
বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার মিশন চালু হতে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে তিন বছরের জন্য একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। সাধারণভাবে, মানবাধিকার রক্ষার উদ্দেশ্যে এমন একটি মিশনকে অগ্রগামী উদ্যোগ হিসেবে দেখা যেতে পারে। কারণ, এতে দেশে যেই সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তাদের ওপর একটি আন্তর্জাতিক চাপ থাকবে—মানবাধিকারের মানদণ্ড মেনে চলার জন্য।
তবে বিষয়টিকে নিছক মানবাধিকারের প্রশ্ন হিসেবে দেখলে হয়তো পুরো চিত্রটি স্পষ্ট হবে না। জাতিসংঘে দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমা দেশ, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব-প্রতিপত্তির বিষয়টি এখন আর গোপন নয়। বর্তমান বিশ্বে ‘মানবাধিকার’ নামক আদর্শটি বহুবার দেখা গেছে কেবল নির্দিষ্ট ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের মানবাধিকার মিশন কতটা নিরপেক্ষ এবং নির্ভেজাল সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
সমঝোতা স্মারকে আরও উল্লেখ আছে, মিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অন্যান্য কূটনৈতিক মিশনের মতো দায়মুক্তির সুবিধা ভোগ করবেন। শুধু তাই নয়, স্থানীয়ভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মীরাও এই সুবিধার আওতায় আসবেন এবং মিশন শেষে দেশের বাইরে চলে গেলেও তাদের দায়মুক্তি বহাল থাকবে। এই দায়মুক্তির সুযোগে কোনো অপব্যবহার হবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়?
আরও বড় প্রশ্ন হলো—বিশ্বে কোন কোন দেশে জাতিসংঘের এই ধরনের মানবাধিকার মিশন আছে? বর্তমানের তালিকায় রয়েছে: বুরকিনা ফাসো, কম্বোডিয়া, চাদ, কলম্বিয়া, গুয়াতেমালা, গিনি, হন্ডুরাস, লাইবেরিয়া, মৌরিতানিয়া, মেক্সিকো, নাইজার, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, সুদান, তিউনিসিয়া এবং ইয়েমেন।
এগুলো প্রায় সবই যুদ্ধবিধ্বস্ত, সংঘাতপূর্ণ বা চরম অপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনে জর্জরিত দেশ। তাদের বেশিরভাগই নাগরিকদের নিরাপত্তা ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ জাতিসংঘের মিশন থাকা সত্ত্বেও এসব দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে দৃশ্যমান কোনো উন্নতির নজির নেই।
তাহলে বাংলাদেশকে এখন এই তালিকায় যুক্ত করা মানে কি? আমরা কি সেই রাষ্ট্রগুলোর কাতারে চলে যাচ্ছি? আন্তর্জাতিক মঞ্চে দেশের ভাবমূর্তি কি এতে উন্নত হবে, নাকি আরও সংকটগ্রস্ত হিসেবে প্রতিভাত হবে?
ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম থেকেই প্রচার করা হয়েছিল, এই সরকারের অধীনে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পাবে, মানবাধিকার রক্ষা পাবে, বাংলাদেশ হবে ‘নিউ সিঙ্গাপুর’। সেই আশার বিপরীতে আজ বাস্তবতা হলো—বাংলাদেশকে যুদ্ধ, দারিদ্র্য কিংবা অপরাধে জর্জরিত রাষ্ট্রগুলোর তালিকায় ঠাঁই দেওয়া হচ্ছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার মিশনের উদ্যোগের লাভ-ক্ষতি এখনই পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়। সময়ই বলবে, এটি ছিল আত্মরক্ষার এক সুযোগ, নাকি দেশের সার্বভৌমত্ব ও মর্যাদার ওপর নতুন এক চ্যালেঞ্জ।
কল্লোল মোস্তফা: লেখক ও গবেষক