Image description
শাহীদ কামরুল
 

জাতীয়তাবাদের প্রতীক প্রাচীন রোমেও খুঁজে পাওয়া যায়। ভারজিলের লেখা আনিয়েড (Aeneid) মহাকাব্যে দেখা যায়, ট্রোজান বীর এইনিয়াস দীর্ঘ সংগ্রাম ও যাত্রার পর রোমের ভিত্তি স্থাপন করেন। এখানে বোঝানো হয়েছে, রাষ্ট্র শুধু ভূগোলের ওপর দাঁড়ায় না; বরং ত্যাগ, কল্পনা ও ভাগাভাগি করা মিথের ভিত্তিতেও গড়ে ওঠে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তেমনই দেখা যায়—ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি সংগ্রাম ছিল বাঙালির জাতীয় কল্পনার নির্মাণ। শহীদদের ত্যাগ ও স্বাধীনতার স্বপ্ন প্রতীকী শক্তি তৈরি করেছিল, যা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। যাইহোক, জাতীয়তাবাদ একটি বহুমাত্রিক ধারণা, যা শুধু ইতিহাস বা রাজনীতির নিরিখেই বোঝা যায় না; বরং সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, নৃতত্ত্ব, অর্থনীতি ও মনোবিজ্ঞানের আলোচনাও এখানে অপরিহার্য।

অধ্যাপক হ্যারল্ড লাস্কি যথার্থই বলেছেন, জাতীয়তাকে কোনো একক উপাদান দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না, কারণ এর উৎস বহুমুখী। জাতীয়তার উপাদানকে সাধারণত বাহ্যিক (যেমন : বংশ, ভাষা, ভূগোল, ধর্ম ও সংস্কৃতি) এবং মানসিক বা আত্মিক (যেমন : অভিন্ন অনুভূতি, ইতিহাসচেতনা ও রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা) ভাগে বিন্যস্ত করা হয়। কিন্তু আধুনিক চিন্তাবিদরা—বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন, আর্নেস্ট গেলনার, অ্যান্থনি স্মিথ ও এরিক হবসবম—জাতীয়তার উৎপত্তিকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন। তাদের আলোচনায় বোঝা যায়, জাতি কখনো প্রকৃতিগত সত্য নয়, বরং ইতিহাস, ক্ষমতা, কল্পনা ও প্রতীকের মাধ্যমে নির্মিত এক সামাজিক সত্তা।

জাতীয়তার অন্যতম ভিত্তি হিসেবে ধরা হয় বংশগত বা কুলগত ঐক্য। মানুষ যখন বিশ্বাস করে যে তারা একই পূর্বপুরুষের সন্তান, তখন তাদের মধ্যে একাত্মবোধ জন্ম নেয়। হের্ডারের ভোক্সগাইস্ট (Volksgeist) তত্ত্ব বলছে, প্রতিটি জাতির নিজস্ব এক আত্মা আছে, যা বংশ, ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে প্রতিফলিত হয়। কিন্তু ইতিহাসে দেখা যায়, বংশগত ঐক্য কখনো জাতি গঠনের নিশ্চয়তা দেয় না। ইংরেজ, জার্মান ও ডাচরা একই রক্তধারার হলেও আলাদা জাতি; বিপরীতে কানাডা বা আমেরিকার মতো রাষ্ট্রে ভিন্ন বংশোদ্ভূত জনগণ মিলে নতুন জাতি তৈরি করেছে। এখানে বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনের ইমাজিনড কমিউনিটি (Imagined Community) তত্ত্ব বিশেষ প্রাসঙ্গিক : মানুষ প্রায়ই কল্পিতভাবে ধরে নেয় যে তারা এক অভিন্ন ঐতিহ্যের অংশ, যদিও বাস্তবে তাদের মধ্যে জৈবিক সম্পর্ক না-ও থাকতে পারে।

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ঐক্য জাতীয়তার শক্তিশালী ভিত্তি। ফিখতে তার অ্যাড্রেসেস টু দ্য জার্মান নেশন (Addresses to the German Nation) গ্রন্থে বলেছিলেন, ভাষা জাতির আত্মাকে ধারণ করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ, যেখানে ভাষা জাতীয় স্বকীয়তার মূল প্রতীক হয়ে উঠেছিল। তবে ভাষা সর্বদা একক নির্ধারক নয় : সুইজারল্যান্ড বহু ভাষাভাষী হয়েও এক জাতি, আবার ইংরেজি ভাষাভাষী আমেরিকা, ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়া আলাদা জাতি।

 

হবসবম তার নেশন্স অ্যান্ড ন্যাশনালিজম সিন্স ১৯৮০ (Nations and Nationalism since 1780) গ্রন্থে বলেছেন, অনেক সময় ভাষা ও সংস্কৃতি ‘উদ্ভাবিত ঐতিহ্য’ (invented tradition) হিসেবে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়, যা বাস্তব ঐক্যের তুলনায় কল্পিত ও প্রণীত ঐক্যকে শক্তিশালী করে। জাতীয়তার আরেকটি মাত্রা হলো ধর্ম। ইতিহাসে ধর্ম বহুবার জাতীয় চেতনার ভিত্তি গড়েছে। মধ্যযুগীয় ইউরোপ খ্রিষ্টধর্মে, আরব বিশ্ব ইসলামে, কিংবা আধুনিক যুগে পাকিস্তান ও ইসরাইল ধর্মীয় ভিত্তিতে গঠিত হয়েছে। কিন্তু ধর্ম সর্বদা টেকসই ঐক্য আনতে পারেনি। পাকিস্তান মুসলিম পরিচয়ের ওপর দাঁড়িয়েও ভেঙে যায়, কারণ ভাষা, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির প্রশ্নে বাঙালিরা ভিন্ন জাতিগত চেতনা অনুভব করেছিল। অ্যান্থনি স্মিথের এথনো-সিম্বলিসম (Ethno-Symbolism) তত্ত্ব এই বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করে—ধর্ম জাতির প্রতীক ও স্মৃতি নির্মাণে ভূমিকা রাখে, কিন্তু এককভাবে স্থায়ী জাতীয়তা তৈরি করতে পারে না।

ভৌগোলিক ঐক্যও জাতীয়তাকে প্রভাবিত করে। একই ভূখণ্ডে বসবাস মানুষকে অভিন্ন চেতনায় আবদ্ধ করে। বাংলাদেশের মানুষের নদীনির্ভর জীবন, কৃষিভিত্তিক সংস্কৃতি ও ভূপ্রকৃতি তাদের মধ্যে বিশেষ ঐক্য তৈরি করেছে। তবে ভূগোল বিভাজনও তৈরি করে : পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভৌগোলিক দূরত্বই তাদের আলাদা করে দেয়। ইহুদিদের উদাহরণ আবার বিপরীত দিকে যায় : ভৌগোলিকভাবে ছড়িয়ে থেকেও তারা নিজেদের এক জাতি ভেবে এসেছে, যা অ্যান্ডারসনের তত্ত্বকে আবার সমর্থন করে। জাতীয়তা গঠনে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। জনগণ যখন অতীতের বীরত্ব, সংগ্রাম ও ত্যাগকে সম্মিলিত স্মৃতি হিসেবে ধারণ করে, তখন তা জাতীয় চেতনাকে শক্তিশালী করে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, কিংবা রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের সাহিত্য-সংগীত এ চেতনাকে দৃঢ় করেছে। তবে হবসবম বলেছেন, ইতিহাস অনেক সময় নির্বাচিত ও পুনর্লিখিত হয়। রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক নেতৃত্ব যে ঘটনাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে, সেটিকেই জাতীয় ইতিহাসে স্থান দেওয়া হয়। এর মানে ইতিহাস সবসময় নিরেট সত্য নয়, বরং রাজনৈতিকভাবে নির্মিত সত্য। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ঐক্যও জাতীয়তার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এক রাজনৈতিক কাঠামো মানুষকে অভিন্ন শাসনব্যবস্থায় যুক্ত করে; আবার অভিন্ন অর্থনৈতিক স্বার্থ জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে। পাকিস্তান আমলে অর্থনৈতিক বৈষম্য—যেখানে পূর্ববাংলা থেকে আয়ের অধিকাংশ পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হতো—জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জ্বালানি হয়ে দাঁড়ায়। মার্ক্সবাদীরা বলেন, জাতীয়তাবাদ প্রায়ই শ্রেণি-সংগ্রাম আড়াল করার হাতিয়ার; কিন্তু বাস্তবে শ্রেণি-সংগ্রামও অনেক সময় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে মিশে যায়, যেমন : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দেখা গেছে। সবচেয়ে গভীর উপাদান হলো ভাবগত বা আত্মিক ঐক্য।

আর্নেস্ট রেনান বলেছিলেন, জাতি হচ্ছে এক ধরনের ‘দৈনন্দিন গণভোট’—মানুষ প্রতিদিন নিজেদের জাতি হিসেবে ঘোষণা করে। এর মানে, জাতীয়তা মূলত মানসিক অভিজ্ঞতা ও কল্পিত চেতনা। তবে বলা যায়, এই চেতনা সবসময় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত ইচ্ছার প্রতিফলন নয়; বরং রাষ্ট্র, রাজনৈতিক এলিট ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে এটি তৈরি ও বজায় রাখা হয়। বাংলাদেশের জাতীয়তাও এর ব্যতিক্রম নয় : যেখানে জনগণের বাস্তব অভিজ্ঞতার পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও রাষ্ট্রযন্ত্র জাতীয়তার রূপ নির্মাণ করেছে। বাংলাদেশের জাতি ও জাতিরাষ্ট্রে উত্তরণ এসব উপাদানের সম্মিলিত প্রকাশ।

ঔপনিবেশিক শোষণ, পাকিস্তানি বৈষম্য, ভাষার প্রশ্নে আত্মত্যাগ, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকারবঞ্চনা এবং মুক্তিযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম—সব মিলিয়ে বাঙালি জাতিকে একটি স্বতন্ত্র জাতি ও পরে জাতিরাষ্ট্রে রূপান্তর করেছে। তবে সমালোচনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই জাতীয়তাবাদ সর্বদা অন্তর্ভুক্তিমূলক ছিল না। পাহাড়ি, আদিবাসী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় প্রায়ই মূলধারার বাইরে থেকেছে। এছাড়া স্বাধীনতার পর ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উত্থান দেখিয়েছে যে ভাষাকেন্দ্রিক জাতীয়তা সর্বদা স্থায়ী ও সর্বগ্রাসী নয়। অতএব, জাতীয়তা গঠনের প্রক্রিয়াকে কোনো একক সূত্রে বাঁধা যায় না। এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, ধর্ম, ভূগোল ও কল্পনার এক জটিল আন্তঃক্রিয়া।

কখনো এগুলোর মধ্যে একটি মুখ্য হয়ে ওঠে, কখনো অন্যটি। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা দেখায়, ভাষা, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক অধিকার মিলে একটি শক্তিশালী জাতীয় চেতনা তৈরি করেছে। তবে সমালোচনামূলক দৃষ্টিতে প্রশ্ন থাকে—এই জাতীয়তাবাদ কতটা গণমানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রতিফলন আর কতটা রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক নির্মাণ? এখানেই জাতীয়তাবাদ ধারণার জটিলতা এবং একই সঙ্গে এর শক্তি নিহিত। বাংলাদেশের জাতি ও জাতিরাষ্ট্র হয়ে ওঠার ইতিহাস নিয়ে আলোচনায় গেলে প্রথমেই বুঝতে হবে যে এটি শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতার কাহিনি নয়; বরং এটি দীর্ঘকালীন সামাজিক-সাংস্কৃতিক রূপান্তরের ফল। জাতি (nation) ধারণাটিকে আমরা যদি অ্যান্থনি স্মিথ, বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন, আর্নেস্ট গেলার বা এরিক হবসবমের আলোচনায় দেখি, তাহলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে জাতি একটি প্রাকৃতিক সত্তা নয়, বরং সামাজিকভাবে নির্মিত একটি কল্পিত সম্প্রদায় (imagined community), যা ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা, ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে বিকশিত হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই ধরনের হয়েছে। এখানে বাঙালি জাতি কোনো একদিনে বা হঠাৎ করে গড়ে ওঠেনি, বরং ঔপনিবেশিক শাসন, ভাষাগত আন্দোলন, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং রাজনৈতিক দমননীতি—সব মিলিয়ে ধাপে ধাপে জাতীয়তাবোধ জাগ্রত হয়েছে এবং তার পরিণতিতে একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র জন্ম নিয়েছে।

ঔপনিবেশিক যুগে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে শাসনকালে জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করেছিল। তারা ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ (divide and rule) নীতি অনুসরণ করে একদিকে হিন্দু-মুসলিম বিভক্তি গভীর করে, অন্যদিকে শিক্ষিত অভিজাত শ্রেণিকে ব্যবহার করে প্রশাসন চালাত। এ সময় বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান ঘটে, যারা ইংরেজি শিক্ষা ও আধুনিকতার আলোয় আলোকিত হলেও নিজেদের সাংস্কৃতিক শিকড় এবং ভাষার প্রতি গভীর আবেগি বন্ধনে আবদ্ধ ছিল।

বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন তার ইমাজিনড কমিউনিটিজ (Imagined Communities) গ্রন্থে যেভাবে বলেছেন—প্রিন্ট ক্যাপিটালিজম বা ছাপাখানার প্রসার জাতীয়তাবোধ গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে—বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। উনিশ শতকে বাঙালি ভাষা ও সাহিত্য যখন বিকশিত হচ্ছিল, তখনই বাঙালি পরিচয়ের ভিত শক্ত হতে শুরু করে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ এই প্রক্রিয়াকে আরো জটিল করে তোলে। পাকিস্তান রাষ্ট্র ধর্মীয় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হলেও বাস্তবে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে ছিল প্রবল বৈষম্য। রাজনৈতিক ক্ষমতা, সামরিক শক্তি, প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ, অর্থনৈতিক সম্পদ—সবই পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল। এর ফলে পূর্ববাংলার মানুষ নিজেদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক মনে করতে শুরু করে। বিশেষ করে, ১৯৪৮ সালে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণার পর বাঙালি যুবক-ছাত্রসমাজ তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে।

এখানেই দেখা যায় জাতীয়তা গঠনের একটি প্রধান উপাদান—ভাষা—কীভাবে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। আর্নেস্ট গেলার বলেছেন, আধুনিক শিল্পসমাজে অভিন্ন ভাষা ছাড়া জাতীয় ঐক্য টিকে থাকতে পারে না। বাংলাদেশে ভাষার প্রশ্ন বাঙালির মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা ও আত্মপরিচয়ের গভীর বোধ তৈরি করেছিল, যা শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল জাতীয়তাবাদের ভিত্তি মজবুত করার প্রথম ধাপ। এখানে রেনানের বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ে যায়—জাতি হলো একটি দৈনিক গণভোট (daily plebiscite), যেখানে জনগণ প্রতিনিয়ত নিজেরা একসঙ্গে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করে।

বাঙালি জাতির জন্য ভাষা আন্দোলন সেই গণভোটেরই প্রতীক ছিল। ভাষার প্রশ্নে জনগণের ঐক্য এবং আত্মত্যাগ প্রমাণ করেছিল, ধর্মীয় ঐক্যের চেয়ে সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত ঐক্য অনেক বেশি শক্তিশালী বন্ধন। ১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে অর্থনৈতিক বৈষম্য জাতীয়তাবোধকে আরো তীব্র করে তোলে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার কর রাজস্বের অধিকাংশ সংগ্রহ করত পূর্ব পাকিস্তান থেকে; কিন্তু সেই সম্পদ ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে। শিল্প-কারখানা, অবকাঠামো, সামরিক বিনিয়োগ—সবই পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক ছিল। পূর্ব পাকিস্তান অবহেলিত এবং শোষিত ছিল। এর ফলে বাঙালির মধ্যে ‘অভিন্ন অর্থনৈতিক স্বার্থ’ ও তার বিপরীতে বৈষম্যের প্রতি ক্ষোভ জন্ম নেয়।

মার্ক্সবাদী বিশ্লেষণে বলা হয়, অর্থনৈতিক শোষণই রাজনৈতিক সংগ্রামের ভিত্তি গড়ে তোলে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধও এক অর্থে এই অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে শ্রেণিগত সংগ্রামের রূপ নিয়েছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালি জাতীয়তাবোধের সর্বোচ্চ প্রকাশ। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতি—সবকিছুর সমন্বয় ঘটেছিল। হবসবম বলেছেন, জাতীয়তা প্রায়ই ‘ইনভেনটিড ট্র্যাডিশন’ (invented tradition) বা উদ্ভাবিত ঐতিহ্যের মাধ্যমে গড়ে ওঠে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্বাধীনতার সংগ্রামের সময় ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে পুনরাবিষ্কার করা হয়েছিল। বাঙালি জাতিকে বলা হয়েছিল বীরের জাতি, যারা বহু শতাব্দী ধরে সংগ্রাম করে এসেছে। এই ঐতিহাসিক কল্পনা জনগণের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলেছিল এবং মুক্তিযুদ্ধকে আরো নৈতিক শক্তি দিয়েছিল।

তবে বাংলাদেশের জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া শুধু ইতিবাচক ইতিহাস নয়; এখানে রয়েছে জটিলতা, দ্বন্দ্ব ও সমালোচনার জায়গাও। প্রথমত, বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠিত হলেও আজও প্রশ্ন থাকে—বাঙালি জাতীয়তা কি সব জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করেছে? পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা, সিলেটি বা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পরিচয়ধারীরা অনেক সময় মনে করেন যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ তাদের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয়কে মুছে ফেলতে চায়।

সুতরাং বাংলাদেশে জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়াকে আমরা একটি ‘ইনক্লুসিভ ন্যাশনালিজম’ (inclusive nationalism) হিসেবে দেখতে পারি, আবার কেউ কেউ বলবেন এটি অনেক ক্ষেত্রে ‘ম্যাজোরিটারিয়ান ন্যাশনালিজম (majoritarian nationalism)। স্মিথের থিওরি অনুসারে, জাতিরাষ্ট্র যদি সব জাতিগোষ্ঠীকে একত্র করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সেখানে দ্বন্দ্ব থেকে যায়।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এই দ্বন্দ্ব আংশিকভাবে বিদ্যমান। ধর্মের ভূমিকা নিয়েও সমালোচনা আছে। পাকিস্তানের মুসলিম জাতীয়তার বিরোধিতা করলেও বাংলাদেশ রাষ্ট্র নিজেকে শুরুতে ধর্মনিরপেক্ষ পরিচয়ে দাঁড় করায়। কিন্তু পরবর্তী সময় রাজনৈতিক বাস্তবতায় ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশের জাতিরাষ্ট্র গঠনের মূল ভিত্তি ছিল ভাষা ও সংস্কৃতির ঐক্য এবং জনগণের একসঙ্গে থাকার ইচ্ছা। অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং রাজনৈতিক দলগুলোর স্বার্থভিত্তিক ইতিহাসচর্চা জাতীয়তাবাদকে বিভক্ত করেছে। তবু ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ দেখিয়েছে যে সাংস্কৃতিক ঐক্য রাষ্ট্র সৃষ্টির শক্তিশালী উপাদান হতে পারে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ টেকসই জাতিরাষ্ট্র হবে কি না—তা নির্ভর করছে বহুত্ববাদ, গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ওপর। (চলবে)

 

লেখক : সাবেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক, ফ্রাই ইউনিভার্সিটি বার্লিন ও জার্মানি