ডক্টর ফারজানা মাহবুবা
বেষ্ট ফ্রেন্ড/জিগরী দোস্ত বলতে যা বুঝায়, আরমানের আব্বু আর আমার আব্বুর মধ্যে আর আরমানের আম্মু আর আমার আম্মুর মধ্যে সেই রকম কলিজার টুকরার মত বন্ধুত্ব থাকার পরও আরমানের সাথে আমার কোনদিন সামনাসামনি কথা হয়নি। যারা জামাত করেছেন বা করেন তাদের কাছে বিষয়টা অবাক লাগবেনা। কারণ জামাতের সংগঠনের ভিতরে এবং পরিবারগুলোর ভিতরে ছেলেমেয়েদের মেলামেশার ক্ষেত্রে ইসলামের সীমারেখা অত্যন্ত কঠোরভাবে মেনে চলা হয়। কিন্তু আরমানের একটা জোকস আমার এখনো মনে পড়ে। ওর সাথে কখনো কথা হয়নি তাহলে ওর জোকস শুনলাম কীভাবে?
সেবার মিন্টো আঙ্কল পুরো পরিবার নিয়ে এসেছিলেন চট্টগ্রামে সাংগঠনিক সফরে। আব্বু আম্মুও আমাদের সবাইকে নিয়ে গিয়েছিলেন দেখা করতে। ফেরার সময় যখন গাড়ীতে উঠছি, দেখলাম বড়ভাইয়া, সালমান ভাইয়া আর আরমান এই তিনজন গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে রাস্তাতেই বসে যাচ্ছে পারলে!
বড়ভাইয়া গাড়ীতে ফিরে এলে জিজ্ঞেস করলাম, কীরে বড়ভাইয়া, তোরা কী নিয়ে এত হাসছিলি?
বড়ভাইয়া তখনো হাসি চাপতে চাপতে বললো, আরমান একটা কৌতুক বলেছে। সেই কৌতুকে দুই জাপানিজ ভাই আছে। সেই দুই জাপানিজ ভাইয়ের একজনের নাম ‘হাগিতিছিতাকিউনা’ আর আরেকজনের নাম ‘মুতিতিছিপানিবিনা’!
বড়ভাইয়া এত দ্রুত নামগুলো বললো যে প্রথমে বুঝিইনি দুই জাপানিজ নাম শুনেই এত হাসির কী হলো! তারপর ও যখন আবার নামগুলো ভেঙ্গে ভেঙ্গে বললো তখন গাড়ীর ভিতরে আমরা সবাই আরেক দফা হুলুস্থুল হাসি! আমি হাসতে হাসতেই বলেছিলাম ‘আরমান তো ভালই ফাজিল!’
সেই ফাজিল কৌতুক করা ছেলেটা, দু’টো ফুটফুটে সন্তানের বাবা, সেই ছেলেটা আজকে প্রায় ছয় বছর ধরে গুম! ছেলেটাকে আওয়ামী-ভারতীয় এজেন্ট গুমখুন-বাহিনী কোথায় নিয়ে গেল আরমানকে কেউ জানেনা।
কেউ বলে আয়নাঘরে আছে।
কেউ বলে ক্যান্টনমেন্টে আন্ডারগ্রাউন্ড টর্চার ক্যাম্প বানানো হয়েছে আরমানদের মত ‘স্পেশাল’ গুম হওয়া মানুষদের জন্য।
আরমানকে নিয়ে যাওয়ার সময় তার পিছন পিছন গাড়ী পর্যন্ত ছুটে গিয়েছিল আরমানের মেয়েটা। ‘আব্বু তুমি জুতা না পড়ে কোথায় যাচ্ছো? আব্বু তোমার জুতা! আব্বু এই যে তোমার জুতা!’
বাবার জুতা নিয়ে পিছনে পিছনে দৌড়চ্ছিল বাচ্চাটা। ভারতীয় এজেন্ট আওয়ামী সাদা পোশাকধারীদের এতটুকু মায়া দয়া হয়নি বাচ্চাটার জন্য। জুতা পড়ার সময়ও দেয়নি আরমানকে। টেনে তুলে নিয়ে যায় গাড়ীতে।
কোথায় নিয়ে গুম করে রেখেছে ওরা আরমানকে তা কেউ না জানলেও, কেনো নিয়ে গিয়েছে আরমানকে তা সবাই জানে। ব্যারিস্টার আরমান যেভাবে তার প্রফেশনাল স্কীলস আর নেটওয়ার্কিং দিয়ে মিন্টো আঙ্কল’র কেইস দেখাশোনা করছিল, আরমানের অস্তিত্ব বাংলাদেশে ভারতীয় র’ বাহিনী যারা প্রকাশ্যে আওয়ামীলীগকে চালায় আর অপ্রকাশ্যে দেশকে চালায় তাদের জন্য থ্রেট হয়ে উঠেছিল। মিন্টো আঙ্কলকে ফাঁসি দেয়ার আগে তাই ছেলেকেই সরিয়ে ফেলেছিল তারা। মিন্টো আঙ্কল ফাঁসি’র আদেশ শুনে শেষ ইচ্ছা হিসেবে চেয়েছিলেন আরমানকে দেখতে।
আওয়ামী ভারতীয় শক্তি সেই ইচ্ছেকে মিন্টো আঙ্কল ফাঁসি থেকে দেরী করতে চাচ্ছেন এমন ভাববে- এটা চিন্তা করে আঙ্কল আবার নিজেই সেই ইচ্ছে উইথড্র করে নিয়ে বলেন, অন্তত: আমার জানাজাটা যেন আরমান পড়ায়!
উঁহু, সে ইচ্ছাও পূরণ করতে দেয়নি ওরা। মিন্টো আঙ্কলকে খুন করেও তারা আরমানকে ছাড়েনি।
জামাত নেতাদের ফাঁসি যে রাজাকারদের বিচার না, এই বিচারের নামে প্রহসন যে পুরোটাই আওয়ামী-ভারত-লীগের রাজনৈতিক চালবাজি, তা চোখের সামনে ফাঁস হয়ে যাওয়া স্কাইপ স্ক্যাণ্ডাল থেকে শুরু করে পদে পদে হাতে নাতে প্রমাণ পেলেও ইন্ডিয়ার ষড়যন্ত্রে সত্যকে চোখের সামনে দেখেও দেখেনি মানুষ। পুরো দেশ আর দেশের মানুষকে নিয়ে দাবার গুটির মত খেলেছে আওয়ামী লীগ আর সেই আওয়ামী লীগকে লিড দিয়েছে ভারতীয় এজেন্সি র’। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরপরই, বিভিন্ন সূত্রমতে, ডিজিএফআই’র ১৪ তলা বিল্ডিং’র ৫ম তলা পুরোটা নিয়ে নেয় র’। এরপর আস্তে আস্তে গুলশানে বেগম জিয়া’র বাসার পাশে, পাকিস্তান দূতাবাসের পাশে, ক্যান্টনমেন্টে সহ বাংলাদেশে রাজনৈতিকভাবে সেনসিটিভ সবগুলো জায়গায় একে একে গড়ে উঠেছে র’ এর একটার পর একটা অফিস।
যারাই এগুলো নিয়ে কথা বলতে চেষ্টা করেছে তাদেরকে হয় টাকা দিয়ে কিনে নেয়া হয়েছে, নাহলে অন্য কোন উপায়ে ব্ল্যাকমেইল করে চুপ করানো হয়েছে, অথবা এতেও না হলে গুম অথবা খুন করা হয়েছে। এজন্যেই সম্প্রতি নেত্রনিউজের করা ‘আয়নাঘর’ ডকুমেন্টারিতে দেখা যায় মিসটেইকেন আইডেন্টিটি’র স্বীকার সেলিমকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় গাড়ীর ভিতর র’ এর বাংলাদেশী এজেন্টরা তাকে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করেছিল ‘হিন্দি আতা হ্যাঁয়?’
বাংলাদেশের দাসত্ব আর ভারতীয় প্রভুত্ব কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে তা সম্প্রতি এই দালাল সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীয় মোমেন বেফাঁসে বলে ফেলেছে “শেখ হাসিনা সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করার, ভারতবর্ষ সরকারকে আমি সেই সেই অনুরোধ করেছি”!
দালাল আওয়ামী সরকার আর প্রভু ভারত, উভয়ের জন্যেই থ্রেট হয়ে দাঁড়িয়েছিল আরমান। আরমানের অস্তিত্ব আর বাবাকে বাঁচানোর চেষ্টায় বার বার ব্যাহত হচ্ছিল আওয়ামী-ভারতীয় প্ল্যান। তাই আরমানকে গুম করা।
আরমান একলা না। আরো কত আরমান যে খুন হয়েছে, গুম হয়েছে, সে হিসাব কে রাখে! কত মা কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে গিয়েছে, কত মা ভাতের প্লেইট সামনে নিয়ে নলা মুখে দিতে গিয়ে কান্নায় চোখের পানি আর নাকের পানিতে সে নলা ভিজিয়ে ফেলে ভাবে, আহা, সন্তানটা আমার কোথায় আছে! কেমন আছে!
আর আরমানের বাচ্চা’র মত কত বাচ্চা আর্তনাদ করেছে ‘আব্বু তোমার জুতা পড়ে যাও!’
সেই খুনের কথা ভুলে যাচ্ছেন কেনো যে বাবাটাকে খুন করে ফেলার আগে লাস্ট ফোন কলে সন্তান বাবার কান্না শুনে আর্তনাদ করে বলেছিল ‘আব্বু, তুমি কাঁদছ যে?’
৩০ অগাস্ট।
ইন্টারন্যাশনাল ডে অফ ভিক্টিমস অফ ইনফোর্সড ডিসএপিয়ারেন্স।
বাংলাদেশের প্রত্যেকটা গুম হওয়া পরিবারের পক্ষ থেকে আসুন সবাই একবার হলেও ভারতীয় প্রভুত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়াই। আওয়ামী সরকারকে বলি, তাদের প্রভু সরকারকে খুশী করতে যত আরমানকে গুম করে রেখেছে, সব আরমানকে ফিরিয়ে দে।
মুজিবের আমলে সীমাহীন লুটপাট আর দুর্নীতির কারণে ১৯৭৪ সালে দূর্ভিক্ষের সময় কবি রফিক আজাদ যেভাবে লিখেছিলেন ‘ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র চিবিয়ে খাবো’, ঠিক সেভাবে আওয়ামী লুটতরাজ আর সীমাহীন গুমখুনের সময়ে আমাদেরও এখন বলার সময় এসেছে, ‘সব আরমানদের ফিরিয়ে দে হারামজাদা, নইলে প্রত্যেকটা মায়ের চোখের পানি বুলেট হয়ে ফিরবে জানিস’।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন