মুহাম্মাদ সাইদুল ইসলাম
বসফরাস আর গোল্ডেন ট্রায়াংগেল থেকে প্রায় সাড়ে নয় হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে অনেক অনেক দুরের মালাক্কা প্রণালী পেরিয়ে ফিরলাম দুনিয়ার "বাগিচা শহর" খ্যাত সিংগাপুরে। আহা, কনস্টান্টিনোপলের দূর্ভেদ্য দেয়ালের পাশে শুয়ে থাকা আবু আইউব আল আনসারী (রা.) থেকে বিদায় নিতে কি যে কষ্ট! বসফরাসের তীর যেন প্রশান্তির সুবাতাস নিয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমায় বারে বার। আয়া সোফিয়ার অনাবিল সৌন্দর্যে এখনো হয়ে আছি মোহবিষ্ট। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম বিশাল তোরণের দিকে, যেখান দিয়ে সুলতান ফাতিহ ১৪৫৩ সালে তার অসাধারণ বাহিনী নিয়ে শির উচিয়ে প্রবেশ করেছিলেন। "আহা, সেই সুলতান আর তার বাহিনী কতইনা সুন্দর!"-- এমনই উচ্চারণ ছিলো আমাদের প্রিয় নবীজীর।
আয়া সোফিয়ার অদূরে ব্লু মসজিদের বিশালতা, সৌন্দর্যের সীমাহীন মহড়া, শৈল্পিক কারুকাজ, আর ক্যালিগ্রাফির অসাধারণ ব্যপ্তি যেন ব্লু স্কাইকে ছাড়িয়ে গেছে। ছয় উঁচু মিনার যেন এশিয়ার চৌহদ্দি পেরিয়ে ইউরোপের ময়দানে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা দিচ্ছে বারংবার। আহা, কি সুবিশাল মন, মননশীলতা, গাম্ভীর্য, আর বিশ্বজয়ের উন্মাদনা ছিলো সে সময়ের সুলতানদের! বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের দীর্ঘ দিনের লালিত গর্ব আর দর্পকে চুরমার করে দিয়েছিল নিমিষে এই ব্লু মসজিদের বিশালতা।
ফাতিহ মসজিদের পাশেই ছিলাম তিনদিন। এই মসজিদে সুলতান ফাতিহর অসিয়ত অনুসারে প্রতিদিন সকালে তিরিশ জন হাফেজ মিলে এক খতম কোরান, ৭০ হাজার বার কালিমা তাওহীদ, এবং ১০ হাজার বার রাসুলের শানে দুরুদ পড়া হয়। সাড়ে পাঁচশ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে আসছে এই ট্রাডিশন। হয়তো চলতে থাকবে কিয়ামত অবধি। কালের সাক্ষী হয়ে এই মসজিদের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ছয় ছয়টি মাদ্রাসা, যা এক সময় ছিলো অটোমান সাম্রাজ্যের এমআইটি বা হার্ভার্ড।
এই ইউরোপ যখন অন্ধকারে নিমজ্জিত, সভ্যতার কোন ধারণাই ছিলো না তাদের, সে সময়ে অটোমানরা প্রতিষ্ঠা করে এক শক্তিশালী বিশ্বসভ্যতা। পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকা সুবিশাল মসজিদগুলো এবং তার চারিপার্শ যেন সেই সোনালী ইতিহাস বারে বারে জানান দিচ্ছিলো আমাকে। কনস্টান্টিনোপল বিজয়ী সুলতান মুহাম্মাদ আল-ফাতিহ (১৪৪৪-১৪৪৬ এবং ১৪৫১-১৪৮১) ছিলেন সাতটি ভাষায় এক্সপার্টঃ তুর্কি, আরবি, ফার্সি, গ্রিক, ল্যাটিন, সার্ব, এবং হিব্রু। তার প্রশাসনিক কাঠামো ছিলো চমৎকার মেরিটোক্রাসি'তে সাজানো। মেধা এবং দক্ষতার ভিত্তিতেই হতো নিয়োগ এবং পদায়ন। সুলতান তৈরি করেন বিশ্বের প্রথম "পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশন ট্রেনিং সেন্টার"-- এন্দেরুন। এন্দেরুনের সিলেবাস ছিলো বিশাল, পড়াশোনাও ছিলো কঠিন। এখানকার সবচেয়ে অসাধারণ ছাত্র, যারা একইসঙ্গে পড়াশোনা, প্রশাসনিক জ্ঞান আর যুদ্ধবিদ্যায় দক্ষ, তাদেরকে সুলতান রেখে দিতেন নিজের কাছে।
এক শক্তিশালী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা হয় যা ছিলো সবার জন্য উন্মুক্ত। এখানে পড়ানো হতো আরবি সহ অনেক ভাষা, শরিয়া, বিজ্ঞান, দর্শন, যুদ্ধবিদ্যা, ভূগোল, সাহিত্য ইত্যাদি। শুধু রাজধানী ইস্তামবুলেই সুলতান ফাতিহ গড়ে তোলেন ১৯২ টি ইমারত। প্রতিটি ইমারতের কেন্দ্রে থাকতো একটি করে মসজিদ। মসজিদের পাশেই থাকতো মাদরাসা, লাইব্রেরি, হাসপাতাল, হোষ্টেল, মুসাফিরখানা, হাম্মামখানা, ছাত্র পথিক ও দরিদ্রদের জন্য খাবার রান্না করার লঙ্গরখানা। সেখানে রোজ তিনবেলা অসহায় মানুষের জন্য পোলাও, গোসত, স্যুপ, রুটি ও জর্দা রান্না করা হতো।
নিজের সময়ের চেয়ে অন্তত চারশ বছর এগিয়ে ছিলেন প্রাজ্ঞ রাষ্ট্রনায়ক মুহাম্মাদ আল-ফাতিহ। তার সালতানাত ছিলো বর্বর ইউরোপে নির্যাতিত ইহুদি এবং খ্রিস্টানদের শ্রেষ্ঠ আশ্রয়। কোন গরীব মানুষ না খেতে পেয়ে কিংবা টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার ঘটনা ছিলো বিরল। অনেক সময়ই ধনীরা যাকাত দেওয়ার লোক খুঁজে পেতেন না। অটোমানদের জন্য দান ছিলো উৎসবের মতো। যেমন কোন পাশার সন্তান যেদিন আনুষ্ঠানিক ভাবে পড়াশোনা শুরু করত, সেদিন একেকজন পাশা পঞ্চাশ, একশ, এমনকি একহাজার শিশুর শিক্ষার দায়িত্ব নিয়ে নিতেন। সালতানাতের কুকুর-বিড়ালের জন্যও ছিলো হাসপাতাল। শীতের সময় মানুষ পাহাড়ে গিয়ে পশুপাখির জন্য খাবার রেখে আসতো, যাতে তুষারপাতের ভিতর পশুপাখিদের না খেয়ে মরতে না হয়। আমার ভ্রমণের সাথী ড. জাহিদ ভাই থেকে শুনেছি, এই ট্রাডিশন এখনো চালু আছে সেখানে।
এই অটোমানরা ধারণ করেছিল ইসলামের সোনালি যুগের সেই বিচার ব্যবস্থা, যেখানে ইহুদির বর্ম চুরির অপরাধ প্রমাণ করতে না পারলে খলিফা বর্ম ফেরত পান না। মূলত তাদের মাধ্যমেই ইউরোপ প্রথম স্বাধীন বিচার বিভাগের ধারণা পায়। [১]
পরিচ্ছন্ন অর্থব্যবস্থা, চমৎকার সামাজিক মূল্যবোধ, শক্তিশালী বিচার বিভাগ, অসাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা, এবং সুশাসন--এসবের সমন্বয়ই অটোমানদেরকে এক অপ্রতিরোধ্য বিশ্বশক্তিতে পরিণত করেছিল। আজ কোথায় সেই সোনালী যুগ, কোথায় সেই দরাজ দিল! এসব ভাবতেই আফসোসের লুহাওয়া হৃদয়ের মাঝে হুহু করে উঠতো।
গিয়েছিলাম সুলেমান মসজিদে। ১৫৫৮ সালে, সুলতান সুলেমানের আমলে, ইস্তাম্বুলের গ্র্যান্ড মসজিদের ইমামের কমপক্ষে সাতটা যোগ্যতার সমন্বয় থাকতো: (ক) আরবি, লাতিন, তুর্কি এবং ফার্সি--কমপক্ষে এই চারটি ভাষার পান্ডিত্য; (খ) কুরআন, বাইবেল এবং তাওরাতে এক্সপার্ট; (গ) শরিয়াহ ও ফিকহের উপর আলেম; (ঘ) পদার্থবিজ্ঞান এবং গণিতে স্নাতকোত্তর জ্ঞান যা দিয়ে ছাত্রদের এই দুই বিষয়ে শিক্ষা দান করতেন; (ঙ) শাস্ত্রদক্ষতা, তীরন্দাজি, তলোয়ার যুদ্ধ এবং যুদ্ধকৌশলে দক্ষ; (চ) দেখতে সুপুরুষ ও সুদর্শন; এবং (ছ) মধুর কন্ঠের অধিকারী [২]। সে সময়কার একজন ইমামের যদি এই বিশাল যোগ্যতার সমাহার থাকে, তাহলে বিশ্ব শাসন তারা করবে, নাকি আজকের নানান মামুলী বিষয়ে তর্কে লিপ্ত, রসনা ও ভোগ বিলাসে আক্রান্ত "ভুড়েল" আলেমরা আর ইতিহাস বিস্মৃত মুসলমানেরা করবে?
বসফরাসের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা তোপকাপির রাজপ্রাসাদ আর তার মাঝে সংরক্ষিত আর্টিফ্যাক্টস আমাকে বারে বারে নিয়ে যাচ্ছিল বিশ্ব ইতিহাসের পরতে পরতে, কখনো নবীজীর কদম মোবারকের একেবারে কাছাকাছি। স্বচক্ষে দেখা তার চুল মোবারকের ছোঁয়া পেলে হয়তো মোমের মতো গলে যেতাম। কাঁপা কাঁপা হৃদয়ে পরম বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলাম হযরত আলীর জুলফিকারের দিকে; আবুবকর, ওমরের তলোয়ার পানে। এগুলো দিয়েইতো তারা মরু সাইমুমে ইসলামের বিজয়কেতন উড়িয়েছিলেন, যার সিলসিলা অব্যাহত ছিলো অটোমান আমল পর্যন্ত।
বসফরাস যেন কালের সাক্ষী হয়ে উম্মাহকে ডাকছে: হে মুসলিম! তোমরা জেগে ওঠো আরেকবার। নিজের ইতিহাস ঐতিহ্যকে স্মরণ করো, অনিবার্য ধ্বংসের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করো এই দুনিয়াটাকে, গড়ে তোল সুবিচার আর সুসভ্যতার এক সুন্দর পৃথিবী।
সূত্রঃ
[১] প্রিন্স মুহাম্মাদ সজল (২০১৮) "সানজাক-ই উসমান (অটোমানদের দুনিয়ায়)", ঢাকাঃ গার্ডিয়ান পাবলিকেশনস।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন