|
শাহ্দীন মালিক
|
|
মন্ত্রিত্ব এখন চাকরি!
13 Nov, 2013
আজ সকালে মন্ত্রীরা যথাসময়ে অর্থাৎ সকাল নয়টায় তাঁদের নিজ নিজ চাকরিস্থলে নিশ্চয় হাজির হয়েছেন। সচিবালয়ে যেসব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরি করেন, তাঁদের হাজির হওয়ার কথা সকাল নয়টায়। এখন মন্ত্রিত্ব যেহেতু অন্য সবার মতো একটা চাকরি, সেহেতু যাঁরা এই চাকরি করেন, তাঁদেরও চাকরির বিধিবিধান মেনে সকাল নয়টাই চাকরিস্থলে হাজির হওয়ার কথা। সময়মতো হাজির না হলে অনিয়মিত হাজিরাজনিত যে শাস্তি পেতে হয় মন্ত্রীদের, এখন থেকে সেটাও মাথা পেতে নিতে হবে।
সব চাকরিতেই, বিশেষত চাকরির নিয়মকানুন বা চাকরির বিধিবিধান যেখানে আছে, সেখানে চাকরিতে যোগদানপত্র দিতে হয় এবং সেই যোগদানপত্র গৃহীত হতে হয়। একইভাবে চাকরি থেকে পদত্যাগ করতে হলে পদত্যাগপত্র দিতে হয় এবং পদত্যাগপত্র গৃহীত হতে হবে। পদত্যাগপত্র গৃহীত না হওয়া পর্যন্ত পদত্যাগ কার্যকর হবে না।
প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক—সব ধরনের সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে, মন্ত্রীরা তাঁদের পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীকে প্রদান করেছেন। খবর অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী এখনো পদত্যাগপত্রগুলো গ্রহণ করেননি, অতএব সরকারিভাবে বলা হচ্ছে, মন্ত্রীরা এখনো নিজ নিজ পদে বহাল আছেন। অর্থাৎ মন্ত্রিত্বও অন্য হাজারো চাকরির মতো একটা চাকরি। এই চাকরিতেও পদত্যাগপত্র শুধু দিলেই তা কার্যকর হবে না। পদত্যাগপত্র কার্যকর হতে হলে তা গৃহীত হতে হবে। অন্যভাবে বলতে গেলে বলতে হচ্ছে, যেহেতু পদত্যাগ গৃহীত হবার প্রয়োজনীয়তার উদ্ভব হয়েছে, সেহেতু মন্ত্রিত্ব একটা চাকরি।
দুনিয়ার অন্যান্য দেশের মতো, আমাদের সংবিধানের ভাষাও সহজ-সরল। ১৪৭ অনুচ্ছেদের ৩ উপ-অনুচ্ছেদটাই একমাত্র জটিল অংশ। এই ১৪৭(৩)টাও কিন্তু মন্ত্রীদের বেলায় প্রযোজ্য। ১৪৭(৩) বুঝতে বা ব্যাখ্যা করতে যদি তালগোল পাকিয়ে যেত, তাহলে না বুঝতাম যে তালগোল পাকানোর পেছনে কারণ আছে। কিন্তু মন্ত্রীর পদত্যাগের ব্যাপারে ৫৮ অনুচ্ছেদের ১ উপ-অনুচ্ছেদ যে বিধান, সেটা মোটেও জটিল কোনো ব্যাপার নয়। পাঠক, নিচে ৫৮(১) অনুচ্ছেদটি পড়ে নিজেই বিবেচনা করুন:
‘৫৮(১)...মন্ত্রীর পদ শূন্য হইবে, যদি—
(ক) তিনি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করিবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট পদত্যাগপত্র প্রদান করেন।’ এখানে জটিলতাটা কোথায়।
প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য নিশ্চয় কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। বুঝতে কারও তকলিফ হওয়ার কথা নয়। তবে উচ্চ এবং মহা-উচ্চ সরকারি সব পদে বা সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সুবিধার্থে একটু ব্যাখ্যা করার প্রয়াস গ্রহণ করি!
৫৮ অনুচ্ছেদের শুরুটা হলো এই বলে যে মন্ত্রীর পদ কীভাবে শূন্য হবে। প্রথম উপদফায় অর্থাৎ (ক) উপদফায় বলা হলো—প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগপত্র ‘প্রদান করিলে’। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী মন্ত্রীরা সবাই প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগপত্র ‘প্রদান করেছেন’। এই ‘প্রদানে’র মাধ্যমে সংবিধান অনুযায়ী পদত্যাগ কার্যকর হয়ে গেছে। গ্রহণ করা বা না করার কোনো সুযোগ সংবিধান রাখেনি।
সংবিধান অনুযায়ী মন্ত্রীরা পদত্যাগপত্র প্রদান না করেও পদত্যাগী হতে পারেন। এই ৫৮ অনুচ্ছেদের ৪ উপ-অনুচ্ছেদে বলা আছে—
‘প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করিলে...মন্ত্রীদের প্রত্যেকে পদত্যাগ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে...।’
অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে মন্ত্রীদের আলাদা করে পদত্যাগপত্র লিখতে হবে না। প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র হিসেবে গণ্য হবে। অর্থাৎ পদত্যাগপত্র না পেশ করেও পদত্যাগ করা যায়। আর এ ক্ষেত্রে যেহেতু পদত্যাগপত্র পেশই করতে হয় না, সেহেতু গ্রহণ করা বা না করার প্রশ্ন অবান্তর।
দুই
মন্ত্রীরা যোগদানপত্র বা জয়েনিং লেটার কীভাবে দেন? মন্ত্রীদের কি যোগদানপত্র দিতে হয়? ‘আমি অদ্য অমুক তারিখে পূর্বাহে কাজে যোগদান করেছি। আমার এই যোগদানপত্র গ্রহণ করে বাধিত করবেন’—
এই গোছের কোনো যোগদানপত্র মন্ত্রীদের দিতে হয় না বা যোগদানপত্র ‘গৃহীত’ হওয়ার কোনো দরকার বা বিধান নেই। তাহলে কী আছে?
‘১৪৮(৩): ...শপথ গ্রহণের অব্যবহিত পর তিনি কার্যভার গ্রহণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে।’ অর্থাৎ শপথ নেওয়াটাই হলো এক অর্থে যোগদানপত্র। এ জন্যই আমরা টেলিভিশনে দেখি যে শপথ নেওয়ার আগে পতাকাবিহীন গাড়ি আর বঙ্গভবন থেকে শপথ নিয়ে বেরিয়ে আসার সময় গাড়িতে পতপত করে পতাকা উড়ছে। নিজামী-মুজাহিদ হলেও।
সংবিধানের ভাষায় ‘কার্যভার গ্রহণ’ করতে যোগদানপত্র লাগে না এবং তা গ্রহণ হওয়ারও প্রয়োজন নেই। একইভাবে পদত্যাগপত্র গ্রহণ বা গ্রহণ না করার কোনো সুযোগ নেই।
তিন
পদত্যাগপত্র যেহেতু এখনো গৃহীত হয়নি আর সে কারণে মন্ত্রীরা মন্ত্রিত্ব করে যাচ্ছেন, সেহেতু মন্ত্রিত্ব এখন চাকরি। সমস্যা হলো, এই চাকরির বিধিমালা বা নিয়মকানুন কী।
সরকারের প্রায় ধরনের চাকরির বিধিমালা আছে। অর্থাৎ চাকরিতে নিয়োগ কীভাবে হবে। পদোন্নতি, বদলি, ছুটি, অবসর ইত্যাদির শর্ত কী, সেগুলো চাকরি বিধিমালায় বিস্তারিত উল্লেখ থাকে। চাকরির নিয়মকানুন না মানলে, কাজে গাফিলতি হলে কীভাবে কী কী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সেসব ব্যাপারও চাকরি বিধিমালার অংশ।
বিভিন্ন ধরনের সরকারি চাকুরেদের বেলায় বিভিন্ন আইন ও বিধিমালা আছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে একই চাকরির বিভিন্ন বিষয়ে বহুবিধ আইন-বিধিমালা থাকতে পারে।
অধমের জানামতে, মন্ত্রীদের চাকরিসংক্রান্ত কোনো আইন বা বিধিমালা নেই। শুধু তাঁদের বেতন-ভাতা সুযোগ-সুবিধাসংক্রান্ত আইন আছে।
কোনো চাকরির ব্যাপারে যদি বিধিমালা বা আইন না থাকে, তাহলে সেই চাকরির শর্তাবলি কীভাবে নির্ধারিত হয়? এ ক্ষেত্রে, অর্থাৎ চাকরির শর্তাবলি-সংক্রান্ত যখন কোনো নির্দিষ্ট আইন বা বিধিমালা না থাকে, তখন আমরা বলি ওই চাকরির শর্তাবলি ‘মাস্টার সার্ভেন্ট রুলস’ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। অর্থাৎ রুক্ষ বাংলায় ‘মনিব-চাকর নিয়ম দ্বারা’।
বেশ কয়েকটি পত্রিকায় পড়লাম, পদত্যাগপত্র প্রদানের সময় পাঁচজন প্রতিমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেছেন।
চার
প্রায় সবকিছুতেই সরকার প্রতিনিয়ত এখন গুবলেট পাকিয়ে ফেলছে। সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। অতীতের অন্য বিভিন্ন সরকারের মতো এই সরকারও অনেক হিসাব-নিকাশ করছে, প্ল্যান-পাঁয়তারা করছে। কিন্তু আমাদের ইতিহাস বলে, ভালো কাজ না করলে কোনো প্ল্যান-পাঁয়তারাই কাজে লাগে না।
বেশি পেছনে যাওয়ার দরকার নেই। গত বিএনপি সরকার তাদের হিসাব আর প্ল্যান অনুযায়ী চতুর্দশ সংশোধনী পাস করিয়েছিল ২০০৪ সালের মে মাসে। অর্থাৎ মেয়াদ শেষ হওয়ার কমবেশি আড়াই বছর আগে। ওই সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের চাকরির বয়স বাড়িয়েছিল ৬৭ বছরে। ধরে নেওয়া হয়, একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হতে পারেন, সে জন্যই এই সংশোধনী। আরও অনেক হিসাব-নিকাশ ছিল। কোনো কিছুই কাজে দেয়নি।
এই সরকারও পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করিয়েছিল প্রায় আড়াই বছর আগে। আর এখন মন্ত্রীর পদকে পর্যন্ত মামুলি চাকরির পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। কোনো কিছুতেই সম্ভবত শেষরক্ষা হবে না।
তাই কূটকৌশল, হিসাব-পাঁয়তারা বাদ দিয়ে সরল বিশ্বাসে জনসেবা করুন। তাতেও ভরাডুবি ঠেকানো যাবে না, তবে আমাদের, অর্থাৎ জনগণের ভোগান্তি কিছুটা হলেও কমবে, আর আমরা তাতেই কৃতজ্ঞ থাকব।
আর মন্ত্রীদের দোহাই—আপনারা কারও চাকরি করেন না। মনিব-চাকরের আইন আপনাদের জন্য নয়।
ড. শাহদীন মালিক: অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট, অধ্যাপক স্কুল অব ল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।
(প্রথম আলো, ১৩/১১/২০১৩)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন