বাংলাদেশে ডিসেম্বর যেভাবে আসে ঠিক সে আদলে এবার নেই। চারদিকে মৃত্যুর মিছিল, আগুন, ধ্বংসযজ্ঞ ও সর্বগ্রাসী আতঙ্ক। অথচ জাতীয় ইতিহাসের এই মাসটি বাঙালির বিজয়ের মাস। এই মাসে, আজ থেকে ৪২ বছর আগে, মুক্তিবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি হানাদার সৈন্য ও তাদের স্থানীয় দোসররা পরাজিত হয়েছিল, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
বাংলাদেশে আগে কখনও রাজনৈতিক সহিংসতা ঘটেনি, লোকজন মরেনি, জ্বালাও-পোড়াও হয়নি_ এ কথা কেউ বলবেন না। কিন্তু আগে কখনও ডিসেম্বর মাসে এ রকম কোনো সহিংস রাজনৈতিক তৎপরতা দেখেনি। প্রতিনিয়ত মানুষ মরছে, মারা হচ্ছে, একই সঙ্গে পুড়ছে ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ। মুক্তিযুদ্ধজয়ী বাঙালির যা কিছু অর্জন, সম্পদ-সংস্কৃতি-সংবিধান_ সবকিছুই যেন আজ আক্রমণের শিকার হচ্ছে!
সঙ্গত কারণেই জনজীবনে কোনো স্বস্তি নেই, কোনো সুরক্ষা নেই, চারদিকেই ব্যাপক নৈরাজ্য। না, আমি রাজনৈতিক দর্শন-নিরপেক্ষ না হলেও দলনিরপেক্ষ। এরপরও বলব, এমন বাংলাদেশ আমি চাইনি।
আমার বিশ্বাস, একটি নির্বাচন ঘিরে যেভাবে ডিসেম্বর মাসটি রক্তাক্ত হয়ে উঠছে, এটি নিছক কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন থাকছে বলে মনে করার কারণ নেই। কাজেই বিজয় দিবসের আনুষ্ঠানিকতা হয়তো কমই, হয়তো কিছু ক্ষেত্রে হবেও না, কিন্তু জাতীয় বিজয়ের আন্তরিক উপলব্ধির দিক থেকে যে কোনো সুনাগরিককেই পরিপূর্ণ হতে হবে। একাত্তরের অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধকে সমাপ্ত করতে হবে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আগামী দিনের নিঃশঙ্ক আনন্দ-গৌরব অম্লান রাখতে হবে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয় : 'দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে তব মঙ্গলালোক, তবে তাই হোক।' আমরা যেন সময়ের সঠিক পথ চিনে নিতে পারি।
বাংলাদেশের সমাজ, সকলেই জানবেন, বড় বেশি রাজনৈতিক সম্পৃক্ত। এরপরও বলব, আসন্ন নির্বাচন নিয়ে যেভাবে চরম সহিংসতা ঘটছে, তা কতটা গ্রহণযোগ্য তা খতিয়ে দেখার বিষয়। আমার বিশ্বাস, মানুষ মেরে মানুষের কল্যাণ করা যায় না। একে রাজনৈতিক আন্দোলন বলার চাইতে রাজনৈতিক বর্বরতা বলাই সঙ্গত।
সকলেই জানেন, বর্তমান সময়ে থাইল্যান্ডেও সরকারবিরোধী প্রবল রাজনৈতিক আন্দোলন চলছে। আন্দোলনকারীরা সরকার অচল করে দিতে চায়। কিন্তু তারা যানবাহনে বা জাতীয় সম্পদে আগুন দিচ্ছে না, মানুষ পুড়িয়ে মারছে না। অন্য আন্দোলনটি ঘটছে ইউক্রেনে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সহযোগিতা চুক্তি করতে অস্বীকার করায় সরকারের পদত্যাগের দাবিতে লাগাতার বিক্ষোভ-ধর্মঘট চলছে। সরকারবিরোধীরা দেশব্যাপী ধর্মঘট কর্মসূচি পালন করছে। এমনকি আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাজধানী কিয়েভের স্বাধীনতা চত্বরে তারা সমবেত হয়েছে।
কিন্তু এসব আন্দোলন সহিংস হয়নি। সরকারবিরোধীরা বিক্ষোভ করছে দৃঢ়ভাবে; কিন্তু শান্তিপূর্ণভাবে। তারা অগি্নসংযোগ বা সাধারণ মানুষ হত্যার মতো চরম অপরাধ করছে না। সরকারও সংযম প্রদর্শন করছে, শক্তি প্রদর্শন করছে না।
টানা হরতালের পর বাংলাদেশেও বিরোধী দলের অবরোধ আন্দোলন চলছে। কিন্তু সে অবরোধ সহিংসতায় ভরা, যা যে কোনো মানুষের জন্যই চরম উদ্বেগজনক। যাত্রীবোঝাই বাসে পেট্রোল-গানপাউডার ছড়িয়ে আগুন দেওয়া হচ্ছে। রেললাইন উপড়ে ফেলা হচ্ছে, আগুন লাগানো হচ্ছে। ধ্বংস করা হচ্ছে জাতীয় সম্পদ। কারখানায় কিংবা পণ্যবাহী ট্রাকে আগুন জ্বালানো হচ্ছে। কিন্তু কেন? যে কোনো বিবেকবান মানুষই প্রশ্ন করবেন, 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার' দাবিটিকে আন্দোলনের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হলেও এটিই কি যে যথার্থ কারণ?
নিশ্চয়ই আমি বলব না, বিরোধী জোটের দাবির বিন্দুমাত্র যৌক্তিকতা নেই, কিংবা তারা যা বলছেন, তা আলোচনার মাধ্যমে একেবারেই ফয়সালা করা যাবে না। কিন্তু আন্দোলনের যে চরিত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তাতে সরকারবিরোধীদের দাবি কি যুক্তির বাইরে চলে যাচ্ছে না? আজ হোক কাল হোক, বর্বরতাসম্পন্ন এই কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে মানুষ অবশ্যই রুখে দাঁড়াবে।
আমি কখনও মনে করি না যে, বিরোধী জোটের দাবির পক্ষে কোনো মানুষ নেই। স্পষ্টতই আছে এবং বিরোধী দলের রাজনৈতিক আদর্শবিরোধী অনেক মানুষও আছেন, যারা নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার বিষয়ে বর্তমান সরকারের অবস্থানকে সমর্থন করেন না। তারা একটা সুরাহা চান; কিন্তু তা হয়নি।
বাংলাদেশের সংবিধানবিরোধী সংগঠন হিসেবে জামায়াত নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর জামায়াতের আশ্রয়-অবলম্বন দরকার, বলাই বাহুল্য। দুর্ভাগ্যক্রমে সে ভূমিকাটিই পালন করছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। কিন্তু এরপরও বলতে হবে, যুদ্ধাপরাধী বা মানবতাবিরোধীদের চলমান বিচার শুধু জামায়াতের জন্যই এক দুঃসহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেনি, করেছে নানা কারণে, বিএনপির জন্যও। বিএনপি অবশ্যই একটি বড় দল, সে দলের পক্ষে উগ্রপন্থার সহায়ক হওয়ার কারণ ছিল না। কিন্তু জামায়াতের হুকুম-নির্দেশের বাইরে যাওয়ার মতো অবস্থা যে দলটির আর নেই, সে বিষয়টিই আজ বহু মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। আমার বিশ্বাস, মাত্রাতিরিক্ত এই জামায়াত-নির্ভরতা বিএনপির মতো বড় দলকেই কেবল ক্ষতিগ্রস্ত করবে না, বাংলাদেশকেও অচল-অস্থির দেশে পরিণত করবে। হয়তো বাংলাদেশের জন্মের বিরোধীরা সেটিই প্রত্যাশা করে।
খবরে জানলাম, পতিত স্বৈরাচারী এরশাদ তার দলের প্রার্থীদের নির্বাচন-প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে নির্দেশ দিয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকার থেকেও ঘটনাটি যে অতিনাকটীয়, বলার অপেক্ষা রাখে না। মাত্র কয়েকদিন আগেও নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে যুক্তি দেখাতে শুনেছি এরশাদ সাহেবকে এন্তার। প্রথমে তিনি নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে কথা বলেছেন। দিন কয়েকের মধ্যে আবার নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে কথা বলেছেন। আবার তার দিনকয়েক পর না যাওয়ার পক্ষে ঘোষণা দিলেন।
আমার এক ক্ষ্যাপা বন্ধু, যিনি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটিরই সমালোচক, নানা কারণে বললেন, এ রকম রাজনৈতিক বেশ্যাবৃত্তি কোনো রাজনৈতিক নেতাকে মানায় না। এমন প্রশ্ন চারদিকেই। কেউ কেউ আবার এও বলছেন, দেখেন, অদূর ভবিষ্যতে এরশাদ সাহেব আবার কী করেন?
নির্বাচন রাজনৈতিক অধিকার, সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার। কে বা কোন দল নির্বাচনে যাবে বা যাবে না, কে কাকে ভোট দেবে বা দেবে না, সেটা তাদের দলীয় সিদ্ধান্ত বা কৌশলের ব্যাপার। কিন্তু এরশাদ সাহেব যেভাবে জ্ঞানত কিংবা অজ্ঞানত নিজের বিরুদ্ধে নিজেই যুদ্ধ ঘোষণা করে চলেছেন, তাতে তাকে নিয়ে কিছু লিখে সময়ক্ষেপণ করার যুক্তি দেখি না।
বলার অপেক্ষা রাখে না, চলতি সহিংস রাজনীতির মধ্যে নির্বাচন নিয়ে সংকট দিনের পর দিন ঘনীভূত হচ্ছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে যাচ্ছে না, এটিই প্রায় পরিষ্কার। জাতীয় পার্টিও শেষ পর্যন্ত সটকে পড়েছে। বলাই বাহুল্য, এসবে দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হওয়ার পথে। দেশ বিপাকে পড়ার পথে।
কিন্তু যত বাধাই আসুক না কেন আওয়ামী লীগ ও তার রাজনৈতিক মিত্ররা জানিয়েছে, ঘোষিত তফসিল অনুযায়ীই নির্বাচন করবে তারা। ঘোষিত তফসিলের একদিনেরও হেরফের মেনে নেবে না তারা।
সব পক্ষের কাছেই অনুরোধ এই বলে যে, না, সহিংসতা কোনো সমাধান নয়। গণতন্ত্রকে টেকাতে হলে নির্বাচন প্রয়োজন, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা প্রয়োজন। এ রকম একটি পরিস্থিতি কোনো শান্তিপ্রিয় মানুষই প্রত্যাশা করেনি । সবাই চান এবং মনেপ্রাণে চান, দেশে একদিকে যেমন গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা বা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাকে সম্মান জানাতে হোক, একই সঙ্গে সংকট সমাধানে সহনশীলতা ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় দেওয়া হোক। হঠকারিতাই জাতিকে উপকৃত করতে পারে না।
নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের তৎপরতা বা চাপ আছে, যাতে একটি সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়। বিদেশিরা বাংলাদেশের মতো দেশ নিয়ে যতটা মাথা ঘামায় আর কোথাও সে রকম হয় বলে জানা নেই আমার। এরপরও বলব, আমরা নিজেরাও আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলবার অধিকার কম কি দেই?
এক সংক্ষিপ্ত সফরে এসে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং বলেছেন, যত বেশি সম্ভব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন দেখতে চায় ভারত। তবে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, নির্বাচন কখন ও কীভাবে হবে সে সিদ্ধান্ত নেবে কেবল বাংলাদেশের মানুষ। তার কথা হচ্ছে, প্রতিবেশী বন্ধু দেশ হিসেবে ভারত প্রত্যাশা করে, বাংলাদেশের নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন ঘটবে। তবে নির্বাচনটি হতে হবে সব ভয়ভীতি ও সন্ত্রাসমুক্ত পরিবেশে এবং যার ফলাফল দেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়।
ঢাকায় এসে নতুন ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদসহ বিভিন্ন মহলের সঙ্গে বৈঠকের পর রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে আমি নিজেও উপস্থিত ছিলাম সেখানে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, আগামী ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সংঘাতময় পরিস্থিতির মধ্যেই ঢাকায় এসেছিলেন সুজাতা সিং। প্রশ্নে প্রশ্নে বেশ নাজেহাল করারও চেষ্টা করেছেন সুজাতা সিংকে কেউ কেউ। কিন্তু বলতেই হবে, ভারতীয় এই কূটনীতিক যথেষ্টই পাকা মানুষ। বললেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে কী করণীয় তা নির্ধারণের ভার বাংলাদেশের রাজনীতিক এবং দেশের জনগণের ওপর। আরও বললেন, ভারত তার নিজের স্বার্থেই স্থিতিশীল ও উন্নতিশীল বাংলাদেশ চায়। একই সঙ্গে ভারত চায়, প্রতিবেশী বন্ধু দেশটির গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকুক। তাই ভারত প্রত্যাশা করে, এ দেশে এমন একটি নির্বাচন হবে, যেখানে জনগণ তাদের মতামতের প্রতিফলন স্বাধীনভাবে ঘটাতে পারবে।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন গণতন্ত্রসম্মত হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য বৈকি। তিনি বলেছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র চর্চার ধরন এক নয়, সব দেশেরই নিজস্ব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও নির্বাচন পদ্ধতি আছে। নির্দলীয় ও তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি ছাড়াই ভারতের গণতন্ত্র বেশ ভালো চলছে। তবে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ধরন কী হবে তা এই দেশের মানুষই ঠিক করবে।
নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে দুই প্রধান দলের মুখোমুখি অবস্থানের কারণে যখন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে, তখন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশ সফরে আসেন। বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন তার বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকেও ঢাকায় পাঠাচ্ছেন। তারানকোর ওই সফরকে সংকট নিরসনে বাংলাদেশের রাজনীতিকদের জন্য একটি 'সুবর্ণ সুযোগ' হতে পারে বলেও মন্তব্য করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডবি্লউ মজীনা।
যে কোনো গণতান্ত্রিক সমাজ বহু দল-মত ও বিশ্বাসে বিভক্ত। আমরাও একইভাবে। সে কারণেই বলি, আমরা যেন আত্মহন্তারক না হই, আমরা যেন মনুষ্যত্বের বিবেচনাসম্পন্ন জাতিতে পরিণত হই।
মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও সাংবাদিক
(সমকাল, ০৭/১২২/০১৩)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন