অলিউল্লাহ নোমান
সোশাল মিডিয়াসহ সর্বত্র আলোচনার বিষয় সাবেক সেনাপ্রধান এম এ আজিজ। যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। হঠাৎ করেই আমেরিকা আজিজসহ পরিবারের সদস্যদের নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এনিয়ে তোলপাড় করা আলোচনার মধ্যে এক শীর্ষ হুন্ডি ও স্বর্ণ চোরাচালানী খুনের ঘটনা ঘটে ভারতে। যদিও এখনো তাঁর লাশ মিলেনি। বলা হচ্ছে লাশ টুকরা টুকরা করে কিমা বানানো হয়েছে। এনিয়ে আলোচনার মধ্যেই সামনে আসেন বেনজির আহমদ। তার স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি ও ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দিয়েছে ঢাকার একটি আদালত। শুধু বেনজির নয়, তার স্ত্রী ও সন্তানের বিষয়ে একই আদেশ দেওয়া হয়েছে। সপ্তাহ জুড়েই এই ৩ ব্যক্তিকে ঘিরে ব্যস্ত সোশাল মিডিয়া।
এই ৩ জনই বর্তমান ফ্যাসিবাদী সরকারের শীর্ষ মহলের ঘনিষ্ঠ হিসাবে আলোচিত। বর্তমান ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় আজিজ এবং বেনজিরের অনেক শ্রম রয়েছে। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে তারা ব্যবহার করেছেন দেশের জনগণের বিরুদ্ধে।
আজিজ আহমদ সেনা প্রধান হওয়ার আগে বিজিবি প্রধান হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৩ সালের ৫ মে রাতের আঁধারে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে শাপলা চত্বরে গণহত্যার কথা নিশ্চয়ই সবারই স্মরণে থাকার কথা। ওই রাতে কত মানুষ খুন হয়েছেন তাঁর কোন সঠিক পরিসংখ্যা নেই। ভবিষ্যতে কোন একদিন অবশ্যই তদন্ত হবে। সঠিক পরিসংখ্যান ও নিহতদের পরিচয় বের হবে। কারণ, ফৌজদারি অপরাধ কখনো তামাদি হয় না। প্রয়োজনে একশ’ বছর পরেও তদন্ত করার সুযোগ রয়েছে আইনে।
সঠিক তদন্ত হলে আজিজ আহমদ এবং বেনজির আহমদের (দুই আহমদ) চুড়ান্ত দণ্ড হওয়ার যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ মিলবে। এই দুই আহমদ সেই রাতে অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আজিজ আহমদ বিজিবি প্রধান এবং বেনজির আহমদ ঢাকা মহানগর পুলিশের প্রধান হিসাবে দায়িত্বে ছিলেন তখন। তাদের উপস্থিতিতেই সেই রাতে গণহত্যার ঘটনা ঘটে শাপলা চত্বরে ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রধান শেখ হাসিনার অতি ঘনিষ্ঠ এই দুই ব্যক্তি। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতেই দেশের জনগণের টাকায় কেনা বুলেট ও অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল শাপলা চত্বরে। আজিজ আহমদকে সম্প্রতি আমেরিকা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির অভিযোগে। বেনজির আহমদের বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ডিসেম্বরেই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে।
এই দুই ব্যক্তি ক্ষমতার অপব্যবহারই শুধু করেননি। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচানের নামে প্রহসনের আয়োজনের মূল কারিগরির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তখন আজিজ আহমদ ছিলেন সেনাপ্রধান এবং বেনজির ছিলেন র্যাবের ডিজি (মহাপরিচালক)। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে ফ্যাসিবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে তারা দুইজন রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যবহারের মূখ্য ভূমিকা পালন করেছেন।
শেখ হাসিনার কল্যাণেই দুইজন রাষ্ট্রীয় দুই গুরুত্বপূর্ণ বাহিনীর শীর্ষপদে আসীন হয়েছিলেন। তারাও এই পদবীর অপব্যবহার করে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে যথাসাধ্য অপচেষ্টা চালিয়েছেন। মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে রাতে ব্যালটে সীল মারা থেকে শুরু করে গুম-খুন করেছেন নির্দ্বিধায়। খুনি-দুর্নীতিবাজ লুটেরা হিসাবে ইতোমধ্যেই তারা পরিচিতি লাভ করেছেন।
শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছিলেন তারা। ভিন্নমত ও ভিন্ন পথের রাজনৈতিক নেতাদের গুম-খুন করেছেন। এই সরকারই এখন বেনজির আহমদের সম্পদ জব্দ করার উদ্যোগ নিয়েছে। শেখ হাসিনার ইচ্ছার বাইরে গিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের এমন উদ্যোগ নেওয়ার হিম্মত ও ক্ষমতা কোনটাই নাই। তেমনি শেখ হাসিনার ইচ্ছার বাইরে গিয়ে আদেশ দেওয়ার এখতিয়ারও নাই বাংলাদেশের আদালতের। সুতরাং বেনজির আহমদের সম্পদ জব্দ করার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন যে উদ্যোগটি নিয়েছেন তাতে শেখ হাসিনার সায় রয়েছে নিশ্চিত। এই উদ্যোগের ফলে আদালত যে আদেশটি দিয়েছে তাতেও শেখ হাসিনার ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটেছে। কেন শেখ হাসিনা বেনজিরের উপর এতটা চড়াও হলেন সেটা এখন কোটি টাকার প্রশ্ন। এই প্রশ্নের সহজ কোন উত্তর আপাতত নেই। তবে শেখ হাসিনার এই উদ্যোগের ফলে দেশের মানুষের সামনে বেনজির আহমদের লুটপাটের খন্ড চিত্র প্রকাশিত হয়েছে। এতে একদফা মিডিয়া ট্রায়াল আপাতত হয়ে গেছে। বেনজির আহমদরা মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রপাগাণ্ডা চালিয়ে মিডিয়া ট্রায়ালের অপচেষ্টা করতেন। প্রয়োজনে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের মাটির নিচ থেকে খুঁজে বের করার হুঙ্কার দিতেন। এখন তাদের বসানো সরকারই বেনজির আহমদের লুটপাটের খণ্ডচিত্র প্রকাশ করছে। বিচার হউক বা না হউক, মিডিয়া ট্রায়াল তো হচ্ছে।
আর আল-জাজিরার কল্যাণে আজিজ আহমদের মিডিয়া ট্রায়াল আরো আগেই হয়েছে। তারা দুইজন এখন পুলিশ ও সেনাবাহিনীর দুর্নীতির চরিত্রের মাইলস্টোন। সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশ কতটা দুর্নীতিগ্রস্থ তাদের দুইজনের প্রকাশিত চিত্র থেকেই পরিষ্কার। দেশের মানুষের টাকায় পোষা হয় সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশ। অথচ, তারাই দেশের সম্পদ লুটপাট করেন এবং জনগণের টাকা কেনা অস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেন।
এক সময় সেনাবাহিনীর আগে “দেশপ্রেমিক” শব্দটি ব্যবহার করা রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল। জেনারেল মঈন ইউ আহমদের সময় থেকে এই বাহিনীর আগে মানুষ আর “দেশপ্রেমিক” শব্দটি ব্যবহার করেন না। কারণ, এই সেনাবাহিনীর মাধ্যমেই ভারত বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব দখল করেছে। জেনারেল মঈন ইউ আহমদ পুরো জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে দেশের সার্বভৌমত্ব তুলে দিয়েছন ইন্ডিয়ার হাতে। এ বাহিনীর কেউ এটার প্রতিবাদ করেননি। সুতরাং পুরো বাহিনী এরজন্য দায়ী। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালের জানুয়ারীতে ক্ষমতায় আসেন শেখ হাসিনা। অনেকেই হয়ত বলবেন, শেখ হাসিনাতো ক্ষমতায় এসেছিলেন নির্বাচনের মাধ্যমে। কিন্তু ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনটি ছিল সাজানো। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি (প্রয়াত) প্রণব মুখার্জির আত্মজীবনীতে মঈন ইউ আহমদের সাথে বোঝাপড়ার বিষয়টি পরিষ্কার করে গেছেন।
অতএব, পুরো বাহিনীর সহায়তায় ভারতের স্বার্থ রক্ষায় শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসানো হয়েছিল সেদিন। পরবর্তীতে ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানেই শেখ হাসিনা মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করেছেন।
এবার আসি আনোয়ারুল আজিম প্রসঙ্গে। সেনাবাহিনী ও পুলিশের নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের নামে প্রহসনের সংসদ সদস্য ছিলেন এই ব্যক্তি। স্বর্ণ চোরাচালান ও হুন্ডি ব্যবসা, মানবপাচার এবং খুনের অভিযোগে এক সময় পলাতক ছিলেন তিনি। তার অনুপস্থিতিতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল আদালত। তাকে খুঁজে বের করার জন্য ২০০৭ সালে ইন্টারপোলে র্যাড অ্যালার্টের ব্যবস্থা করেছিল বাংলাদেশ পুলিশ। এই ব্যক্তিকেই শেখ হাসিনা মনোনয়ন দিয়ে পরপর ৩টি ভুয়া নির্বাচনে। তাঁকে বিজয়ী করতে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানেই ভোট জালিয়াতি করা হয়েছে। ইন্টারপোলের রেড অ্যালার্টের আসামীকে ২০১৪ সালে শেখ হাসিনা মনোনয়ন দিয়ে সংসদ সদস্য বানিয়েছেন। ওই নির্বাচনে বিরোধী দল অংশ না নেওয়ায় ভোটের ব্যালটে সীল মারার কাজটি করেছিল পুলিশ। তদারকিতে ছিল সেনাবাহিনী। ২০১৮ সালে ২৯ ডিসেম্বর দিবাগত রাতেই ভোট ডাকাতি এবং ২০২৪ সালে ভোটার অনুপস্থিতির নির্বাচনে বিজয়ী এই স্বর্ণ চোরাচালানী এবং খুনের দায়ে অভিযুক্ত আনোয়ারুল আজিম।
ইতোমধ্যে ভারতীয় বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, শেখ পরিবারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। জাতীয় সংসদ হচ্ছে দেশের আইনসভা। দেশের কল্যাণে বিভিন্ন আইন তৈরি করার দায়িত্ব এই সংসদ সদস্যদের। শেখ হাসিনা ও শেখ পরিবারের কল্যাণে আনোয়ারুল আজিমের মত ব্যক্তিরাই এখন জাতীয় সংসদে বসে জাতির জন্য আইন তৈরি করেন।
আনোয়ারুল আজিমের প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় না বললেই নয়। ২০১৩ সালের পর ঝিনাইদহ জেলা গুপ্ত হত্যার জন্য আলোচিত হয়ে উঠে। বিশেষ করে বিরোধী দলের উঠতি নেতাদের ধরে নিয়ে গুম পরবর্তীতে ক্ষত বিক্ষত লাশ পাওয়ার ঘটনা ঘটতে থাকে। ২০১৬ সালে সোহান নামে ছাত্র শিবিরের এক কর্মীকে তুলে নিয়ে যায় সাদা পোশাকধারী পুলিশ সদস্যরা। তখন তাঁকে খুঁজে পেতে এবং ছেড়ে দেওয়ার জন্য স্থানীয় কয়েক শত লোক আনোয়ারুল আজিমের দরবারে হাজির হন। তাঁকে অনুনয় বিনয় করেন স্থানীয় মানুষজন। সোহানের পরিবার আওয়ামী লীগে যোগ দিবে বলে অঙ্গীকারও করেন। তখন তাদের মুখের উপরে বলেছিলেন, কারো আওয়ামী লীগ করার দরকার নেই। আওয়ামী লীগের জন্য তিনি নিজেই যথেষ্ট। এই বলে লোকজনকে তাড়িয়ে দেন তিনি। পরবর্তীতে সোহানের ক্ষত বিক্ষত লাশ পাওয়া যায়। সোহানের মা চিৎকার করে তখন বলেছিলেন, তোরা যদি মেরেই ফেলবে আমার সন্তানের চোখ তুলে নিলে কেন! বেনজির আহমদদের পাহারায় এই স্বর্ণচোরা চালানীরাই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেন প্রতিটি এলাকায়।
বাংলা প্রবাদে একটি কথা আছে-পাপ বাপকেও ছাড়ে না। তাদের পাপের বোঝা এতটাই ভারী হয়েছে, নিজের বসানো সরকারই পাপের খতিয়ান খুঁজে বের করছে। আনোয়ারুল আজিমদের লাশ টুকরা টুকরা করে কিমা বানানোর খবর বের হচ্ছে।
লেখক: যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত সাংবাদিক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন