সৈয়দ আবদাল আহমদ
প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজিব ওয়াজেদ জয়কে প্রাণনাশের কথিত ষড়যন্ত্রের অভিযোগে সম্প্রতি একটি ফরমায়েসি রায় হয়েছে। এই রায়ে দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ও যায়যায়দিন সম্পাদক শফিক রেহমানকে ৭ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। এমন দুজন মানুষ এ ধরনের হীন কাজ করতে পারেন, একথা কি বিশ্বাসযোগ্য? মোটেই না। জীবনের নিরাপত্তাহীনতার কারণে এ দু’জন সম্পাদক বর্তমানে প্রবাসে নির্বাসনে থাকতে বাধ্য হয়েছেন। আমরা জানি, সরকারের রোষানলের শিকার হয়ে দেশের গুণী এই দুই সম্পাদক জেল-জুলাম নির্যাতন ভোগ করেছেন। মাহমুদুর রহমান ৫ বছরের বেশি কারাবন্দি ছিলেন এবং শফিক রেহমান জেল খেটেছেন প্রায় এক বছর।
দেশের স্বার্থের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয়ার কারণেই বর্তমান ফ্যাসিবাদি হাসিনা সরকারের অন্যায় জুলুমের শিকার হয়েছেন তারা। এরমধ্যে সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ওপর জুলুম-নির্যাতনের মাত্রা সীমাহীন।
দেশ ও জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে মাহমুদুর রহমান একজন সংগ্রামী ও প্রতিবাদী মানুষ। ইতোমধ্যে তিনি ঘোষণা করেছেন, অতীতের মতো বর্তমানে দেয়া ফরমায়েসি রায়েও তিনি ভীত নন। কারণ তিনি কোনো অন্যায় করেননি। প্রধানমন্ত্রীর পুত্রকে প্রাণনাশের ষড়যন্ত্রের তার বিরুদ্ধে কথিত অভিযোগকে তিনি একেবারেই মিথ্যা এবং বানোয়াট বলেছেন। কারণ এই মামলাটি যখন করা হয় তখন তিনি গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে বন্দি ছিলেন এবং ২০০৫ সালের পরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যাননি। তাছাড়া ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে এমন অভিযোগ তোলা হলে আদালত অভিযোগটির খতিয়ে দেখে এর কোনো ভিত্তি নেই উল্লেখ করে খারিজ করে দেন। মামলার অভিযোগে দাবি করা হয়, ঢাকার জাসাস অফিসে গিয়ে মাহমুদুর রহমান নাকি হত্যা প্রচেষ্টার ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন। এ প্রসঙ্গে মাহমুদুর রহমানের বক্তব্য হচ্ছে, জাসাস অফিসে যাওয়া তো দূরের কথা সেই অফিসটি কোথায় তাও তিনি জানেন না। মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘এমনকি বিএনপি নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আমি জীবনে মাত্র দু’বার গিয়েছি। একবার আমার দেশ এর অনুষ্ঠানে বিএনপির সাবেক মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে দাওয়াত করতে এবং আরেকবার নীচতলায় একটি বই প্রকাশনা অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে যোগদান করতে গিয়ে। তিনি বলেছেন, ‘ক্ষমতাসীনরা কতটা দেউলিয়া এই মামলাই তার প্রমান। আসলে এরা ভিন্নমতকে দমন করে স্বার্থ হাসিলের জন্যই এমন দমন-পীড়ন ও নির্যাতনের পথ বেছে নিয়েছে।’ মাহমুদুর রহমান দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, “আমার দীর্ঘ পাঁচ বছরের বন্দিজীবন, রিমাণ্ডে নির্যাতন, হত্যার উদ্দেশ্যে আমার ওপর ফ্যাসিবাদী আক্রমন, পরিবারকে হয়রানি এবং সর্বশেষ ফরমায়েসি এই রায় এসব কিছু আমাকে আমার বিশ্বাস ও আদর্শ থেকে এক চুল পরিমানও বিচ্যুত করতে পারেনি এবং কখনো পারবে না। আমার মনোবলেও এতটুকু চিড় ধরেনি। আমি শিখেছি, প্রকৃত মানুষের ধর্মই হচ্ছে জুলুম, অবিচার ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। আমি সত্য ও ন্যায়ের পথে আছি, দেশের স্বার্থের পক্ষে আছি। জুলুমের প্রতিবাদ করেই যাবো।’
মাহমুদুর রহমান ঠিকই বলেছেন। বিদেশে নির্বাসনে থেকেও তিনি তার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রবাসে মিডিয়ার টকশোতে যেমন মতামত তুলে ধরছেন, তেমনি লিখছেনও। নির্বাসনকালেও আমরা দেখেছি ব্রিটেনের প্রখ্যাত একটি প্রকাশনা সংস্থা ক্যামব্রিজ স্কলার পাবলিশার্স থেকে ‘পলিটিক্যাল হিস্ট্রি অব মুসলিম বেঙ্গল’ নামে তার একটি সাড়া জাগানো বই প্রকাশিত হয়েছে। লন্ডন থেকে চালু হওয়া আমার দেশ অনলাইন সম্পাদনা করছেন। নিয়মিত বাংলা ও ইংরেজিতে সম্পাদকীয় লিখে বর্তমান ফ্যাসিবাদী শাসনের মুখোশ উন্মোচন করছেন।
একজন মাহমুদুর রহমানের পরিচিতি
সংবাদপত্র জগতে প্রবেশের আগে মাহমুদুর রহমানের পরিচয় ছিল তিনি বাংলাদেশের একজন অন্যতম অগ্রণী শিল্প উদ্যোক্তা। ১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই তিনি কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৭ সালে মাহমুদুর রহমান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গ্রাজুয়েশন করেন এবং ১৯৮৬ সালে জাপান থেকে সিরামিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে উচ্চতর ডিপ্লোমা ডিগ্রী অর্জন করেন। এরপর ১৯৮৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবসা প্রশাসন থেকে এমবিএ করেন। পেশাগত জীবনে তিনি টিএনসি গ্রুপের পরিচালক ও সিইও ছিলেন। টেক্সটাইল, সিরামিক ও কেমিক্যাল সেক্টরে ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে তার দক্ষতা অপরিসীম। তিনি ১৯৭৭ সালে ব্রিটেনের গ্যাস কোম্পানী বৃটিশ অক্সিজেন কোম্পানী বিওসিতে অপারেশন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পেশা শুরু করেন। এরপর মুন্নু গ্রুপ, ডানকান ব্রাদার্স, বেক্সিমকো গ্রুপ, পদ্মা টেক্সটাইল ইত্যাদি কোম্পানীতে গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেন এবং এসব শিল্প বিকাশে অবদান রাখেন। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশে প্রথম ‘বোন চায়না’ প্ল্যান্ট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সিরামিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে তিনি বিশ্বে টেকনোলজিক্যাল ‘ব্রেক থ্রো’ করেন। মুন্নু সিরামিক, শাইন পুকুর সিরামিক এবং আর্টিসান সিরামিকসহ বিভিন্ন কোম্পানীর সিরামিক সামগ্রী তৈরি এবং তা বিদেশে রফতানির ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন তার অন্যতম কৃতিত্ব। এরপর ২০০১ সালের অক্টোবরে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বিএনপি সরকার গঠন করলে তিনি বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান এবং সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা হিসেবে কৃতিত্বের সাক্ষর রাখেন।
সরকারের দায়িত্ব শেষ হলে তিনি একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন এবং নিজের প্রতিষ্ঠান আর্টিসান সিরামিকস এর ব্যবসা পরিচালনা করেন। ২০০৬ সালের শেষের দিকে সেনা সমর্থিত জরুরী সরকার ক্ষমতায় আসার পর তিনি একজন লেখক-কলামিস্ট হিসেবে আবির্ভূত হন। দৈনিক নয়াদিগন্তে প্রতি সপ্তাহে তার লেখা কলাম বের হতো এবং অল্প সময়ের মধ্যেই জনপ্রিয় কলামিস্ট হিসেবে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় একদল সাংবাদিকের অনুরোধে তিনি দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার দায়িত্ব নেন এবং সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত হন। তিনি বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের আহ্বায়ক হিসেবে পেশাজীবীদের নেতৃত্ব দেন। বর্তমানে তিনি জীবনের নিরাপত্তাহীনতায় তুরস্কের ইস্তাম্বুলে নির্বাসিত জীবন-যাপন করতে বাধ্য হয়েছেন। এই নির্বাসিত সময়েও তিনি মালয়েশিয়ার একটি খ্যাতিমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ইন্ডিয়ান হেজিমনি’ বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেছেন।
আমার দেশ ও মহমুদুর রহমান
দৈনিক আমার দেশ ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয়। এনটিভি গ্রুপের মালিকপক্ষ শুরুতে পত্রিকাটির উদ্যোক্তা ছিলেন। ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় পত্রিকার মালিকরা গ্রেফতার ও কারাবন্দি হন। একই সময় বিএসইসি ভবনে আগুন লাগলে আমার দেশ অফিসও পুড়ে যায়। এ পরিস্থিতিতে পত্রিকাটি চরম আর্থিক সংকটে পড়ে। সাংবাদিক-কর্মচারীদের প্রায় এক বছরের বেতন বকেয়া পড়ে যায়। ব্যাংক ঋণের সুদ বাড়তে থাকে। ঋণ পরিশোধে ব্যাংক চাপ সৃষ্টি করে। মালিকপক্ষ এর কোনো সুরাহা করতে না পেরে আমার দেশ বিক্রী করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পত্রিকার সম্পাদক প্রখ্যাত সাংবাদিক আতাউস সামাদের নেতৃত্বে সাংবাদিকরা এমন চরম কষ্টের মধ্যেও পত্রিকার প্রকাশনা অব্যাহত রাখেন এবং একই সঙ্গে পত্রিকাটি মালিকানা নেয়ার জন্য নতুন উদ্যোক্তা খুঁজতে থাকেন।
মাহমুদুর রহমান সাংবাদিকতা পেশায় নিজেকে জড়িত করবেন, সেটা কখনও ভাবেননি। তিনি তার নিজের প্রতিষ্ঠান ‘আর্টিসান সিরামিক’ নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। এর পাশাপাশি নয়াদগিন্তে লিখতেন। তার লেখার কারণে তখন তিনি সাংবাদিক সমাজে বেশ পরিচিত হয়ে ওঠেন। একদিন কারওয়ান বাজারে দৈনিক আমার দেশ অফিসে তিনি আসেন সম্পাদক আতাউস সামাদকে তার গবেষণা প্রতিষ্ঠানের একটি সেমিনারে দাওয়াত করতে। আমরা আমার দেশের সাংবাদিকরা চিন্তা করলাম পত্রিকার সংকট বিষয় তার সঙ্গে আলোচনা করলে কেমন হয়? সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আতাউস সামাদ ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা তাকে আমার দেশ-এর হাল ধরার জন্য অনুরোধ করি। তিনি আমাদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে বলেন, সংবাদপত্র চালানোর বিষয়ে তার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই এবং তার এত টাকাও নেই। আমরা তাকে স্মরন করিয়ে দেই যে, তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা। একা পত্রিকার ভার নিতে না পারলে কয়েজন বিনিয়োগকারীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি যেনো আমার দেশের মালিকানা গ্রহণ করেন। আমরা সাংবাদিকরাও তাকে সহযোগিতা করবো। একদিন, দু’দিন, তিনদিন বলার পর তিনি পত্রিকাটি নেয়ার ব্যাপারে রাজি হন। এরপর পূর্বের মালিকপক্ষের সঙ্গে সকল আলোচনা চূড়ান্ত করে মালিকানা পরিবর্তনের মাধ্যমে আমার দেশ এর দায়িত্ব নেন মাহমুদুর রহমান ও তার সহযোগী উদ্যোক্তারা। বলা যায় যে, সাংবাদিকরা তাদের প্রয়োজনে তাকে অনুরোধ করে সাংবাদিকতা পেশায় নিয়ে আসেন।
আগেই উল্লেখ করেছি মাহমুদুর রহমান একজন সফল উদ্যোক্তা। বাংলাদেশের এক সাকসেস স্টোরির নাম মাহমুদুর রহমান। তার কর্মজীবনে তিনি যে কাজেই হাত দিয়েছেন সফল হয়েছেন। কর্মজীবনের শেষ সময়ে সাংবাদিকতায় এসে সেখানেও তিনি বাজিমাত করেছেন। তিনি আসায় খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমার দেশ পত্রিকার সমস্যা দূর হয়ে যায়। একটি মৃতপ্রায় সংবাদপত্রের দায়িত্ব নিয়ে পত্রিকাটিকে পাঠকপ্রিয়, আলোচিত এবং ইফেকটিভ সংবাদপত্র হিসেবে দাঁড় করান তিনি। চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার সার্কুলেশন থেকে পত্রিকাটির সার্কুলেশন দু’লাখের বেশি হয়ে যায়।
সাংবাদিক-কর্মচারীদের পূর্বের বকেয়া তিনি যেমন পরিশোধ করে দেন, তেমনি মাসিক বেতন প্রতি মাসের ৭ তারিখের মধ্যে দেয়ার চেষ্টা করেন। আমার দেশে তিনি যোগ দেয়ার দু’বছর পর্যন্ত পত্রিকায় সম্পাদক ছিলেন আতাউস সামাদ। এরপর স্ত্রী ও নিজের অসুস্থতার কারণে আতাউস সামাদ সম্পাদকের পদ ছেড়ে দিলে মাহমুদুর রহমান এ পত্রিকার সম্পাদক হন। তবে তার অনুরোধে উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে সামাদ ভাই পত্রিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। আতাউস সামাদের মৃত্যুর পর পত্রিকার পুরো দায়িত্ব এসে পড়ে মাহমুদুর রহমানের কাঁধে।
আমার দেশ যেভাবে তৈরি করেন মাহমুদুর রহমান
আমার দেশের দায়িত্ব নেয়ার পর সম্পাদক মাহমুদুর রহমান সিদ্ধান্ত নেন যে, এ পত্রিকা হবে দেশ ও জনগনের প্রকৃত মুখপাত্র। জাতীয় স্বার্থের ব্যাপারে এ পত্রিকা কোনো আপোস করবে না। পত্রিকাটি সব সময় কালোকে কালো এবং সাদাকে সাদা বলবে। সাহসের সঙ্গে অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশ করবে। সত্য প্রকাশে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। এই নীতিমালার প্রেক্ষিতে আমার দেশ-এ প্রকাশ হতে থাকে অনিয়ম-দুর্নীতি, লুটপাট, মানবাধিকার লংঘন, ক্ষমতার অপব্যবহার, খুন, গুম, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, সীমান্তে বিএসএফ-এর হত্যাযজ্ঞ, প্রতিবেশী ভারতের আগ্রাসী নীতি, মামলা-হামলা, নির্বাচন জালিয়াতিসহ সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে বস্তুনিষ্ঠ সব রিপোর্ট। একইসঙ্গে প্রতি সপ্তাহে প্রকাশ হতে থাকে মাহমুদুর রহমানের মন্তব্য প্রতিবেদন। ‘বিচারপতির স্কাইপ কেলেংকারি’, ‘চেম্বার জজ মানে সরকার পক্ষের স্টে’, ‘শাহবাগে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি’ ইত্যাদি অসংখ্য সাড়া জাগানো রিপোর্টের কারণে আমার দেশ পত্রিকা যেমন তুমুল জনপ্রিয় পত্রিকা হয়ে ওঠে, তেমনি পত্রিকাটি এবং সম্পাদক সরকারের রোষানলে পড়েন। সরকার ও সরকার দলীয় লোকজন এবং গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র আমার দেশ ও সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। শারীরিক আক্রমনের শিকার হওয়া ছাড়াও সরকারের জেল-জুলুমের শিকার হন মাহমুদুর রহমান। দু দফায় পাঁচ বছরের বেশি তাকে কারাবন্দি রাখা হয়। ৩৮দিন রিমাণ্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। তার বিরুদ্ধে ১৩৪টি মামলা দিয়ে হয়রানী করা হয়। নিজ অফিসে প্রায় তিন মাস অবরুদ্ধ ছিলেন। কারওয়ান বাজার বিএসইসি ভবনে আমার দেশ অফিসে রহস্যজনক আগুন লাগিয়ে পত্রিকা অফিস পুড়িয়ে সব রেকর্ডপত্র ও রেফারেন্স ধ্বংস করে দেয়া হয়। তেজগাঁওয়ে আমার দেশ এর নিজস্ব ছাপাখানা সীল-গালা করে পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়। মাহমুদুর রহমানের মা এবং স্ত্রীর নামেও দেয়া হয় মামলা।
মাহমুদুর রহমানের সাংবাদিকতা
সাংবাদিক হিসেবে অনুসন্ধানী রিপোর্ট পত্রিকায় করানো একজন সম্পাদকের কাজ। মাহমুদুর রহমান সে কাজই করেছেন। বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন এমন বাইরের লোকের সঙ্গে একজন বিচারপতি যোগসাজশ করে রায় লিখছেন, এমন অন্যায় অনৈতিক ঘটনা ফাঁস করে দেয়া কি একজন সম্পাদকের দায়িত্ব নয়? মাহমুদুর রহমান জনস্বার্থে বিচারপতির স্কাইপ কেলেংকারি ফাঁস করে দিয়ে সেই দায়িত্বই পালন করেছেন। নাস্তিক ব্লগাররা ব্লগে নবী করিম (সা.) ও ইসলামের বিরুদ্ধে কটূক্তিপূর্ণ লেখা লিখে যাচ্ছে। ইসলামবিদ্বেষী এই চক্রের জঘন্য তৎপরতা বন্ধ করার জন্য এবং আর কেউ যাতে এমন দুঃসাহস দেখাতে না পারে জনস্বার্থে সেটা প্রকাশ করে দেয়া কি একজন সাংবাদিকের কর্তব্য নয়? মাহমুদুর রহমান পত্রিকা সম্পাদক হিসেবে সে দায়িত্বই পালন করেছেন।
প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় এবং জ্বালানি উপদষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীকে ৫০ লাখ ডলার উৎকোচ দেয়ার একটি অভিযোগ নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশের দায়ে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে এই জেল-জুলুম নেমে এসেছিল। সরকারের জ্বালানি মন্ত্রণালয় পেট্রোবাংলার তদন্ত কার্যক্রমের ভিত্তিতেই রিপোর্টটি ছাপা হয়েছিল। রিপোর্টটি করেছিলেন আমার দেশ এর সিটি এডিটর এম আবদুল্লাহ। গ্রেফতারের পর অবশ্য আরেকটি সত্য রিপোর্টের জন্য মাহমুদুর রহমানকে আদালত অবমাননার মামলায় জড়ানো হয় এবং দণ্ড দেয়া হয়। সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমানের করা ‘চেম্বার জজ মানে সরকার পক্ষের স্টে’ শিরোনামে একটি সত্য রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল আমার দেশ পত্রিকায়। এই রিপোর্টের প্রেক্ষিতে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে আদালত অবমাননার বিস্ময়কর অভূতপূর্ব বিচারে আইনবহির্ভূতভাবে শাস্তি দেয়া হয় মাহমুদুর রহমান ও সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমানকে। আপিলের অভিযোগ থেকেও তারা বঞ্চিত হন। অবিচারের শিকার হয়ে প্রথম দফায় দীর্ঘ সাড়ে ৯ মাস কারাভোগ করেছেন মাহমুদুর রহমান। বিচারের সময় তার সম্পর্কে মহামান্য বিচারপতিদের অকল্পনীয় সব উক্তিও উচ্চারিত হয়েছে। তাকে বলা হয়েছে ‘চান্স এডিটর’। আমার দেশ এর রিপোর্টটি ১০০ ভাগ সত্য প্রমান পেশ করলে এ সম্পর্কে বলা হয়-‘ট্রুথ ইজ নো ডিফেন্স’। মাহমুদুর রহমান তাতে ঘাবড়ে যাননি, মনোবল হারাননি। তিনি তার বিশ্বাসে অটল-অনড় থেকে সততার সঙ্গে সত্য প্রকাশেই ব্রতী হন। আইনজীবীরা তাকে আদালতের কাছে ক্ষমা চাইতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বলেছেন, আমাদের রিপোর্ট সত্য, আমরা ক্ষমা চাইতে পারি না। তার এই সংগ্রাম এখনও চলছে।
সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক তাকে ‘চান্স এডিটর’ মন্তব্য করে আদালতে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন। মাহমুদুর রহমান এর প্রতিবাদ না করে আদালতে তিনি শুধু পনের জন বিশিষ্ট সম্পাদকের একটি তালিকা পেশ করেছিলেন, যারা সম্পাদক হওয়ার আগে সাংবাদিকতা করেননি কিংবা তাদের সাংবাদিকতার পূর্বঅভিজ্ঞতা ছিল না। এর মধ্যে ছিলেন অবজারভার পত্রিকায় প্রখ্যাত সম্পাদক আবদুস সালাম, ইত্তেফাকের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, সংবাদের আহমদুল কবীর। এ তালিকা প্রদান ছাড়াও তিনি নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন যে সাংবাদিকতায় তার অন্তত তিন বছরের অভিজ্ঞতা আছে। তিনি প্রখ্যাত সাংবাদিক আতাউস সামাদের মতো একজন সম্পাদকের সঙ্গে কাজ করেছেন, পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করছেন এবং আমার দেশ-এর বহু বছরের অভিজ্ঞ একদল ভাইব্রেন্ট সংবাদকর্মীর সঙ্গে কাজ করে সাংবাদিকতা রপ্ত করেছেন। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সাংবাদিকতার সব নীতিমালা মেনে বস্তুনিষ্ঠভাবে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করছেন। পত্রিকার কাজে ১৮ ঘণ্টারও বেশি তিনি সময় দিচ্ছেন। সপ্তাহে একদিন মন্তব্য প্রতিবেদন লেখার পাশাপাশি পত্রিকায় কখনও কখনও তিনি একজন রিপোর্টার হয়ে রিপোর্ট করছেন, কখনও বার্তা সম্পাদকের কাজ করছেন। আবার কখনও সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয় লেখার পাশাপাশি সংবাদিকদের প্রতিবেদন, নিবন্ধ দেখে দিয়েছেন। এমনকি মাঝে মাঝে প্রুফ রিডিংয়ের কাজও তিনি করছেন। পত্রিকার মেকআপ-গেটআপও তদারকি করেছেন।
কেন রোষানল, কেন ঈর্ষা
মাহমুদুর রহমান কেন সরকারের রোষানলে। সরকার সমর্থক একশ্রেণীর লোকের কেন তার প্রতি এত ঈর্ষা? এ বিষয়টি তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে তার কর্ম এবং যোগ্যতাই এই ঈর্ষার কারণ। মাহমুদুর রহমান অন্যায়ের কাছে মাথা নত করতে জানেন না। এ জন্যেই সরকারের রোষানলের শিকার তিনি।
আগেই বলেছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের দুর্নীতির অভিযোগের একটি বস্তুনিষ্ঠ খবর দৈনিক আমার দেশ ২০১০ সালে প্রকাশ করেছিল। এরপর থেকেই শুরু হয় নির্যাতন।
শাহবাগ থেকে যখন উচ্চারিত হলো ‘ফাঁসি চাই, জবাই করো’, যখন ঘোষিত হলো আমার দেশ, নয়াদিগন্ত, সংগ্রাম, দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভি বন্ধ করতে হবে, মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করতে হবে, যখন বলা হলো ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে হবে তখনই এর বিরুদ্ধে কলম ধরলেন মাহমুদুর রহমান, সোচ্চার হলো আমার দেশ। কারণ সেটা ছিল নগ্ন ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ড। তাই আমার দেশ যথার্থভাবেই প্রতিবেদন প্রকাশ করল ‘শাহবাগে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি’। সেদিন যথার্থভাবেই অবস্থান নেয় আমার দেশ। শাহবাগীদের ওইসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে যদি আমার দেশ ও মাহমুদুর রহমান সোচ্চার না হতেন, তাহলে শাহবাগিরা ফ্রাংকেনস্টাইনের দানব হয়ে দেশের শান্তি, স্বস্তি, গণতন্ত্র খুবলে খুবলে খেত। এদের অত্যাচারে সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠত।
সেদিন মাহমুদুর রহমান ও আমার দেশ সঠিক সাংবাদিকতাই করেছেন। আমার দেশ শাহবাগিদের গণতন্ত্রবিনাশী এবং ইসলাম বিরোধী ততপরতার বিরুদ্ধে রিপোর্ট করেছে। ফ্যাসিবাদী আচরণের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করেছে। প্রশাসন, আইন-আদালতকে জিম্মি করার বিরুদ্ধে রিপোর্ট করেছে। পারিবারিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করেছে। শাহবাগীদের নেতা ইমরান এইচ সরকারের একেকটি বক্তব্য সেদিন যেন একেকটি অবশ্য পালনীয় নির্দেশ ছিল। এরই সমালোচনা করে রিপোর্ট করেছে আমার দেশ।
জাতীয় স্বার্থ ও মাহমুদুর রহমান
২০০৮ সালের আঁতাতের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ ক্ষমতাসীন হয়। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠনের পর দেশের মানুষের আশা ছিল তারা সঠিক পন্থায় দেশ পরিচালনা করবে। কিন্তু তা না করে শেখ হাসিনার সরকার একের পর এক এমন পদক্ষেপ নেন যা দেশ ও জাতীয় স্বার্থ বিরোধী। সরকারের অপশাসনে গনতন্ত্র ও সুশাসন নির্বাসনে চলে যায়। বিচার ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যায়। নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ভুলুণ্ঠিত হয়। আইসিটি অ্যাক্ট, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ একের পর এক কালো আইন প্রণয়ন করে ভিন্নমতকে দমন করা হয়। দুর্নীতি-লুটপাট, খুন, গুম, মানবাধিকার লংঘন চরম আকারে ধারণ করে। ক্ষমতা কব্জা করে রাখার সকল কৌশল বাস্তবায়ন করে শেখ হাসিনার সরকার। দেশে চলতে থাকে ভয়ংকর অরাজকতা। দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যায়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এতটাই বেড়ে যায় যে, সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস ওঠে।
দমন-পীড়ন, মামলা-হামলা ও গুলি বোমা চালিয়ে নির্বাচন হাইজ্যাক করা হয়। ২০১৪ সালে বিনা ভোটের ভুয়া নির্বাচন হয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশ নেত্রী খালেদা জিয়াকে ফরমায়েসি রায়ে সাজা দিয়ে ২০১৮ সালের নিশিরাতের ভোটের ভুয়া নির্বাচন হয়।
আমার দেশ পত্রিকা প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর। সম্পাদক মাহমুদুর রহমান তার মন্তব্য প্রতিবেদনের মাধ্যমে এর প্রতিবাদ জানান। একইসঙ্গে টেলিভিশন টকশোগুলোতে অংশ নিয়ে এসব অপকর্ম তুলে ধরেন। এক পর্যায়ে তিনি পেশাজীবীদের নিয়ে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম এবং লংমার্চ-মিছিল করেন। আমরা দেখেছি সিলেট অভিমুখে তিনি ভারতের ‘টিপাইমুখ বাঁধে’র প্রতিবাদে লংমার্চ করেন। বাংলাদেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে ভারতকে ট্রানশিপমেন্ট দেয়ার প্রতিবাদে পেশাজীবীদের নিয়ে মিছিল করে গেছেন আখাউড়া তিতাস পাড়ে। তিতাস নদীতে বাঁধ দিয়ে ভারতকে ট্রানশিপমেন্ট সুবিধা দেয়ার জন্য রাস্তা করা হয়। এই রাস্তা বিশিষ্ট নাগরিকদের নিয়ে মাহমুদুর রহমান কেঁটে দেন। ফারাক্কার প্রতিক্রিয়ায় পদ্মা নদীর দূরাবস্থা এবং তিস্তার পানি ন্যায্য হিস্যার দাবিতে তিনি রাজশাহী-যশোরে গণসমাবেশ করেছেন। সীমান্তে ফেলানীসহ অসংখ্য বাংলাদেশিকে ভারতীয় বিএসএফ গুলি করে ও পিটিয়ে হত্যার বিরুদ্ধে তিনি সভা-সমাবেশ করেছেন দেশের বিভিন্ন সীমান্তবর্তী জেলায় গিয়ে। পত্রিকায় লেখালেখির পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বইও তিনি লিখেছেন। এসব বইয়ে যেসব ভবিষ্যদ্বানী তিনি করেছেন আজ তা সত্যে পরিণত হয়েছে। মাহমুদুর রহমান এক ডজনের মতো বই লিখেছেন। সবগুলো বই-ই বেস্ট সেলার। এর মধ্যে রয়েছে ‘জেল থেকে জেলে’, ‘নবরূপে বাকশাল’, ‘গুমরাজ্যে প্রত্যাবর্তন’, কার মান কখন যায়, ‘জয় আসলে ভারতের’, ‘দুর্নীতিমুক্ত দেশ’ এবং সর্বশেষ ‘মুসলিম বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস’ উল্লেখযোগ্য।
ফ্যাসিবাদী আক্রমনের শিকার মাহমুদুর রহমান
‘‘গারদের দরজা খুলে গেল। খর্বাকৃতি একটা অবয়ব আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমি ততক্ষণে উঠে বসেছি। লোকটি দ্রুত পায়ে এসেই আমার শার্টের কলার ধরে হ্যাঁচকা টানে দাঁড় করিয়ে দিল। তাকে চিনে ফেললাম, আমার মামলার আইও। কিছু বুঝে উঠার আগেই অন্য একজন পেছন থেকে দ্রুত আমার চোখ বেঁধে ফেলেছে। বোতাম খুলে শরীর থেকে শার্টটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। ঘটনার আকস্মিকতার ঘোর কেটে মাথা পরিষ্কার কাজ করছে। এরা আততায়ী, আমাকে শেষ করে দিতে এসেছে। একবার ভাবলাম, চিৎকার করি। পরক্ষণেই মনে হলো, বন্দিশালায় আমার সেই চিৎকার এই কাপুরুষদের আনন্দের খোরাকই কেবল জোগাবে।’’
এই বর্ননা মাহমুদুর রহমান নিজেই লিখেছেন তার ‘জেল থেকে জেলে’ নামক বইয়ে। ২০১০ সালের জুলাই মাসে ক্যান্টনমেন্ট থানার ভেতরে তার ওপর হামলা হয়েছিল। থানার গারদে সেদিনের নির্যাতনে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখতে পান থানার ডিউটি অফিসারের মেঝেতে তিনি শুয়ে আছেন, সর্বাঙ্গ ভেজা।
বইটিতে তিনি আরো লিখেন, ‘‘সকাল সাতটা না বাজতেই ক্যান্টনমেন্ট থানার কর্মকর্তা, কনস্টেবল দল বেঁধে গারদে এসে আমাকে সহানুভূতি জানিয়ে গেলেন। রাতের হত্যা প্রচেষ্টার ঘটনা পুরো থানায় জানাজানি হয়ে গেছে। ওদের কাছ থেকে টুকরো টুকরো যে খবর পেলাম সেগুলো জোড়া দিয়ে গতরাতে কী ঘটেছিল সেই চিত্রটিই আমার মতো করে এখানে বিবৃত করছিÑ ‘রাত একটার পর একটি সিভিল গাড়িতে পাঁচজনের একটি দল ক্যান্টনমেন্ট থানায় প্রবেশ করে। তাদের মধ্যে দু’জন পুলিশ কর্মকর্তা ছিল, যার একজনকে আমি চিনতে পেরেছি। অন্য কর্মকর্তার নাম জিজ্ঞাসা করে জবাব পেলাম না। সবাই এড়িয়ে গেল। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, বাকি তিনজনকে থানার কেউ চিনতে পারেনি। কনস্টেবল, কর্মকর্তা এক বাক্যে বললো, ওই তিনজন পুলিশ বাহিনীর কেউ নয়। তাহলে তারা কারা? তারা ছিলেন তিন আততায়ী। দলটি এসেই কর্তব্যরত এএসআই’র কাছ থেকে আমার সেলের চাবি নিয়ে থানার বাতি নিভিয়ে দেয়। সেলে ঢোকার সময় থানার কাউকে কাছে থাকতে দেয়নি। নির্যাতনে আমি অজ্ঞান হয়ে গেলে মৃত ভেবে এরা খানিকটা আতংকিত হয়ে আমাকে থানায় ফেলে রেখে চলে যায়।’’
থানার ভেতরে মাহমুদুর রহমানের ওপর কী ভয়ংকর আক্রমন হয়েছিল এটা তার বিবরণ। ২০১০ সালের জুনে প্রথমবার গ্রেফতার হওয়ার পর ক্যান্টনমেন্ট থানায় তার ওপর এই আক্রমণ হয়েছিল রিমাণ্ডে থাকা অবস্থায়। অবশ্য তার ওপর প্রথম আক্রমণ হয় গ্রেফতার হওয়ার দু’ আড়াই মাস আগে ২০১০ সালের এপ্রিলে। ওই হামলার দিন তিনি কারওয়ান বাজার থেকে অফিস শেষ করে গুলশানের বাসায় যাচ্ছিলেন। তেজগাঁও সাত রাস্তার মোড় পেরিয়ে তার গাড়ি সামান্য উত্তরে একটি পেট্রোল পাম্পের কাছাকাছি যেতেই বোমা ও হাতুড়ি দিয়ে গাড়িতে আক্রমণ হয়। দুর্বৃত্তদের নিক্ষিপ্ত হাতুড়ি পেছনের কাঁচ ভেঙ্গে গাড়ির ভেতরে গিয়ে পড়ে। ভাঙা কাঁচে মাহমুদুর রহমান সামান্য আহত হলেও হাতুড়ির আঘাত থেকে অলৌকিকভাবে রক্ষা পান। তার ওপর তৃতীয় আক্রমণটি হয় লন্ডনে ২০১২ সালে। প্রথম দফায় জেল থেকে মুক্তি লাভের পর তিনি লন্ডনে গেলে আওয়ামীলীগের প্রবাসী সমর্থকরা তাকে আক্রান্ত করে।
চতুর্থ দফায় মাহমুদুর রহমান আক্রমণের শিকার হন ২০১৮ সালের ২২ জুলাই কুষ্টিয়ার আদালত প্রাঙ্গণে। একটি মানহানির মামলায় তিনি সেখানে জামিন নিতে গিয়ে রক্তাক্ত হয়েছিলেন। জামিন লাভের পর তিনি ঢাকার উদ্দেশ্য ফেরার সময় সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ আদালতে তাকে ঘেরাও করে। এ প্রেক্ষিতে তিনি সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এমএম মোর্শেদের শরণাপন্ন হন এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ নিয়ে তার এজলাসে আশ্রয় নেন। সেখানে প্রায় চার ঘন্টা অবরুদ্ধ থাকার পর কোর্ট দারোগা ও ওসি এসে তাকে বের করে এনে একটি প্রাইভেটকারে তোলে দেয়। গাড়িটি কিছুদূর যেতেই আদালত চত্বরেই ছাত্রলীগের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী লাঠি-সোটা, ইট ও পাথর দিয়ে আক্রমণ চালায়। তার মুখ, মাথা, ঘাড় ও চোখের নিচে আঘাত করা হয়। রক্তাক্ত হয় তার সারা শরীর। আঘাতে চোখের নিচে ক্ষতস্থানে চারটি, মাথার পেছনে তিনটি এবং পিঠের ক্ষতস্থানে দুটি সেলাই লাগে। রক্তনালী কেটে যাওয়ায় প্রচুর রক্তপাত হয়। এতে তার শার্ট-প্যান্ট রক্তে ভেসে যায়।
কুষ্টিয়ার আদালতে মাহমুদুর রহমানকে নিরাপত্তা দেয়ার জন্য বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আগেই অনুরোধ করেছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই প্রথম আলোকে জানান, বিএনপি মহাসচিবের অনুরোধের প্রেক্ষিতে তৎক্ষণাৎ তিনি কুষ্টিয়ার এসপি মেহেদি হাসানকে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সেদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশ মানা হয়নি। পুলিশের উপস্থিতিতে প্রকাশ্য দিবালোকে শত শত মানুষের সামনে রক্তাক্ত হলেন আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। আক্রমণকারীরা তার ভাড়া করা মাইক্রোবাসের চাবিও নিয়ে যায়। যশোরে ফেরার জন্য তার জন্য কোনো গাড়ি পাওয়া যায়নি, কুস্টিয়ায় চিকিৎসারও ব্যবস্থা হয়নি। অবশেষে একটি অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করে তিনি ও তার সফরসঙ্গীরা যশোরে আসেন। বিমানবন্দরে যশোরের চিকিৎসকরা তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। বিমানে ঢাকায় আনার পর ইউনাইটেড হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়।
ভয়কে জয়
সততা ও সাহসেরই এক নাম মাহমুদুর রহমান। সুশিক্ষিত এই মানুষটি সত্য প্রকাশে যেমন ভয় পাননা, তেমনি সততায় তিনি অনন্য। এজন্যেই তিনি লিখতে পেরেছিলেন ‘সততায় পারবেন না প্রধানমন্ত্রী’।
কুস্টিয়ার আদালত চত্ত্বরে প্রাণনাশের হুমকীর মুখে, রক্তাক্ত অবস্থায়ও ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরেই তিনি বলেছেন, “এই দেশ ও জাতীয় স্বার্থ, দেশের মানুষ এবং ইসলামের জন্য প্রয়োজনে আমি একাই জীবন দেব”। তার এই সাহসী এবং দৃঢ় মনোবলে এই মুহূর্তে আমার বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার একটি উক্তির কথা মনে পড়ছে। ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, ‘সাহসী তিনিই, যিনি ভয়কে জয় করেন।’ মুহমুদুর রহমানের শরীর থেকে অজস্র রক্ত ঝরেছে। কুষ্টিয়ায় আওয়ামী ছাত্রলীগের আক্রমনে তার রক্ত-মাখা শার্ট আমাদেরকে ঊনষত্ত্বরের আসাদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই রক্ত বৃথা যাবে না। তেমনি ফরমায়েসি রায়েরও একদিন হিসাব দিতে হবে। অন্যায় পরাভূত হবেই। সেদিনই বিজয়ের হাসি হাসবেন আমার দেশ সম্পাদক ড. ইঞ্জিনিয়ার মাহমুদুর রহমান।
সৈয়দ আবদাল আহমদ
নির্বাহী সম্পাদক
দৈনিক আমার দেশ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন