অলিউল্লাহ নোমান
শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের পাটাতন গড়ে দিয়েছিলেন সুপ্রিমকোর্টের বিচারকরা। ফ্যাসিবাদের পাটাতন গড়ে দেওয়ার দায়িত্ব যারা নিয়েছিলেন তাদের একজন হলেন এম এ মতিন (দু:খিত তাঁর নামের আগে 'বিচারপতি' শব্দটি ব্যবহার করে এই শব্দের অবমাননা করা থেকে বিরত থাকলাম)। গত ৩ দিন আগে একটি ওয়েবিনারে তাঁর বক্তব্য দেখে কিছুটা বিস্মিত হয়েছি। তিনি অনেক নীতিবাক্য উচ্চারণ করেছেন। ‘তাঁর মুখে এই নীতিবাক্য মানায় না’ শিরোনামে আমার ফেইসবুক প্রোফাইলে তাৎক্ষণিক কিছু তথ্য উপস্থাপন করেছিলাম। এর আগেও একটি পত্রিকায় ইন্টারভিউ দিয়ে এম এ মতিন এরকম কিছু নীতিবাক্য উচ্চারণ করেছিলেন। সেদিনও তাঁকে অতীত স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য আমার দেশ-এ একটি উপ-সম্পাদকীয় লিখেছিলাম। এম এ মতিন সাহেবের মুখ থেকে যতবার এরকম নীতিবাক্য উদগীরণ হবে, আমি ততবার তাঁকে বিষয় গুলো স্মরণ করিয়ে দেব।
ফ্যাসিবাদের পাটাতন গড়ে দেওয়ার দায়িত্ব যারা নিয়েছিলেন তাদের একজন হলেন এম এ মতিন
মতিন সাহেবের বিবরণীতে যাওয়ার আগে ফ্যাসিবাদের পাটাতন গড়তে ২০০৯ সালের জানুয়ারী থেকে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের নাম গুলো এখানে লিখে রাখতে চাই। ২০০৯ সালে প্রধান বিচারপতি ছিল তাফাজ্জাল ইসলাম। তিনি ১৯৯১ সালে বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ে হাইকোর্ট বিভাগে নিয়োগ পাওয়া বিচারক ছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরপরই তাঁকে প্রধান বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ দেন। অবসরে যাওয়ার আগে সংবিধানের ৫ম সংশোধনীকে মুছে ফেলার চুড়ান্ত দায়িত্বটি তিনি পালন করে, সকলেরই তা স্মরণে থাকার কথা। ২০০৫ সালে চার দলীয় জোট সরকার ক্ষমায় থাকাকালীন পুরান ঢাকার একটি সিনেমা হলের মালিকানার মামলাকে কেন্দ্র করে খায়রুল হক ৫ম সংশোধনী বাতিল করে রায় দিয়েছিলেন। সেদিন সরকার তাৎক্ষনিক প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করে রায়টির কার্যকারিতা স্থগিতাদেশ নিয়েছিল। তবে আপিল শুনানী করা সম্ভব হয়নি। কেন সম্ভব হয়নি এটা নিয়ে বিস্তারিত আরেকদিন লেখা যাবে।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরপরই আপিলটি শুনানী করার উদ্যোগ নেন। তাফাজ্জাল ইসলাম শেখ হাসিনার ফরমায়েশ অনুযায়ী ৫ম সংশোধনীকে সংবিধান থেকে সরিয়ে দেওয়ার চুড়ান্ত দায়িত্বটি পালন করেন তখন। সংবিধান থেকে আল্লাহ’র উপর আস্থা ও বিশ্বাসের বিধান বাতিলসহ খায়রুল হকের রায়কে অনুমোদন করা হয়েছিল তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বে। তাঁর সাথে ৫ম সংশোধনীর আপিল শুনানীতে ফজলুল করিম, এম এ মতিন ছিলেন আপিল আদালতে বিচারকের আসনে। এম এ মতিনকেও বিশ্বস্ত হিসাবে আপিল বিভাগে নেওয়া হয় শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর। এ তো গেল ৫ম সংশোধনী মানে সংবিধান থেকে আল্লাহ’র উপর আস্থা ও বিশ্বাস বাতিল করার ঘটনা।
৫ সংশোধনী বাতিল চুড়ান্ত করার দুইদিন পরই তাফাজ্জাল ইসলাম অবসরে চলে যান। প্রধান বিচারপতি হন ফজলুল করিম। তিনি তখন দায়িত্ব নেন শেখ হাসিনার মানবতা বিরোধী অপরাধ গুলোকে জায়েজ করার। যেমন, বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের আটক করে গুম, ক্রসফায়ারের নামে টার্গেট কিলিং, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের ঘটনাকে সুপ্রিমকোর্ট থেকে সমর্থন জানানো। শেখ হাসিনার এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগ থেকে ভিকটিমের পক্ষে আদেশ দেওয়া হলেও আপিল বিভাগ শেখ হাসিনাকে সমর্থন জানিয়ে সে গুলো স্থগিত করে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করে তখন।
ফজলুল করিমের পর প্রধান বিচারপতি হিসাবে দায়িত্ব দেওয়া হয় চিহ্নিত আওয়ামী লীগার খায়রুল হককে। দুইজনকে সুপারসিড করে তাঁকে প্রধান বিচারপতি বানানো হয়। খায়রুল হক প্রধান বিচারপতির আসনে বসে প্রথম যে কাজটি করেছেন সেটা হল বেগম খালেদা জিয়াকে তাঁর ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া।
খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন ২০১০ সালের অক্টোবরের ১ তারিখে। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বেগম খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে বের করার আদেশ অনুমোদন করেন কোন রকমের শুনানীর সুযোগ না দিয়ে। হাইকোর্ট বিভাগে একটি ফরমায়েশি রায়ে বেগম খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল। সে রায়ের বিরুদ্ধে বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে আপিল করা হয়। খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি হয়ে তড়িঘড়ি করে আপিলটি শুনানীর তালিকায় নিয়ে আসেন। শুনানীর দিনে দৃশ্য কেউ না দেখে থাকলে বুঝবেন না কি আগ্রাসী মনোভাব ছিল সেদিন। খায়রুল হকের সাথে ছিলেন মোজাম্মেল হোসেন এবং এস কে সিনহা। বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক উল হক দাড়িয়ে বলেছিলেন শুনানী শুরুর আগে ব্যারিস্টার মওদুদ সাহেব একটি আবেদন পেশ করবেন। আবেদনটি আগে শুনানী করা হউক। ব্যারিস্টার মওদুদ সাহেব আবেদন পেশ করার জন্য দাঁড়ালেন। শেখ হাসিনার অনুগত তিন পাণ্ডব (খায়রুল, মোজাম্মেল, সিনহা) মওদুদ আহমদের আবেদন পেশ করার সুযোগ দিতে নারাজ। ব্যারিস্টার রফিক উল হক দাড়িয়ে নিবেদন করছিলেন আগে দেখেন তিনি কি পেশ করেন। তারপরই আমরা শুনানী করব। কিন্তু খায়রুল হক, মোজাম্মেল হোসেন ও এস কে সিনহা রফিক উল হককে তাগিদ দেন শুনানী শুরু করতে। এনিয়ে আধা ঘন্টার মত চাপাচাপি চলতে থাকে। সিনহা বাবু সেদিন ছিলেন খুবই উত্তেজিত অবস্থায়। কোনভাবেই মওদুদ আহমদের আবেদন উত্থাপনের সুযোগ দিতে নারাজ তারা। মওদুদ আহমদের আবেদনটি ছিল বেগম খালেদা জিয়া এই তিন বিচারপতির প্রতি অনাস্থা জানিয়েছেন। ন্যায় বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করে অনাস্থা জানানোর আবেদনটি উত্থাপনের সুযোগ দেওয়া হয়নি। এই আবেদন উত্থাপন নিয়ে চাপাচাপির এক পর্যায়ে হঠাৎ করেই খায়রুল হক বললেন, আমরা এখন রায় দিব। বেগম খালেদা জিয়ার বাড়ি বাতিল করে হাইকোর্ট বিভাগের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল আর শুনানীর সুযোগ দেওয়া হয়নি। শুনানী ছাড়াই রায় দিয়ে দিলেন। লিভ টু আপিল খারিজ।
বছর খানেক পরই খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি পদ থেকে অবসরে যাবে। অবসরে যাওয়ার আগে নিজে উদ্যোগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলটি শুনানীর জন্য তালিকাভুক্ত করেন। অবসরে যাওয়ার দুইদিন আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে রায় দিয়ে যান। তাঁর সাথে সায় দিয়েছিলেন তখন মোজাম্মেল হোসেন, সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ও সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। খায়রুল হকের পর ধারাবাহিকভাবে তারা ৩ জনই প্রধান বিচারপতি হয়ে অবসরে গেছেন।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট হচ্ছে ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে মানুষ যেন নিজের মত করে ভোট দেওয়ার সুযোগ পায়। সেটা কেড়ে নিয়েছিলেন খায়রুল হক, মোজাম্মেল হোসেন, সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ও সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। বাকী যে ৩ জন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার পক্ষে রায় দিয়েছিলেন তাদের কারো ভাগ্যে প্রধান বিচারপতি পদটি জুটেনি। প্রধান বিচারপতি পদ থেকে সিনহাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়ার পর মোস্ট সিনিয়র হিসাবে আবদুল ওয়াহাব মিয়া ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেছেন কিছুদিন। কিন্তু প্রধান বিচারপতি নিয়োগের সময় তাঁকে সুপারসিড করে সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে বেছে নেন শেখ হাসিনা।
এখানে আরেকটি বিষয় বলে রাখা দরকার। পছন্দের ব্যক্তিদের দিয়ে ফ্যাসিবাদের পাটাতন গড়তে সহযোগিতার জন্য ক্ষমতা গ্রহণের পরই আপিল বিভাগে বিচারকের সংখ্যা ৭জন থেকে ১১ জনে উন্নীত করা হয়েছিল। কারণ, মানবতা বিরোধী কর্মকাণ্ডের বৈধতার জন্য শেখ হাসিনার প্রয়োজন ছিল অনুগত বিচার ব্যবস্থা। চার দলীয় জোট সরকারের সময় আপিল বিভাগে বিচারকের সংখ্যা প্রথমে ছিল ৫ জন। চার দলীয় জোট সরকার আপিল বিভাগে দুটি বেঞ্চ গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিল। তখন আপিল বিভাগে বিচারকের সংখ্যা ৫ থেকে ৭ জনের উন্নীত করা হয়েছিল। শেখ হাসিনা সরকার গঠনের পরপরই এটাকে ১১ জনে উন্নীত করা হয়। কারণ, শেখ হাসিনার অনুগত ব্যক্তিদের হাইকোর্ট বিভাগ থেকে আপিল বিভাগে নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন মনে করেন। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তখন আপিল বিভাগে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ছিল। এরমধ্যে ৫ম সংশোধনী বাতিল করে হাইকোর্ট বিভাগে খায়রুল হকের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে দায়ের করা আপিল, শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার অভিযোগে দায়ের করা মামলার আপিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বৈধ এবং গণতন্ত্রের জন্য অলঙ্কার হিসাবে উল্লেখ করে হাইকোর্ট বিভাগের ৩ সিনিয়র বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত বৃহত্তর বেঞ্চের দেওয়ার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুলোতে শেখ হাসিনার ইচ্ছা অনুযায়ী রায় নেওয়ার নিমিত্তে আপিল বিভাগে বিচারকের সংখ্যা বাড়াতে অনুগত ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হয় তখন। তখনই খায়রুল হক, মোজাম্মেল হোসেন, সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ও এম এ মতিনদের মত ব্যক্তিদের দলবদ্ধভাবে আপিল বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হয়। ফ্যাসিবাদের পাটাতন গড়া হয়ে গেলে আপিল বিভাগে বিচারকের সংখ্যা আবার ৭ জনে নামিয়ে আনা হয়েছে।
বিচারকের আসনে বসে যারা ফ্যাসিবাদের পাটাতন গড়তে শেখ হাসিনাকে সহযোগিতা করেছেন তাদেরকে চিনে রাখার জন্য বারবার এই নাম গুলো বলা প্রয়োজন মনে করি। বিচারকের আসনকে অপব্যবহার করে কিভাবে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করা হয়, সেটার বাস্তব উদাহরণ হচ্ছে আজকের বাংলাদেশ।
এই কাসুন্দি টানলাম ফ্যাসিবাদের পাটাতন গড়ার পেছনের কারিগরদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য। পরবর্তীতে গত ১৫ বছরে বর্তমান হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগে সাবেক ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের গুণ্ডা দিয়ে চুড়ান্ত করা হয়েছে। অনুগত বিচার বিভাগ গড়তে চিহ্নিত সন্ত্রাসী, খুনের মামলার চার্জশিটভুক্ত প্রধান আসামীকেও বিচারক হিসাবে নিয়োগ দিয়েছেন শেখ হাসিনা।
এবার আসা যাক এম এ মতিনের প্রসঙ্গে। কিভাবে ফ্যাসিবাদের পাটাতন আপিল বিভাগ গড়ে দিয়েছিল তাঁর একটি বাস্তব উদাহরণ হচ্ছে আমার দেশ। এই মতিন সাহেব তখন আপিল বিভাগের বিচারকের আসনে ছিলেন।
আমার দেশ ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। শেখ হাসিনা সুপ্রিমকোর্টকে কিভাবে কব্জায় নিয়েছেন সেটা নিয়ে অনুসন্ধান করেছিল আমার দেশ। অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল-‘চেম্বার মানেই সরকার পক্ষে স্টে’। এই প্রতিবেদন প্রকাশের দেড় মাস পর আদালত অবমাননার অভিযোগে রুল জারি করে তৎকালীন প্রধান বিচারপতির আসনে বসা ফজলুল করিমের নেতৃত্বে আপিল বিভাগ। এই রুলের শুনানীর সময় সম্পাদক মহোদয়ের লেখা- ‘স্বাধীন বিচারের নামে তামাশা’ শীর্ষক একটি মন্তব্য প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল আমার দেশ বিচার বিভাগকে অব্যাহতভাবে অবমাননা করছে সেটা প্রমান করা। কিন্ত এম এ মতিন তখন উত্তেজিত হয়ে বললেন, এইটা দিয়ে আরেকটি আদালত অবমাননার মামলা তৈরি করে নিয়ে আসেন। আমরা এইটা পৃথকভাবে আরেকটি মামলা হিসাবে শুনবো। এসময় এম মতিন আরো কিছু অবাঞ্ছিত কথা বলেন। এম এ মতিনের এই উত্তেজনায় সায় দেন প্রধান বিচারপতির আসনে বসা ফজলুল করিমসহ বাকীরা। মোট ৬ জন বিচারক আসনে ছিলেন সেদিন। ফজলুল করিম ও এম এ মতিন ছাড়া বাকী ৪জন হলেন শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান, খায়রুল হক, মোজাম্মেল হোসেন ও সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী পরের দিন আরেকটি আদালত অবমাননার অভিযোগ দাখিল করলেন এম কে রহমান। এটার জন্য আলাদা রুল জারি করে পৃথক শুনানীর দিন ধার্য্য করলেন।
‘চেম্বার মানেই সরকার পক্ষে স্টে’ প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে ইস্যু করা আদালত অবমাননার রুলটির শুনানী করেছিলেন আমার দেশ সম্পাদক শ্রদ্ধেয় মাহমুদুর রহমান নিজে। কারণ, আদালত অবমাননার অভিযোগ উঠলে রেওয়াজ অনুযায়ী ক্ষমা চাওয়া হয়। সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক উল হকসহ অনেকেই তখন সম্পাদক মহোদয়কে ক্ষমা চাওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বিনয়ের সাথে সেটা নাকচ করে দিয়ে বলেন, আমার দেশ যা প্রকাশ করেছে সবই সত্য ঘটনা। সুতরাং সত্য প্রকাশ করে ক্ষমা চাইবো না। এতে আইনজীবীরা মনে করেছিলেন আপিল বিভাগের বিরুদ্ধে লেখা প্রতিবেদনের পক্ষে তারা শুনানী করা থেকে বিরত থাকবেন। তাই সম্পাদক মহোদয় নিজেই শুনানীর দায়িত্ব নেন। এর আগেই সম্পাদক মহোদয়কে অন্য বানোয়াট মামলায় গ্রেফতার করে কারাগারে রাখা হয়েছিল। কারাগার থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় আপিল বিভাগে নিয়ে আসা হয় আদালত অবমাননার শুনানীর জন্য।
টানা ৩ দিনের শুনানীতে সুপ্রিমকোর্টের এক নম্বর আপিল আদালত আইনজীবীতে ঠাসা ছিল। সম্পাদক মহোদয়কে ৬ বিচারপতি প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে থাকলেন। সেদিনের এই দৃশ্য দেখে মনে হয়েছিল তারা ইন্টারোগেশন সেলে বসেছেন। একজন দাগী আসামীকে ইন্টারোগেশন করছেন। আইনের বিচার বিশ্লেষণ নয়, একজন সম্পাদককে নাজেহাল করার উদ্দেশ্য নিয়েই যেন তারা বিচারকের আসনে বসেছিলেন। তাদের ভাষা, প্রশ্ন ও বডি ল্যাঙ্গুয়েজ প্রমান করেছিল তারা বিচারের জন্য নয়, প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে বসেছেন প্রতিশোধ নিতে।
প্রশ্নবাণের মধ্যেই শুনানীর দ্বিতীয় দিনে সম্পাদক মহোদয় আমার দেশ-এর প্রতিবেদনের পক্ষে তথ্যপ্রমাণ হিসাবে কিছু ডকুমেন্টস উপস্থাপন করলেন। এধরনের মামলায় নিয়ম হচ্ছে প্রকাশিত প্রতিবেদনের পক্ষে তথ্য উপস্থাপন করা। নিয়ম অনুযায়ী বেঞ্চ অফিসার ৬ বিচারকের হাতে ডকুমেন্টস গুলো তুলে দিলেন। এই ডকুমেন্টস হাতে নিয়ে উত্তেজিতভাবে নাড়তে নাড়তে এম এ মতিন সাহেব বললেন- ‘এখানে ট্রুথ ইজ নো ডিফেন্স’।
সাথে সাথে প্রধান বিচারপতির আসনে বসা ফজলুল করিম বললেন-“আমরা এখানে সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে বসিনি!”
তাদের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে শাহ আবু নাঈম বলে উঠলেন- “সভ্যতা ভব্যতা বলে একটা কথা আছে।” সিনহা সাহেব আরেকটু উত্তেজিত হয়ে সম্পাদক মহোদয়কে উদ্দেশ্য করে বললেন-“আপনি নিজেকে কি মনে করেন? আমরা এসব দেখব না। আমরা দেখব আদালতকে অবমাননা করা হয়েছে কি না।”
খায়রুল হক উত্তেজিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন-“আপনি কোথায় সাংবাদিকতা পড়েছেন?” সম্পাদক মহোদয় তখন জবাবে বললেন, বুয়েটে ক্যামিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ করে জাপানে সিরামিকে উচ্চতর ডিগ্রী নিয়েছি। সঙ্গে সঙ্গেই খায়রুল হক সাহেব বলে উঠলেন, ‘ও আপনি তাহলে চান্স সম্পাদক’। পরবর্তীতে সম্পাদক মহোদয় ৮ জন খ্যাতনামা সম্পাদকের নাম বললেন, যারা বিভিন্ন পেশা থেকে সরাসরি সম্পাদক হয়েছিলেন। এরমধ্যে, ইত্তেফাকের মানিক মিয়া, অবজারভারের আবদুস সালাম, জহুর হোসেন, ইনকিলাবের এ এম এম বাহাউদ্দিনের নামও ছিল। তারাও কি তাহলে চান্স সম্পাদক ছিলেন, এমন প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া হল খায়রুল হকদের সামনে। সম্পাদক হওয়ার আগে তো তারা কেউ-ই সাংবাদিকতা পেশায় ছিলেন না। ভিন্ন পেশা থেকেই সরাসরি সম্পাদক হয়েছিলেন। ৬ বিচারক তখন মুখ একটু গম্ভীর করে অন্য প্রসঙ্গে ফিরে গেলেন।
এই নিউজের মূল অনুসন্ধান ছিল সুপ্রিমকোর্টের চেম্বার আদালতের বেআইনি আদেশ নিয়ে। হাইকোর্ট বিভাগ তখনো পুরোপুরি শেখ হাসিনার কব্জায় নেওয়া সম্ভব হয়নি। হাইকোর্ট বিভাগের বিভিন্ন বেঞ্চ থেকে আইন অনুযায়ী আদেশ দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস থেকে চেম্বার আদালতে গিয়ে স্থগিতাদেশ চাইতো। কোন ন্যায়-অন্যায় যাচাই ছাড়াই হাইকোর্ট বিভাগের আদেশ স্থগিত করা হত। এনিয়ে ছিল মূল প্রতিবেদন।
প্রতিবেদনটিতে অনেক গুলো মামলার উদাহরণ দেওয় হয়েছিল, যে গুলোতে চেম্বার জজ আইনের তোয়াক্কা না করেই স্থগিতাদেশ দিয়েছিল।
প্রকাশিত প্রতিবেদনের সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে তারা আমাদের জেল জরিমানা করলেন। তাও আবার আইনের সীমারেখা ছাড়িয়ে। আইনে বলা আছে আদালত অবমাননার জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি-অনূর্ধ্ব ৬ মাসের কারাদণ্ড এবং অনধিক ২০০০ টাকা জরিমানা। তারা আইনের সীমারেখা ছাড়িয়ে কারাদণ্ডের পাশাপাশি সম্পাদক মহোদয়কে ১ লাখ টাকা এবং আমাকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেছিলেন। এই বেআইনি জরিমানা আমরা পরিশোধ করিনি। অনাদায়ে অতিরিক্ত কারাভোগ করেছি।
মাস খানেক পরই ফজলুল করিম অবসরে যাবেন। প্রধান বিচারপতি হওয়ার প্রতিযোগিতা মতিন, শাহ আবু নাঈম ও খায়রুল হকের মধ্যে। টানা ৩দিন আমাদের বিরুদ্ধে উত্তেজনা দেখিয়ে জেল জরিমানার পর রায়টি লেখার দায়িত্ব নিলেন মতিন সাহেব। কারণ আপিল বিভাগে একজন রায় লিখেন। বাকীরা দেখে স্বাক্ষর করেন অথবা ভিন্নমত থাকলে নিজের অভিমত গুলো লিখে স্বাক্ষর করেন।
পরবর্তীতে জানতে পেরেছিলাম, আমাদের বিরুদ্ধে উত্তেজনা দেখিয়ে রায়ের পর মতিন সাহেব রাতের বেলায় মুজিব কোট গায়ে লাগিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রীদের বাসায় গেছেন প্রধান বিচারপতি হওয়ার তদবীর করতে। তারপরও ভাগ্যের চাকা উল্টা দিকে ঘুরেছে। প্রধান বিচারপতি আর হতে পারেননি। শেখ হাসিনার পছন্দ তখন খায়রুল হক। পরবর্তীতে আর আমাদের বিরুদ্ধে রায়টি না লিখে ফাইল ফেরত দিলেন। শেষ পর্যন্ত সিনহা বাবু এক বছর পর রায় লিখেছিলেন। রায় লেখার আগেই আমরা কারাভোগ করে মুক্তি পেয়ে যাই।
মতিন সাহেবরা যতবারই এরকম লোক দেখানো আইনের শাসনের কথা বলবেন, ততবার আমি তাদেরকে সেই দিনের ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেব। কারণ, তারাই শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের পাটাতন গড়ে দিয়েছিলেন। এখন এসব বলে মানুষের মন থেকে অতীত ভোলাতে চাচ্ছেন।
প্রধান বিচারপতি না বানালেও শেখ হাসিনা মতিন সাহেবদের নানাভাবে পুরস্কৃত করেছেন। অবসরের পর শ্রম আদালতের বিচারক বানিয়ে সরকারি বাড়ি-গাড়ি দিয়েছিলেন বহুদিন।
লেখক: যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত সাংবাদিক।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন