|
জসিম উদ্দিন
|
|
সীমান্তহত্যা মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবী
02 Nov, 2013
দশ বছরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীÑ বিএসএফ বাংলাদেশের অন্তত এক হাজার নাগরিককে হত্যা করেছে। পৃথিবীর অন্য কোনো সীমান্তে এতগুলো মানুষ হত্যা তো দূরের কথা, আহত হবেন এমন চিন্তাও করা যায় না। কানাডার ইমিগ্রেশন এ বাহিনীকে ‘খুনে’ বাহিনী হিসেবে চিহ্নিত করে সে দেশে তাদের ঢুকতে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। যেসব সীমান্তে সীমান্তরক্ষীরা প্রতিপক্ষ বাহিনী ও রাষ্ট্রের নাগরিকদের ওপর আক্রমণ চালায়, সেসব কেউ বন্ধুপ্রতিম দেশ নয়। ফিলিস্তিন-ইসরাইল এবং আজারবাইজান-আর্মেনিয়া এমন প্রতিবেশী দেশের উদাহরণ। অথচ বাংলাদেশের সাথে ভারতের রয়েছে উষ্ণ বন্ধুত্বের সম্পর্ক। এটি বিশ্বের একমাত্র বিরল বন্ধুত্বের উদাহরণ। যেখানে প্রতিবেশীরা বন্ধুদের ওপর নিষ্ঠুর অত্যাচার চালায়। এই বাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যার পর উৎসব করে। উলঙ্গ করে শরীরে তেল মেখে নারকীয় কায়দায় পেটায়। আবার এসব ঘটনা ভিডিও করে নিজেরাই ছেড়ে দেয়। এ এক বিকৃত উল্লাস।
এক হাজার হত্যাকাণ্ডের একটিরও বিচার হয়নি। ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ বন্ধুত্বের খাতিরে লাশের দাফন করে চুপ মেরে যাচ্ছে। এবার একটা অভিনব বিচারের আয়োজন করল বিএসএফ। এই বিচার সবার জন্য অসম্মান ও অমর্যাদা বয়ে আনলেও জিতেছে ঘাতকপক্ষ। বাড়াল কেবল আত্মীয়স্বজনের দুঃখভার। স্পষ্ট হলো এ বিচারের লক্ষ্য ছিল খুনির জন্য পরোক্ষভাবে একটি পুরস্কারের ব্যবস্থা করা। খুনিদের বিশ্বাস আরো শক্ত করে দেয়া হলোÑ সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা করলে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ থাকবে না। গুলিবিদ্ধ কিশোরী ফেলানীর ছোট দেহটি পাঁচ ঘণ্টা কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলেছে। রক্তশূন্য হয়ে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত চার ঘণ্টা মেয়েটি পানি পানি বলে ঘোঙালেও বিএসএফের হৃদয় একটুও টলেনি। বিএসএফের গুলির মুখে বাংলাদেশ সীমান্ত থেকেও কেউ মেয়েটিকে পানি পানের জন্য এগিয়ে যেতে পারেনি।
বিএসএফ আসাম-মেঘালয় ফ্রন্ট বিচারের (প্রহসনের) আয়োজন করে। বিচারকও এই বাহিনীর সদস্য। যেই বাহিনী ‘খুনি’ বলে স্বীকৃতি পেয়েছে। শীর্ষস্থানীয় পাঁচ আঞ্চলিক কর্মকর্তার সমন্বয়ে গঠিত ওই বিচারক প্যানেল মন্তব্য করে খুনি অমিয় ঘোষের বিরুদ্ধে প্রাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ ‘অপ্রমাণিত ও অপর্যাপ্ত’। খুনির সাজা ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যু, ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা; প্রেসিডেন্টের ক্ষমার আওতায় পড়লে একেবারে কম গিয়ে সেটা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। কিন্তু অমিয় ঘোষের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার যুক্তি বিএসএফ সদস্যদের এ বিচারক প্যানেল খুঁজে পায়নি। তাহলে মেয়েটিকে কোন ভূতে গুলি করে মেরেছে! এ ধরনের বিচার খুনের স্পৃহাকে বাড়িয়ে দেবে নিঃসন্দেহে। এর আগে বিএসএফ সদস্যরা অন্তত এটুকু বিশ্বাস করত, বিচার হলে তারা অপরাধী সাব্যস্ত হবে। শাস্তি জানের বদলা জান না হলেও কিছু একটা অন্তত হবে। এখন কর্তৃপক্ষ প্রকাশ্যে ট্রাইব্যুনাল বসিয়ে প্রমাণ করে দিলোÑ দেখো হত্যাকারীদের কোনো ভয় নেই। একেবারে প্রকাশ্যে দিবালোকে হত্যা করলেও আমরা নির্দোষ প্রমাণ করে দেব।
বাংলাদেশ ও ভারতের তাবৎ মানবাধিকার সংগঠন চুপ করে বসে থাকলেও কলকাতার মানবাধিকার সংগঠন ‘মাসুম’ বিবেকের তাড়নায় নীরবতা ভাঙল। তাদের পক্ষ থেকে কৃতি রায় মন্তব্য করেছেন, ‘বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। ফেলানী এই সন্ত্রাসের শিকার। বাংলাদেশ সরকার ও সীমান্ত রক্ষায় নবগঠিত ‘বর্ডার গার্ড’ চোখ বন্ধ করে রাখলেও আবেগ ধরে রাখতে পারেনি ফেলানীর মা-বাবা। বাবা নুরুল ইসলাম বলেছেন, একজন হত্যাকারীর এ ধরনের অমানবিক কাজ বিনাবিচারে পার পেতে পারে না। অপরাধীকে সাজানো নাটকের মাধ্যমে নির্দোষ ঘোষণাকে ভারত সরকারের প্রতারণা বলে উল্লেখ করে তার মা বলেন, ‘আমরা এ বিচারকে প্রত্যাখ্যান করি।’ গরিব নুরুল ইসলাম আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হবেন বলে ঘোষণা করেছেন। রাষ্ট্র বা নাগরিক অধিকার রক্ষায় নিয়োজিত বাংলাদেশী কোনো গ্রুপ সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসেনি। নুরুল ইসলামের এ আশা এখন শুধু হতাশা বাড়াবে।
পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ভারতীয় সীমান্তরক্ষা বাহিনীর আচরণ সম্পূর্ণ বিপরীত। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও নাগরিকদের ব্যাপারে তারা যেমন বেপরোয়া ও আইনবহির্ভূত আচরণ করে, পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে ঠিক ততটাই যেন আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এমনকি হত্যার শিকার হলেও দাঁড়ি কমা মেনে মাত্রাজ্ঞান রেখে চলে। প্রমাণ হয় ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা শক্তের ভক্ত নরমের যম। ২৩ অক্টোবর বুধবার রাতে এক বিএসএফ সদস্যকে হত্যা ও ছয়জনকে আহত করেছে পাকিস্তানি বাহিনী। ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের ৫০টি স্থানে বিএসএফকে লক্ষ্য করে একযোগে গুলি চালিয়েছে পাকিস্তানিরা। নিজেদের সদস্যকে হত্যা ও আহত হওয়ার ঘটনা প্রকাশ করার সাথে সাথে বিএসএফ সদর দফতর থেকে দাবি করা হচ্ছে পাকিস্তান এক বছরে ২০০ বার অস্ত্রবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। বিএসএফের এ ধরনের বক্তব্যের মধ্যে করুণাপ্রাপ্তির আকুতি ও আইনের প্রতি অনুগত ভাব দেখানোর অভিব্যক্তি রয়েছে।
একই দিন খবরে প্রকাশÑ বাংলাদেশের ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্ত থেকে লাল মিয়া নামে একজনকে ধরে নিয়ে গেছে। লাল মিয়ার বিরুদ্ধে বিএসএফের অভিযোগ তিনি গরু ব্যবসায়ী। লালমিয়ার কপালে কী ঘটেছে পরের দিনের মিডিয়ায় দেখা যায়নি। কিন্তু পাকিস্তান সীমান্তে বিএসএফ কোনো পাকিস্তানি সীমান্তরক্ষী হত্যা করেছে এমনকি মামুলি কোনো নাগরিককে ধরে নিয়ে গেছে এমন কোনো খবর নেই পর দিন। তবে খবর পাওয়া গেল বাংলাদেশের বেনাপোল সীমান্তে এক বৃদ্ধকে হত্যার। চেকপোস্টোর কাছেই বিএসএফ ওই বৃদ্ধকে হত্যা করে গাছে ঝুলিয়ে রাখে। এরপর দিন এক ডজন বাংলাদেশীকে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ। মনে হতে পারে, পাকিস্তান সীমান্তে একচেটিয়া মার খাওয়া এই বাহিনী প্রতিশোধ নিচ্ছে বাংলাদেশ সীমান্তে। চীন, মিয়ানমার সীমান্তে ভারতীয় এ বাহিনীকে আরো শীতল অবস্থানে দেখা যায়। বছরের পর বছর হতাহতের কোনো ঘটনা পাওয়া যায় না।
নবগঠিত বর্ডার গার্ড নিয়ে বিএসএফের স্বস্তির অনেক কারণ আছে। সীমান্ত নিয়ে উদ্বেগ ও উৎসাহ বা কোনো কার্যক্রমও যেন তাদের নেই। তারা বর্তমান সরকারের সময় দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক দমন অভিযান নিয়ে ব্যস্ত। সীমান্ত রক্ষা এবং নাগরিকদের জীবন রক্ষা যে তাদের দায়িত্বের মধ্যে এরকম কখনো মনে হচ্ছে না। শাপলা চত্বরে বাংলাদেশের আলেমদের ওপর ক্র্যাকডাউনে নেতৃত্বে ছিল তারাও। ওই অভিযানে কতজন মানুষ হত্যা করা হয় সরকারের পক্ষ থেকে কোনো হিসাব দেয়া হয়নি। বিজিবির দায়িত্বশীল কর্মকর্তার পক্ষ থেকে এই হত্যা অভিযানের পক্ষে সাফাই গাইতে দেখা গেছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কঙ্কাল উদ্ধার হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের পক্ষ থেকে ৭০ জন হত্যার একটি হিসাব তুলে ধরা হয়। এরপর অধিকারের শীর্ষ কর্মকর্তা আদিলুর রহমানকে সরকার গ্রেফতার করে। এর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে একটি রায়ের বিরুদ্ধে সৃষ্ট বিক্ষোভ দমাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিজিবি ব্যবহৃত হয়। সরকারি বাহিনীর গুলিতে কয়েক দিনে প্রায় ২০০ মানুষ প্রাণ হারায়। আহত হয় হাজার হাজার নাগরিক। দেশের নিরাপত্তা হেফাজতের জন্য সৃষ্ট বাহিনী দেশের মানুষের বুকে গুলি চালাচ্ছে। বিএসএফ হয়তো এ বাহিনীকে শক্তিহীন ও অথর্ব মনে করে না; তবে তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য যে সীমান্ত নয় সে ব্যাপারে নিশ্চিত।
প্রতিপক্ষ বাহিনীর অন্যায় ও বেআইনি কর্মকাণ্ডকে সমর্থন দেয় এমন কোনো বাহিনী বিশ্বে পাওয়া যায় না। বছরের প্রথম আট মাসে বিএসএফ ২১ বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউনের পক্ষ থেকে বিষয়টি সম্পর্কে বিজিবি মহাপরিচালকের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি দাবি করেন, ‘মাত্র’ ১৬টি সীমান্ত হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১৪ জনকে মেরেছে বিএসএফ। তিনি আলাদাভাবে উল্লেখ করেন, ‘দুজন স্থানীয় বিরোধের জেরে মারা গেছে, তাদের হত্যার সাথে বিএসএফের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। ’
তিনি বলেন, ‘বিএসএফ সদস্যরা প্রাণঘাতী কোনো অস্ত্র আর ব্যবহার করে না, এমনকি বাংলাদেশীদের বিরুদ্ধে তারা ভারী অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করে না। ওই বাংলাদেশীরা রাবার বুলেটের আঘাতে নিহত হয়েছে। সম্ভবত তারা খুব কাছে থেকে রাবার বুলেটের আঘাত পেয়েছেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘এমনকি ছোটখাটো পাথরের আঘাতে মানুষ মারা যেতে পারেন। সেটি যদি শরীরের কোনো স্পর্শকাতর অঙ্গে আঘাত হানে।’
পাঠকেরা মনে করতে পারেন, এ বক্তব্য প্রকৃতপক্ষে বিএসএফ-প্রধানের। প্রতিবেদক ভুল করে বিএসএফ প্রধানের জায়গায় বিজিবি প্রধানের নাম বসিয়ে দিয়েছেন। ভালো করে খেয়াল করলে পাঠকের এ ভ্রান্তি কেটে যাবে। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রধান নিজেদের দায়িত্ব কর্তব্যের কথা বলতে গিয়ে প্রতিবেদককে যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, তা বিএসএফের অপরাধের পক্ষে সাফাই হয়ে গেছে। বিএসএফ ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে না। তারা রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। আবার ব্যাখ্যা দিয়ে বলছেন, রাবার বুলেট কোজ রেঞ্জ থেকে শরীরে আঘাত হানলে মানুষ প্রাণ হারায়। তিনি আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে বোঝাচ্ছেন এমনকি হালকা পাথরের আঘাতেও মানুষ প্রাণ হারাতে পারে। প্রতিবেদক অবশ্য পাল্টা প্রশ্ন করেননিÑ তাহলে ইসরাইলিরা বা আর্মেনিয়ান সীমান্তরক্ষীরা ভারী অস্ত্র ব্যবহারের পরও কেন সীমান্তে সেখানে এত বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটছে না। বিজিবির কাজ এমন হতে পারে না নিজের দেশের মানুষের হত্যার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা চালাবে। মার খেয়ে যদি কেউ ব্যাখ্যা করে তাদের কেন মারটি দেয়া হলো; আর বলে এ ধরনের মার খাওয়াটা অযৌক্তিক নয়; তাহলে বিএসএফ কেন বিশ্বের যেকোনো নিষ্পাপ বাহিনীও প্রতিপক্ষের ওপর হত্যা খুন করতে দ্বিধা করবে না। তাদের আঙুল ট্রিগারের ওপর সব সময় নিশপিশ করবে।
চীন, পাকিস্তান ও মিয়ানমার সীমান্তের মতো বাংলাদেশের সীমান্তে বিএসএফ কেন আইন মানছে না তার আরো একটি জোরদার কারণ রয়েছে। সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যার খবর দেশীয় মিডিয়ায় গুরুত্ব পায় না। সরকারের অন্যায় কর্মকাণ্ডের সমালোচনাকে সংবিধানবহির্ভূত আচরণ বলে ব্যাখ্যা করতে তৎপরতা দেখালেও সীমান্তে হত্যাকে একটি খবর হিসেবেও তুলে ধরতে আগ্রহ দেখায় না তারা। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে ভারী যন্ত্রপাতি বহন করে নিয়ে যায় ভারত। ভারী যানবাহনের চাপে দুর্বল রাস্তা ভেঙে গুঁড়িয়ে গিয়ে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে যায়। বড় বড় ট্রেলারের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিতাস ও অন্য নদীর ওপর এক ডজন বাঁধ দিতে হয়। এর ফলে কৃষি ও মৎজীবীদের জীবীকা বিপন্ন হয়। শত শত চাকার ট্রেলরগুলো যখন বাংলাদেশের ক্ষতি করে চলেছে মিডিয়ায় কোনো সংবাদ দেখা যায়নি। আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ও বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছিলেন। ইলিয়াস আলী গুম হয়ে গেছেন। মাহমুদুর রহমানকে একটি মামলায় ছয় মাস জেল খাটতে হয়েছে। ওই মামলায় বিচারকের একটি উক্তি ছিল, ‘ট্রুথ ইজ নট ডিফেন্স’। ছাড়া পাওয়ার পর আবারো তাকে আটক করা হয়েছে। এবার তার ওপর আরো নিষ্ঠুর নির্যাতন নেমে এসেছে। বাংলাদেশের বেশির ভাগ বুদ্ধিজীবীর চিন্তাভাবনা এসব মিডিয়ার সমান্তরালে রয়েছে।
বাংলাদেশের মিডিয়া বুদ্ধিজীবী আর ভারত সরকারের মধ্যে চিন্তার মিলটি জনগণের বিপক্ষে কাজ করছে পুরোদমে। ‘গণজাগরণের’ নামে শাহবাগ থেকে যখন সারা দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হলো, তখন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী বিপথগামী বিভ্রান্ত উচ্ছৃঙ্খল নারী-পুরুষদের শুভেচ্ছা ও স্বাগত জানিয়েছেন। জনগণের অংশগ্রহণের নামে কথিত এ আন্দোলনকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়েছে মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীরা। মানবতাবিরোধী অপরাধের নামে বাংলাদেশের যে বিচার চলছে, তা দেশে বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এ ধরনের একটি বিতর্কিত বিচার নিয়ে ভারত অত্যন্ত উৎসাহের সাথে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। কোনো দেশ এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়ার মতো অভদ্রতা দেখায়নি। এতে সাধারণ মানুষের এ ধারণা জন্ম নেয়া স্বাভাবিক যে, ভারতের শাসকেরা কখনো বাংলাদেশের জনগণের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায় না। তারা মিডিয়া এবং বুদ্ধিজীবীকেন্দ্রিক গোষ্ঠীকে কব্জায় রেখে বাংলাদেশের মানুষের আনুগত্য চায়। প্রতিবেশীদের সাথে ভারতের এ ধরনের নীতি শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপে ব্যর্থ হয়েছে। এ নীতির প্রয়োগ করতে গিয়ে নেপালে স্থিতিশীল সরকার কায়েম ব্যাহত হচ্ছে। এ ধরনের নীতিতে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারত মাঝে মাঝে সফলতা পাচ্ছে। তবে তা বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণের জন্য স্থায়ী কল্যাণ বয়ে আনছে না। দণি এশিয়ার স্থিতিশীলতাও এতে নষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশের মিডিয়া এবং বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে রাখলেই ভারতের স্বার্থ উদ্ধার হয়ে যাবে না। এ জন্য দরকার ভারত সরকারের নীতির পরিবর্তন। এটা যেন কোনো রকমে ভারতের শাসকদের বুঝে আসে না।
বন্ধুত্বের সম্পর্ক আরো উন্নত করতে (ভারত সরকারের মতে) ১০০ বাংলাদেশী তরুণকে সফরে নিয়ে গেছে ভারত। এরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, সাংবাদিক ও বিভিন্ন দফরের কর্মকর্তা। আট দিনের সফরে তারা দিল্লি, আগ্রা ও বেঙ্গালুর ভ্রমণ করেন। সাক্ষাৎ করেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সাথে। সফর শেষে ২৮ অক্টোবর তারা দেশে ফিরে এসেছেন। প্রতিনিধিদল ভারতে যাওয়ার আগে ক্রিকেট হিরো সাকিব আল হাসান ও অভিনেত্রী জয়া আহসানকে অতিথি করে একটি প্রীতি সম্মেলনের আয়োজন করে ভারতীয় দূতাবাস। এ ধরনের প্রতিনিধি দলের সফর একটি সৌজন্য রেওয়াজ। জনগণের সাথে ভিন্ন দেশের বন্ধুত্ব তৈরির একটি সোপান। এ কার্যক্রমকে ভারত সব সময় বাংলাদেশে একটি কোটারি তৈরির কাজে ব্যবহার করতে চেয়েছে। এর মাধ্যমে তারা দুর্বল একটি গোষ্ঠীকে বাগে নিতে পেরেছে। এরা সব সময় ব্যবহার হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে। ফলে অল্প কিছু মানুষ ভারতের অন্যায় কর্মকাণ্ডের (সীমান্ত হত্যা জোর করে চাপিয়ে দেয়া চুক্তি) পক্ষে দাঁড়াচ্ছে কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে তারা ভারতপন্থী হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।
(নয়া দিগন্ত, ০২/১১/২০১৩)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন