অলিউল্লাহ নোমান
আওয়ামী ট্রাইব্যুনাল (কথিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল) ও ফ্যাসিবাদ অনুগত ইন্ডিয়াপন্থি মিডিয়ার গালে খসে চপেটাঘাত করেছেন সুখরঞ্জন বালী। সাদাসিধে সাধারণ পরিবারের লোক তিনি। কিন্তু অদম্য সাহসী। তাঁর এই অদম্য সাহস বারবার ফ্যাসিবাদ অনুগত ইন্ডিয়াপন্থি মিডিয়া গুলোর মুখোশ খুলে দিচ্ছে। মৃত্যুর মুখোমুখি করেও তাঁকে সত্য বলা থেকে বিরত রাখতে পারেনি ফ্যাসিবাদ।
সুখরঞ্জন বালীর নাম মিডিয়ায় এসেছিল ২০১২ সালের নভেম্বরে। আমার দেশ পত্রিকায় তাঁর একটি ইন্টারভিউ ছাপা হয়েছিল। শিরোনাম ছিল-‘আদালতে সত্য কথা বলতে এসেছি’। কিন্তু তাঁকে আদালতে পৌঁছানোর সুযোগ দেয়নি আওয়ামী ষড়যন্ত্র। এই ইন্টারভিউটি যেদিন ভোরে পত্রিকার পাতায় ছাপা হয়েছিল, সেদিন সকাল ১০টার দিকে তাঁকে অপহরণ করে ফ্যাসিবাদের সহযোগী পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। দিবালোকে হাইকোর্ট মাজার গেইট দিয়ে সামনে অগ্রসর হয়ে ট্রাইব্যুনালের দিকে যাচ্ছিলেন তিনি। একজন আইনজীবীর গাড়িতে করে যাওয়ার তাঁকে নামিয়ে নেয় পোশাকি ও সাদা পোশাকি পুলিশ। সেদিন সকালে সুখরঞ্জন বালীকে অপহরণের উদ্দেশ্যে ট্রাইব্যুনালমুখি প্রতিটি গাড়ি তল্লাশি করছিল পুলিশ। অনেক পত্রিকা ও টেলিভিশনের সাংবাদিকদের সামনেই তাঁকে অপহরণ করা হয়। কিন্তু ফ্যাসিবাদের সহায়ক সাংবাদিকরা বিষয়টি বেমালুম চেপে যায়। বালীকে অপহরণ করা হয়েছে বললে তাদের মনের খায়েশ মিটবে না। তাদের মনের খায়েশ হচ্ছে আল্লামা সাঈদীর ফাঁসি দেখা। তাই বিষয়টি বেমালুম চেপে গিয়ে সরকারি ভাষ্য ফলাও করে প্রচার করেছে তখন।
সুখরঞ্জন বালীকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হবে এটা জানতেন নিজামুল হক নাসিমরা। কারণ, সুখরঞ্জন বালীর বক্তব্য ভিডিও করে ট্রাইব্যুনালে দিয়েছিলেন আল্লামা সাঈদীর আইনজীবীরা। জানিয়েছিলেন সরকার পক্ষের অন্যতম প্রধান সাক্ষী সুখরঞ্জন তাঁর ভাইকে হত্যায় আল্লামা সাঈদীর সম্পৃক্তা নেই বলে ভিডিওতে স্বীকার করেছেন। তিনি আদালতে এসেছেন একই কথা বলতে। তখন নিজামুল হক নাসিমের নেতৃত্বে গঠিত ট্রাইব্যুনাল একটি অজুহাত বের করে। বলা হয়, নতুন সাক্ষী আনতে আগে আবেদন করা হয়নি। নতুন করে সাক্ষী আনতে হলে আগে আবেদন করতে হবে। পরের দিন হাজির করার জন্য আল্লামা সাঈদীর আইনজীবীরা আবেদন করলেন। এতে নিজমুল হক নাসিমরা মনে করেছিলেন সুখরঞ্জন হাজির হয়ে বক্তব্য দিলে তাদের ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে যাবে। তাই সুখরঞ্জন যাতে ট্রাইব্যুনাল পর্যন্ত পৌছাতে না পারেন, সেই ব্যবস্থা করলেন তারা।
সুখরঞ্জন বালীকে অপহরণের পর আল্লামা সাঈদীর আইনজীবীরা বিষয়টি ট্রাইব্যুনালে অবহিত করেছিলেন। ট্রাইব্যুনাল বিষয়টি তদন্ত করে দেখার জন্য প্রসিকিউশন ও পুলিশকে নির্দেশ দেয়। সেদিন দুপুরের পরই তারা ট্রাইব্যুনালকে জানিয়ে দেয় এমন কোন ঘটনা ট্রাইব্যুনালের গেইটে ঘটেনি। সুখরঞ্জন বালীকে অপহরণের পর তাঁকে খোজে বের করতে হাইকোর্ট বিভাগেও একটি রীট আবেদন করা হয়েছিল। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের অনুগত হাইকোর্টও এনিয়ে কোন নির্দেশনা দেওয়া থেকে বিরত থাকে।
সুখরঞ্জন বালী মূলত সরকার পক্ষের সাক্ষীর তালিকায় ছিলেন। পরিকল্পিতভাবে মৃত্যুদণ্ড দিতে বিসাবালী হত্যা মামলায় আল্লামা সাঈদীকে জড়িত করেছিল ট্রাইব্যুনালের কথিত তদন্তকারীরা। বিসাবালীর ভাই সুখরঞ্জন বালীকে প্রধান সাক্ষী বানাতে চেয়েছিল প্রসিকিউশন। কিন্তু মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজি হননি তিনি। বরং উল্টা আদালতে সত্য ঘটনা বলতে চেয়েছিলেন সুখরঞ্জন। তাই আল্লামা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষী দিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসেছিলেন পিরোজপুর থেকে ঢাকায়।
অপহরণের পর সুখরঞ্জন বালীকে সীমান্ত পার করে বিএসএফ-এর হাতে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে তাকে আটক দেখাল বিএসএফ। তখনো বাংলাদেশের মানুষ জানে না সুখরঞ্জন কোথায়। ফ্যাসিবাদ অনুগত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভিন্নমতের মানুষকে ধরে নিয়ে গুম করার পর আর খোঁজ মিলে না। এদিক থেকে সুখরঞ্জন কিছুটা হলেও ভাগ্যবান। তাঁকে ইন্ডিয়ার সীমান্তরক্ষী বিএসএফ অবৈধ অনুপ্রবেশের মামলা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিল। অপহরণের দীর্ঘদিন পর তাঁকে পশ্চিমবঙ্গের দমদম কারাগারে আবিষ্কার করেছিলেন সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান। তাঁর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানা গিয়েছিল সুখরঞ্জন জীবিত এবং কলকাতার দমদম কারাগারে আটক আছেন। এরপর ডেভিড বার্গম্যানের আরেকটি প্রতিবেদনে জানা গিয়েছিল অবৈধ অনুপ্রবেশের মামলায় সাজা শেষ হয়ে যাওয়ার পর, সুখরঞ্জন ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন জানিয়েছেন।
সুখরঞ্জন বালী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সত্য বলতে কথিত ট্রাইব্যুনালে এসে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন। সীমান্তের ওপারে ভারতীয় কারাগারে জেল খেটেছেন। কঠিন পথ অতিক্রম করে দেশে ফিরেছেন কখন সেটা কারো জানা ছিল না। আল্লামা সাঈদীর ইন্তেকালের পর আবার আলোচনায় আসলেন তিনি। সেই কঠিন সত্যটি জনমানুষের সামনে বলতে হাজির হয়েছিলেন আল্লামা সাঈদীর বাড়িতে। সোশ্যাল মিডিয়ার মুখোমুখি দাড়িয়ে সরাসরি লাইভে বলেছেন, তার ভাই বিসাবালী হত্যার সাথে আল্লামা সাঈদী জড়িত নয়। তাঁকে দিয়ে সরকার পক্ষ মিথ্যা সাক্ষী দেওয়াতে চেয়েছিল। কারা কিভাবে তাঁর ভাইকে হত্যা করেছিল সেটাও বলেছেন লাইভে।
বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদ অনুগত ভারতপন্থি মিডিয়া সুখরঞ্জনের উপস্থিতি দেখে মুখ লুকিয়ে নিয়েছেন। যে টেলিভিশন চ্যানেল এবং মিডিয়া গুলো বেহায়া নির্লজ্জের মত আল্লামা সাঈদীর নামের আগে আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত বলে আখ্যায়িত করে তাদের গালে খসে চড় দিয়েছে সুখরঞ্জন। এজন্য তারা সুখরঞ্জনের উপস্থিতি নিয়ে নীরব।
শুধু সুখরঞ্জন নয়, এর আগে আল্লামা সাঈদীর বিরুদ্ধে ভাগীরথী চন্দ্র নামে আরেক ব্যক্তিকের হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছিল। তাঁর ছেলে গণেশ চন্দ্র ছিলেন সরকার পক্ষের সাক্ষীর তালিকায়। সুখরঞ্জন ট্রাইব্যুনালে আসার আগে গণেশ এসেছিলেন ট্রাইব্যুনালে আল্লামা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষী দিতে। সরকার পক্ষের সাক্ষী এসে আসামী পক্ষে প্রকাশ্যে সাক্ষ্য দেওয়ার ঘটনায় ট্রাইব্যুনাল দেখল মুখে চুনকালি মারা হচ্ছে। গণেশের সাক্ষ্য দেওয়ার পর আওয়ামী গণমাধ্যম ও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতাদের দিয়ে গঠিত ট্রাইব্যুনাল কিছুটা চমকে গিয়েছিল। কি হচেছ এসব। ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে যাচ্ছে। তাই সুখরঞ্জনকে আর ট্রাইব্যুনালের সাক্ষীর ডকে দাঁড়ানোর সুযোগ দেওয়া হয়নি।
পরবর্তীতে স্কাইপ স্ক্যাণ্ডাল প্রকাশের পর বিচারের নামে ষড়যন্ত্রের মুখোশ খসে পড়েছিল। আল্লামা সাঈদীর মামলা চলাকালীন রায় লেখা হচ্ছিল বেলজিয়ামে। এটা উঠে এসেছিল ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতা ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান নিজামুল হক নাসিম ও আহমদ জিয়াউদ্দিনের কথোপকথনে।
স্কাইপ স্ক্যাণ্ডাল প্রকাশের পর নিজামুল হক নাসিম ট্রাইব্যুনাল থেকে সরে গেলেও বেলজিয়ামের লেখা রায় সরেনি। আর এই রায়ের আলোকেই আওয়ামী মিডিয়া গুলো আল্লামা সাঈদীর নামের আগে দণ্ডপ্রাপ্ত বলে আখ্যায়িত করেন।
লেখক: যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত সাংবাদিক।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন