মিনার রশিদ
বিচারপতিদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থেকে মুক্ত থেকে বিবেকের প্রতি অনুগত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন বিদায়ী প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। বিচারিক কর্মজীবনের শেষ দিন বিদায় অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, বিচার বিভাগ প্রজাতন্ত্রের হৃদপিণ্ড। রাষ্ট্রের বিচার বিভাগের দক্ষতার চেয়ে শ্রেষ্ঠত্বের আর কোনো উপযুক্ত পরীক্ষা নেই। একটি জাতির জনগণ শাসন বিভাগ বা আইন বিভাগের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলতে পারে, কিন্তু বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা হারালে সে জাতিকে খারাপ দিনটির জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
গোধূলি লগ্নে ইনার মুখ থেকে এই কথা শুনে কী প্রতিক্রিয়া দেখাব, মনের মধ্যে যে ভাবনাগুলো আসছে তার মধ্যে সবচেয়ে মোলায়েমটিও আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত হয়ে যেতে পারে! অবশ্য সর্বোচ্চ আদালতের মর্যাদাকে এমন খেলো বানানো হয়েছে যে এখন আর আদালত অবমাননা শব্দটিই আমাদের আইনের বই থেকে আপনা আপনি উঠে গেছে। সিটিং প্রধান বিচারপতিকে বটতলার উকিল সহ আরও অনেক খাপসা খাপসা কথা বলে গালি দেওয়া হয়েছে এবং আক্ষরিক অর্থেই লাথি মেরে দেশ থেকে বের করা হয়েছে। তারপরেও আদালত অবমাননা হয় নাই কিংবা মিথ্যা অভিযোগের জন্যে সেই বিচারপতির কোনও সাজা হয় নাই।
মহামান্য প্রধান বিচারপতির এই সতর্কবাণী শুনে প্রথমেই মনে পড়ে আরেক প্রাক্তন প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানের কথা। তিনি যথার্থই বলে গেছেন, দেশটি পড়ে গেছে বাজিকরদের হাতে! অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, জেল থেকে বের হলে আলোচিত মক্ষ্মীরাণী পাপিয়াও জেনার বিরুদ্ধে ওয়াজ শুরু করবেন, নিজেকে তাবদ দুনিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় বা তৃতীয় সতী নারী হিসাবে দাবি করবেন। কারণ এক গডফাদার দৈনিক ৭০/৮০ রাকাত তাহাজ্জুদ পড়েন বলে তার মুমিন ভাইদের জানিয়েছেন। নিজেদেরকে যারা শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ হিসাবে ঘোষণা করেন এবং দায়িত্বকালীন প্রতিটা মুহূর্তে একটি দলের বিচারিক পাহলোয়ান হিসাবে ভূমিকা রেখেছেন, তারাই আবার বিদায়ের আগে বিচারপতিদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নিয়ে নীতিকথা ছেড়েছেন!
বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় এই বিচারিক পাহলোয়ানদের সকল খবর দেশের চৌহদ্দি পেরিয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে! এই সব বিচারিক পাহলোয়ানগণ উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে বসিয়ে মৃত্যুদণ্ডের মত ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট দিয়েছে। এক কাদের মোল্লাকে কসাই মোল্লা বানিয়ে ফাঁসি দিয়েছে বলে ভিক্টিমের স্বজনরা অভিযোগ করেছে। দেলোয়ার হুসেইন সাঈদীকে দেউল্যা বানিয়ে মেডিকেল কিলিং এর মাধ্যমে শেষ করে দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সাঈদীর পক্ষে সাক্ষী দিতে ইচ্ছুক সুখরঞ্জন বালীকে আদালতের সামনে থেকে অপহরণ করা হয়েছে। স্কাইপি কেলেঙ্কারির মাধ্যমে এরা পুরাপুরি উলঙ্গ হয়ে পড়েছে।
এদেশের প্রধানমন্ত্রী পদটি এখন ব্যান্ডিট কুইনের মত হয়ে পড়েছে। উনি দুজন মানুষকে পদ্মায় চুবানোর খায়েস প্রকাশ করেছেন। তাতেই কথিত স্বাধীন আদালত মালুম করে ফেলেছে, এই দুজনকে (ড.ইউনূস ও বেগম জিয়াকে) কী করতে হবে! এমতাবস্থায় ড.ইউনূসের প্রতি কেমন আচরণ করা হবে সেই আশংকা থেকেই বারাক ওবামা এবং হিলারি ক্লিনটন সহ ১৬০ জন বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিত্ব এগিয়ে এসেছেন! ১০৬জন নোবেল লরিয়েট সহ ১৬০জন বিশ্বখ্যাত মনীষীদের কোন বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতির ঘটনা দ্বিতীয়টি আছে কি না জানা নেই।
এই বিবৃতির ওজন বা গুরুত্ব পরিমাপের শক্তি বর্তমান সরকার এবং তার ল্যাস্পেন্সাররা হারিয়ে ফেলেছে! এই বিবৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ১৭১জন তথাকথিত বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং ৫০জন সম্পাদক যে পাল্টা বিবৃতি দিয়েছেন তা থেকে এদের মগজে কী জিনিস রয়েছে তা সহজেই আন্দাজ করা যায়।
অথচ এদেশে যে কয়টি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নিয়ে গর্ব করা যেত তার মধ্যে উচ্চ আদালত ছিল অন্যতম। সে সময় আওয়ামী ঘরানার মানুষ হিসাবে পরিচিত বিচারপতিগণ যে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন সেটাও আজকের প্রেক্ষাপটে বিস্ময়কর বলে মনে হবে! বিচারপতি শাহাবুদ্দিন (প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট), বিচারপতি হাবিবুর রহমান, বিচারপতি লতিফুর রহমান প্রমুখ আওয়ামী ঘরানার মানুষ হলেও এরা ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয়, কখনই বিবেকের বিরুদ্ধে কাজ করেন নাই। ইনাদের নিরপেক্ষতাকেও শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সঙ্গত কারণেই হজম করতে পারে নাই।
আওয়ামী মানসিকতা কখনোই স্বাধীন বিচার ব্যবস্থাকে সহ্য করতে পারে না! ১৯৭২-১৯৭৫ সালে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার কণ্ঠ চেপে ধরা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের পট পরিবর্তনের পর বিচার ব্যবস্থাকে আবার সঠিক ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান! স্বৈরশাসক হলেও এরশাদ সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন কিংবা সে জায়গায় হাত দিতে সাহস করেন নাই। ১৯৯১ সালে নতুন গণতান্ত্রিক ধারা শুরু হলে স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার পথে নতুন গতিপ্রাপ্ত হয়! ১৯৯৬-২০০১ সালে যেহেতু একটা সুসংহত ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, কাজেই ঐ পিরিয়ডটিতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সুবোধ বালকের মত আচরণ করতে বাধ্য হয়! সেই সময়ে আমাদের উচ্চ আদালতের একটি সাহসী রায়ের কথা এখানে আলোচনা করা যেতে পারে!
রায়টি দেওয়া হয়েছিল ১৯৯৯ সালের ৪ঠা মার্চ। প্রধান বিচারপতি এটিএম আফজালের নেতৃত্বে গঠিত সেই বেঞ্চটিতে বিচারপতি মোস্তফা কামাল, বিচারপতি লতিফুর রহমান, বিচারপতি বিবি রায় চৌধুরী, বিচারপতি এএম মাহমুদুর রহমান। প্রধান বিচারপতি এটিএম আফজলের সভাপতিত্বে সুপ্রিম কোর্টের ৫ জন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত আপিল বিভাগের ফুল বেঞ্চ এক আদেশে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘রংহেডেড’ ঘোষণা করে সাংবিধানিক কার্যক্রম নিয়ে মন্তব্য করতে আরো সতর্ক থাকতে নিদেশ দিয়েছিলেন। অর্থাৎ তখনকার বিচারপতিদের শিরদাঁড়া তখনও এতটুকু মজবুত ছিল যে সিটিং প্রধানমন্ত্রীকে তিরস্কার করতেও কুণ্ঠিত হন নাই!
এর প্রতিশোধ হিসাবেই সম্ভবত: এক এগারো নামক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে প্রথমেই স্বাধীন বিচার বিভাগের মেরুদণ্ডটি ভেঙে দেওয়া হয়। এরপর একে একে নিয়োগ দেওয়া হয় তাফাজ্জল ইসলাম, এবিএম খায়রুল হক, এস কে সিনহা, সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এবং হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর মত বিচারপতিদের। যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমান ভাই তাঁর 'শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের পাটাতন তৈরি করেছেন যেসব বিচারকরা' শীর্ষক কলামে বিচারপতি নামের এই বিচারিক পাহলোয়ানরা কীভাবে বিচারের বাণীকে নিভৃতে কাঁদিয়েছেন তার একটু সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন।
এখানে একটা আইনগত ফাঁক আমরা সকলেই এড়িয়ে গেছি কিন্তু ভয়াবহ পরিণাম সকলেই উপভোগ করছি। ১৯৯৯ সালে তখনকার প্রধানমন্ত্রীকে যে রং- হেডেড আখ্যা দেওয়া হয়েছিল - এর পরেও তিনি ডাক্তারি পরীক্ষা এবং পুনরায় আদালতের রিভিউ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী থাকেন কীভাবে সেই প্রশ্নটি উঠে আসছে!
সর্বোচ্চ সেই আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ করা হয় নাই বা সেই রায়ের বিপরীতে অন্য কোনও রায় দেওয়া হয় নাই। উচিত ছিল ডাক্তারি প্রমাণ উপস্থাপনের মাধ্যমে প্রমাণ করা যে উনি অপ্রকৃতস্থ নন। ফলে সুপ্রিম কোর্টের রায় এবং সংবিধানের এই দুটি ধারা মতে তিনি অবৈধ প্রধানমন্ত্রী। এদেশের যে কোনও নাগরিক বিষয়টি নিয়ে রিট করলে তিনি অবৈধ হিসাবে ঘোষিত হবেন!
তিনি যদি কোন উপযুক্ত আদালত কর্তৃক অপ্রকৃতস্থ বলে ঘোষিত হন তবে সংবিধানের ৬৬ (২) (ক) ধারা অনুসারে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার এবং সংসদ সদস্য থাকবার যোগ্য হবেন না। আবার সংবিধানের ৫৬(৩) ধারা মতে প্রধানমন্ত্রীর জন্যে সংসদ সদস্য হওয়া অত্যাবশ্যক। উচ্চ আদালত কর্তৃক রং-হেডেড বা অপ্রকৃতস্থ ঘোষণার পর তিনি কার্যত সংসদ সদস্য হিসাবে থাকতে পারেন না। আবার সংসদ সদস্য না থাকলে তিনি প্রধান মন্ত্রী হিসাবেও থাকতে পারবেন না!
লেখক: মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, লেখক ও গবেষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন