|
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী
|
|
অনুপস্থিত জাতীয় বুর্জোয়া, উপস্থিত সুশীল সমাজ এবং জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ
26 Dec, 2013
দেশে এখন যে ভয়াবহ নৈরাজ্য চলছে তাতে সমাজের কোনো অংশই স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছে না। জাতীয় রাজনীতির বিভাজন সমাজ জীবনকেও বিভাজিত করে ফেলেছে। যতই দিন যাচ্ছে বিভাজন রেখাটি গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। সরকারের কর্তাব্যক্তিরা মুখে হাসি নিয়ে অভয়বার্তা শোনালেও তাদের হাসিতেই মিশে থাকছে দুশ্চিন্তার স্পষ্ট ছাপ।
৫ জানুয়ারি নির্বাচন হলেই কি সংকট কেটে যাবে? এভাবেই যদি নির্বাচনবিহীন নির্বাচন হয়, আইনের মারপ্যাঁচে তাকে যতই বৈধতা দেয়া হোক না কেন, সমস্যা দূর না হয়ে আরও জটিল হবে। আরও গভীরে চলে যাবে। আর সেই গভীর খাদ থেকে জাতীয় রাজনীতি-অর্থনীতিকে তুলে আনার দায় ষোল আনাই বর্তাবে সরকারের কাঁধে।
কাজেই সময় থাকতেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া, ৫ জানুয়ারির আগেই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটা সমাধান খুঁজে বের করা মঙ্গলজনক হবে। ১৫৪ আসনে বিনা নির্বাচনে নির্বাচন সমাপ্ত, অবশিষ্ট আসনে নির্বাচনের অভিনয়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্যই এটা করতে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলছেন বিরোধী দল জ্বালাও-পোড়াও বন্ধ করলে আবার নির্বাচন দেয়া হবে। দশম সংসদের পরপরই একাদশ সংসদের নির্বাচন হতে পারে। এ বিষয়টি নিয়ে এর আগে লিখেছি। সেক্ষেত্রে এটা হবে অনেকটা ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারি মডেলের নির্বাচন। বিএনপি এ প্রস্তাবে সায় দেয়নি। দেয়ার কথাও নয়। এ রকম সমাধান বিরোধী পক্ষের কাছে গ্রহণীয় করতে হলে তা আরও স্পষ্ট করতে হবে। ১৯৯৬ সালে সপ্তম সংসদের নির্বাচন হয়েছিল ১৫ ফেব্র“য়ারি। তার মাত্র সাড়ে তিন মাস পর ১২ জুন অষ্টম সংসদের নির্বাচন। বিরোধী দলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল, যেহেতু বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যদের পদত্যাগের কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস করে সংবিধান সংশোধন করা যাচ্ছে না, সেহেতু কেবল সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী পাস করার জন্যই ওই নির্বাচন। তিন মাস পর ওই সংসদ ভেঙে দিয়ে আবার নির্বাচন দেয়া হবে।
ক্ষমতাসীন সরকারের সেই আগাম প্রতিশ্র“তির কারণেই সেদিনের বিরোধী আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচন হতে দিয়েছিল। নির্বাচনের পর অবশ্য বিএনপির একাংশ চেষ্টা করেছিল প্রতিশ্র“তি মতো নির্বাচন না দিয়ে ক্ষমতায় জেঁকে বসতে। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। সে কাহিনী সবার জানা।
এবারও যদি আইনি জটিলতায় ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচন কোনোভাবেই পিছিয়ে দেয়া না যায় এবং যথা শিগগিরই একাদশ সংসদের নির্বাচন দিতে সরকার আন্তরিক থাকে, তাহলে ১৯৯৬ সালের মতো প্রধানমন্ত্রীকে ৫ জানুয়ারির আগেই জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে একাদশ সংসদ নির্বাচনের দিন-তারিখ ঘোষণা করতে হবে। একই সঙ্গে ওই নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা নিয়ে জাতীয় ঐকমত্যে আসতে হবে।
দলীয় সরকারের অধীনে নয়, যথার্থ নিরপেক্ষ একটি সরকারের অধীনে সে নির্বাচন হতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। সে বিষয়টি ক্ষমতাসীন সরকারের কর্তাব্যক্তিরা এখনও উপলব্ধি করছেন না, তা সত্যিই তাজ্জবের ব্যাপার।
কাদের মোল্লার ফাঁসি ও পাকিস্তান প্রসঙ্গ
কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান জাতীয় সংসদে নিন্দা প্রস্তাব পাস হওয়া এবং পাকিস্তানি তালেবানদের পক্ষ থেকে ইসলামাবাদে বাংলাদেশ হাইকমিশন উড়িয়ে দেয়ার হুমকি দুদেশের সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আরেকটি বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করল। এমনিতেই ১৯৭১ সালের মর্মান্তিক ঘটনাবলীর স্মৃতি দুদেশের সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সুউচ্চ প্রাচীর হয়ে বিরাজ করছে। অথচ আঞ্চলিক ও জাতীয় প্রেক্ষাপটে উপমহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক-সর্বক্ষেত্রে পারস্পরিক সমঝোতা ও সহযোগিতার কোনো বিকল্প নেই।
পাকিস্তানের প্রায়-ঔপনিবেশিক শৃংখল ভেঙে আমরা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতিসত্তা নির্মাণ করেছি। সেজন্য মূল্য দিতে হয়েছে অনেক। তবে যে কোনো জাতির জন্যই স্বাধীনতার পর যত দ্রুত সম্ভব অতীত দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পর্ব পেছনে ফেলে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করা বিধেয়। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আমাদের প্রত্যাশা ছিল পাকিস্তান সেই শুভ-প্রয়াসে যথাযথ সাড়া দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের একাত্তরের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা জানাবে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে চীন, কোরিয়া ও মঙ্গোলিয়ায় হানাদার জাপানি ওই সৈন্যদের নিষ্ঠুরতা ও অত্যাচার-নিপীড়নের ঘটনাবলীর জন্য জাপান সম্রাট স্বয়ং ওইসব দেশের সরকার ও জনগণের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। এতে কি জাপান ছোট হয়ে গেছে? ভিয়েতনামে মার্কিন দখলদার বাহিনী সুদীর্ঘকাল বর্বরতা চালিয়েও দখল বজায় রাখতে পারেনি। লজ্জাজনক হার মেনে নিয়ে তাদের সেদেশ থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। কিন্তু এর কয়েক বছরের মধ্যেই মার্কিন সরকার স্বপ্রণোদিত হয়ে কুশলী পদক্ষেপ নিয়ে ভিয়েতনামের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে নিয়েছে।
দুর্ভাগ্যবশত পাকিস্তানের নেতৃত্ব সে পথে যাননি। যদিও ব্যক্তিপর্যায়ে আজকের পাকিস্তানের জনগণের বিপুল অংশ একাত্তরের ঘটনাবলীর জন্য নানাভাবে দুঃখ প্রকাশ করে আসছেন। অনেকে বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাইতেও বলছেন। সময়ের ব্যবধানে দুদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার পথে ছিল। কিন্তু পাকিস্তানি জাতীয় সংসদ সেই প্রক্রিয়া থামিয়ে দিল।
বাংলাদেশের মানুষ সাধারণভাবে পাকিস্তান জাতীয় সংসদের কথিত নিন্দা প্রস্তাবে ভয়ানকভাবে মর্মাহত। তারা দায়িত্বজ্ঞানহীন ও নিন্দনীয় কাজ করেছেন। এর দায় পাকিস্তানকেই বহন করতে হবে।
ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের বিক্ষোভ ও অনুপস্থিত জাতীয় বুর্জোয়া
দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতার বিরুদ্ধে দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ও সোচ্চার হয়েছেন। এবার আর জনগণ থেকে দূরে, নিজস্ব ভবন পাঁচতারা হোটেলে বসে রাজসিক অনুষ্ঠান নয়। একেবারেই রাস্তায় নেমে মিছিল। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে দুই নেত্রীকে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বলেছেন। ঘোষণা দিয়েছেন, নইলে তারা কঠোর কর্মসূচি দেবেন।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও আহাজারির কারণ স্পষ্ট। হরতাল ও অবরোধ নামক দুই দানবীয় কর্মকাণ্ড দেশজুড়ে সব কিছু প্রায় বিকল করে দিয়েছে। জন-চলাচলের সঙ্গে পণ্য পরিবহনও বন্ধ। আগে রাস্তায় গাড়ি ভাংচুর হতো। এখন পেট্রল ঢেলে পোড়ানোর মহোৎসব চলছে। গাড়ির সঙ্গে গাড়ির যাত্রী, ড্রাইভার-হেলপার, ঘুমন্ত শিশু আগুনে পুড়ে প্রাণ হারাচ্ছে, হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যুর প্রহর গুনছে। অবশ্যম্ভাবীরূপে ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির, শিল্প-কারখানা স্তব্ধ। দেশের অর্থনীতি এমন বিপর্যয়ের সম্মুখীন আর কখনও হয়নি। পরিস্থিতি কবে, কিভাবে স্বাভাবিক হবে, তা কেউ বলতে পারছেন না।
বর্তমান সরকার যে কোনো প্রকারে তাদের ভাষায় সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রেখে নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কাজটা মোটেই সহজ হচ্ছে না। সেটা সম্ভব হলেও যে অচলাবস্থা কেটে যাবে তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্প উদ্যোক্তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা অচিরে দূরীভূত হওয়ার ব্যাপারেও আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না।
রাষ্ট্রীয় সংবিধানে অন্যতম মূলনীতি হিসেবে সমাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তবে ক্ষমতাসীন সরকারের নেতাদের মুখে এখন আর সমাজতন্ত্রের খই ফোটে না। বাংলাদেশ এখন একটি নির্ভেজাল পুঁজিবাদী রাষ্ট্র।
পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা জাতীয় অর্থনীতির চালকের আসনে থাকেন। সেই সুবাদে রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়ে। বর্তমান বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়।
মধ্যবিত্ত উঠতি পুঁজিপতি ও উদ্যোক্তাদের বুর্জোয়া নামে অভিহিত করা হয়। মার্ক্সবাদী সাহিত্যে বুর্জোয়া শব্দটি গালি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। শিল্প-উদ্যোগ কিংবা বিত্ত-সম্পদ গড়ে তোলার সব ধরনের প্রয়াসকেই গণবিরোধী এবং পুঁজিবাদী শোষণ প্রক্রিয়ার অংশ বিবেচনা করার এ প্রবণতা মানব উন্নয়নের গতিধারায় কতটা যৌক্তিক, সে ব্যাপারে বিতর্কের অবকাশ রয়েছে।
আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রে পুঁজিবাদের একটা সহনীয় রূপ তৈরির চেষ্টা হয় কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণার মধ্য দিয়ে। রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কর্তৃত্বে গণতান্ত্রিক প্রশাসন গড়ে তোলার মাধ্যমে রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। এ প্রক্রিয়ায় জাতীয় জীবনে দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্প-উদ্যোক্তা সম্প্রদায়ের ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের সবাই কেবলই মুনাফা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভোর থাকবেন, ন্যায়-অন্যায় বাছবিচার করবেন না, দেশ-জাতি নিয়ে মোটেই ভাবনাচিন্তা করবেন না, তা মনে করা যথার্থ নয়। বিদেশী পণ্যে দেশ সয়লাব হয়ে গেলে দেশের কল-কারখানাগুলোকে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হবে। দেশ ভালো না থাকলে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা প্রয়োজনীয় সুরক্ষা পাবে না। সেই আশংকা থেকেও জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ ও সুরক্ষার প্রশ্নে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা সোচ্চার হবেন। তাদের দেশপ্রেম অনেকটা আÍস্বার্থ চিন্তাপ্রসূত হলেও ক্ষতি নেই। মার্কসীয় শ্রেণী বিশ্লেষণে এ শ্রেণীর ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের নামকরণ করা হয়েছে জাতীয় বুর্জোয়া নামে। মাও সেতুং তার লংমার্চের সময় এ শ্রেণীর ব্যবসায়ী-শিল্পপতি ও ধনিক শ্রেণীকে বিপ্লবের সহযোগী শক্তির মর্যাদা দিয়েছেন।
মাও সেতুং-এর ভাষায় : We should not abandon the enlightened gentry who co-operated with us in the past and continue to co-operate with us at present, who approve of the struggle against the United States and Chiang Kai-shek and who of the land reform.' (Inner Party directive by Mao on March 1, 1948).
মাও-এর এ বিচার বিশ্লেষণ সর্বকালে সর্বদেশের জন্য প্রযোজ্য। এখানে যুক্তরাষ্ট্র এবং চিয়াং কাইশেকের উল্লেখ সাধারণভাবে বহিঃশত্র“র নির্দেশক।
এ শ্রেণীর ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা নিজ নিজ জাতি-রাষ্ট্রের সুরক্ষা ও স্বনির্ভরতার পক্ষে দৃঢ় ভূমিকা পালন করবেন সেটাই প্রত্যাশিত। কারণ, তারা উপলব্ধি করেন বলেই তারা জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেন। তারা এটাও উপলব্ধি করেন যে, দেশে সুস্থ, সবল ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত না থাকলে দেশ ভালো চলতে পারে না। তাই জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর ইতিবাচক ভূমিকা আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পলন করে।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি সমাজ জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর সেই প্রত্যাশিত ভূমিকা পালনে কতটা সজাগ সে প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠতে পারে। তারা দেশের রাজনীতির অচলাবস্থায় হতাশ, সরকারের প্রশাসনিক ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ। কিন্তু এদেশে সুস্থ রাজনীতি চর্চার ক্ষেত্রে তারা কি সহায়ক ভূমিকায় আছেন? গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় দেশে বহুমাত্রিক রাজনীতির বিকাশ আবশ্যক। সেজন্য প্রয়োজন বিভিন্ন মতাদর্শের সুসংগঠিত ও আদর্শনিষ্ঠ রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠা। আমাদের ব্যাবসায়ী-শিল্পপতিরা সে ব্যাপারে কোনো দায়-দায়িত্ব কি অনুভব করেন?
ব্যবসা-বাণিজ্য যদি মুনাফা শিকার, নীতি-নিষ্ঠা জলাঞ্জলি দিয়ে কেবলই ক্ষমতার দোরগোড়ায় পূজা দেয়া এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের যথেচ্ছ লুণ্ঠন বিবেচিত হয়, তাহলে দুর্নীতির কাছে নীতি মার খাবে, কালো টাকার কাছে সাদা টাকা মার খাবে সেটাই তো স্বাভাবিক। এ ধারায় জাতীয়তাবাদী জাতীয় বুর্জোয়ার পরিবর্তে পরনির্ভর দালাল ও মুৎসুদ্দী পুঁজির বিকাশ ঘটতে থাকে এবং জাতীয় অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হয়ে যায়। যার লক্ষণ আমাদের অর্থনীতিতে এখন স্পষ্ট।
সাম্প্রতিককালে আমাদের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের আরেকটি প্রবণতা লক্ষণীয়। পাকিস্তান আমলেও দেশের খ্যাতিমান ব্যবসায়ীরা প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে সম্মানজনক দূরত্বে থাকতেন, কিন্তু রাজনৈতিক দল-উপদলকে তাদের পছন্দ অনুযায়ী পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন। সব দল-মতের রাজনীতিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে তারা কমবেশি সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করতেন। এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন তারা সরাসরি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছেন। রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবসায়িক কাজে লাগানোর লক্ষ্যে এ খাতে পুঁজি বিনিয়োগ করছেন। এ কাজ করতে গিয়ে তারা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাথা ক্রয় করছেন অথবা নগদ টাকায় নমিনেশন কেনার প্রতিযোগিতায় নামছেন। এভাবে তারাই পথভ্রষ্ট রাজনীতিকে চরমভাবে নীতিভ্রষ্ট করে চলেছেন।
অপরাজনীতির শিকার হয়ে যেসব ব্যবসায়ী-শিল্পপতি এখন রাস্তায় নেমে প্রতিকার দাবি করছেন, আমাদের জাতীয় রাজনীতির এ করুণ পরিণতির জন্য তাদের দায় কারও চেয়ে কম নয়। সুস্থ রাজনীতির স্বচ্ছ পৃষ্ঠপোষক না হয়ে তারা রাজনীতির অস্বচ্ছ কানাগলিতে বিচরণ করে একদিকে সুস্থ রাজনীতিকে অসহায় করে তুলেছেন, অপরদিকে ক্ষমতার কেনাকাটায় লিপ্ত হয়ে তারা ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাবানদের আরও শক্তিমান করে সব গণমুখী রাজনৈতিক উদ্যোগের পথ রুদ্ধ করছেন। দেশে আজ দুই বিবদমান গোষ্ঠীর অন্তহীন ক্ষমতা-ক্ষুধা প্রতিটি মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। কিন্তু কোনো বিকল্প ইতিবাচক শক্তির উত্থান প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
দেশে যথার্থ জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর অনুপস্থিতি তার অন্যতম প্রধান কারণ।
উপস্থিত সিভিল সোসাইটি
তবে জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণী না থাকলেও আজকের বাংলাদেশে একটি কলকণ্ঠ সুশীল সমাজের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। ইংরেজি সিভিল শব্দটির বাংলা তর্জমা করা হয়েছে সুশীল। এ ভাষান্তর যথার্থ কি-না সে ব্যাপারে বিতর্ক হতে পারে।
সাধারণত সিভিল সোসাইটি বলতে বোঝায়- যারা সরকারের বাইরে থেকে এবং কোনো রাজনৈতিক দলের লোক না হয়ে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নের প্রশ্নে স্বপ্রণোদিত ও স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে পরামর্শকের ভূমিকা পালন করেন। আমাদের দেশে সেই অর্থে সিভিল সোসাইটি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ বা দলবিশেষের প্রতি আনুগত্যের বাইরে থেকে যারা স্বাধীনভাবে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করবেন অথবা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে জনকল্যাণ বা সমাজকল্যাণমূলক কাজে নিবেদিত থাকবেন, তাদের সমন্বয়েই সিভিল সোসাইটি গড়ে উঠবে। কিন্তু বাস্তবে বিভিন্ন এনজিও সংস্থার কর্মকর্তা ও ব্যক্তিরা যেভাবে স্বনিয়োজিতভাবে সিভিল সোসাইটির পরিচয় বহন করেন তার যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। সমাজবিজ্ঞানী হেলাল মহিউদ্দিন এ ব্যাপারে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলেছেন : ' there is a political sociological need to establish an operational discourse of civil society towards understanding of distinctions between the Civil Society and Pseudo-Civil Society or, Civil Society Mafia.' (Decentralization of 'civil society mafia' and coercive politics in Bangladesh, ASA University Review, Vol. 5 No 2, July -December, 2011).
অর্থাৎ সিভিল সোসাইটি, ভুয়া সিভিল সোসাইটি এবং সিভিল সোসাইটি মাফিয়ার পার্থক্য অনুধাবন করতে হবে।
এ নিয়ে বারান্তরে আলোচনার ইচ্ছা রইল।
শেষ কথা
আজকের বাংলাদেশে যথার্থ জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণী এখনও গড়ে ওঠেনি- এই বক্তব্যে আমাদের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা নাখোশ হবেন সন্দেহ নেই। তাদের হেয় করার উদ্দেশ্যে এ কথাগুলো বলা হয়নি। আমাদেরও একটি শক্তিশালী জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণী গড়ে উঠুক, সেই প্রত্যাশা থেকেই এ মন্তব্য।
অনুরূপভাবে একটি যথার্থ দলনিরপেক্ষ, স্বপ্রণোদিত ও স্বেচ্ছাসেবী সিভিল সোসাইটি গড়ে ওঠাও জরুরি।
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী : রাজনীতিক, ভূ-রাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক
(যুগান্তর, ২৬/১২/২০১৩)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন