Image description

প্রবাদে আছে, ঢাকের কাঠি ঢাকেই থাকে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন প্রশাসনের কাছে প্রত্যাশা ছিল, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাই হবে তাদের কাজের মূল ভিত্তি। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, প্রবাদের মতোই সেটা আর হয়নি।

চট্টগ্রামে লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ, অর্থায়ন, পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় ডেনমার্কের এপিএম টার্মিনালের সঙ্গে সরকারের তড়িঘড়ি করে ৩০ বছরের চুক্তি যেন তারই প্রমাণ।

চুক্তি সইয়ের জন্য যে সময় বেছে নেওয়া হয়েছে এবং চুক্তির শর্তাবলী সম্পর্কে যে নগণ্য তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে, তার সবই যেন 'কাকতালীভাবে' মিলে যাচ্ছে পতিত সরকারের সময় ভারতের আদানির সঙ্গে হওয়া অসামঞ্জস্যপূর্ণ ২৫ বছরের বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির সঙ্গে।

সন্দেহ নেই, বাংলাদেশের উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে চট্টগ্রাম বন্দরের আধুনিকায়ন জরুরি এবং অত্যাধুনিক কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ এরই অংশ। কিন্তু যেভাবে এই চুক্তি করা হয়েছে, তা সন্দেহের মেঘ ঘণীভূত করেছে এবং ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করেছে এক অশুভ দৃষ্টান্ত।

২০২৩ সালে এপিএম টার্মিনালের মূল কোম্পানি মায়েরস্ক গ্রুপের একটি অনাকাঙ্ক্ষিত প্রস্তাবের মাধ্যমে এই চুক্তির সূত্রপাত—প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যার অনুমোদন দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।

২০১৪ সালের ৩ জানুয়ারি বাংলাদেশ–ডেনমার্কের প্রথম যৌথ প্ল্যাটফর্ম বৈঠকে এপিএম টার্মিনালস বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব গ্রহণ করে। এরপর ছয় মাসের মাথায় সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি) কর্তৃপক্ষ সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনকে এই প্রকল্পের লেনদেন পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেয়—যেখানে এ ধরনের নিয়োগে সর্বোত্তম পদ্ধতি হচ্ছে টেন্ডার আহ্বান করা।

এই নিয়োগের পর দুই মাসও না পেরোতেই আওয়ামী লীগ সরকার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং শান্তিতে নোবেল জয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। ক্ষমতায় এসে জনগণের জন্য সর্বোত্তম সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্য থেকে আওয়ামী লীগের আমলে স্বাক্ষরিত প্রতিযোগিতাহীন চুক্তিগুলো বাতিলের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।

পরবর্তী সময়ে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ছাড়াই দেওয়া বেশকিছু চুক্তি নবায়ন করা হয়নি। নবায়নযোগ্য জ্বালানির বেশকিছু চুক্তি, সামিট গ্রুপের সঙ্গে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল চুক্তি এবং দেশের প্রধান অপরিশোধিত তেল আমদানি স্থাপনা পরিচালনার জন্য চীনা ঠিকাদার নিয়োগ বাতিল করা হয়।

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার উদাহরণ স্থাপন করতে মহেশখালীর অদূরে ৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকার সিঙ্গেল-পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) টার্মিনালের পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নতুন করে টেন্ডার আহ্বান করে সরকার। এসপিএম নির্মাণকারী চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিকে জ্বালানি আইনের বিশেষ বিধানের আওতায় এটি পরিচালনার সুযোগ দেওয়ার কথা থাকলেও, তাদেরকে উন্মুক্ত দরপত্র প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে বলা হয়।

অন্তর্বর্তী সরকারের ন্যায্যতার প্রতি দৃশ্যমান অঙ্গীকার বিবেচনায় নিলে এটা ধরে নেওয়া স্বাভাবিক ছিল যে, আগের সরকারের করা বন্দর-সংক্রান্ত চুক্তিগুলোও পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সেটা করা হয়নি। বরং, আগামী ফেব্রুয়ারিতে কার্যকাল শেষ হওয়ার আগেই তড়িঘরি করে এসব দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি চূড়ান্ত করছে।

লালদিয়া চুক্তিও আওয়ামী লীগ আমলের এমনই একটি অন্যায্য চুক্তি, যা অন্তর্বর্তী সরকার চূড়ান্ত করেছে।

আন্তর্জাতিক চর্চা অনুযায়ী, অন্যায্য প্রস্তাবগুলোকে 'সুইস চ্যালেঞ্জ' প্রক্রিয়ার আওতায় আনা উচিত—যেখানে স্বচ্ছতা, প্রতিযোগিতা ও জনস্বার্থে সর্বোচ্চ মূল্য নিশ্চিত করা যায়। সুইস চ্যালেঞ্জ পদ্ধতিতে সরকার কোনো অন্যায্য প্রস্তাব পাওয়ার পর বিকল্প প্রস্তাব আহ্বান করে এবং সবচেয়ে ভালো পাল্টা প্রস্তাবটি পাওয়ার পর মূল প্রস্তাবদাতাকে সেই প্রস্তাবের সমান বা আরও ভালো প্রস্তাব দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, অন্তর্বর্তী সরকার এই পথ বেছে না নিয়ে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে গিয়েছে—যা আইনসিদ্ধ হলেও উত্তম চর্চা নয়।

এরপর আসে চুক্তির ধরন—যার মেয়াদ ৩৩ বছর এবং কর্মক্ষমতার লক্ষ্য পূরণ হলে আরও ১৫ বছর মেয়াদ বাড়ানোর সুযোগ আছে। এত দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উচ্চ রাজনৈতিক অঙ্গীকার অত্যন্ত জরুরি। কারণ, রাজনৈতিক পরিবর্তন বা প্রভাবশালী স্বার্থগোষ্ঠী প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। তাই শুরু থেকেই পিপিপি প্রকল্পের যৌক্তিকতা বিশ্বাসযোগ্য ও স্বচ্ছভাবে উপস্থাপন করা সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি, যাতে বিস্তৃত রাজনৈতিক সমর্থন নিশ্চিত হয় এবং স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক চাপ মোকাবিলা করা সম্ভব হয়।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বর্তমানের অন্যতম দুই প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর বিবৃতি থেকে বোঝা যায়, অন্তর্বর্তী সরকার এ প্রক্রিয়ায় তাদের সম্পৃক্ত করেনি। অথচ আগামী নির্বাচনের পর এই দুই দলের যেকোনো একটি ছোট দলগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে সরকার গঠনের সম্ভাবনা বেশি এবং ক্ষমতায় আসার পরই এপিএম টার্মিনালের সঙ্গে চুক্তি কার্যকর হবে। তাদেরকে চুক্তির বিষয়বস্তু সম্পর্কে অন্ধকারে রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়ার উদ্দেশ্য পরিষ্কার নয় এবং একইসঙ্গে এটা জবাবদিহির অভাবও সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরে—যা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত।

যে গতিতে চুক্তি সই হয়েছে সেটা সন্দেহকে আরও উসকে দেয়। মাত্র দুই সপ্তাহে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ) সব প্রক্রিয়া শেষ করেছে—যা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অবিশ্বাস্য শোনায়।

এপিএম টার্মিনালস ৪ নভেম্বর তাদের প্রযুক্তিগত ও আর্থিক প্রস্তাব দাখিল করে; ৫ নভেম্বর প্রযুক্তিগত ও ৬ নভেম্বর আর্থিক প্রস্তাব মূল্যায়ন এবং একই দিনে আলোচনা শুরু হয়। ৭ ও ৮ নভেম্বর সাপ্তাহিক ছুটির মধ্যেই সিপিএ ও এপিএম টার্মিনালসের মধ্যে আলোচনা শেষ হয়। ৯ নভেম্বর সিপিএ বোর্ড প্রস্তাব অনুমোদন করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠায় এবং পরদিনই আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।

১২ নভেম্বর অর্থনৈতিক বিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটি (সিসিইএ) চূড়ান্ত প্রস্তাব অনুমোদন করে। প্রধান উপদেষ্টা ১৬ নভেম্বর চূড়ান্ত অনুমোদন দেন এবং একই দিনে এপিএম টার্মিনালসকে এলওএ (লেটার অব অ্যাওয়ার্ড) দেওয়া হয়।

সাধারণত এলওএ দেওয়ার পর অন্তত দুই সপ্তাহ পরে চুক্তি সই হয়। কিন্তু লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল নিয়ে এই চুক্তি পরদিন ১৭ নভেম্বরেই সই হয়ে যায়—যেদিন সারা দেশের নজর ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় হাসিনার রায় ঘোষণার দিকে।

এরপর আসে চুক্তির শর্তাবলি প্রকাশের প্রশ্ন। সাধারণত এ ধরনের চুক্তিতে গোপনীয়তা ধারা থাকে। তবে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারগুলো ক্রমেই স্বচ্ছতা বাড়াতে এবং ভবিষ্যতের জটিলতা এড়াতে চুক্তির তথ্য প্রকাশে সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে।

প্রতিবেশী দেশ ভারত পিপিপি চুক্তি সম্পর্কে যতটা সম্ভব তথ্য প্রকাশের চেষ্টা করে। ব্রাজিল, চিলি ও পেরুর মতো লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে ইতোমধ্যেই চুক্তির ব্যাপক সক্রিয় প্রকাশনীতি মানদণ্ডে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাজ্য প্রকাশমুখী নীতি গ্রহণ করেছে; অস্ট্রেলিয়া ও কানাডাও তাদের প্রকল্প ও চুক্তি সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ করে।

এককথায়, পিপিপি প্রকল্পের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে বিশ্বজুড়ে তথ্য প্রকাশের দিকে স্পষ্ট ঝোঁক রয়েছে। পুরো চুক্তি প্রকাশ না করলেও অনেক দেশে সরল ভাষায় চুক্তির সারাংশ প্রকাশের প্রচলন শুরু হয়েছে।

কিন্তু লালদিয়া চুক্তির ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার পিপিপি আইন ২০১৫-এর গোপনীয়তা ধারার আশ্রয় নিয়ে পুরো প্রক্রিয়াকে গোপন রেখেছে। এটা পাস করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার এবং এখানে স্বচ্ছতার ভয়াবহ ঘাটতি রয়েছে। 
তাছাড়া, পিপিপি আইনের ৩৪ ধারায় প্রাক-চুক্তি গোপনীয়তার কারণে তথ্য প্রকাশ করা যাবে না—এ যুক্তিও বিভ্রান্তিকর।

এই ধারা শুধু প্রাক-চুক্তির কার্যক্রমের জন্য প্রযোজ্য এবং স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে যে, তথ্য অধিকার আইন ২০০৯-এর বিধানই প্রাধান্য পাবে। অর্থাৎ সরকারকে প্রাক-চুক্তি পর্যায়েও তথ্য প্রকাশ করতে হতো। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—কোনো চুক্তি সই হলে তা জনদলিল হয়ে যায় এবং প্রকাশে কোনো আইনি বাধা থাকে না।

এক্ষেত্রে সম্ভবত চুক্তিটি দেশের স্বার্থরক্ষা করেছে এবং এটি বেশ ভালো চুক্তিও হতে পারে। কিন্তু জনগণকে এই প্রক্রিয়ার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হলে এই সম্ভাব্য মাইলফলক হতে যাওয়া চুক্তির মর্যাদা আরও বৃদ্ধি পেত।

বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারও পূর্ববর্তী সরকারের অপশাসনের মতো একই গোপনীয়তাপূর্ণ কাজ অব্যাহত রেখেছে—যা ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারগুলোর জন্য এক বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে।

জিনা তাসরিন: সাংবাদিক, দ্য ডেইলি স্টার