আসিফ আদনান

১৯৯৬ বা ৯৭ সালের কথা। বেলগ্রেড, সার্বিয়া। স্বৈরশাসক স্লোবোদান মিলোসোভিচের বিরুদ্ধে আন্দোলন হচ্ছে শহর জুড়ে। মিলোসভিচের কুকীর্তির ফিরিস্তি অনেক লম্বা। তবে প্রতিবাদের এই ঢেউটা শুরু হয়েছিল ১৯৯৬ সালের ডামি নির্বাচনের বিরুদ্ধে।

.

আন্দোলনের মূল কর্মসূচী ছিল রাস্তায় মিছিল আর মার্চ করা। শান্তিপূর্ণভাবে। কিন্তু পদে পদে সমস্যা তৈরি করছিল পুলিশ। সেই সাথে চলছিল দক্ষিণ ইউরোপের হাড়কাপানো শীতকাল। প্রথম দিকে মানুষ কর্মসূচীতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিলেও, এক সময় উপস্থিতি কমতে লাগল।

.

কী করা যায়? ভাবতে বসলো আন্দোলনের আয়োজকরা। মিলোসোভিচের মতো স্বৈরাচারের পতন এক দিনে হবে না। এর জন্য আন্দোলন চালিয়ে যেতে মাসের পর মাস। কিন্তু জনগণ যদি এখন আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তাহলে মনোবল ভেঙ্গে যাবে একেবারেই। হারিয়ে যাবে আন্দোলনের মোমেন্টাম।

.

সিদ্ধান্ত হল, এমন কোন কর্মসূচী দিতে হবে যেটায় যারা রাজপথে নামতে পারছে না, তারাও খুব সহজে অংশ নিতে পারবে। একই সাথে এই অংশগ্রহণ ভিসিবলও হবে। অর্থাৎ কর্মসূচী এমন হবে, যাতে মিলোসোভিচ বোঝে, পুরো সমাজ তার বিরুদ্ধে।

.

সেই কর্মসূচী কী?

.

সার্বিয়ায় প্রতি সন্ধ্যায় ৭.৩০-৮.০০ পর্যন্ত জাতীয় টেলিভিশনে খবর দেখানো হতো। আমাদের বিটিভির ৮টার সংবাদের মতো আর কি। আর বিটিভি-র মতোই সেই সংবাদ জুড়ে থাকতো মিলোসোভিচের নানা গুণগান আর নির্লজ্জ রিজিম প্রপাগ্যান্ডা।

.

এটা ১৯৯৭ এর কথা, তখনো অতো বেশি টিভি চ্যানেলও ছিল না। বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে। সবাই একরকম বাধ্য ছিল শান্ডারপুরে বাতাবী লেবুর বাম্পার ফলনের খবর দেখতে। এই খবরের সময়টাকে কেন্দ্র করেই দেয়া হল কর্মসূচী।

.

ঠিক হল, সবাই সন্ধ্যা ৭.৩০ থেকে ৮ পর্যন্ত নিজ ঘরের ব্যালকনি কিংবা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে শব্দ করবে। যে কেউ এই কর্মসূচীতে অংশ নিতে পারবে। এতে খুব একটা ঝুঁকি নেই, আবার অনেকে মিলে যখন এই কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করবে – তখন সেটা উপেক্ষা করাও সম্ভব না।

.

প্রথমে ব্যাপারটা শুরু হল বেলগ্রেডের কিছু বাড়ি থেকে। ৭.৩০ এ সার্বিয়ার বিটিভি-র খবর শুরু হলেই লোকজন ব্যালকনিতে গিয়ে হাড়িপাতিল আর থালাবাসন পেটাতে শুরু করলো।

.

দু এক দিনের মধ্যে পুরো বেলগ্রেডের অধিকাংশ মানুষ থালাবাসন পিটিয়ে আন্দোলনের পক্ষে আর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান জানান দিলো। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ব্যাপারটা ছড়িয়ে পড়লো অন্যান্য শহরগুলোতে।

.

রেডিও স্টেশনগুলোতে রীতিমতো লাইভ টেলিকাস্ট শুরু করলো – অমুক শহরের অমুক পাড়ায় ব্যাপক আওয়াজ হচ্ছে। অমুক এলাকাতে লোকজন লাউড স্পিকার বসিয়ে আওয়াজ করছে। অমুক শহরের একটা ডিস্কো ক্লাব প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করছে।

.

অল্প দিনের মধ্যে মিলোসোভিচ আর তার পান্ডারা জেনে গেল, জনগণ তার বিরুদ্ধে।

.

না, এই কর্মসূচীতে মিলোসভিচের পতন হয়নি। তার পতনের জন্য সময় লেগেছিল আরও কয়েক বছর। তবে এই সময়টাতেই তার শেষের শুরুটা হয়ে গিয়েছিল। কারণ জনগণ নিজের অবস্থানটা জানাতে পেরেছিল, এবং সেটা ঐক্যবদ্ধভাবে।

.

তারা সবাই তখন রাজপথে নামতে পারেনি, সত্য। কিন্তু এই কর্মসূচীর মাধ্যমে তারা একে অপরকে জানাতে পেরেছিল – তুমি একা না, আমরা সবাই আছি স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে।

.

একা মানুষ ভয় পায় বেশি। মিছিলের মধ্যে, সমষ্টির মধ্যে অন্য রকমের সাহস নেমে আসে। আর এই সাহস পরে এই মানুষগুলোকে ব্যালকনি থেকে নামিয়ে নিয়ে গিয়েছিল মিছিলের কাতারে। যে মিছিলে মিছিলে এক সময় পতন হয়েছিল স্বৈরাচারী মিলোসোভিচের।