|
আহমদ রফিক
|
|
বাংলাদেশ সম্পর্কে পাকিস্তান এখনো একাত্তরেই
26 Dec, 2013
আবারও নতুন করে প্রমাণিত হলো পাকিস্তান বাঙালি মুসলমানের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সমস্যার সঠিক সমাধান ছিল না। ধর্মীয় ঐক্য জাতিসত্তার স্বার্থের অনুকূল নাও হতে পারে। বিশ্বজুড়ে জাতিরাষ্ট্র গঠনের, বিশেষ করে ভাষিক জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রেক্ষাপট এমনই। আর সে সত্য পাকিস্তানি শাসকবর্গ অতিদ্রুত বাঙালি জনগোষ্ঠীকে বুঝিয়ে দিয়েছিল স্বপ্নের মতো স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের মাস কয়েকের মধ্যেই বাঙালির ভাষিক স্বার্থের ওপর আঘাত করে। জনগোষ্ঠীর তরুণ সদস্য অনেকেই তা যথারীতি বুঝে নিয়েছিল।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের প্রতিবাদী আন্দোলন তার প্রমাণ। অবশেষে একাত্তরে চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ ও গণহত্যার বর্বরতা, যার খণ্ডচিত্র তৎকালীন বিদেশি পত্রপত্রিকাগুলো ভালোভাবে তুলে ধরেছিল, বিশেষ করে ব্রিটিশ ও আমেরিকান দৈনিক এবং সাপ্তাহিকগুলো। সে চিত্র পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের স্থানীয় ঘাতক দোসরদের নৃশংস অপরাধের ইতিহাস।
যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার আন্তর্জাতিক আইনমাফিক এ পর্যন্ত কম হয়নি, এখনো হচ্ছে। বাংলাদেশ দেরিতে হলেও সে কাজ শুরু করে জাতীয় দায়মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। যথারীতি গঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এবং দীর্ঘ সময় নিয়ে সব পক্ষের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে বিচারপ্রক্রিয়া চলছে। স্বজনহারানো ব্যক্তিরাই নন, যুক্তিবাদী বাঙালি মাত্রেরই জানা বর্তমানে বিচারের জন্য আটক অপরাধীদের হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাবলি।
আর তেমন অপরাধের শাস্তি যে মৃত্যুদণ্ড, বিশ্বের অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ইতিহাসে তা ধরা রয়েছে। তাই সম্প্রতি জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার বিচারের রায় কার্যকর করার মধ্যে কোনোপ্রকার অসংগতি নেই। তবু কান টানলে যে মাথা আসে, তার প্রমাণ রেখেছে পাকিস্তান কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ঘোষিত বিচারিক রায় কার্যকর করার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া প্রকাশের মাধ্যমে। তাও গণমাধ্যমের প্রতিক্রিয়া নয়, রীতিমতো পার্লামেন্টে প্রস্তাব পাস করে।
প্রমাণ করে দিয়েছে পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলা ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর বিচ্ছিন্ন হওয়ার তাগিদ কতটা সঠিক ছিল। যদিও দায়টা তাদেরই ছিল। কারণ একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জনরায় না মেনে সেই জনগোষ্ঠীর ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে একাত্তরের পঁচিশে মার্চ থেকে অবিশ্বাস্য নরকের আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো কাজ পাকিস্তানি বাহিনীই শুরু করেছিল। তাদের সঙ্গে একই অপরাধে হাত মেলায় স্থানীয় পাকিস্তানপ্রেমী বাঙালি নামের কলঙ্ক জামায়াত-মুসলিম লীগ নামের রাজনৈতিক দলের সদস্য ও বিহারিরা।
রাজনৈতিক-কূটনৈতিক কারণে অপরাধী পাকিস্তানি সেনাদের বিচার করা না গেলেও স্থানীয় অপরাধীদের বিচার হওয়া যুক্তিসংগত পদক্ষেপ। কিন্তু পাকিস্তান এ বাস্তবতা ও এ সত্য মানতে নারাজ। তাই একাত্তরের গণহত্যার অপরাধ নিয়ে বহুকথিত ক্ষমা চাওয়া দূরে থাক, সেটা চার দশক পর এখনো তারা সঠিকই মনে করছে, যা অপরাধের জের টানার শামিল। বৃথাই আমাদের কিছুসংখ্যক উদারমনা সাংবাদিক বা বুদ্ধিজীবী পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া নিয়ে আসর গরম করেছেন। দুই-চারজন আসমা জাহাঙ্গীর ব্যতিক্রমেরও ব্যতিক্রম। কিছুদিন আগে কথিত নিরপেক্ষ পাকিস্তানি সাংবাদিক হামিদ মীরের পাল্টি খাওয়ার ঘটনা বাঙালির পাকিস্তানি মোহ দূর করার জন্য যথেষ্টই ছিল।
ভালোই হলো পাকিস্তান তার অপরাধী চরিত্র নতুন করে রাষ্ট্রনৈতিকভাবে প্রকাশ করেছে। এবং বাংলাদেশে এর প্রতিক্রিয়াও যথারীতি ও যুক্তিসংগত। গণজাগরণ মঞ্চের তরুণদের আবেগ খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। এই তরুণদের পূর্বসূরি তরুণরাই তো বাংলাদেশকে মুক্ত করতে একাত্তরে প্রাণের বিনিময়ে লড়েছে, প্রাণ দিয়েছে। সঙ্গে বিভিন্ন বয়সী মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াই ও আত্মদান স্মরণীয় ঘটনা।
সংগত কারণে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম থেকে শুরু করে একাধিক রাজনৈতিক দল ও সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংস্থা, এমনকি পুরো গণমাধ্যম কাদের মোল্লাবিষয়ক পাকিস্তানি ভূমিকার বিরুদ্ধে বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে এতটুকু দেরি করেনি। তাদের প্রতিক্রিয়ার ভাষিক প্রকাশও বড় একটা ভিন্ন নয়। তাদের কারো মতে পাকিস্তানের এ ভূমিকা 'পরোক্ষে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল', উদারমনাদের মতে তা 'কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত', তবে অনেকের মতে এ ঘটনা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পাকিস্তানের নাক গলানো, যা অনাকাঙ্ক্ষিতও বটে।
কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, 'কাদের মোল্লার জন্য পাকিস্তানের এত উদ্বেগ কেন?' হয়তোবা তাদের অপরাধ-সঙ্গী হওয়ার কারণে। বাঙালি তার স্বভাবগত ঔদার্যে ধরে নিয়েছিল যে পাকিস্তানের নয়া প্রজন্মের শাসকগোষ্ঠী তাদের পূর্বসূরিদের কৃত গণহত্যার উত্তরাধিকার বহন করে না। আধুনিক চেতনায় এমনটাই হওয়ার কথা। কিন্তু পাকিস্তান এদিক থেকে রবাবরই ভিন্ন। যে অমানবিক সহিংসতার প্রকাশ ঘটিয়ে তার জন্ম, সেই ধারা, সেই চরিত্র রাষ্ট্রনৈতিক-রাজনৈতিকভাবে তারা ঝেড়ে ফেলতে পারেনি। পারবেও না।
তাই অনেক বাঙালি ক্রিকেটপ্রেমীর চোখ খুলে দিয়েছে ক্রিকেট কিংবদন্তি রাজনৈতিক নেতা ইমরান খানের মন্তব্য- 'কাদের মোল্লা নির্দোষ', তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে। ইমরান খানের মার্কিনবিরোধী মনোভাব তাঁর সাম্প্রতিক রাজনৈতিক মন্তব্যের সঙ্গে খাপ খায় না। কিন্তু এ নির্জলা সত্য আজ বাঙালিকে বুঝতে হবে যে বাংলা-বাঙালি সম্পর্কে পাকিস্তানিদের বিজাতীয় মনোভাব প্রজন্মান্তরেও বদলায়নি, তা তিনি যত বড় খেলোয়াড় বা সাংবাদিক হোন না কেন। বাঙালি সম্পর্কে এটাই চিরাচরিত পাকিস্তানি মানসিকতা। সেখানে রাজনীতিক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বে কোনো তফাত নেই।
কূটনীতিকরা তাঁদের পেশাগত কারণে উদারপন্থার অনুসারী হয়ে থাকেন। হিসাব-নিকাশ করে, আগপাছ ভেবে তাঁদের কথা বলা, মন্তব্য করা উচিত- পাছে কোনো অবাঞ্ছিত প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটে। তবু কাদের মোল্লাবিষয়ক পাকিস্তানি ভূমিকার সমালোচনায় আমাদের এক জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক মন্তব্য করেছেন যে এ ধরনের ঘটনার কারণে 'পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক শীতল হবে।'
আসলে তৎকালীন পাকিস্তানেই নয়, পৃথিবীর যেকোনো দেশে খুন, ধর্ষণ, বাড়িঘরে আগুন আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। আর যুদ্ধাবস্থায় ঘটলে তা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত, যা বিচারযোগ্য অপরাধ। সে হিসেবে পাকিস্তানেরও উচিত ছিল তাদের যুদ্ধাপরাধীদের নৃশংসতার বিচার করা। কিন্তু তারা বিচার করা দূরে থাক, নানাভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে যে একাত্তরে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের স্থানীয় দোসরদের গণহত্যা জায়েজ ছিল। এমন বিরূপ মানসিকতার রাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখা খুব কঠিন।
বাংলাদেশ পাকিস্তানের এ জাতীয় অযৌক্তিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কঠোর কূটনৈতিক অবস্থান নিয়ে সঠিক কাজই করেছে। কিন্তু সেই সঙ্গে স্ববিরোধী ঘটনা হচ্ছে গণজাগরণ মঞ্চের প্রতিবাদীদের লাঠিপেটা করে আহত করা। কারণ ওই প্রতিবাদ পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ ছিল- তাদের দাবি যত কঠোরই মনে হোক। এর সম্ভাব্য কূটনৈতিক ভাষ্য ধোপে টেকে না।
প্রসংগত, ইমরান খানকে আমাদের প্রশ্ন : কোন তথ্যের ভিত্তিতে তাঁর এমন দাবি যে কাদের মোল্লা নির্দোষ? তৎকালীন ঘটনাবলি এর ভিন্ন প্রমাণই তুলে ধরে। আর বাংলাদেশে অবস্থানকারী বিহারি তথা তৎকালীন অবাঙালিদের ভূমিকা যে পাকিস্তানপন্থী হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাহাত্তরের পর থেকে তারা নিজদের পাকিস্তানি দাবি করে পাকিস্তানে যাওয়ার জন্য অনেক মিটিং-মিছিল করেছে। কিন্তু পাকিস্তান সরকার এ ব্যাপারে বরাবর নিশ্চুপ। দুর্বোধ্য কারণে বাংলাদেশ সরকারও এ বিষয়ে যথেষ্ট তৎপর ছিল না।
তাদের বাসস্থান 'জেনেভা ক্যাম্পে পাকিস্তানিদের সঙ্গে বৈঠক করে জামায়াত' এবং 'পরিকল্পনা হয় গণজাগরণ মঞ্চে হামলার'- পত্রিকার এমন ছোটখাটো খবরে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। এটা একাত্তরেরই নব্যখেলা, এখন জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডবে হত্যা ও নাশকতায় যা দেখা যাচ্ছে। প্রকৃত সত্য হলো, পাকিস্তান ও পাকিস্তানপন্থীরা স্বাধীন বাংলাদেশকে কখনো মেনে নেয়নি, এখনো নেবে না। তাদের কূটকৌশল ও জামায়াত-শিবিরের নাশকতা একই চরিত্রের। তাই বিচার উভয়েরই হওয়া উচিত। আর গণজাগরণ মঞ্চের 'পাকিস্তানি পণ্য বর্জনের' আহ্বান বাঙালিদের মনেপ্রাণে গ্রহণ করা সংগত বলে মনে করি। আহ্বান জানাই বাঙালিকে আত্মমর্যাদায় সচেতন হতে।
লেখক : গবেষক ও ভাষাসৈনিক
(কালের কন্ঠ, ২৬/১২/২০১৩)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন