মিনার রশিদ
বিশিষ্ট বাম চিন্তক বদরুদ্দীন ওমর বিএনপিকে একটি দামি পরামর্শ দিয়েছেন! গত ১৬ই জুন জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে গণসংস্কৃতি ফ্রন্ট আয়োজিত ‘গণতন্ত্রের সংগ্রাম ও সংবাদপত্র’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান আলোচক ছিলেন জনাব ওমর। সেখানে তিনি বলেন, ‘ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে তাড়াতে হবে। তাদের অধীনে নির্বাচন হবে না। বিএনপিও বলছে আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। কিন্তু নির্বাচন করতে দেয়া হবে না, সে কথা বিএনপি বলছে না।’
সাগরেদরা তাদের গুরুর উক্ত উপদেশের না না ফজিলতের কথা বর্ণনা করে যাচ্ছেন!! এর বহুত বহুত ফায়দা তুলে ধরছেন! এসব দেখে একটি গল্প মনে পড়ে গেল।
এক মোড়ল মারা যাওয়ার আগে গ্রামবাসীকে ডেকে বলে, দেখো আমি সারাজীবন তোমাদেরকে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছি। জানি, তোমরা আমার এই অপরাধ ক্ষমা করতে চাইলেও মন থেকে তা করতে পারবে না। তাই তোমাদেরকে অনুমতি এবং পরামর্শ দিচ্ছি যে আমার মৃত্যুর পর তোমরা আমার লাশের পশ্চাৎদেশে একটি বাঁশ ঢুকিয়ে সদর রাস্তায় টানিয়ে রাখবে। আশা করি, এর মাধ্যমে আমার উপর তোমাদের যে ক্ষোভ রয়েছে তা কিছুটা হলেও লাঘব হবে। আর এটাই হবে আমার কৃত অপরাধের যথাযোগ্য শাস্তি! মোড়লের অত্যাচারে অতিষ্ঠ গ্রামবাসী মৃত্যুপথযাত্রী এই মোড়লের কথায় আন্তরিকতা এবং অনুশোচনা টের পেল! মোড়লের মৃত্যুর পর তার পরামর্শ মতই মৃত মোড়লকে বাঁশ প্রয়োগের সেই কাজটি উৎসাহ ভরেই সাঙ্গ করল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর পুলিশ এসে গ্রামের সবাইকে ধরে নিয়ে জেলে চালান করে দিল। গ্রামবাসী তখন মাথা চাপড়িয়ে বলতে লাগল, হায়রে মোড়ল! জীবিত থাকতে তো আমাদের জ্বালিয়েছই, মরণের সময়েও তোমার হাত থেকে নিষ্কৃতি মিলল না!
পশ্চিমা গণতান্ত্রিক বিশ্ব যখন এদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যে ভিসা স্যাংশন সহ বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে এসেছে সেই মুহূর্তে বদরুদ্দীন ওমরের এই পরামর্শটি সত্যি চমৎকার মনে হয়েছে! বদরুদ্দীন ওমররা বিএনপিকে এখনও নেহায়েত নাবালক ঠাহর করে! সকাল বিকাল হাসিনাকে গালি দিয়েও এই বদরুদ্দীন ওমররা 'বিকল্প কী' এই বয়ানটি প্রতিষ্ঠা করেছে! বিভিন্ন ফোবিয়া বা জুজুর ভয় দেখিয়ে ফ্যাসিবাদের আয়ু বাড়িয়েছে! যে অনুষ্ঠানে ওমর সাহেব এই পরামর্শটি ছুড়ে দিয়েছেন সেই মঞ্চেই উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নুরুল কবির, প্রথম আলো পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান।
প্রথম আলোর কলামিস্ট এই সোহরাব হাসান সম্পর্কে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন পড়বে বলে মনে হয় না। বিএনপির স্থায়ী কমিটির কিছু সদস্য নিজেদের পরিচয় গোপন করে যাদের কাছে নিজেদের হতাশা প্রকাশ করতেন তাদের একজন ছিলেন লন্ডন প্রবাসী মরহুম আব্দুল গাফফার চৌধুরী এবং অন্যজন এই সোহরাব হাসান! পরের দিন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সেই সদস্যের মনোযাতনা আগাচৌ কালের কণ্ঠ বা জনকণ্ঠে প্রকাশ করতেন এবং সোহরাব হাসান করতেন প্রথম আলোতে! ইদানিং এই সোহরাব হাসান বিএনপির মন অনেকটাই গলিয়ে ফেলছেন। কারণ আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে অনেক সত্য কথা ইদানিং তিনি লিখছেন! লেখার শেষদিকে সেই সব সত্য কথার পেছনের সত্যটা তুলে ধরে আজকের আলোচনার ইতি টানব।
ইনারা একটি চেইন সাজিয়ে এই এই মহত কর্মটি করেন। হীরক রাজার যেমন ছিল তন্তর-মন্তর ঘর, এদের আছে তেমনি এই তন্তর-মন্তর চেইন বা মালা। তন্তর-মন্তর এই চেইনের এক প্রান্তে থাকেন বদরুদ্দীন ওমরের মত কেউ, তাঁর পাশে প্রথম আলো বা ডেইলি স্টারের খাস কেউ! চেইনের মাঝখানে রাখা হয় বাম ব্যাকগ্রাউন্ডের কিছু ব্যক্তিত্ব যারা বর্তমান ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কিছু সাহসী কথা উচ্চারণ করে সুনাম বা জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন! চেইনের অপর প্রান্তে রাখা হয় আগে থেকেই বিএনপি পন্থী বুদ্ধিজীবী হিসাবে ট্যাগ মারা মরহুম ডাক্তার জাফর উল্লাহ ভাইয়ের মত কেউ! উনি এন্তেকাল করায় পজিশনটি আপাতত: খালি হয়ে গেছে। সম্ভবত নতুন কাউকে এই জায়গায় প্রতিস্থাপনের চিন্তাভাবনা চলছে! সহজ সরল এই মানুষটি (ডাক্তার জাফর উল্লাহ) পেছনের নটরাজদের এই খেলা কতটুকু ধরতে পেরেছিলেন, তা গবেষণার বিষয়।
শতভাগ বাম উপাদানে তৈরি চমৎকার এই ‘তন্তর-মন্তর’ চেইনের মাধ্যমেই বিশেষ বয়ানগুলো বিএনপির মগজে বা শরীরে ঢুকানোর চেষ্টা করা হয়!! প্রথমে চেষ্টা করে বিএনপিকে বিষ খাইয়ে মারতে, সেটা সম্ভব না হলে পরের চেষ্টা থাকে মিঠাই খাইয়ে মারার!
এবার আসুন দেখি, বিশেষ কিছু বয়ান যা এই চেইনের মাধ্যমে ছড়ানো হয়েছে!
“২০১৪ সালে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে বিএনপি মারাত্মক ভুল করেছে!”
“বেগম খালেদা জিয়া প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাৎ না করে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরেছে।”
“কোকোর মৃত্যুর সময় শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে দিয়ে মারাত্মক ভুল করেছে!”
উক্ত চেইনের মাধ্যমেই এই বয়ানগুলো বিএনপির কলিজার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ প্রত্যেকটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তখনকার বাস্তব প্রেক্ষাপট চিন্তা করে। উল্টো করলে অবস্থার কোনো পরিবর্তন হত না! এদের সেসব বয়ান শুনে মনে হবে যে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করার জন্যে কোকোর মৃত্যুর সময় ছাড়া আর কোনো সময় হাসিনার হয় নাই। এই জ্ঞানপাপীর দল এই প্রশ্নটি কখনও করে নাই যে একজন ব্যক্তির প্রাইভেট লাইফ এবং পাবলিক লাইফের কনফ্লিক্টকালীন নাজুক মুহূর্তে এই ধরনের সাক্ষাৎকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জন্যে চরম বেদনাদায়ক হতে পারে! অথচ মতলববাজেরা এই ঢুল বাজিয়েই গেছে!
পরবর্তীতে অনেক বিএনপি নেতা বা জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবীদের মুখেও এই ধরণের আফসোস শুনেছি! বুদ্ধিবৃত্তিক এই উপদ্রবের কারণেই ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে বিএনপির সামনে অন্য কোনও উপায় ছিল না! যদিও এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেই প্রমাণ করতে পেরেছে যে ২০১৪ সালে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তটি সঠিক ছিল।
২.
ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আমাদের নেত্রী গ্যারান্টি দিয়েছে, বাংলাদেশে নির্বাচন অবাধ হবে, সুষ্ঠু হবে, নিরপেক্ষ হবে।
এই কথা শুনে এদেশের দুধের বাচ্চাও ওয়াক-থু বলে উঠবে। তবে এই বয়ান বা ভাবনাটিকে যদি 'যন্তর-মন্তর' চেইন দিয়ে সামনে আনা হয় তবে সহজেই গেলানো সম্ভব হবে। সেই কাজটিও শুরু হয়ে গেছে!
প্রথম আলোর সোহরাব হাসান গত ১০ই জুন একটি কলাম লিখেছেন। “যদি '১৪ ও '১৮ সালের মতো নির্বাচন না হয়?” শিরোনামের ঐ কলামটি শুরু করা হয়েছে বিএনপির মুরোদের প্রশংসা করে! তারুণ্যের সমাবেশ ও নারী সমাবেশের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়েছে।
প্রথম কয়েকটি লাইন পড়লেই বিএনপির কঠিন হৃদয়টিও কমপক্ষে ৫০ ভাগ গলে যাবে। এরপর আওয়ামীলীগের ভেতরে যে অস্থিরতা, যে আভ্যন্তরীণ কোন্দল সেগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন! পুরা লেখাটিতে বিএনপির মন পুরো গলিয়ে দিয়ে শেষের প্যারায় বলেছেন,
“আওয়ামী লীগের নেতারা কি মনে করছেন আগামী নির্বাচনটিও তাঁরা আগের মতো করতে পারবেন? ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছিল। আওয়ামী লীগ ফাঁকা মাঠে গোল দিয়েছে। ২০১৮ সালে বিএনপি নির্বাচনে এলেও প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় নূরুল হুদা কমিশন এমনভাবে নির্বাচনটি সাজিয়েছিল, কষ্ট করে ভোটারদের (বেশির ভাগ) ভোটকেন্দ্রে যেতে হয়নি, আওয়ামী লীগের প্রার্থীদেরও ভোট চাইতে হয়নি। এবার যদি সত্যি সত্যি বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয় এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসন পক্ষপাত না দেখায়, তাহলে নির্দলীয় কিংবা নির্বাচনকালীন যে সরকারের অধীনেই নির্বাচন হোক না কেন, পুলিশ পাহারায় থেকে যাঁরা এখন বড় বড় কথা বলছেন, তাঁদের সত্যিই কঠিন বাস্তবতার মুখে পড়তে হবে।”
অর্থাৎ সোহরাব হাসান বলতে চাচ্ছেন যে সরকারের অধীনেই নির্বাচন হোক না কেন (নির্দলীয় কিংবা নির্বাচনকালীন যে সরকারের অধীনেই নির্বাচন হোক না কেন) বিএনপির বিজয় সুনিশ্চিত! কাজেই হেলায় সুবর্ণ সুযোগ হারাবেন না!
প্রথম আলো সহ বাম ঘরানার এই বুদ্ধিবৃত্তিক ইতরামির বিরুদ্ধে বিএনপি যদি কার্যকর প্রতিরোধ (বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক) সৃষ্টি করতে না পারে তবে অগত্যা ক্ষমতায় আসলেও শান্তি মিলবে না!
লেখক: মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, লেখক ও গবেষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন