মিনার রশিদ
এই শিরোনামটির শব্দচয়ন ও ভাবধারাটি ধার করেছি বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুল ইসলামের একটি বিখ্যাত উদ্ধৃতি থেকে।
রক্তের জায়গায় খুন লেখায় রবীন্দ্রনাথ কবি নজরুলের উপর গোস্বা করেছিলেন! তার জবাবে কবি স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, "আমি মনে করি বিশ্ব-কাব্যলক্ষ্মীর একটা মুসলমানি ঢং রয়েছে। ও সাজে তাঁর শ্রীর হানি হয়েছে বলেও আমার জানা নেই। এই বাংলা কাব্য লক্ষ্মীকে দুটো ইরানী 'জেওর' পরালে তার জাত যায় না, বরং তাকে আরও খুব সুরতই দেখায়।"
মরুর গন্ধ নিয়ে এই কিসিমের রাবীন্দ্রিক উসখুস/ইশপিশ পুরো শতাব্দীব্যাপী সক্রিয় ছিল, ইদানিং আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে! সভাপতিত্ব বাদ দিয়ে রামেন্দু মজুমদাররা এখন পৌরোহিত্য করেন। মৃত্যুদিবস বাদ দিয়ে প্রথম আলো/চ্যানেল আই গং এখন প্রয়াণ দিবস পালন করে। তাদের সেই আবেশ বিএনপির কথিত প্রগতিশীল অংশেও সঞ্চারিত হয়ে পড়ছে বলে মালুম হচ্ছে। বিএনপি বলয়ের প্রগতিশীল অংশের নিজের ধর্ম নিয়ে অস্বস্তি দেখে বলতে ইচ্ছে হয়, বিশ্ব রাজনীতি লক্ষ্মীর খ্রিস্টানি ঢং, হিন্দু ঢং এর পাশাপাশি একটি মুসলমানি ঢং রয়েছে। এই মুসলমানি ঢং থেকে আবার ইসলামি ঢং- এর কিঞ্চিৎ পার্থক্য রয়েছে। রাজনীতির মুসলমানি ঢং বনাম ইসলামি ঢং বলতে কী বোঝাতে চাচ্ছি তা একটু পরে বিশদভাবে আলোচনা করা হবে।
একবার কয়েকজন পাকিস্তানি যুবক মদপানের নিমিত্তে আমেরিকার একটি বারে ঢুকে। সেই বারের ফ্রন্ট ডেস্ক পাশে পৃথিবীর নানা দেশের পতাকা দিয়ে সাজানো। সেখানে সৌদি পতাকাও স্থান পায়। তা দেখে যুবকরা বারের ম্যানেজারকে নির্দেশ দেয়, এই পতাকা এখান থেকে নামাও। কারণ আমাদের ধর্মের কলেমা এখানে লেখা রয়েছে। অর্থাৎ নিজে মদখোর পাপী হয়েও বারের মধ্যে কলেমার এই বাণী রাখা সহ্য করবে না।
মাঝে মাঝে ইসলামের নৈতিক সীমার বাইরে চলে গেলেও নিজেকে মুসলমানিত্বের সীমানার বাইরে মনে করে না! এই মানসিকতার রাজনৈতিক প্রকাশটিই সম্ভবতঃ রাজনীতির মুসলমানি ঢং! এই ঢংটির চর্চা করে গেছেন স্যার নবাব সলিমুল্লাহ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী এবং সর্বশেষ শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান! শেরে বাংলা বলেছিলেন, আমাকে যদি কলিকাতার বাবুরা প্রশংসা করে তাহলে বুঝবে যে আমি তোমাদের ক্ষতি করছি। আর কলিকাতার বাবুরা যদি আমার দুর্নাম করে তাহলে বুঝবে আমি ঠিকপথে আছি। দুঃখজনক হলো তাঁরই পরের পুরুষ এখন আধিপত্যবাদের দালালি রাজনীতির সাথে জড়িত।
আর রাজনীতির ইসলামী ঢংটির চর্চা করে গেছেন হাজী শরিয়ত উল্লাহ, তিতুমীর, মওলানা আব্দুর রহিম, মওলানা তমিজ উদ্দীন, মওলানা হাফেজজি হুজুর, প্রফেসর গোলাম আজম, আব্বাস আলী খাঁন, মওলানা মতিউর রহমান নিজামী প্রমুখ। রাজনীতির ইসলামী ঢংটিকে বলা যায় একটা পারফেকশনিস্ট গ্রুপ! এরা ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে একটি পারফেকশন চাহেন।
প্রথম গ্রুপটির টার্গেট ছিল নিজ সম্প্রদায় বা জাতির রাজনৈতিক অধিকার আদায় এবং তার সুরক্ষা। মুসলিম বিশ্ব থেকে ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন এই অংশটির রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন এবং তা যথাযথভাবে ধরে রাখাই এই গ্রুপটির প্রধান ভাবনা (Priority) ছিল। কাঙ্ক্ষিত পারফেকশনের আশায় বর্তমান রাজনৈতিক অধিকার বা জিও-পলিটিক্যাল সুযোগগুলোকে দুর্বল কিংবা ঝুঁকিতে ফেলতে এরা রাজি নন! নিজের ধর্মের প্রতি একটা টান বা শ্রদ্ধাবোধ থাকলেও এরা সবাই আধুনিক সেক্যুলার শিক্ষায় শিক্ষিত! আধুনিক রাষ্ট্র বিজ্ঞান বা গ্লোবাল ভাবনায় ব্যাঘাত বা বিঘ্ন ঘটাতে পারে এমন কিছু গ্রহণ করতেও এঁরা রাজি নন! নিজের ধর্ম এবং গ্লোবাল রাজনৈতিক ভাবনার মধ্যে একটা সমন্বয়ের চেষ্টা করেন।
বিএনপির উপর লেবেলের কিছু নেতা এবং বুদ্ধিজীবী নিজেদের এই পরিচয়টি নিয়ে একটু অস্বস্তি প্রকাশ করলেও মধ্য এবং তৃণমূলের নেতা কর্মীরা সেই বোধটিই ধারণ করেন। ইসলামি ঢং থেকে নিজেদের মুক্ত দেখাতে গিয়ে নিজেদের রাজনীতির মুসলমানি ঢংটিকেও অস্বীকার করে বসেন! ইনারা ভুলে যান সংবিধানে আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস বাক্যটি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানই সংবিধানে ঢুকিয়েছিলেন! সংবিধানের শুরুতে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম তিনিই ঢুকিয়েছিলেন! উনিশ দফার মধ্যে তিনটি দফাতে এই মুসলমানি ঢংটি স্পষ্ট হয়েছে।
সারা বিশ্বে ইয়ং সুটেড-বুটেড ও ড্যাম স্মার্ট একজন মুসলিম লিডার হিসাবে মনোযোগ কাড়েন। তাঁর পাশে দেখা যেত অতীব সুন্দরী এবং আধুনিকা একজন ফার্স্ট লেডি। এরপরেও মুসলিম বা ইসলামিক বিশ্বের নেতা হিসাবে পরিচয় দিতে তিনি কোনো হীনমন্যতায় ভুগেন নি! ব্যক্তি জীবনে নিজে শতভাগ ইসলাম চর্চা না করলেও যারা এদেশে এসব চর্চা করেছেন তাদের নির্ভরতার সবচেয়ে বড় খুঁটিটি তিনি হয়ে উঠেছিলেন। একারণেই তাঁকে বোধহয় জীবনটি দিতে হয়েছিল এবং দেশের আপামর জনতা তাঁকে শহীদ হিসাবে গণ্য করেন! বিএনপির শিরনী খেয়েছেন, খাচ্ছেন এবং ভবিষ্যতে খাবেন এমন অনেক মুন্সি এবং তাদের পোষ্যরা এই খবরটি রাখেন না!
অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও একই নির্ভরতায় তাদের আস্থা রাখতে পেরেছিলেন। দাদা গয়েশ্বর রায় সহ অনেকেই এগিয়ে এসেছিলেন। নিজের সম্প্রদায়কে যারা ভালোবাসেন তারা অন্য সম্প্রদায়কেও ঘৃণা করেন না। এর নমুনা জিয়া রেখে গেছেন!
এই দুটি দলের একটি কমন প্রতিপক্ষ রয়েছে। চরিত্রগতভাবে এরা অত্যন্ত ধূর্ত এবং মারমুখী। এরা সহজেই ইসলামি ঢংটিকে বেকায়দায় ফেলে দেয়। কিন্তু মুসলমানি ঢংটিকে তেমনভাবে মোকাবেলা করতে পারে না। কৌশলগত কারণেই ধূর্ত প্রতিপক্ষ এই দুটি ঢংকে এক সাথে বেঁধে ফেলে এবং নাম দেয় বিএনপি - জামাত! এতে বিএনপিকে প্রগতিশীল হিসাব দেখাতে উদগ্রীব অংশটুকু অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েন। নিজেরা এমন কিছু মন্তব্য করেন যা নিজেদের পুরো রাজনৈতিক স্বার্থ বা কৌশলের বাইরে চলে যায়। পুরো ফ্যানোমেনাটি একটি সংখ্যায় ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে না। তাই আগামী কয়েকটি সংখ্যায় সমসাময়িক ঘটনা উল্লেখ করে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করব!
পিনাকী সিনড্রোম: বামপন্থীদের দিকে বিএনপির এই Fatal attraction জাতির জন্যে সত্যি Fatal হয়ে পড়ছে!
বিএনপির প্রগতিশীল অংশ মাহমুদুর রহমানের পর পিনাকীর মত ব্যক্তিকেও নিজেদের প্রগতিশীলতার পথে কি বাঁধা হিসাবে গণ্য করছেন? এটি আমার বর্তমান গবেষণার অংশ, এটি আমার চূড়ান্ত মতামত বা সিদ্ধান্ত নয়। দয়া করে এটিকে একটি একাডেমিক আলোচনা হিসাবে গ্রহণ করুন এবং আমাকে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহায়তা করুন! আমার পর্যবেক্ষণ ভুল হলে তা ধরিয়ে দিন! দিন কয়েক আগে একজন সাংবাদিক সাহিত্যিক একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সাংবাদিক মহোদয় বামপন্থীদের এক হাত নিলেও নিজে সেই বামপন্থীদের প্রিয় বা বহু চর্চিত শব্দমালা, ব্যবহার করেছেন। বুর্জোয়া শব্দটির ব্যবহার দেখে সহজেই বোঝা যায় উনি অত্যন্ত উঁচু মানের বামপন্থী ছিলেন। কারণ নিজের রিজিউমে বামপন্থী অতীত দেখালে তা অত্যন্ত ওজনদার হয়ে পড়ে। এদের মুখ থেকে বিএনপি কোনো প্রশংসা শুনলে বিএনপির প্রগতিশীল অংশ যারপরনাই গলে যান। লেখাটির প্রথম অংশ চমৎকার হলেও শেষদিকে পিনাকীদার সমালোচনা করতে গিয়ে তাঁকে খোমেনি হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে! বিএনপি পন্থী বুদ্ধিজীবী হিসাবে পরিচিত বেশ কিছু প্রিয় মুখ সেই লেখাটির দারুণ প্রশংসা করে মন্তব্য করেছেন! আমিও সেই লেখার প্রশংসা করেছি তবে এখানে পিনাকীকে টেনে এনে কেন তাঁকে খোমেনি বলে ডাকা হলো তা জানতে চেয়েছি আমার পরবর্তী গবেষণার স্বার্থে।
পিনাকীদা তাঁর কথার কামানগুলো স্বগোত্রীয়দের দিকে তাক করায় অনেকেই হতাশ হয়েছেন। এই কনসার্নটি ব্যক্তিগত সম্পর্কের সুবাদে আমি উনাকে অবহিত করেছি! উনি আমাকে বলেছেন, কী করব মিনার ভাই, আমাকে ওরা এমনভাবে খোঁচান যে জবাব না দিয়ে থাকা যায় না। উক্ত লেখাটি পড়ে তার সাথে দ্বিমত পোষণ করা কঠিন। বিভিন্ন উপায়ে চেষ্টা করেছি। এখন পর্যন্ত সাংবাদিক মহোদয় আর মুখ খুলছেন না, কেন উনি পিনাকীদাকে খোমেনি হিসাবে আখ্যায়িত করলেন এবং বললেন যে উনি বাংলাদেশে খোমেনি স্টাইলের বিপ্লবের চিন্তাভাবনা করছেন! উনাদের জবাব পেলে পিনাকী সিনড্রোমের বাকি অংশটুকু লিখব।
লেখক: মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, লেখক ও গবেষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন