেপাল ও ভুটান বর্তমানে স্বাধীন রাষ্ট্র। অপর দিকে এ দু’টির মাঝখানে অবস্থিত সিকিমের পায়ে আবদ্ধ হয়েছে পরাধীনতার শিকল।
পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী বৌদ্ধ গুরু পদ্মসম্ভবা অষ্টম শতাব্দীতে সিকিম সফর করেন এবং সেখানকার অধিবাসীদের বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা দিয়ে রাজতন্ত্রের ভবিষ্যদ্বাণী করেন। ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি সিকিমে নামগিয়েল রাজবংশ রাজ্য শাসনের কর্তৃত্ব লাভ করে এবং সে কর্তৃত্ব তিন শতকেরও বেশি সময় ধরে ভারত কর্তৃকস্বাধীনতা হরণ পর্যন্ত অক্ষুণœ থাকে। নামগিয়েল বংশের শাসন অব্যাহত থাকাকালে প্রথম ষার্ধশতকে সিকিম পুনঃপুন নেপালি আক্রমণকারীদের আগ্রাসী অভিযানে রাজ্যের ভূমি হারানোসহ লুণ্ঠনের কবলে পড়ে। পরে উপমহাদেশটিতে ব্রিটিশেদের শাসনকালে সিকিম ব্রিটিশদের সাথে মিত্রতা বন্ধনে আবদ্ধ হলে নেপাল সর্বাত্মক শক্তি দিয়ে সিকিমের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এ যুদ্ধে সিকিমের বেশির ভাগ অঞ্চল নেপালের কাছে হাতছাড়া হয়ে যায়। এরপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অষ্টাদশ শতকের প্রারম্ভে নেপাল আক্রমণ করলে গুর্খা যুদ্ধের প্রাদুর্ভাব হয় এবং এ যুদ্ধ-পরবর্তী সিকিম নেপালের সাথে সুগাউলি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে দখল করা ভূমি ফেরত পায়। ভারতের পশ্চিম বাংলার দার্জিলিং জেলা একসময় সিকিমের অংশ ছিল। অষ্টাদেশ শতকের তৃতীয় দশকের মাঝামাঝি সিকিম সামান্য অর্থের বিনিময়ে দার্জিলিং শহরের মালিকানা ব্রিটিশদের নিকট হস্তান্তরে বাধ্য হয় এবং এর কিছুকাল পর সম্পূর্ণ দার্জিলিং জেলা ও মোরাং অঞ্চল ব্রিটিশদের হস্তগত হয়। উপমহাদেশটিতে ব্রিটিশ শাসনকালে ব্রিটিশরা সিকিমের রাজাকে স্বাধীনসত্তা বজায় রেখে দেশ পরিচালনার নিশ্চয়তা দেয়।
সিকিম স্থলবেষ্টিত হিমালয় পাদদেশের একটি রাজ্য। এর পশ্চিমে নেপাল, উত্তরে চীনের তিব্বত, পূর্বে ভুটান ও দক্ষিণে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য। সর্বশেষ ২০১১ এ অনুষ্ঠিত আদমশুমারি অনুযায়ী সিকিমের লোকসংখ্যা ছয় লাখ ১১ হাজারের কাছাকাছি। সিকিম গোয়া এরপর ভারতের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম রাজ্য। পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্গা সিকিম নেপাল সীমানায় অবস্থিত। সিকিমের আয়তন সাত হাজার ৯৬ বর্গ কিলোমিটার বা ২ হাজার ৭৪০ বর্গমাইল। এটি ভারতের সবচেয়ে কম জনবসতিপূর্ণ রাজ্য।
ব্রিটিশদের কাছ থেকে উপমহাদেশের স্বাধীনতা লাভ পরবর্তী জওয়াহেরলাল নেহরু ভারতের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে গণভোটের মাধ্যমে সিকিমকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা করা হলেও তা ব্যর্থ হয়। কিন্তু নেহরুর শাসনামল থেকেই সিকিম ভারতের বিশেষ আশ্রিত রাজ্য হিসেবে পরিগণিত হতে থাকে এবং এর প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ ভারত নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। ভারতের সাথে চীনের সিকিমের নাথুলা পাস বা গিরিপথ দিয়ে একমাত্র স্থল যোগাযোগ ছিল। ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধের পর এ পাসটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল, যা পরে ২০০৬ সালে খুলে দেয়া হয়।
নামগিয়েল রাজবংশের শেষ রাজা চগিয়াল পান্ডেল থন্ডুপ নামগিয়েল ১৯৬৫ সালে সিংহাসন আরোহণ করেন। রাজার আমেরিকান স্ত্রী হুপ কুক সিকিমের সাবেক সম্পদের প্রত্যাবর্তনবিষয়ক নিবন্ধ লিখলে ভারত চরমভাবে অসন্তুষ্ট হয়। ১৯৭৪ সালে সিকিমে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাতে ৩২ আসনের পার্লামেন্টে লেন্দুপ দর্জির নেতৃত্বাধীন এসএনসি ৩১টি আসনে জয়ী হয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে সরকার গঠন করে। সরকার গঠন পরবর্তী সিকিমকে ভারতভুক্ত করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৯৭৫ সালের ২৭ মার্চ লেন্দুপ দর্জির মন্ত্রিসভা সিকিমের রাজতন্ত্র বিলোপের সিদ্ধান্ত নেয় । এরপর সিদ্ধান্তটি পার্লামেন্টে অনুমোদন পরবর্তী চার দিনের মাথায় সাজানো ও পাতানো গণভোটের আয়োজন করে বলপ্রয়োগে সিকিমকে ভারতভুক্ত করা হয়।
গণভোট বিষয়ে সিকিমের সচেতন জনগোষ্ঠীর অভিমত গণভোটটি ছিল নেহায়ত একটি আনুষ্ঠানিকতা। মূলত গণভোট অনুষ্ঠানের আগেই সিকিমের সর্বত্র ছদ্মবেশে ভারতীয় পুলিশ ও সৈন্যদের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে, যারা বন্দুকের ভয় দেখিয়ে সিকিমের নাগরিকদের গণভোটের সপক্ষে ভোটদানে বাধ্য করেছিল।
সিকিমের নামগিয়েল রাজবংশ বৌদ্ধধর্মাবলম্বী হলেও রাজ্যের অর্ধেকেরও বেশি নেপালি বংশোদ্ভূত হিন্দু জনগোষ্ঠী বৌদ্ধ রাজার শাসনকে কখনো তাদের স্বার্থের অনুকূলে ভাবেনি।
১৯৭৩-৭৫ সালে বৌদ্ধ রাজার বিরুদ্ধে আন্দোলন চলাকালে দেখা গেছে সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেসের প্রতি ভারতের সমর্থন এতই প্রকাশ্য ছিল যে, রাজার বিরুদ্ধে আন্দোলনে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী স্থানীয় সিকিমিদের অংশ নেয়া নগণ্য হওয়ায় বিক্ষোভকে ব্যাপকতর করার প্রয়াসে দার্জিলিংসহ ভারতের আশপাশের এলাকা থেকে লোক এনে বিক্ষোভ সংগঠিত করা হতো এবং সবাইকে অবাক করার মতো ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা সাদা পোশাকে সিকিমে ঢুকে এসব বিক্ষোভে অংশ নিত। ক্ষমতাচ্যুত রাজা চগিয়ালের এডিসি হিসেবে কর্মরত ক্যাপ্টেন সোনাম ইয়াংদার ভাষ্য থেকে ওপরের বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায়।
সিকিমে রাজতন্ত্রবিরোধী বিক্ষোভ ভারতের মদদে যখন বেড়ে যায়, তখন ভারতের পক্ষ থেকে ভয় ছিল, সিকিমের অস্থিতিশীলতার সুযোগে চীন এটিকে তিব্বতের অংশ দাবি করে চীনের অন্তর্ভুক্তির প্রচেষ্টা চালাবে। কিন্তু রাজা চগিয়াল রাজতন্ত্র রক্ষার ক্ষেত্রে ভারত সবসময় সচেষ্ট থাকবে এ বিশ্বাসে কখনো চীনকে তার নিজ দেশের অভ্যন্তরীণ গোলযোগে বিজড়িত করতে চাননি।
সিকিমের ক্ষেত্রে ভারতকে বরাবরই দ্বৈত ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। ভারত সবসময় রাজা চগিয়াল লামডেনকে বলে এসেছে যেকোনো মূল্যে সিকিমের রাজতন্ত্র রক্ষা করতে হবে। আর অন্য দিকে লেন্দুপ দর্জিকে বলে আসছিল যেকোনো কিছুর বিনিময়ে হলেও রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করতে হবে। ভারতের মিথ্যা আশ্বাসে সরল রাজা পরে বোকা বনলেও সে আশ্বাস ক্ষণকালের জন্য হলেও লেন্দুপ দর্জির মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আশা পূরণ করেছিল।
সিকিমের পাশে ভুটান ১৯৭১ সালে জাতিসঙ্ঘের সদস্যপদ লাভ করে। ভুটানের পথ ধরে সিকিম স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জাতিসঙ্ঘের সদস্যপদ লাভ করলে তা যে সিকিমের ভারতভুক্তির ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে দেখা দেবে, সে বিষয়টি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সঠিকভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তা ছাড়া কৌশলগত কারণে হিমালয়ের কোলে নেপাল ভুটানের মতো ভারত-চীন সীমান্তে তৃতীয় একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটুক, তা ভারত কখনো চায়নি।
১৯৭৫ সালে সিকিম ভারতের অন্তর্ভুক্ত হলে লেন্দুপ দর্জি ভারতের ২২তম রাজ্যের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। কিন্তু তার সে গৌরব চার বছরের মাথায় ভূলুণ্ঠিত হয়। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে দেখা গেল পূর্ববর্তী নির্বাচনে একটি আসন বাদে অবশিষ্ট সব আসনে নিরঙ্কুশ বিজয়ী দল এসএনসি একটি আসন লাভেও সমর্থ হয়নি। এক সময়ের পরাক্রমশালী মুখ্যমন্ত্রী লেন্দুপ দর্জি নির্বাচনে তার মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়ে দেখেন ভোটার তালিকায় তার নামটি পর্যন্ত নেই। যদিও এর মাধ্যমে তিনি বুঝতে পারেন নেপথ্যে শক্তি ভারত তার রাজনৈতিক জীবনের ইতি টেনে দিয়েছে। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। নামগিয়েল রাজবংশের অবসান ঘটাতে গিয়ে লেন্দুপ দর্জি ইতিহাসসমৃদ্ধ ঐতিহ্যবাহী একটি স্বাধীন রাজ্যের সার্বভৌমত্ব ভারতের হাতে তুলে দেন। তার এ কাজের জন্য তাকে এক অভিশপ্ত জীবন বয়ে বেড়াতে হয়। রাজনীতি থেকে বিদায়-পরবর্তী নিজ মাতৃভূমি সিকিমে বাস করার মতো তার জন্য সহায়ক পরিবেশ ছিল না। শেষ জীবনে তাকে অনেকটা বাধ্য হয়েই প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিংয়ের কালিমপং শহরে ভীতসন্তস্ত্রভাবে একাকী, নিঃসঙ্গ ও নিন্দিত জীবনযাপন করতে হয়েছে।
ক্ষমতা হারানো-পরবর্তী নির্বাসিত জীবনযাপনকালে লেন্দুপ দর্জিকে আক্ষেপের সাথে বলতে শোনা গেছে, কার্য হাসিলের আগে জওয়াহেরলাল নেহরু ও ইন্দিরা গান্ধী তাকে সবসময় উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাতেন। কিন্তু যে মুহূর্ত থেকে তাদের অভীষ্ট উদ্দেশ্য সফল হয়েছে, তখন থেকে তাকে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করা হয়। ভারত সরকার ও রাজ্য সরকারের দেয়া ‘পদ্মভূষণ’ ও ‘সিকিম রতœ’ উপাধি বিষয়ে তার মন্তব্য ‘নিজ দেশের জনগণের কাছে আমি যখন প্রত্যাখ্যাত, তখন এ উপাধি দুইটি আমার কাছে কোনো অহঙ্কারের বস্তু নয় বরং গলার কাঁটাস্বরূপ।’ লেন্দুপ দর্জি ১০৩ বছরের দীর্ঘায়ু লাভ করেছিলেন, কিন্তু তার শেষ জীবন ছিল স্ত্রী, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধববিবর্জিত অসহনীয়, অপমানিত, নিঃসঙ্গ ও একাকিত্বের জীবন। নিজ দেশের স্বাধীনতা ভারতের হাতে তুলে দিয়ে দেশের মাটি ও জনগণের সাথে তিনি যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, এ বিষয়ে তার আত্মোপলব্ধি অন্তর্জ¡ালা ও হতাশা প্রশমনে কিছুটা সহায়ক হলেও তা কি হারানো স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিতে পেরেছিল?
সিকিমসহ ভারতের অনেক রাজ্যের নাগরিকদের ভাষা, কৃষ্টি, সভ্যতা, ধর্ম প্রভৃতি হিন্দি ভাষাভাষী ভারতীয়দের থেকে আলাদা এবং এ বিষয় উপলব্ধি করতে পেরেই ১৯৭৮ সালে ইন্দিরা গান্ধী পরবর্তী ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই বলেছিলেন, সিকিমের ভারতে অন্তর্ভুক্তি ঐতিহাসিক ভুল। কিন্তু কালের ব্যবধানে তিস্তা নদী দিয়ে অনেক পানি গড়িয়ে ভাটিতে চলে যাওয়ায় এখন কি আর সে ভুল সুধরাবার সময় আছে?
স্বেচ্ছায় নির্বাসনে থাকাকালে লেন্দুপ দর্জি স্বাধীনতা বিক্রির দায় তার একার নয়Ñ এরূপ বক্তব্য দিতে চাইলে এসএনসির কোনো নেতা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা হতে বিরত থাকেন। ভারতের কূটকৌশলে একদা জননন্দিত লেন্দুপ দর্জি জননিন্দিত হয়ে নির্বাসনে থাকাকালে অবহেলিতভাবে অবমাননাকর ও অপমানজনক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে তার সে মৃত্যু সিকিমবাসীর মধ্যে কোনো ধরনের দুঃখের উদ্রেক করেনি এবং এমনকি ব্যথিত হয়ে কাউকে কোনো ধরনের সহমর্মী ও সহানুভূতিশীল বক্তব্য দিতেও দেখা যায়নি। একেই বলে বিশ্বাসঘাতকের ভাগ্যের নির্মম পরিহাস।
সপ্তদশ শতকের মীরজাফরের মতো ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধের লেন্দুপ দর্জি ইতিহাসের একজন বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত। মীরজাফরের নামটি উচ্চারণের সাথে সাথে যেমন বাঙালি মুসলমানদের মুখ দিয়ে ঘৃণাভরে থুতু নির্গত হয়, ঠিক তেমন সিকিমবাসীর লেন্দুপ দর্জির ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম কিছু হয় না।
যেকোনো জাতি ও দেশের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করার জন্য মীরজাফর ও লেন্দুপ দর্জির মতো ঘৃণিত ও কুলাঙ্গার মানুষের জন্ম। দেশের স্বার্থের প্রতিকূলে অবস্থান নিয়ে যেকোনো দেশের শীর্ষ নেতৃত্ব বিদেশী যেকোনো শক্তির সহায়তায় ক্ষমতায় টিকে থাকা প্রলম্বিত করতে পারলেও তা যে অবশেষে ফলদায়ক হয় না এ দু’জন ঘৃণিত ও কুলাঙ্গারের অভিশপ্ত জীবন ও করুণ পরিণতি হতে এ শিক্ষা লাভ করতে পারলে ভবিষ্যতে হয়তো আমাদের দেশের আর কোনো শীর্ষ নেতা ভুল পথে পা বাড়াবেন না।
আমাদের যেকোনো শীর্ষ নেতার স্মরণে রাখা প্রয়োজন দেশের স্বার্থের প্রতিকূলে অবস্থানের ক্ষেত্রে সুবিধাভোগী অনেকে সহযোগী হলেও ইতিহাসের বিচারে দায় মীরজাফর ও লেন্দুপের মতো অপর কারো বহন করে চিরদিনের জন্য বংশপরম্পরায় অভিশপ্ত হতে হবে না। সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
(নয়া দিগন্ত, ০৪/০১/২০১৪)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন