|
মোস্তফা কামাল
|
|
মানুষ হত্যার রাজনীতি বন্ধ করুন
06 Nov, 2013
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সম্প্রতি দেশের দুটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিক জনমত জরিপ প্রকাশ করেছে। বহুল আলোচিত ওই জরিপে দেখা গেছে, জনপ্রিয়তায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপি অনেক এগিয়ে আছে। এ মুহূর্তে নির্বাচন হলে বিএনপি আওয়ামী লীগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ভোট বেশি পাবে। এর ফলে সরকার ভীষণভাবে মানসিক চাপে পড়েছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরাও মাঠ ছেড়ে দেওয়ার মতো অবস্থা। আর বিরোধী দল বিএনপি স্বস্তির ঢেঁকুর তুলছে।
জনমত জরিপের ফলাফল নিয়ে সারা দেশে ব্যাপক বিতর্ক চলছে। বিষয়টি সরকারপক্ষের কাছে বিস্ময়কর, অতিরঞ্জন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে হয়েছে। তারা বলছে, বাস্তবতার সঙ্গে জনমত জরিপের কোনো মিল নেই। তবে বিএনপি ঘরানার লোকেরা মনে করেন, জনমত জরিপের তথ্য অনেকটাই বাস্তবসম্মত। এতে অতিরঞ্জন কিছু নেই। অবশ্য জনমত জরিপে অংশগ্রহণকারী কোনো কোনো ব্যক্তি স্বীকার করেছেন, 'আওয়ামী লীগ অনেক ভালো কাজ করেছে। তার পরও আওয়ামী লীগকে ভোট দেব না।'
আওয়ামী লীগের দৃশ্যমান ভালো কাজ কী কী জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধুর ভক্ত জনৈক ভদ্রলোক বললেন, যে দেশে খুনিদের বিচার নিষিদ্ধ ছিল, সেই দেশে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার হয়েছে। স্বাধীনতার ৪০ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে আওয়ামী লীগ সরকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। জেলখানায় জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার প্রক্রিয়াও শেষ হওয়ার পথে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না এলে এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার কোনো দিন হতো না।
তা ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকার শিক্ষা খাতের ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়েছে। সড়ক ও রেল যোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি, বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন করেছে। রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে। মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন করেছে। এখন আর মানুষ না খেয়ে মারা যায় না। এ সবই দৃশ্যমান উন্নয়ন। এর বিপরীতে বিএনপির দৃশ্যমান কোনো উন্নয়ন নেই। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ১০ বছর দেশ পরিচালনা করলেও দেশের উন্নয়নে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার চেয়ে শেখ হাসিনা অনেক বেশি দক্ষ ও পরিপক্ব। রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা এবার বেশ মুনশিয়ানার পরিচয় দিচ্ছেন।
কিছুদিন আগে সংলাপে বসার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খালেদা জিয়াকে ফোন করেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ ধরনের ফোন কালচার আগে কখনো দেখা যায়নি। শেখ হাসিনা সরাসরি খালেদা জিয়াকে ফোন করে সংলাপে বসার আহ্বান জানান। তিনি তাঁকে অনুরোধ করেন, 'হরতাল প্রত্যাহার করে গণভবনে আসুন। আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করি।'
কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, দুই নেত্রীর ফোনালাপের পূর্ণ বিবরণ যখন গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়ে গেল, তখন এ দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে নিজেকে খুবই ছোট মনে হয়েছে। আমাদের দেশ যাঁরা পরিচালনা করেন, তাঁরা এভাবে গ্রাম্য স্টাইলে ঝগড়া করতে পারেন! দুই নেত্রীর ফোনালাপের সময় বিভিন্ন ইস্যুতে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। তাতে কিছু ব্যক্তিগত বিষয়ও উঠে এসেছে। তখন খালেদা জিয়া যত বেশি উত্তেজনা দেখিয়েছেন, শেখ হাসিনা ততটাই নরম ছিলেন। হতে পারে এটা শেখ হাসিনার কৌশল এবং পূর্বপরিকল্পিত টেলিসংলাপ। খালেদা জিয়া রাজনৈতিক এই কৌশলটা ধরতে পারলেন না কেন? কেন তিনি সেদিন উত্তাপে ফেটে পড়লেন?
দুই নেত্রীর টেলিসংলাপের ঘটনায় শেখ হাসিনার প্রতি মানুষের সহানুভূতি বেড়েছে। অন্যদিকে খালেদা জিয়া যে আচরণ করেছেন, তাতে বিএনপির নেতা-কর্মী-সমর্থকরাও বিস্মিত হয়েছেন। খালেদা জিয়া এমন আচরণ করতে পারেন, তা কারো ধারণার মধ্যে ছিল না। যদিও খালেদা জিয়ার ভক্তরা বলছেন, টেলিফোনে শেখ হাসিনাকে পেয়ে তিনি রাগ-ক্ষোভ ঝেড়েছেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেই খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। ওই বাড়িতে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তাঁর অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। বাড়ি ছাড়ার সময় আপসহীন নেত্রীর চোখে পানি দেখে অনেকেই চোখের পানি ফেলেছেন। তাঁর দুই ছেলেকে দেশে ফিরতে দেওয়া হচ্ছে না। তাঁর দলের নেতা-কর্মীরা গত প্রায় পাঁচ বছরই দৌড়ের ওপর ছিলেন। অনেকে নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সব মিলিয়ে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করার সব ধরনের চেষ্টা হয়েছে। কাজেই খালেদা জিয়ার কাছ থেকে স্বাভাবিক আচরণ আশা করাই বাতুলতা।
বিএনপির এই যুক্তি একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু বিএনপি কেন আলোচনার সুযোগ হাতছাড়া করল? একদিকে বিএনপি নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগই সংলাপ চায় না। তারা তো চাইবেই না। তারা কৌশলে বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখবে। এটা তো সবার জানা। বিএনপি নেতারাও যখন বুঝতে পারছেন যে তাঁদের ছাড়াই আওয়ামী লীগ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাহলে সংলাপের আহ্বানে সাড়া না দেওয়ার কারণ কী?
এখন একের পর এক হরতাল দিয়ে বিএনপি পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে তুলছে। গত হরতালের আগে এবং টানা তিন দিনের হরতালে ২২ জনের প্রাণহানি ঘটে। এবারও হরতাল ডেকেই জ্বালাও-পোড়াও শুরু হয়। প্রথম দিনের হরতালে চারজনের করুণ মৃত্যু হয়। এ দেশে মানুষের জীবনের কি কোনোই দাম নেই! মা-বাবার চোখের সামনে শিশু কিংবা শিশুসন্তানের চোখের সামনে মা-বাবার করুণ মৃত্যু আর কত দেখতে হবে আমাদের? আমরা আর পারছি না! আমাদের রাজনীতিকরা কী করে এসব হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখেন? তাঁদের বুক কি একটুও কাঁপে না!
গতকাল সহযোগী একটি দৈনিকের রিপোর্টে দেখলাম, গত ২২ বছরে (তিন সরকারের আমলে) রাজনৈতিক সহিংসতায় দুই হাজার ৫১৯ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে বিএনপি সরকারের আমলে (১৯৯১-১৯৯৬) ১৭৪ জন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে (১৯৯৬-২০০১) ৭৬৭ জন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে (২০০৭-২০০৯) ১১ জন এবং আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে (২০০৯-২০০১৩) ৫৬৪ জন মারা গেছে। এত মানুষের প্রাণহানির দায় কার? রাজনীতিকরা এর দায় এড়াতে পারবেন কি?
যে রাজনৈতিক দল কথায় কথায় হরতাল ডেকে মানুষকে দুর্ভোগে ফেলে, দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করে, সেই দলকে কেন আমরা ভোট দিয়ে বারবার ক্ষমতায় আনি? দাবি আদায়ের জন্য কেন ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি দিতে হবে? রাজনীতিকদের ক্ষমতার লড়াইয়ে কেন সাধারণ মানুষ বলি হবে?
রাজনীতিকদের কাছে অনুরোধ, মানুষ হত্যার রাজনীতি, দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের রাজনীতি বন্ধ করুন। সাধারণ মানুষের রক্ত মাড়িয়ে, তাঁদের লাশের ওপর পা দিয়ে রাজনীতিকরা ক্ষমতার আসনে বসবেন, তা আমরা দেখতে চাই না। রাজনীতিকদের অপরাজনীতির খেসারত দেবে দেশের সাধারণ মানুষ- তা আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। এ দেশের মানুষ অসম্ভব শান্তিপ্রিয়। আপনাদের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে সাধারণ মানুষের শান্তি বিনষ্ট হতে পারে না। এ দেশের মানুষ কিন্তু ঘুরে দাঁড়াতেও জানে। তারা কিন্তু আপনাদের না বলবে। সেদিন বেশি দূরে নয়।
আমরা মনে করি, আলোচনার মাধ্যমে যেকোনো সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আলোচনার মাধ্যমেই চলমান সমস্যার সমাধান করবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা। কিন্তু আমরা দেখছি, সরকার সংলাপের নামে কেবল সময়ক্ষেপণ করে চলেছে। নানা ছুতায় সংলাপে বসতে দেরি করছে। এর মধ্যে উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তিনি মহাসচিব পর্যায়ে নিঃশর্ত আলোচনায় রাজি হয়েছেন। অথচ প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় দিয়েছেন বৃহস্পতিবার। তিনি এতটা দেরি না করলেও পারতেন। এতেই বোঝা যায়, সংলাপে ক্ষমতাসীন দলের অনাগ্রহ আছে।
আবার বিএনপি অপেক্ষা না করেই হরতাল দিয়ে সংলাপের পরিবেশ নষ্ট করেছে। হরতাল দিয়ে যে দাবি আদায় করা যায় না, তা তো প্রমাণিত। তার পরও কেন এই হরতাল? হরতাল কেবল মানুষের দুর্ভোগ বাড়ায়। মায়ের বুক খালি করে। পরিবারকে অসহায় করে। বিএনপির কাছে অনুরোধ, এ ধরনের কর্মসূচি থেকে বিরত থাকুন। আপনারা বিকল্প কর্মসূচির কথা ভাবুন। প্রয়োজনে মানববন্ধন, অবরোধ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও করুন। তার পরও হরতালের মতো অর্থনীতি ধ্বংসকারী, প্রাণসংহারী কর্মসূচি বাদ দিন।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
(কালের কন্ঠ, ০৬/১১/২০১৩)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন