ইমতিয়াজ মাহমুদ
ফুটফুটে এই মেয়েটা ইডেন কলেজে দর্শন পড়তো। সাথে সাংবাদিকতা করতো। ওর নাম পিতামাতার নাম গ্রামের ঠিকানা এগুলি নিয়ে কোনো গ্রহণযোগ্য সংশয় নেই। ওর আনুষ্ঠানিক নাম বৃষ্টি খাতুন, কিন্তু নিজে সে নাম গ্রহণ করেছিল অভিশ্রুতি শাস্ত্রী। অনেকেই এরকম নাম গ্রহণ করে, এটা খুব অভিনব কিছু না। কিছুদিন আগে জানতে পারলাম যাকে আমরা রাখাল রাহা বলে চিনি তাঁর নামটাও নাকি এইরকম একটা স্বেচ্ছায় গৃহীত ছদ্মনাম, তাঁর মূল নাম নাকি সাজ্জাদ হোসেইন (এই তথ্যটি সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই, ফেসবুক কমেন্টে কয়েকজন বলেছেন মাত্র)। লেখক, কবি, অভিনেতা বা এরকম সৃজনশীল লোকজনের মধ্যে এরকম নাম গ্রহণের প্রবণতা সম্ভবত বেশি। রুদ্র মোহাম্মদ শহিদুল্লার রুদ্র অংশটি বা ব্রাত্য রাইসুর ব্রাত্য অংশটি ওদের নিজেদের প্রদত্ত নাম। মুনীর চৌধুরীর মূল নামও সম্ভবত একটু ভিন্ন।
ভারতের অভিনেতা দিলিপ কুমারের আসল নাম ছিল ইউসুফ খান। ভারতের প্রখ্যাত র্যাপার বাদশার মূল নাম আদিত্য প্রতীক সিং শিশোদিয়া। এক বাঙালি শিল্পী শান্তনু ঘোষ বম্বেতে গাইতে গিয়ে নাম নিয়েছে শান। সঙ্গীতশিল্পী কুমার সানুর মূল নাম কেদারনাথ ভট্টাচার্য। আরও উদাহরণ দেবো? মেয়েটার মৃত্যু হয়েছে বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডে। কিন্তু ওকে সনাক্ত করতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি চট করেই সকলে সনাক্ত করেছেন যে এই মেয়েটা অভিশ্রুতি শাস্ত্রী বা বৃষ্টি খাতুন। সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল, ওর মৃতদেহ হয়তো ওর পিতামাতার কাছে হস্তান্তর করা হয়ে যেতো, বাধ সেধেছে রমনার কালীবাড়ির ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মহোদয়। কী কারণে বা কোন অধিকারে তিনি এরকম করছেন জানি না, সভাপতি মহোদয় গিয়ে দাবি করেছেন অভিশ্রুতি শাস্ত্রী জন্মগতভাবেই হিন্দু। তাঁর দাবি হচ্ছে, অভিশ্রুতি নাকি বেনারসের কোনো এক ব্রাহ্মণের কন্যা,অফিশিয়ালি যারা ওর পিতামাতা ওরা নাকি বৃষ্টির জন্মদাতা পিতামাতাই নয়।
[২] এইটা একটু অস্বস্তির সৃষ্টি করেছে। এইখানে একটা কথা বলে রাখি, ধর্মান্তরিত হয়ে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করার কোন বিধান নাই। ইহুদীদেরও এরকম নিয়ম ছিল আপনি চাইলেই ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করতে পারবেন না। ইহুদীরা নাকি সম্প্রতি কি একটা কায়দা করেছে যে নানা রকম প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে অন্য ধর্ম থেকে চাইলে কেউ ইহুদী হতে পারে প্রক্রিয়াটা বেশ জটিল, আমি বিস্তারিত জানিও না। ভারতে উগ্রবাদী হিন্দুরাও সম্প্রতি একটা কায়দা বের করেছে ঘর ওয়াপসি। ঘর ওয়াপসির ভিত্তি হচ্ছে একটা ধারণা যে ভারতবর্ষে একসময় সকলেই হিন্দু ছিল। সে অনুযায়ী কোনো মুসলমান বা খৃস্টান চাইলেই একটা শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়ায় আবার হিন্দু ধর্মে ফিরতে পারে। না, একজন অহিন্দু চাইলে হিন্দু ধর্ম অনুসরণ করতে পারে, পূজা অর্চনা করতে পারে। ইউরোপে আমেরিকায় এরকম অনেক মানুষ আছে যারা কৃষ্ণভক্ত, কীর্তন করে, নামজপ করে। এদের মধ্যে শ্বেতাঙ্গ গুরুও আছে, যারা রীতিমতো দীক্ষা টিক্ষা দেয়। এরকম ভক্ত যে কেউ হতে পারে কিন্তু ওরা তো পুরোপুরি সনাতন ধর্মের মানুষ বলে বিবেচিত হবে না আরকি। সনাতন ধর্মের হতে হলে আপনাকে সনাতন ঘরেই জন্মাতে হবে। বৃষ্টির যে পিতামাতা, ওরা যেহেতু সনাতন ধর্মাবলম্বী নয়, তাইলে তো বৃষ্টির পক্ষে সনাতন ধর্মাবলম্বী হওয়া সম্ভব নয়।
এখন নাকি ডিএনএ পরীক্ষা হচ্ছে। ডিএনএ পরীক্ষায় ওর পিতামাতা যদি উত্তীর্ণ হয়ে যায় তাইলে তো ল্যাঠা চুকে গেলো। আমার তো মনে হয় ডিএনএ পরীক্ষায় ওরা উত্তীর্ণ হয়ে যাবে। কেন এরকম মনে হচ্ছে? বিশেষ কোনো কারণ নাই এমনিই মনে হচ্ছে। বৃষ্টির বাবার একটা ভিডিও দেখেছি, বেচারার জন্যে খুব মায়া লেগেছে। ভিডিওতে দেখলাম মন্দিরের সভাপতি মহোদয় তাঁকে খুব ধমকাচ্ছেন। বাবাটার জন্যে খুব মায়া লেগেছে, আহারে, একদিকে কন্যার মৃত্যুর শোক, তাঁর উপর এই উটকো একটা লোক তাঁকে তাঁর কন্যার পিতৃত্ব নিয়ে সংশয় তুলে ধমকাচ্ছে।
[৩] আর যদি কোনো কারণে ডিএনএ পরীক্ষায় দেখা যায় যে না, মেয়েটা ওদের বাচ্চা না, তাহলে শুরু হবে আসল সংকট। সবুজ মিয়ার কন্যা নয়, তার মানেই কিন্তু এমন না যে সে কোনো হিন্দু ব্যক্তির কন্যা হয়ে গেলো। তখন মন্দিরের এই সভাপতিকে দায়িত্ব দিয়ে বলতে হবে যে সভাপতি মহোদয়, যা তুই বেনারসের শাস্ত্রীদের ধরে নিয়ে আয় আমরা ওদের ডিএনএ টেস্ট করে দেখি। আর সেটা যদি না হয় তাহলে মেয়েটাকে বেওয়ারিশ হিসাবে দাফন করতে হবে। তখন আবার তর্ক উঠবে, অজ্ঞাত পিতামাতার সন্তান তাকে কি মাটি দেওয়া হবে নাকি আগুন। লক্ষ্য করে দেখবেন, এই পুরো ব্যাপারটাই ঘটছে ধর্মের কারণে। ওকে আপনি বৃষ্টি খাতুন বলেন বা অভিশ্রুতি শাস্ত্রী বলুন, মেয়েটা যে মানুষ ছিল সেই ব্যাপারে তো কোন সংশয় নেই। মৃত্যুর পর একজন মানুষকে মাটি দেওয়া হলো কি পুড়িয়ে ফেলা হলো তাতে সেই মৃতব্যক্তির কি যায় আসে? কিসসু না। এই যে অভিশ্রুতি মেয়েটি, ওকে কবর দেওয়া হলো নাকি পুড়িয়ে ফেলা হলো তাতে ওর কি যায় আসে? কিন্তু বাগড়া দিচ্ছে কে? ধর্ম। এর সমাধান কী করে হবে? বেচারার লাশটা পড়ে আছে লাশকাটা ঘরে আর মন্দিরের সভাপতি আর ওর পিতামাতা তর্ক করছে ওর ধর্ম নিয়ে। আপনি কি মনে করেন এই ঘটনার সমাধান হবে? হবে না। ধর্ম বিশ্বাসী লোকেরা মানুষ চেনে না, মানুষ মানে না ওরা চেনে কেবল হিন্দু আর মুসলমান। ওরা এই তর্ক করেই যাবে বহু বহু বছর। লেখক: আইনজীবী। ফেসবুক থেকে
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন