মইনুল হক
এরশাদ কে নির্বাচনে নিতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রকাশ্যে নগ্ন ভূমিকা নিয়েছিলো দিল্লী। তৎকালীন দিল্লীর বিদেশ সচিব সু্জাতা সিং জাতীয় পার্টির প্রেসিডেন্ট এরশাদ কে নির্বাচনে অংশ নিতে সরাসরি চাপ প্রয়োগ করেছিলেন যা এরশাদ নিজেই স্বীকার করেছিলেন। আরো আগের কথা বলতে গেলে, এক এগারোর পটভূমি যে দিল্লীর কলকাঠিতেই তৈরী হয়েছিলো সেটা জেল থেকে প্যারোলে ছাড়া পেয়ে শেখ হাসিনার কথাতেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিলো যখন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এক এগারো কে নিজদের আন্দোলনের ফসল হিসেবেই অভিহিত করছিলো শেখ হাসিনা নিজেই।
ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিন এর পুতুল সরকার কিভাবে দিল্লীর পাতানো ছকে সব করছে ভারতে তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হওয়া প্রণব মুখার্জি তাঁর “The Coalition Years 1996-2012” বইয়ে সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। বাংলাদেশে ভারতীয় স্বার্থের প্রধান প্রতিবন্ধক বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি’কে স্থায়ীভাবে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে উৎখাত করার জন্যেই দিল্লী দীর্ঘদিন যাবত বাংলাদেশে তার এজেন্টদের দিয়ে প্রোপাগান্ডা চালিয়ে আসছিলো। প্রথম আলো-ডেইলি স্টার গং ধারাবাহিকভাবে অসত্য ও অতিরঞ্জিত প্রতিবেদন ও সংবাদ ছেপে বাংলাদেশের মানুষকে ভুল বুঝিয়ে বিএনপি, খালেদা জিয়া ও জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে উস্কে দিচ্ছিলো। সয়াবিন তেলের দাম লিটারে এক টাকা বাড়লেই হাওয়া ভবন – তারেক রহমান সিন্ডিকেটের কল্পিত বয়ান তৈরী করে মাঠে ছেড়ে দিতো। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর বিরাট একটি অথর্ব অংশ না বুঝেই ওই সব প্রোপাগান্ডা গলধ:করণ করতো। ৫৫ টাকা থেকে ৫৬ টাকা সোয়াবিন তেলের লিটার হলেই রাজনীতি অতিসচেতন সেই লোকগুলো ফুঁসে উঠতো। ধূর্ত হাসিনাও জানতো কিভাবে সেই পাবলিক সেন্টিমেন্ট কে কাজে লাগিয়ে ফায়দা হাসিল করা যায়। “দশ টাকা কেজি চাল খাবো, নৌকা মার্কায় ভোট দেবো” – হাসিনার সেই শ্লোগান আবাল বাঙালী তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে গলধ:করণ করছে।
আমি প্রশ্ন করতে চাই, ওহে আবালের দল কখনো কি হাসিনার আমলে দশ টাকা কেজি চাল খেয়েছো? সত্তর থেকে আশি টাকায় চাল খেলেও এখন কিন্তু মার্কেটে কোন সিন্ডিকেটের নাম শুনবেন না। ১৬০ থেকে ২০০ টাকা লিটার সয়াবিন তেলের দাম হয় – প্রতিবাদী করার মতো আওয়াজ তোলারও ক্ষমতা নেই এখন! অদ্ভুত আপনাদের বিবেক ও সচেতনতা!
মূল আলোচনায় ফিরে আসছি, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের পাতানো নির্বাচনে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এসেই দিল্লীর প্রভুর ছক অনুযায়ী এগুতে থাকে। বিডিআর এর উপর প্রতিশোধ নেয় দিল্লী। বেগম জিয়ার শাসনামলে বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত উত্তেজনায় বিডিআর জোয়ানদের সাহসী ভূমিকায় বিএসএফ নাস্তানাবুদ হয়। এমনকি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী সাধারণ গ্রামবাসী বিএসএফ এর আগ্রাসনের দাঁত ভাঙ্গা জবাব দেয়। বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী বিএসএফ জোয়ানদেরকে খতম করে তাদের লাশ পুড়িয়ে গ্রামবাসী গাছের ডালে ঝুলিয়ে রেখেছিলো। ভারত সেই অপমান জনক পরাজয় ভুলতে পারেনি। তাই ২০০৯ সালে দিল্লীর পাপেট হাসিনা ক্ষমতায় আসার কয়েক মাসের মাথায়ই বিডিআর বিদ্রোহের নামে বিডিআর এর সিনিয়র অফিসারদেরকে হত্যা করা হয়। হাসিনা ও সেই সময়ের সেনাপ্রধান মঈনুদ্দিন আহমেদ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে তখন।
পরবর্তী টার্গেট হিসেবে প্রশাসনের সকল স্তরে ভারতে আজ্ঞাবহদের পদায়ন শুরু হয়। সচিবালয় ও পুলিশ বাহিনীতে অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকে হিন্দু জনগোষ্ঠীর লোকদের নিয়োগ এবং পদায়ন। শেখ হাসিনাও ঐ জনগোষ্ঠীর লোকদেরকে নিজের ভোট ব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করে আসছে দীর্ঘদিন ধরেই এবং তাদেরকেই নিজের অবৈধ ক্ষমতার পাহারাদার হিসেবে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে। আপনাদের যদি এই বাস্তবতা বুঝতে অসুবিধা হয় তাহলে সচিবালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে আনুপাতিক হারের কতগুণ বেশি হিন্দু জনগোষ্ঠীর লোক আছে তা নিজ দায়িত্বে খবর নিয়ে দেখবেন। থানাগুলো তে বেশির ভাগ ওসিই হলো হিন্দু। পত্রিকা পড়বেন আর খেয়াল রাখবেন কোনো থানা সংশ্লিষ্ট খবরে সেই থানার ওসি’র নাম কি।
ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা অফিস করে এনএসআই ও ডিজিএফআই এর সদর দপ্তরে! একটা দেশের জাতীয় নিরাপত্তা কতোটা কুক্ষিগত হলে আরেকটি দেশ সেই অবস্থা তৈরী করে নিতে পারে একবার চিন্তা করে দেখুন। সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফ বাংলাদেশীদেরকে পাখির মতো গুলি করে মারলে সেটার পক্ষে সাফাই গায় বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী! পররাষ্ট্র মন্ত্রী প্রকাশ্য সভায় বলে, সে ভারতে গিয়ে ভারত কে বলে এসেছে শেখ হাসিনার সরকার কে যাতে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখে! এ কোন দেশে বাস করছেন আপনারা একবার চিন্তা করে দেখেছেন?
২০২৩ সালের শেষের দিকে প্রথাগত ভাবে বাংলাদেশে আরেকটি জাতীয় নির্বাচনের সময় সমাগত। ২০০৮ এ ভারতে পৃষ্ঠপোষকতায় ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিনদের পরিচালিত নাটকের ফলশ্রুতিতে ক্ষমতায় আসে শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালে আসে বিনা ভোটে এবং ২০১৮ সালে নিশি ভোটে।
এবার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সোচ্চার হয়েছে বাংলাদেশে সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যে, তার চাইছে বাংলাদেশের মানুষ যাতে মুক্তপরিবেশে ভয় ভীতি মুক্ত থেকে ভোটের মাধ্যমে তাদের পরবর্তী সরকারকে নির্বাচন করতে পারে। ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট হাসিনার সমস্যাটি সেখানেই। তিনি জানেন একটি ফ্রি ও ফেয়ার ইলেকশন হলে ২০-২৫ টির বেশি আসন পাবেন না। এই সুদীর্ঘ ১৫ বছরের দুঃশাসনে যে লুটপাট, খুন, গুম করেছেন সেগুলোর জন্যে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। তাইতো নিজেই স্বীকার করেছেন দল ক্ষমতায় না থাকলে কারো পিঠের চামড়া থাকবে না। জনবিচ্ছিন্ন ফ্যাসিস্টরা শুধু জনগণ নয় এমনকি নিজের ছায়াকেও ভয় পায়।
এমনি অবস্থায় কয়েকদিন আগে দিল্লীর আশীর্বাদ প্রাপ্তির আশায় হাসিনা তার চার সদস্যের প্রতিনিধি দল ভারতে পাঠিয়েছিলো। দিল্লী ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান জেনে প্রকাশ্যে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পক্ষে দাঁড়াতে পারছে না। ইসলামী জঙ্গিবাদের ভূয়া ধোঁয়া তুলে দিল্লী এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশে তার প্রভাব কে জায়েজ করার চেষ্টা করেছে। সমস্ত সুবিধা হাতিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশের লেন্দুপ দর্জি খ্যাত শেখ হাসিনার সরকারের কাছে থেকে। শেখ হাসিনা নিজেই বলেছেন, ভারত কে যা দিয়েছি, ভারত তা সারা জীবন মনে রাখবে।
আজকে যখন আকার ইঙ্গিতে ভারত বাংলাদেশে সামরিক অভিযানের ভয় দেখাচ্ছে তখন কোনো দেশপ্রেমিক নাগরিকের চুপ করে বসে থাকার সুযোগ নেই। ভারত কে বাংলাদেশের মানুষ স্মরণ করিয়ে দিতে চায় – ভারত রাশিয়ার চেয়ে শক্তিশালী কোনো দেশ নয় এবং বাংলাদেশও জনশক্তি ও সামরিক সক্ষমতায় ইউক্রেনের চেয়ে দুর্বল নয়।
আজকে আগস্ট ১২, ২০২৩ সালে মানবজমিন অনলাইন সংবাদ প্রকাশ করেছে “শুক্রবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি বলেছেন, তৃতীয় পক্ষ- সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ বিষয়ক জল্পনায় যেতে চাই না। অবশ্যই এসব জল্পনা। ওই ব্রিফিংয়ে দ্য হিন্দুর সাংবাদিক কল্লোল ভট্টাচার্য তাকে প্রশ্ন করেন, শুক্রবার ঢাকায় বিএনপির বিশাল র্যালি হয়েছে। আগামী নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর বিপুল চাপ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমি বলতে চাই, এই চাপ এবং আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে এই সংঘাতময় রাজনীতির ফলে তৃতীয় পক্ষ হস্তক্ষেপ করতে পারে। এর মধ্যে আছে সেনাবাহিনীও। একটি সংবাদপত্রে কয়েক দিন ধরে এ বিষয়ে কলাম প্রকাশিত হয়েছে। তাই আমি জানতে চাই, বাংলাদেশের ইতিহাসের এই সংকটময় মুহূর্তে ভারত আসলে কি ভাবছে? এ প্রশ্নের জবাবে অরিন্দম বাগচি বলেন, মনে হয় গত সপ্তাহেই অথবা তার আগের সপ্তাহেও এ বিষয়ে কথা বলেছি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পটপরিবর্তন নিয়ে আসলেই আমার বিশেষ কোনো মন্তব্য নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে সংবিধানে একটি অবস্থান আছে। এ নিয়ে আমরা আসলে কোনো মন্তব্য করব না। এ বিষয়টিতে সুনির্দিষ্টভাবে বলার মতো কিছু নেই আমার কাছে। তৃতীয় পক্ষ, সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের জল্পনায়ও আমি যেতে চাই না। অবশ্যই এসব জল্পনা। আমরা আশা করব নির্বাচন হবে শিডিউল অনুযায়ী, শান্তিপূর্ণ”।
প্রিয় পাঠক, আপনি যদি কূটনৈতিক ভাষার প্রতি খেয়াল করেন তাহলে সহজেই বুঝতে পারবেন ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের মুখপত্র “দ্য হিন্দু”র সাংবাদিককে দিয়ে প্রকারান্তরে প্রশ্নটি উত্থাপন করানো হয়েছে যাতে ভারতীয় সেনা হস্তক্ষেপের বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসা যায়। আর ভারতীয় রাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি বলছেন, “সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের জল্পনায়ও আমি যেতে চাই না” – মানে হলো প্রচ্ছন্ন ভয় দেখানো। কাকে ভয় দেখাতে চাচ্ছে ভারত? দ্য হিন্দুর সাংবাদিক কল্লোল ভট্টাচার্য কিন্তু টার্গেট অডিয়েন্সকে পরিষ্কার ভাবেই বলে দিয়েছেন, “ শুক্রবার ঢাকায় বিএনপির বিশাল র্যালি হয়েছে। আগামী নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর বিপুল চাপ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে”।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশে দিল্লীর তল্পিবাহকেরা কিন্তু টু শব্দটিও করবে না। সুস্পষ্ট বিদেশী সামরিক হস্তক্ষেপের বিষয়েও তারা কোনো কথাই বলবে না। কারণ তারা দেশটিকে দিল্লীর করদ রাজ্য হিসেবেই রেখে দিতে চায়।
আমরাও সুস্পষ্ট ভাবে দিল্লী ও তার দোসরদের কে বলে দিতে চাই – নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে যে জাতি স্বাধীন হয়েছে প্রয়োজনে নয় বছর কেন, অন্তত যুদ্ধের জন্যেও আমরা প্রস্তুত আছি। আমার দেশের মাটির এক ইঞ্চি মাটির সার্বভৌমত্বের ব্যাপারেও আমরা আপোষ করবো না।
দিল্লীর পাপেট হাসিনাকেও দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়ে দিতে চায়, লেন্দুপ দর্জির ভূমিকা থেকে ফিরে আসুন। বাংলাদেশের মানুষ ক্ষমাপরায়ণ নিজের কৃতকর্ম স্বীকার করে ক্ষমা চাইলে বাংলাদেশের মানুষ বিবেচনার করতেও পারে, কিন্তু দিল্লীর বাহিনীকে বাংলাদেশে ডেকে আনলে পরিণতি হবে ভয়াবহ ও অকল্পনীয়।
ডেট্রয়েট, মিশিগান
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন