বাজিমাত করলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গণভোট, জুলাই সনদসহ রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণের পর রাজনৈতিক দলগুলো মিছিল নিয়ে রাস্তায় নামেনি। জাতি যেন এক দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বাঁচল। রাজনৈতিক সমঝোতার ইনোভেটিভ আইডিয়া নিয়ে জাতির সামনে হাজির হয়ে তিনি সত্যিই চমকে দিয়েছেন সবাইকে। গণহত্যাকারী শেখ হাসিনা তার অগ্নিসন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিয়ে ফাঁসির রজ্জু থেকে বাঁচার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বিবাদের সুযোগে মাঠ দখলের যে চেষ্টা চালানো হয়েছিল, ড. ইউনূসের চালে কাত হয়ে সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫। বিভিন্ন কারণে বহুদিন আলোচনায় থাকবে দিনটি। জুলাই গণহত্যার মাস্টারমাইন্ড শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রায়ের তারিখ ঘোষণা করা হয় এই দিনে। ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার মামলার রায় ঘোষণা করা হবে আগামী ১৭ নভেম্বর সোমবার। ১৩ নভেম্বর কিছু একটা করা যায় কি না, সে অপচেষ্টায় আওয়ামী লীগ ‘লকডাউন’-এর নামে যে হরতাল ডেকেছিল, তাকে পাত্তাই দেননি রাজধানীবাসী। অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জুলাই জাতীয় সনদ, সনদের বাস্তবায়ন আদেশ জারি এবং গণভোট নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল, তার একটি চমকপ্রদ সমাধান হাজির করেন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে। বলা যায়, তিনি বাজিমাত করেছেন।
পাশাপাশি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণের বিষয়বস্তু নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি বৈঠকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন। সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, অনুমোদন নিয়েছেন, নিজেও অনুমোদন দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে বৃহস্পতিবারই জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ জারি করেন। এর মাধ্যমে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি রচিত হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে দেওয়া তার ভাষণে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে একই সঙ্গে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট আয়োজনের ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। এসবের মাধ্যমে চব্বিশের জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে তিনটি গুরুদায়িত্ব অর্পিত আছে, সেগুলোর ব্যাপারে বড় ধরনের অগ্রগতি দৃশ্যমান হয়েছে।
বিএনপি জামায়াত এনসিপি কে কী পেল, কী হারাল
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে একই দিনে দুই ভোটের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে বিএনপি, জামায়াত এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির মধ্যে যে বিরোধ চলছিল, তার একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান দিয়েছেন। এ ব্যাপারে সরকারের চূড়ান্ত অবস্থান জানিয়ে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, আদেশ জারি করে গেজেট প্রকাশ করে তার আইনি ভিত্তিও দিয়ে দিয়েছেন।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস মূল যে চমকটি দেখিয়েছেন, সেটা হলো—মাত্র একটি প্রশ্নে ‘হ্যাঁ-না’ দিয়ে গণভোটে দেশবাসীর মতামত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন। সেখানে চারটি বিষয় উল্লেখ থাকলেও সেগুলোয় আলাদা মতামত দেওয়ার সুযোগ থাকবে না। এটাকে তার একটি ইনোভেটিভ আইডিয়া বলা যেতে পারে। ইনোভেটিভ আইডিয়ার জন্য সারা বিশ্বে ড. ইউনূসের সুনাম রয়েছে। নোবেল পুরস্কারও জুটেছে মূলত ইনোভেটিভ আইডিয়া নিয়ে কাজ করে। ড. ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এভাবেই জানিয়েছেন যে, গণভোটে মূল প্রশ্ন থাকবে একটি। আর ক, খ, গ, ঘ দিয়ে চারটি বিষয় আলাদাভাবে থাকবে। কিন্তু উত্তর হবে এক প্রশ্নে হ্যাঁ বা না দিয়ে। বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের এ সিদ্ধান্ত জানান।
ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘জুলাই সনদের আলোকে আমরা গণভোটের ব্যালটে উপস্থাপনীয় প্রশ্নও নির্ধারণ করেছি। আমি প্রশ্নটি এখন আপনাদের সামনে পাঠ করে শোনাচ্ছি। প্রশ্নটি হবে এরকম—‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং জুলাই জাতীয় সনদে লিপিবদ্ধ সংবিধান সংস্কারসম্পর্কিত নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলোর প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করছেন?’
ক) নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ার আলোকে গঠন করা হবে।
খ) আগামী জাতীয় সংসদ হবে দুই কক্ষবিশিষ্ট। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন দরকার হবে।
গ) সংসদে নারী প্রতিনিধি বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে যে ৩০টি প্রস্তাবে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমত হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলো বাধ্য থাকবে।
ঘ) জুলাই সনদে বর্ণিত অন্যান্য সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়ন করা হবে।
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ ও জুলাই আদেশ জারির পর বিএনপি, জামায়াত ও এনিসিপি তাদের নিজ নিজ ফোরামের জুররি বৈঠকে বসেছে। আলোচনা-পর্যালোচনা করে তারা জুলাই সনদের বাস্তবায়ন আদেশ ও একসঙ্গে দুই ভোট এবং গণভোটে উত্থাপনীয় বিষয়গুলো নিয়ে তাদের আনুষ্ঠানিক মতামত জানাবে।
গত ১৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই সনদ স্বাক্ষরের পর ঐকমত্য কমিশন ২৮ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টার কাছে সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, তার রিপোর্ট জমা দেওয়ার পরই নতুন করে জট পাকে।
ড. ইউনূসের বৃহস্পতিবারের ভাষণে দেওয়া সিদ্ধান্তে বিএনপির দিক থেকে খুশি হওয়ার মতো ঘটনাগুলো হলো—বিএনপির অন্যতম দাবি ছিল সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একদিনে করা। সেটা ড. ইউনূসের ভাষণে সিদ্ধান্ত হিসেবে এসেছে। অন্যদিকে উচ্চকক্ষে শতভাগ পিআর চেয়েছিল জামায়াতে ইসলামী। সেটাও ড. ইউনূসের ভাষণে সিদ্ধান্ত হিসেবে এসেছে। স্বাক্ষরিত সনদে বিএনপির দেওয়া নোট অব ডিসেন্ট জুলাই আদেশের প্রস্তাবে বাদ দেওয়া হয়েছিল। ড. ইউনূসের দেওয়া বাজিমাত প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্ট ফিরিয়ে এনে গণভোটে আলাদাভাবে ‘ঘ’ উপধারায় উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি উচ্চকক্ষ গঠনে রাজি থাকলেও আপত্তির জায়গা ছিল উচ্চকক্ষের নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে করা নিয়ে। ড. ইউনূস ‘খ’ উপধারায় সেটাকে গণভোটে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলেও প্রক্রিয়ার একপর্যায়ে ‘র্যাংকড চয়েস’ নিয়ে বিএনপির আপত্তি থাকায় নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিল। ড. ইউনূস বিষয়টি উপেক্ষা করে ‘ক’ উপধারায় সেটা গণভোটে দিয়েছেন। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশন ও অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ায় গঠিত হবে বলে জানিয়ে দিয়েছেন। এসব বিষয়েও কোনো কোনো প্রক্রিয়াগত জায়গায় বিএনপির আপত্তি আমলে নেওয়া হয়নি। তবে রাষ্ট্রপতিকে আদেশে স্বাক্ষর করতে হবে বলে বিএনপির জোর দাবি ছিল। জামায়াত ও এনসিপি আপত্তি দিয়ে বলেছিল কেবলমাত্র প্রধান উপদেষ্টা আদেশে স্বাক্ষর করবেন। ড. ইউনূস উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন, তার নিজের স্বাক্ষর এবং রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর নিয়ে গেজেট প্রকাশ করে সনদের আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করেছেন। অর্থাৎ কোনো ফাঁকফোকর রাখেননি।
জামায়াতে ইসলামীর দাবি উচ্চকক্ষে শতভাগ পিআর-এর বিষয়টি ড. ইউনূস ‘খ’ উপধারায় গণভোটে পাঠিয়েছেন। জুলাই সনদের আইনি বৈধতার একটি জোর দাবি ছিল জামায়াতের পক্ষ থেকে। সেটাও প্রধান উপদেষ্টা মেনে নিয়ে আদেশ জারি করেছেন। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন গঠন ও অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও সদস্যদের নিয়োগে বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট উপেক্ষা এবং জামায়াত ও এনসিপির মতামতকে প্রাধান্য দিয়েই গণভোটে প্রস্তাব করা হয়েছে। অন্যদিকে নোট অব ডিসেন্ট একেবারেই না রাখার পক্ষে জামায়াত শেষদিকে এসে জোরালো অবস্থান নিলেও ড. ইউনূস উল্লিখিত বিষয় ছাড়া বাকি বিষয়গুলো নোট অব ডিসেন্ট রেখেই বলেছেন, ‘(ঘ) জুলাই সনদে বর্ণিত অন্যান্য সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়ন করা হবে।’
এনসিপি গত ১৭ অক্টোবর জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেনি। তার আগ পর্যন্ত তারা অলোচনায় সক্রিয় ছিল। তারা সনদে স্বাক্ষর করবে না, এমন কথাও বলেনি। বরং বলেছিল সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন হবে এবং এর আইনি ভিত্তির বিষয়টি নিশ্চিত হয়েই তার সনদে স্বাক্ষর করবে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তারা সনদে স্বাক্ষর করেনি। তবে সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়ার যে মূল দাবি তাদের ছিল, সেটা ড. ইউনূস তার সর্বশেষ পদক্ষেপের মাধ্যমে পূরণ করেছেন। নোট অব ডিসেন্ট বাদ দিয়ে সনদ বাস্তবায়নে এনসিপির দাবি পূরণের উদ্দেশ্যে মূল সংস্কারের বিষয়গুলো গণভোটে পাঠিয়েছেন। অর্থাৎ সব নোট অব ডিসেন্ট বাদ না দিয়ে মৌলিক বিষয়গুলোর পক্ষে অবস্থান নিয়ে সেটা গণভোটে পাঠিয়েছেন ড. ইউনূস।
সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একদিনে করার যে ঘোষণা ড. ইউনূস দিয়েছেন, এনসিপি নেতারা আগেই জানিয়েছিলেন এ ব্যাপারে তাদের তেমন আপত্তি নেই। তবে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে স্বৈরাচারের দোসর আখ্যায়িত করে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশে তার স্বাক্ষর না দেওয়ার জন্য এনসিপির দাবি উপক্ষো করেছেন ড. ইউনূস।
রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত জরুরি বৈঠকের পর প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ধন্যবাদ জানিয়েছে।
বৈঠক শেষে বৃহস্পতিবার রাতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আজ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। সেই সঙ্গে সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোট করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। এজন্য আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় স্থায়ী কমিটি তাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছে।
ব্রিফিংয়ে আরো বলা হয়, সভায় গত ১৭ অক্টোবর স্বাক্ষরিত জুলাই জাতীয় সনদের ওপর জনগণের সম্মতি গ্রহণের জন্য গণভোট আয়োজন এবং যথাসময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
এর আগে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সংলাপে নেতৃত্বদানকারী সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা ভাষণের মাধ্যমে নিজের সই করা জুলাই সনদ লঙ্ঘন করেছেন।’ কারণ যে জাতীয় সনদে তিনি (ড. ইউনূস) স্বাক্ষর করেছেন, তা তিনি রক্ষা করেননি এবং এ ভাষণের মাধ্যমে তা তিনি লঙ্ঘন করেছেন।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সাবেক সংসদ সদস্য ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরের সভাপতিত্বে দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মগবাজারে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে নায়েবে আমির, সেক্রেটারি জেনারেল এবং সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলসহ কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্যরা অংশগ্রহণ করেন।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ পর্যালোচনা করে বলা হয়, একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের আয়োজনের ঘোষণা জাতির কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি এবং গণদাবি মানা হয়নি।
এছাড়াও বৈঠকে দেশের বর্তমান সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, জনগণের প্রত্যাশা এবং আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে উদ্ভূত প্রেক্ষাপট নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়।
বৈঠকে দেশ ও জাতির কল্যাণ, ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠা এবং আগামীর বাংলাদেশকে একটি শান্তিপূর্ণ, ন্যায়ভিত্তিক ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে সর্বস্তরের জনগণের সহযোগিতা ও দোয়া কামনা করা হয়।
এর আগে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় একই দিনে গণভোট ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি বলে মন্তব্য করেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার।
বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টায় প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানাতে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা বলেন।
রাজধানীর মগবাজারে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ব্রিফিংয়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আরো বলেন, প্রধান উপদেষ্টা জনগণের অভিপ্রায় ও জনদাবি উপেক্ষা করে একই দিনে গণভোট ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিয়েছেন। এতে একটি সংকট তৈরি হবে। কারণ, গণভোটের আগে ভোটারদের জানা দরকার যে, কী কী সংস্কার হলো এবং কী কী সংশোধনী আনা হয়েছে। সে বিষয়ে একটি মাইন্ডসেট তৈরি করার পরই জনগণ হ্যাঁ বা না ভোট দেবে। কিন্তু এখন সে বিষয়গুলো না বুঝেই একই দিনে দুটি ভোট দিতে হবে।
গোলাম পরওয়ার বলেন, যে সংকট নিরসনে জামায়াতসহ ইসলামি দেশপ্রেমিক আট দল দাবি করে আসছিল যে, এ ভোট জাতীয় নির্বাচনের আগে দিতে হবে। তাহলে পরে আদালত বা আইনি ভিত্তি নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠবে না। সে সংকট রয়েই গেল, নিরসন হলো না।
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে আদেশ জারি, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনে গণভোট, সংবিধান সংস্কার পরিষদ এবং প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের বিষয়টি থাকায় ইতিবাচক হিসেবে দেখছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তবে এ বিষয়ে দলটি এখনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি। জুলাই সনদে স্বাক্ষর করাসহ কয়েকটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে এনসিপির নেতারা জরুরি বৈঠকে বসেছেন। বৈঠক শেষে দলীয় অবস্থান জানানো হবে।
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের আগে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, গণভোট এবং জাতীয় নির্বাচন একই দিনে হলে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু ইসির সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এজন্য সরকার এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে আমরা আহ্বান জানাব, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করুন। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী না করে গণভোট এবং জাতীয় নির্বাচন একদিনে দিলে এটি হুমকির মুখে পড়বে।
এদিকে, প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বা আদেশের কিছু বিষয়ে ভিন্নমত থাকা সত্ত্বেও এটাকে স্বাগত জানিয়েছে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি।
বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণের পর এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু এবং সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ এক বিবৃতিতে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যকে মেনে নেওয়ার পক্ষে অবস্থান ব্যক্ত করেন।
বিবৃতিতে এবি পার্টির শীর্ষ নেতৃত্ব বলেন, যার যা মত থাকুক না কেন, সরকার বা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সবদিক বিবেচনা করে একই দিনে গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন, উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক ভোটের হিসাবে আসন নির্ধারণ এবং গণভোটে একমত ও ভিন্নমতকে অন্তর্ভুক্ত করে ব্যালট তৈরিসহ চূড়ান্ত কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন।
নেতৃদ্বয় মনে করেন, এটি এখন একটি অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য সমাধান। সার্বিক বিচারে এ ঘোষণাকে এবি পার্টি ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। নেতৃদ্বয় আশা প্রকাশ করেন, বিএনপি ও জামায়াতসহ সব রাজনৈতিক দল বিভক্তি পরিহার করে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও আনন্দমুখর পরিবেশে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে এবং দেশকে একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক পথে পরিচালনা করতে সহায়তা করবে।
এদিকে, খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা আবদুল বাছিত আজাদ গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে জুলাই জাতীয় সনদ, ২০২৫ বাস্তবায়ন আদেশ জারির সিদ্ধান্ত ইতিবাচক এবং জনঅভিপ্রায়ের বহিঃপ্রকাশ। এটি জনগণের কাঙ্ক্ষিত সংস্কারের প্রত্যাশা পূরণে একধাপ অগ্রগতি।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির আল্লামা মামুনুল হক বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে করার ঘোষণা দিয়ে এবং একই প্রশ্নের মধ্যে আলাদা আলাদা চারটি অংশ রেখে গণভোটকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা হয়েছে।
অন্যদিকে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’-এর গেজেট প্রকাশের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছে নাগরিক সংগঠনের সম্মিলিত প্ল্যাটফর্ম নাগরিক কোয়ালিশন। একই সঙ্গে গণভোট আয়োজনে দেশের সব রাজনৈতিক দলকে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছে তারা। কারণ, ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস ছাড়া এটির পূর্ণ বাস্তবায়ন দুরূহ হবে বলে মনে করছে সংগঠনটি। বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে নাগরিক কোয়ালিশনের প্রতিক্রিয়ায় এসব কথা বলা হয়। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন সংগঠনের সহসমন্বয়ক ফাহিম মাশরুর।
গণভোট জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে হবে এবং এটি নিয়ে কোনো সমস্যা নেই বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি ও যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. মির্জা গালিব। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার গণভোটের প্রশ্নটিকে যে চার ভাগে ভাগ করল, এর পেছনে অন্য একটি ফিলোসফি কাজ করছে। কিছু বিষয়কে তারা নন-নেগোশিয়েবল হিসেবে ধরে নিয়ে এক প্রশ্নের মধ্যে দিয়ে দিয়েছে। আর এর বাইরের বিষয় পরের পার্লামেন্টের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। যেমন, উচ্চকক্ষে পিআর, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন গঠন—এগুলো নন-নেগোশিয়েবল, ফলে গণভোটে এক প্যাকেজের মধ্যেই যাবে। এ ধরনের আরো কিছু নন-নেগোশিয়েবল ইস্যু আছে। এর বাইরের বিষয়গুলো পরের পার্লামেন্টের কাছে যাবে। চতুর্থ প্রশ্নে এটা বলা আছে—‘জুলাই সনদে বর্ণিত অন্যান্য সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়ন করা হবে।’
বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে নির্বাচনকে উৎসবমুখর করা। নির্বাচনে পুরো মনোযোগ দেওয়া। দেশের মানুষ ১৫ বছর কোনো ভোট দিতে পারেনি। ভোট দেওয়ার জন্য তারা উন্মুখ। দেশের মানুষ চায় সুন্দর নির্বাচন। সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনি লড়াইয়ে নেমে পড়ুক। এটা সবার প্রত্যাশা।
হাসিনার সন্ত্রাস রায়ের তারিখ ঠেকাতে পারেনি
জুলাই গণহত্যার মাস্টারমাইন্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কবে রায় ঘোষণা করবে ট্রাইব্যুনাল, প্রতীক্ষিত সে দিনটির কথা জানা গেছে বৃহস্পতিবার। এজন্য দেশবাসীর সঙ্গে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিল জুলাই আন্দোলনের অন্যতম তিন স্টেকহোল্ডার বিএনপি, জামায়াত এবং এনসিপি। এই তিন দলের চাওয়াও এক। তারা চায় শেখ হাসিনার সর্বোচ্চ সাজা ফাঁসি হোক। যেমনটি ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলামও বলেছেন। হাসিনার সাজা ঘোষণার দিন ধার্য করা হয়েছে ১৭ নভেম্বর সোমবার। রায় ঘোষণার দিন-তারিখ ঠিক করাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ অনলাইনে ঘোষণা দিয়ে সারা দেশে ‘লকডাউনের’ নামে হরতাল ডেকেছিল। চারদিনের কর্মসূচি ছিল, শেষ দিন বৃহস্পতিবার ছিল সর্বাত্মক। কিন্তু সারা দেশে ডজনখানেক বাস ও একটি ট্রেনে আগুন দেওয়া ও কয়েকটি স্থানে যান চলাচলে বাধা দেওয়া ছাড়া তেমন কিছুই করতে পারেনি। বরং বৃহস্পতিবার রাজপথ ছিল হাসিনাবিরোধী জুলাইযোদ্ধা ও রাজনৈতিক শক্তির দখলে। বিক্ষুব্ধ জনতা বাসে আগুন দেওয়ার জেরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আগুন দেয়। বোমা মারতে গিয়ে পুলিশের হাতে সারা দেশেই কমবেশি ধরা পড়েছে আওয়ামী কর্মী নামক সন্ত্রাসীরা। অগ্নিসন্ত্রাস চালিয়ে জুলাই গণহত্যার দায় থেকে হাসিনার যে মুক্তি নেই, সেটা বৃহস্পতিবার আবারও প্রমাণ হয়েছে।
জাহেদ চৌধুরী
লেখক : ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, আমার দেশ