|
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী
|
|
জামায়াত নিয়ে বিএনপির উভয় সংকট
02 Jan, 2014
আমাদের জাতীয় রাজনীতি এখন গভীর গিরিখাতের অতল অন্ধকারে। কতটা অতলে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে সোমবার সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে দুই প্রধান জোটের নেতা-কর্মীদের সম্মুখ সমরে। পরিস্থিতি খারাপের দিকে গড়াতে পারে সে আশংকা সবার মনেই ছিল। কিন্তু এভাবে একেবারে দেশের সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে এরকম ঘটনা ঘটবে তা বোধহয় কারও কল্পনাতেও আসেনি। বর্ষীয়ান আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার রফিক উল হক এক কথাতেই বলেছেন, ‘সুপ্রিমকোর্টের জানাজা হয়ে গেছে।’
আমাদের পেশাজীবীরা, বিশেষ করে সাংবাদিক, শিক্ষক ও আইনজীবীরা যেভাবে দলীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন তার পরিণতি কখনোই শুভ হতে পারে না। জাতীয় প্রেস ক্লাব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণেও প্রায় অনুরূপ ঘটনা ঘটেছে। যারা কথায় কথায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেন, তারা জাতীয় পতাকা কিংবা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পতাকা হাতে নিয়ে সেদিন যে নিষ্ঠুর বর্বরতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন, তাকে আর যা-ই হোক মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বহিঃপ্রকাশ বলা যাবে না।
একই পেশায় নিয়োজিত উচ্চশিক্ষিত সহকর্মীদের, নবীন-প্রবীণ নির্বিশেষে, এভাবে পরস্পরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার দৃষ্টান্ত সারা দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ যেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা।
রাজনীতির ‘সাম্প্রদায়িক’ বিভাজন?
আমাদের রাজনৈতিক বিভাজন কি ‘সাম্প্রদায়িক’ বিভাজনের রূপ নিতে চলেছে?
‘সাম্প্রদায়িকতা’ বলতে সাধারণভাবে বোঝানো হয় ধর্মীয় সংঘাত। এক ধর্মের লোকের সঙ্গে অন্য ধর্মের লোকদের বৈরী অবস্থান। ঘৃণা-বিদ্বেষ বা শত্র“তামূলক আচরণ, যা মাঝে-মধ্যে প্রত্যক্ষ দাঙ্গা-হাঙ্গামার রূপ ধারণ করে।
রাজনৈতিক মতবাদ বা দলীয় পরিচয়ও যে ‘সাম্প্রদায়িকতা’র রূপ নিতে পারে, আজকের বাংলাদেশ কি তারই দৃষ্টান্ত হয়ে উঠছে? দেশ এখন যেন দুটি বিশেষ সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছে : ‘আওয়ামী’ ও ‘জাতীয়তাবাদী’। যে বিভাজন মানুষে মানুষে ধর্মীয় বিভাজনের চেয়েও বেশি দূরত্ব সৃষ্টি করছে। দুই দলের রাজনৈতিক অবস্থান ও মতাদর্শ এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন দু’য়ের বিভেদ ধর্মীয় বিভেদের মতো অলংঘনীয়।
অবশ্য দুই পক্ষের রাজনৈতিক অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গিতে ধর্মীয় বিভাজনের ছাপ নেই, সে কথাও বলা যাবে না। এক পক্ষ দক্ষিণমুখী হতে হতে একেবারে ‘ধর্মান্ধতা’র ছাতার নিচে চলে গেছে। অপর পক্ষ ‘অসাম্প্রদায়িক’ হতে গিয়ে এখন ‘ধর্মবিদ্বেষী’ বা ‘ইসলামবিরোধী’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ফলে দেশের রাজনীতি এখন কার্যত ধর্মান্ধতা ও ধর্মবিদ্বেষ (ইসলাম বিদ্বেষ?)- এই দুই ধারার ‘সাম্প্রদায়িক’ সংঘাতের রূপ নিয়েছে।
বিএনপির ‘দক্ষিণায়ন’
এই প্রক্রিয়া বিএনপির জন্য বিশেষভাবে বিব্রতকর হয়েছে। বর্তমান আওয়ামী সরকার বেশ কয়েকজন জামায়াত নেতাকে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ‘মানবতাবিরোধী’ অপরাধের অভিযোগে বিচারের সম্মুখীন করেছে। সেই বিচারে ইতিমধ্যে কয়েকজনকে ফাঁসির দণ্ড দেয়া হয়েছে। একজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। এ নিয়ে দেশে-বিদেশে বেশ তোলপাড় চলছে। জামায়াতে ইসলামী নতুন করে ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ ও ‘যুদ্ধাপরাধী’দের দল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সেই জামায়াতে ইসলামী বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোটের অন্যতম শরিক হওয়ায় তার দায় এখন বিএনপির কাঁধে। ফলে বিএনপি উভয় সংকটে। শ্যাম রাখি, না কুল রাখি!
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে বলা হয় ‘স্বাধীনতার ঘোষক’। ১৯৭১ সালের ২৬-২৭ মার্চ তিনি চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে যে ঘোষণা দিয়েছিলেন তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব খাটো করে দেখা যাবে না। বিএনপি বরাবর দাবি করে আসছে যে, জিয়ার সেই ঘোষণার মধ্য দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের সূচনা, যার পরিণতিতে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তার পেছনে এটি ছিল অন্যতম কারণ। আর সে কারণেই আওয়ামী লীগের বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও আশির দশকে বিএনপিও স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তি হিসেবে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
সেই বিএনপি কি-না জোট বেঁধেছে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে! জামায়াত নেতারা একাত্তরে কে কোথায় কাকে তখন হত্যা করেছেন বা হত্যায় সহায়তা করেছেন- তা বিচার সাপেক্ষ। কিন্তু তারা যে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন, ন্যায়-অন্যায় সব পথে, সে ব্যাপারে বিতর্কের সুযোগ নেই।
স্বাধীনতার পর সরকার কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে জামায়াতে ইসলামীকে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল কি-না মনে করতে পারছি না। তবে ওই সময় প্রকাশ্য রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করার কথা সম্ভবত দলটির নেতা-কর্মীরা কেউই ভাবেননি। বস্তুত পাকিস্তানের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে দলটির বিলুপ্তি ঘটাই ছিল প্রত্যাশিত।
শুধু রাজনৈতিক মতাদর্শ বা অবস্থানের ভিন্নতার কারণে কোনো দলকে নিষিদ্ধ করা গণতন্ত্রের রীতি হতে পারে না। একাত্তরে কেউ যদি মনে করে থাকেন যে, পাকিস্তান ভেঙে গেলে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠী বৈরী অবস্থানে নিক্ষিপ্ত হবে, সে জন্য তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে না। ওটা রাজনৈতিক অবস্থান। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়ের মধ্য দিয়ে তার জবাব দেয়া হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের পর পরিবর্তিত বাস্তবতা অনুধাবন করে এই শ্রেণীর লোকেরা যদি নবগঠিত রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য পোষণ করে নতুনভাবে রাজনীতি করতে চায় তাহলে তাদের সেই সুযোগ দেয়া আবশ্যক।
কিন্তু যারা ওই সময় পাকবাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যায় অংশ নিয়েছে, তারা স্পষ্টতই দেশদ্রোহিতা ও যুদ্ধাপরাধ করেছে, তাদের আইনের মুখোমুখি করা অবশ্যই যথাযথ পদক্ষেপ। তবে এক্ষেত্রেও বাস্তবতা ও পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় নিয়ে অগ্রসর হওয়া বাঞ্ছনীয়, যাতে করে হিতে বিপরীত ঘটে না যায়। যে কোনো রাজনৈতিক পদক্ষেপে লাভ-ক্ষতির বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিবেচনায় থাকা আবশ্যক। জাতি গঠনের প্রক্রিয়ায় এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাম্প্রতিক ইতিহাসে দক্ষিণ আফ্রিকা বা ভিয়েতনাম থেকে আমরা সেই শিক্ষা নিতে পারি। বঙ্গবন্ধু সেই পথেই এগিয়েছেন।
পাকিস্তান আমলে জামায়াতে ইসলামীর অন্যতম প্রধান তাত্ত্বিক ছিলেন মাওলানা আবদুর রহীম। তিনি দলটির পূর্ব পাকিস্তান শাখার আমীরও ছিলেন। মাওলানা রহীম মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক বাহিনীর কার্যকলাপে অসন্তুষ্ট ছিলেন। একাত্তরে তার দল যা করেছে তার অনেক কিছুতে তার সমর্থন ছিল না। তিনি মনে করতেন, একাত্তরের সব দায়ভার মাথায় নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী নামে দল পরিচালনা করা ঠিক হবে না। তাই তিনি ‘ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ- আইডিএল’ নামে একটি নতুন দল গঠন করেছিলেন।
১৯৭৮ সালের দিকে জিয়াউর রহমান ‘রাজনৈতিক দল বিধি অধ্যাদেশ- পিপিআর’ জারি করেন। ওই আইনের অধীনে দেশের সব রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন করতে বলা হয়। মাওলানা আবদুর রহীম জামায়াতে ইসলামী নামে দল পুনরুজ্জীবনের বিরোধিতা করেন। তিনি ‘ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ’ নামেই দলীয় কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। কিন্তু অধ্যাপক গোলাম আযমের নেতৃত্বে দলের অন্যরা তাতে রাজি না হয়ে জামায়াতে ইসলামীর পুনরুজ্জীবন ঘটান এবং তা যথারীতি নিবন্ধিত হয়। মাওলানা রহীমের আইডিএল রাজনীতির মঞ্চ থেকে হারিয়ে যায়।
আজকের দিনের পরিস্থিতির দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট যে, ‘জামায়াতে ইসলামী’ নামে দলটির পুনর্গঠন বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ জিয়াউর রহমান সেই সুুযোগ অবারিত করে একাত্তরের দানবটিকে বংলাদেশের রাজনীতির স্কন্ধে সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো চেপে বসে থাকার সুযোগ দিয়েছেন। একই কারণে আজকের দিনেও এই দলের সাধারণ নেতা-কর্মী এবং সমর্থকদেরও একাত্তরের দায়ভার বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। একাত্তর সালে যাদের অনেকের জš§ই হয়নি।
এক্ষেত্রে মাওলানা আবদুর রহীমের দূরদর্শিতা লক্ষ্য করার মতো। জামায়াত নেতারা তার পরামর্শ মেনে নিলে হয়তোবা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন হতো। আইডিএল গঠিত হওয়ার পর ১৯৭৭ সালের দিকে আমি দু’বার তার নাখালপাড়ার বাসভবনে গিয়ে কথা বলে তার রাজনৈতিক অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গি জানার চেষ্টা করেছিলাম। আমরা ‘দেশবাংলা’য় তার একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকারও ছাপিয়েছিলাম।
রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধিত হতে দিলেও জিয়াউর রহমান জামায়াতে ইসলামী থেকে দূরত্ব বজায় রাখার নীতি অনুসরণ করেছেন। এই কাজটি যে তিনি সচেতনভাবেই করেছেন তা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি। জিয়ার মৃত্যুর পরেও বিএনপির রাজনীতিতে এই নীতি বজায় থেকেছে।
১৯৮৩ সালে এরশাদের সামরিক স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে ‘৫-দফা’ দাবিনামার ভিত্তিতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ‘৭ দল’ ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ‘১৫ দলে’র মধ্যে ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐক্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছিল। ওই সময় জামায়াতকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে নেয়ার জন্য দলের ভেতরের একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে। মনে পড়ে, মতিঝিলে মরহুম সালাম তালুকদারের অফিসে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সভা হয়েছিল। জামায়াতকে জোটে নেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টিকারীরা মরহুম অলি আহাদ সাহেবকেও সেখানে নিয়ে আসেন। আমি এবং আরও কয়েকজন এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেই। সম্ভবত ৫ দফা দাবিনামা তৈরি এবং তার ভিত্তিতে ২২-দলীয় ঐক্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমার উদ্যোগ ও ভূমিকা বিবেচনায় চাপ সৃষ্টিকারীরা রণে ভঙ্গ দেয়। ফলে সে যাত্রায় জামায়াতকে বিএনপি জোটের বাইরে থাকতে হয়।
তবে তাদের জোটে না নিলেও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের যুগপৎ ধারায় তাদের অংশগ্রহণকে আমরা স্বাগত জানিয়েছি। কারণ আমার বিশ্বাস, একাত্তরে এ দলের স্বজাতিদ্রোহিতা ক্ষমাহীন হলেও এই দলের সর্বস্তরের কর্মী-সমর্থকদের ঢালাওভাবে ‘রাজাকার’ আখ্যায়িত করা যথার্থ নয়। আজকের দিনের অনেকেরই জানার কথা নয় যে, রাজাকার বাহিনী ছিল মূলত তৎকালীন মুসলিম লীগের সমর্থক ও সমাজের সুবিধাবাদী অংশের কিছু চিহ্নিত ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত। নগদ প্রাপ্তি এবং নানাবিধ সুবিধার লোভেই এই নরাধমরা পাক বাহিনীর সেবাদাস হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর সম্পৃক্ততা ছিল মূলত আলবদর বাহিনীতে। বাছাই করা জামায়াত কর্মীদের সমন্বয়ে ওই বাহিনী গঠিত হয়েছিল বলে জানা যায়। সাধারণভাবে এই বাহিনীকে বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য দায়ী করা হয়।
আমাদের আজকের দিনের রাজনৈতিক কর্মীদের এটাও জানা দরকার যে, পাকিস্তান আমলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন ছিল খুবই সীমিত। পাকিস্তানপন্থীদের মধ্যে তখন মুসলিম লীগের সমর্থন তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি ছিল। আজকের বাংলাদেশে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন তো মুসলিম লীগ নেই বললেই চলে। অপরদিকে জামায়াতের ভোটের পরিমাণ যদি শতকরা ৫ ভাগ হয়, তাহলে মোট ৯ কোটি ভোটারের মধ্যে তা দাঁড়াবে ৪৫ লাখ। এতগুলো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে সম্পূর্ণরূপে হিসাবের বাইরে রেখে জাতীয় রাজনীতির রণকৌশল নির্ধারণ বা সুস্বাস্থ্যের কথা ভাবা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
১৯৮৬’র নির্বাচনের সময় স্বৈরাচারবিরোধী জাতীয় ঐক্য থেকে আকস্মিকভাবে সরে গিয়ে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নেয়। আওয়ামী লীগকে অনুসরণ করে জামায়াতও তাতে অংশ নেয়। বিএনপি সেই নির্বাচন বয়কট করে। আমার মতে ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছিল আওয়ামী লীগের জন্য আত্মঘাতী। আওয়ামী লীগ তাতে যোগ না দিলে ওই বছরেই এরশাদের পতন অনিবার্য ছিল এবং দল হিসেবে আওয়ামী লীগ বিএনপির চেয়ে এগিয়ে থাকত।
১৯৯১-এর নির্বাচনে জামায়াত এককভাবে লড়েছে এবং নির্বাচনের পর স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বিএনপিকে সরকার গঠনে সমর্থন দেয়। কিন্তু ১৯৯৬-এর নির্বাচনের আগে তারা ভোল পাল্টে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একাট্টা হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। অতঃপর নির্বাচনের মাঠেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে একজোট হয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতের এই সখ্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। বস্তুত এই পর্যায়েই জামায়াত জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্য, হাসপাতাল ক্লিনিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনে জোর তৎপরতা চালায় এবং দলের একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত নির্মাণে সক্ষম হয়।
এভাবেই জামায়াত অত্যন্ত কুশলী রণকৌশল গ্রহণ করে বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে সময় সুযোগ মতো পালাক্রমে কাজে লাগিয়েছে। দুই দলই জামায়াতকে পালাক্রমে সাহচর্য ও শক্তি দিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০১-এর নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে জামায়াত বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে উদ্যোগী হয়। বিএনপির ভেতরের একটি অংশ তাতে অতি-উৎসাহে সাড়া দেয়। তারা একই সঙ্গে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকেও দলে আনার প্রক্রিয়া শুরু করে। স্বাভাবিকভাবেই এ উদ্যোগের সঙ্গে আমি একমত হতে পারিনি। ‘মানবজমিনে’ প্রকাশিত একটি ধারাবাহিক নিবন্ধে আমি এই উদ্যোগের তীব্র বিরোধিতা করি। কিন্তু তা ঠেকানো যায়নি। আমাকেই সরে আসতে হয়েছে।
শেষ কথা
সেদিন আমার যে অভিমত ছিল তা আজও সেভাবেই আছে। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির একমঞ্চে ওঠা উভয় পক্ষের জন্যই বিব্রতকর, এমন কি আÍঘাতী। স্কুলের বাচ্চাদের ‘তিন পায়ে দৌড়’ দেয়ার মতো। দু’জনেরই গতি কমার এবং আছড়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে পদে পদে। যার দৃষ্টান্ত আমরা এখন চোখের সামনে দেখছি।
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী : রাজনীতিক, ভূ-রাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক
(যুগান্তর, ০২/০১/২০১৪)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন