Ehsanul Haque Jasim (এহসানুল হক জসীম )
·
জামায়াতে ইসলামীর আনুগত্য ও বিরোধিতা-- উভয় ক্ষেত্রেই একটা অন্ধত্ব ছিলো। জামায়াতের ব্যাপারে নিরপেক্ষ মন্তব্য করার সুযোগ ছিলো না। জামায়াত-শিবির বিরোধী কোন লোক কিংবা জামায়াত ঘরানার নন এমন কোন লোকও যদি জামায়াতের কোন কাজকে ভালো বলে ফেলে তাহলে সে জামায়াত-শিবির হয়ে যেতো। জামায়াতের পক্ষে যায় এমন কথা বললে প্রগতিশীলতা চলে যেতো। পতিত স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের সময়ে এই চর্চা বেশি ছিলো। আবার জামায়াতের সমালোচনা করার মতো কোন বিষয় বা ইস্যু নিয়ে দলটি বা দলটির কোন নেতার সমালোচনা করলে সেটা আবার মেনে নিতে পারতো না জামায়াত অনুগত বেশিরভাগ লোক।
অন্ধ আনুগত্য ও অন্ধ বিরোধিতা থেকে জামায়াতে ইসলামী কি বেরিয়ে আসতে পেরেছে? তবে দলটির আমীর ডা. শফিকুর রহমান নিজে ইদানিং বেশি সমালোচিত হচ্ছেন। কিছু কিছু মন্তব্য করে তোপের মুখে পড়ছেন। অবশ্য এবার তিনি বেশি সমালোচিত হচ্ছেন নিজ বলয়ের লোকজন ও ইসলামপন্থীদের দ্বারা। ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়-নীতি অনুসরণের মাধ্যমে ভারতসহ প্রতিবেশী সব দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক চায় জামায়াতে ইসলামী’-- এমন মন্তব্য করার কারণে অনেকে তীর্যক মন্তব্য করে। মিডিয়ায় শিরোনাম হয়- জামায়াত কখনো ভারতবিরোধী ছিল না। প্রতিবেশি-সহ সবার সাথে বন্ধুত্বের নীতি নিয়ে আগানোই তো বিচক্ষণতা। ভারত যদি নিজ থেকে সম্পর্ক নষ্ট করে, যেটা এখন করছে, সেটা ভিন্ন কথা।
আওয়ামী লীগকে ক্ষমা ঘোষণা করে ৫ আগস্টের পর পরই তিনি বেশ সমালোচনার মুখে পড়েন। ব্যাখা করেন- এটা জামায়াতের পক্ষ থেকে ক্ষমা, মানে দলীয় প্রতিশোধ না নেওয়ার ঘোষণা। তাতেও তাঁর প্রতি সমালোচনা থামেনি। তিনি ক্ষমা করবেন কেন? অথচ এই ক্ষমা ঘোষণা ছিলো নবী মুহাম্মাদ (সা.) থেকে নেওয়া একটি লেসন। মক্কা বিজয়ের পর নবী ক্ষমা ঘোষণা করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ডা. শফিকুর রহমান এ-ও ঘোষণা করেন যে, কোন ভিকটিম যদি ন্যায়-বিচারের জন্য আশ্রয় প্রার্থী হয়, আইনি পদক্ষেপের দিকে আগায়, মামলা করে, তাহলে দল হিসেবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিকারের জায়গা থেকে জামায়াতে ইসলামী সেই লোককে সহযোগিতা করবে।
লন্ডনে একটি অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের ব্যাপারে জামায়াতের আমীর মন্তব্য করেন, ‘‘আমি বারবার ফ্যাসিজম আর ফ্যাসিস্ট বলা পছন্দ করি না’’। এতে অনেকে ক্ষেপেন। বেশি ক্ষেপেন স্বয়ং জামায়াত-শিবিরের বড় একটি অংশ। ডা. শফিকুর রহমানের এই বক্তব্য ফ্যাসিবাদের পক্ষপাতিত্ব ছিলো না। তিনি মূলত উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতির দিকে মনোযোগের জায়গা থেকে এটা বলেছিলেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কেন্দ্রিক রাজনীতি থেকে বের হয়ে উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতিতে অধিক মনোনিবেশ করা দরকার। ডা. শফিকুর রহমান হয়তো সেটাই বুঝিয়েছেন। কিন্তু ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে বলতে মুখে ফনা তুলছেন না কেন- এই জায়গা থেকে অনেকে তাঁর সমালোচনা করছেন। ওদেরকে পতিত স্বৈরাচার বলুন, ফ্যাসিস্ট বলুন, তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। অন্যের বিরোধিতায় বেশি সময় ব্যয় করলে উন্নয়ন ও উৎপাদনে বেশি মনোযোগ দেওয়া যায়না।
নারীরা তাদের ইচ্ছামতো পোশাক পরবে- এমন একটি মন্তব্য করে গতকাল থেকে তিনি আবারো আলোচনা-সমালোচনায়। অনেকে তাঁর উপর ক্ষেপেছেন। তাঁর ইসলামী নলেজের ঘাটতি আছে, বলছেন। তিনি ইসলাম বিরোধি বক্তব্য দিয়েছেন বলে অনেক ইসলামপন্থী লোক বয়ান তৈরির চেষ্টা করছেন। অথচ জামায়াত আমীরের এই বক্তব্য যথাযথ হয়েছে; ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। তিনি কাউকে উলঙ্গ থাকার কথা বলেননি। নারীর পোশাকের স্বাধীনতার কথা বলেছেন। আর এই স্বাধীনতার বিষয়টি জামায়াতের রাষ্ট্র পরিচালনার নীতির ক্ষেত্রে, জামায়াতের দলীয় ক্ষেত্রে নয়। এই দেশ তো আর কেবলই মুসলিমদের দেশ নয়, এখানে অন্য ধর্মের লোকও আছে। ইসলাম ধর্মের পর্দার বিধান অন্য ধর্মের নারীদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন তো নেই। অন্যদিকে, অনেক মুসলিম নারীও পর্দা করেন না। মিশনারী জায়গা বা ধর্মীয় প্রচারণার জায়গা থেকে এটার গুরুত্ব সেই নারীদেরকে বুঝাতে পারেন। কিন্তু রাজনৈতিক দর্শন ও রাষ্ট্রীয় চিন্তার জায়গা থেকে তাদের উপর চাপ প্রয়োগ করার নীতিতে বিশ্বাসী হওয়া উচিত নয়। ডা. শফিকুর রহমান মন্দ বলেননি। তিনি তো ইসলামের পর্দার বিধানের বিপক্ষে বলেননি, বেপর্দা থাকার কথা বলেননি, উলঙ্গ বা অর্ধ-উলঙ্গ হয়ে থাকার কথা বলেননি।
জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান আমীর ডা. শফিকুর রহমানকে বেশ ডাইনামিক লোক মনে হচ্ছে। সমাজ, রাজনীতি, কূটনীতি ইত্যাদি তিনি বেশ ভালো বুঝেন বলে মনে হচ্ছে। তাঁকে দূরদর্শি রাজনৈতিক নেতা বলে মনে হচ্ছে। তিনি সম্প্রতি যেসব মন্তব্য করছেন, বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে- তাঁর এই মন্তব্যগুলো অতি উঁচু মাপের ছিলো, উন্নত চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ছিলো, বাস্তবসম্মত ছিলো। কিন্তু এসব মন্তব্য করে তিনি আলোচিত-সমালোচিত হচ্ছেন। বেশি সমালোচিত হচ্ছেন নিজ বলয়ের লোকজনের কাছে ও ইসলামপন্থীদের কাছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন