আরিফুল হক
ইতিহাসের এই খ্যাতনামা যোদ্ধা নিসার আলি কে কয়জন চিনবেন জানিনা, তবে তিতুমীর উচ্চারণ করলে কিছু মানুষ নামটির সঙ্গে পরিচিত হতেও পারেন। এখানে বলে রাখি এই বিশাল মানুষটিকে ইতিহাসে হেয় করার উদ্দেশ্য নিয়ে ইংরেজ ও তৎকালীন বাবু সম্প্রদায় তাঁর উৎকৃষ্ট নাম নাসির আলির পরিবর্তে নিকৃষ্ট নাম বা নিক নেম তিতা মীর বা তিতুমীর ব্যবহার করেছেন। দুঃখের বিষয় মুসলমান ঐতিহাসিকরাও সেই প্রথা বজায় রেখে চলেছেন।
আমরা সচরাচর দেখি যে হিন্দু ভায়েরা মুসলমানদের নামের বিকৃত উচ্চারণ করে থাকে। যেমন সোহরাওয়ার্দী জায়গায় সুরাবর্দ্দী, আওরঙ্গজেব এর জায়গায় আওরংজীব, নোয়ামিঞা কে দুদু মিয়া ইত্যাদি। মুসলমানরা কোন মানুষের নিক নামে বা নিকৃষ্ট নামে ডাকতে অভ্যস্ত নয়। স্বামী বিবেকানন্দ এর আসল নাম ছিল বীরেশ্বর ডাক নাক ছিল বিলে। কোন মুসলমান কি তাঁকে 'স্বামী’ বলে সম্বোধন করেছে? তেমনি রামকৃষ্ণ পরমহংস এর নাম ছিল গদাধর বা গদা ইত্যাদি। মানুষকে তার উৎকৃষ্ট নামে ডাকাই আমাদের রাসূল সঃ এর নির্দেশ।
ফিরে আসি মওলানা সৈয়দ নিসার আলির কথায়।
সৈয়দ নিসার আলি ১৭৮২ খৃষ্টাব্দে ২৪ পরগনা জেলার চাঁদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল মীর হাসান আলি এবং মাতার নাম আবিদা রোকাইয়া খাতুন। মীর নিসার আলি কোরানে হাফেজ ছিলেন।
বাল্যকাল থেকেই নিসার আলির উদ্দেশ্য ছিল ১) মুসলমানদের অধর্মীয় আচরণ থেকে বাঁচান। ২) শাসক ইংরেজদের ইংগিতে পরিচালিত অত্যাচারী শোষক জমিদারদের হাত থেকে শোষিত হিন্দু-মুসলমান প্রজাদের রক্ষা করা এবং ৩) ভারতবর্ষকে ইংরেজ শাসন মুক্ত করা।
মীর নিসার আলি ছিলেন দীর্ঘদেহী, বলিষ্ঠ বীরোচিত দেহ, নির্ভীক, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন, অনলবর্ষী বক্তা। মুষ্টিযুদ্ধ, অসিযুদ্ধ, তীরান্দাজী, প্রভৃতি যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী।
তাঁর গুরু সৈয়দ আহমদ তখন সীমান্তপ্রদেশে লড়াই করছেন। সেইসময় দেশের জন্য মৃত্যু পাগল নওজোয়ানদের একত্রিত করে মীর নিসার আলি অবিভক্ত বাংলায় অত্যাচারী জমিদারের নির্যাতন এবং তাদের সহযোগিতাকারী ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু করলেন । নিসার আলি প্রথমে সশস্ত্র যুদ্ধ এবং রক্তপাত চাননি। কিন্ত জমিদার বাবুরা তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে দেননি।
ইংরেজদের বলে বলীয়ান তারাগুনিয়ার জমিদার রামনারায়ণ, পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায়, নগরপুরের জমিদার গৌরপ্রসাদ চৌধুরী প্রমূখ একজোট হয়ে নিম্নোক্ত আদেশ জারি করলেন—
১) যারা নিসার আলির শিষ্যত্ব করবে, দাড়ি রাখবে গোঁফ ছাঁটবে, তাদের ফি দাড়ির উপর আড়াই টাকা, এবং ফি গোঁফের উপর পাঁচ সিকা খাজনা দিতে হবে।
২) মসজিদ প্রস্তুত করলে প্রত্যেক কাঁচা মসজিদের জন্য পাঁচ’শ টাকা এবং প্রত্যেক পাকা মসজিদের জন্য একসহস্র টাকা জমিদার সরকারে নজর দিতে হবে।
৩) পিতা-পিতামহ বা আত্মীয় স্বজন সন্তানের যে নাম রাখবে, সে নাম পরিবর্তন করে আরবি নাম রাখলে প্রত্যেক নামের জন্য খারিজানা ফি পঞ্চাশ টাকা জমিদার সরকারে জমা দিতে হবে।
৪) গো-হত্যা করলে হত্যাকারীর দক্ষিণহস্ত কেটে ফেলা হবে, যেন সে আর গো-হত্যা করতে না পারে।
৫) যে ব্যক্তি নিসার কে নিজ বাড়ীতে স্থান দিবে তাকে তার ভিটা থেকে উচ্ছেদ করা হবে।
মীর নিসার আলি জমিদারদের এ হেন জঘন্য নির্দেশের জবাব অস্ত্রের ভাষায় দিতে পারতেন, সে প্রস্তুতি তাঁর ছিল। কিন্তু তিনি হঠকারী যুদ্ধের পথে না গিয়ে শুধুমাত্র শান্তি বজায় রাখার জন্য পুঁড়ার জমিদারের কাছে একটা পত্র লিখলেন। মীর নিসার আলির সেই পত্রটির ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম। পত্রটি এখানে হুবহু তুলে ধরা হল।
“বঃ জনাব বাবু কৃষ্ণদেব রায়
জমিদার মহাশয় সমীপে, পুঁড়ার জমিদার বাড়ী।
মহাশয়!
আমি আপনার প্রজা না হইলেও আপনার স্বদেশবাসী। আমি লোকপরম্পরায় জানিতে পারিলাম যে, আপনি আমার উপর অসন্তুষ্ট হইয়াছেন, আমাকে ‘অহাবী’ বলিয়া আপনি মুসলমানদের নিকট হেয় করিবার চেষ্টা করিতেছেন, আপনি কেন এরূপ করিতেছেন তা বুঝিতে পারা মুশকিল। আমি আপনার কোন ক্ষতি করি নাই। যদি কেহ কোন মিথ্যা কথা বলিয়া আপনাকে উত্তেজিত করিয়া থাকে তাহা হইলে আপনার উচিত ছিল, সত্যের সন্ধান করিয়া হুকুম জারি করা। আমি দ্বীন ইসলাম জারি করিতেছি। মুসলমানদিগকে ইসলাম ধর্ম শিক্ষা দিতেছি। ইহাতে আপনার অসন্তোষের কি কারন থাকিতে পারে? যাহার ধর্ম সেই বুঝে। আপনি ইসলামধর্মের উপর হস্তক্ষেপ করিবেন না। অহাবী ধর্ম বলিয়া দুনিয়ায় কোন ধর্মই নাই। আল্লাহর মনোপুত ধর্মই ইসলাম।
ইসলাম শব্দের অর্থ হইতেছে শান্তি। ইসলামি ধরনের নাম রাখা, দাঁড়ি রাখা, গোঁফ ছোট করা, ঈদুল আজহার কোরবানি করা ও আকীকাতে কোরবানি করা মুসলমানদিগের উপর আল্লাহর ও আল্লাহর রাসূলের আদেশ। মসজিদ প্রস্তুত করিয়া আল্লাহর উপাসনা করাও আল্লাহর হুকুম। আপনি ইসলামধর্মের আদেশ বিধিনিষেধের উপর হস্তক্ষেপ করিবেন না। আমি আশা করি আপনি আপনার হুকুম প্রত্যাহার করিবেন।
ফকত হাকির ও নাচিজ
সৈয়দ নিসার আলি (ওরফে তিতুমীর)"
সৈয়দ নিসার আলি তাঁর পত্রটি সাহসী ও নম্র শিষ্য আমিন উল্লা মারফত পুঁড়ার জমিদারবাড়িতে পাঠিয়ে ছিলেন। নিষ্ঠুর জমিদার পত্রটি পড়েই আমিনউল্লাহ কে আটক করে, এবং বাঘ সিংহ মারার মত পিটিয়ে পিটিয়ে তাঁকে হত্যা করে। মীর নিসার আলি এ খবর শুনে অশ্রুসংবরন করতে পারেননি। দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলেছিলেন ‘আমার আজাদী আন্দোলনের প্রথম শহীদ আমিনউল্লাহ।'
কৃষ্ণদেবের জরিমানা আদায় শুরু হল সরফরাজ পুরে ।মীর নিসারের সমর্থকরা বাধা দিলেন। জমিদারের লাঠিয়ালরা মসজিদে এবং গ্রামে পাইকারিহারে আগুন ধরিয়ে দিতে আরম্ভ করলো ।মীর নিসার সাহেব বারাসত কোর্টে নরহত্যা, মসজিদ পোড়ানোর অভিযোগ এনে মামলা করলেন, সে মামলা ডিসমিস হয়ে গেল। তিনি কলিকাতায় আপীল করলেন, সেখানেও সুবিচার পেলেননা।
অবশেষে তিনি তাঁর অনুসারীদের পুঁড়া আক্রমণ করার নির্দেশ দিলেন। নারায়ে তাকবীর আল্লাহ হু আকবার ধ্বনিতে চারদিন মুখরিত করে মর্দে মুমিনরা পুঁড়ার জমিদার বাড়ী আক্রমণ করলো। জমিদারের সেনাবাহিনী, নীলকরদের কর্মচারী, এবং পাদ্রীদের দলবল একজোট হয়ে বিপ্লবীদের প্রতিরোধ করলো কিন্তু বিপ্লবী গোলাম মাসুম এর সেনা পরিচালনার অবাক করা কৌশল দেখে হতভম্ব হয়ে তারা দিক্বিদিকে ছুটে পালাতে লাগলো। গ্রামের সাধারন মানুষ স্বাধীনতা ঘোষণা করলো ।বাংলা-ভারতের ইংরেজ শাসক ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল।
১৮৩১খৃঃ ১৪ নভেম্বর ইংরেজ সেনাপতি ক্যাপ্টেন আলেকজান্ডারের নেতৃত্বে একদল ইংরেজ সেনাবাহিনী মীর নিসার আলির বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করল। গোবরডাঙ্গার কাছে এক ময়দানে নিসার বাহিনীর জওয়ানরা হঠাৎ তাদের আক্রমণ করল। মাত্র দেড়ঘন্টা সময়ের মধ্যে ইংরেজদের সব সৈন্য নিহত হল, সেনাপতি আলেকজান্ডার আহত হয়ে পালিয়ে গেলেন। ১৭ নভেম্বর নদীয়ার ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে আরও একটা ইংরেজ সিপাহী দল মীর নিসারের বাহিনীর কাছে পরাজিত হল।
এই পরাজয়ে কলিকাতার ইংরেজ বড়সাহেবরা বিচলিত হয়ে পড়ল। তারা মীর নিসার বাহিনীকে পরাজিত করার জন্য একজন সুদক্ষ সেনাপতির অধীনে একহাজার সুদক্ষ সুসজ্জিত সৈন্য, একহাজার বন্দুক ও যথেষ্ট গোলা বারুদ সহ কয়েটা উন্নতমানের কামান পাঠাল। গোবরডাঙ্গা ময়দানে মীর নিসার বাহিনী তাদের আক্রমণ করলেন, কিন্তু এবার বন্দুকের কাছে পরাজিত হলেন।
পরাজয়ের পর মীর নিসার আলি হত্যাবশিষ্ট জওয়ানদের নিয়ে পিছু হটে তেঁতুলিয়া গ্রামে এসে জড় হলেন, সেখানেও ইংরেজ সৈন্যরা তাদের পিছু নিল।
খোলা ময়দানে ইংরেজ সৈন্যদের কামান বন্দুকের সামনে দাঁড়ানো সম্ভব নয়, এই ভেবে তিনি গ্রামের চাষীদের সহায়তা নিয়ে বাঁশ দিয়ে এক কেল্লা নির্মাণ করলেন। নির্মিত হল ‘বাঁশের কেল্লা’। এই বাঁশের কেল্লার ভিতর থেকে বিষাক্ত তীর ছুঁড়ে নিসার বাহিনী ইংরেজ সেনাদের প্রতিহত করতে লাগল। বাঁশের কেল্লা থেকে তীর ছুঁড়ে তীরন্দাজ মীর নিসার আলি ও সেনাপতি গোলাম মাসুম ইংরেজ বাহিনীকে স্তব্ধ করে দিলেন। বহু ইংরেজ সৈন্য হতাহত হল।
এবার ইংরেজ বাহিনী বাঁশের কেল্লার দিকে কামানের গোলা ছুঁড়তে লাগল। এইভাবে আড়াই ঘন্টা যুদ্ধ চলার পর, একটা গোলার আঘাতে সৈয়দ নিসার আলি পড়ে গেলেন, তারপরও লাঠিতে ভড়করে তিনি জওয়ানদের উৎসাহ যোগাতে লাগলেন! ওদিকে সেনাপতি গোলাম মাসুম আগুনের মধ্যেই লাফ দিয়ে বেরিয়ে কামান দখল করার জন্য কামানের দিকে ছুটলেন। কিন্তু তার পূর্বেই বিরাট গোলা বিস্ফোরণে কেল্লা ভেঙে পড়লো। অজস্র দেশপ্রেমিক যোদ্ধা শাহাদত বরন করলেন। গোলাম মাসুম বন্দী হলেন।
দেশের স্বাধীনতার জন্য রক্ত ঢেলে শহীদ হলেন মীর নিসার আলি, সেনাপতি গোলাম মাসুমের ফাঁসী হল, যারা বেঁচেছিলেন তাঁদের জাহাজে ভরে দূরে কেন দ্বীপে পাঠিয়ে দেয়া হল, আহতদের হাসপাতালে নেয়ার নাম করে নদীতে ফেলে হত্যা করা হল।
আজ ১৯২ বছর পর এইসব দেশপ্রেমিক শহীদানদের কথা লিখতে গিয়ে মনে পড়ছে আজকের কথা। এই মূহুর্তের কথা। নিজের কাছেই প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে তবে কি এইসব শহীদানের রক্ত কি বৃথা হয়ে গেল! পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায়, ইংরেজ অনুগত রাম রাম রায়,তাদের বরকন্দাজ, পাদ্রীরা সকলেই তো এখনও বহাল তবিয়তে তাদের শোষণ নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে, শুধু ভোল পাল্টেছে মাত্র। এখনও তো দেশপ্রেমিক মীর নিসার আলিকে গুলিতে প্রাণ দিতে হচ্ছে। এখনও গোলাম মাসুম, মিসকিন শাহ দের ফাঁসিতে প্রাণ দিতে হচ্ছে। এখনও দেশে বিচার নেই আইন নেই। এখনওতো দেশের সম্পদ কয়েকটি বাড়ীতে গিয়ে জমা হচ্ছে। এখনওতো দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী জমিদার বাড়ীর স্বার্থে জনসাধারণের উপর গুলি চালায়।
তবেকি নারকেলবেড়িয়া ইতিহাস, মীর নিসার আলির ইতিহাস থেকে কোন শিক্ষাই আমরা নিইনি!
গোলাম মাসুম, মিসকিন শাহ, আমিনউল্লাহ সহ কোটি কোটি শহীদ মুজাহেদিনের রক্তে ঋণ শোধ করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছে। তবে শে শুনি আমরা স্বাধীন জাতি?
লেখক: বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও বহু গ্রন্থের লেখক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন