কদরুদ্দীন শিশির
·
একটি স্যাটায়ার আর্টিকেলের কারণে ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক ও আর্টিকেলের লেখককে লিগাল নোটিশ দিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র ফজলে নুর তাপস।
তার অভিযোগ, "মানহানিকর ও মনগড়া খবর প্রকাশ" করেছে ডেইলি স্টার!
এইটা একইসাথে 'মজার ও হাস্যকর' এবং 'অদ্ভুত ও ভয়াবহ' একটি খবর।
আরে ভাই, স্যাটায়ারের একটা বৈশিষ্ট্যই তো তাতে মনগড়া অতিরঞ্জণ থাকবে! মেয়র একজন আইনজীবী, নোটিশ ইস্যুও করেছেন আরেক আইনজীবী। ফলে তাদের রিডিং কম্প্রিহেনশনকে আন্ডারমাইন করার কারণ নাই। কিন্তু তারপরও তারা কি বুঝেন নাই ওটা একটা 'রম্য রচনা'? লেখক এবং পত্রিকা তো খুব স্পষ্ট করে ডিসক্লেইমার দিয়ে রেখেছে যে, একটি স্যাটায়ার বা রম্য রচনা। এবং সেখানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বা মেয়র তাপস এসব নামও নেয়া হয়নি! 'ফাপস ধুর' তো ঢাকা দক্ষিণের মেয়র নন, স্যাটায়ার আর্টিকেল মতে, ওই নামটি 'ধোকা সাউথ টাউন করপোরেশন' নামক কল্পিত কোন শহরের মেয়রের নাম! ঘোষিত রম্য রচনা এবং সেখানে থাকা কল্পিত নামের চরিত্রকে নিজের গায়ে মাখা একধরনের রম্য আচরণ বৈকি!
এসব গেল হাস্যকর দিক!
সংবাদমাধ্যমে রম্য বা স্যাটায়ারমূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হওয়া খুবই স্ট্যান্ডার্ড একটা প্রাক্টিস, সারা দুনিয়ায়। ডেইলি স্টার তা করে আসছে বহু বছর ধরে।
ভয়াবহ দিক হচ্ছে, বাংলাদেশের ক্ষমতাবান ব্যক্তিবর্গ এতই অসহনশীল হয়ে উঠছেন যে, স্যাটায়ার আর্টিকেলের জন্য পত্রিকা ও লেখককে শত কোটি টাকার মানহানির নোটিশ দিচ্ছেন!
আরও ভয়াবহ দিকটি হলো, এই ঘটনায় বাংলাদেশের মিডিয়ার রিপোর্টেজ।
মাত্র একটি পত্রিকা (বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড) ছাড়া কেউই তাদের প্রতিবেদনে এই কথাটি উল্লেখ করেনি যে, স্যাটায়ার আর্টিকেল প্রকাশের কারণে মেয়র লিগাল নোটিশ দিয়েছেন।
একটি টিভি চ্যানেলের অনলাইনে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনের শিরোনাম দিয়েছে: "গাছ কাটার সংবাদ প্রকাশ: ক্ষতিপূরণ চেয়ে ডেইলি স্টার সম্পাদকের বিরুদ্ধে মেয়র তাপসের নোটিশ"।
এই শিরোনামটি সম্পর্ণ বিভ্রান্তিকর। এতে মিসইনফরমেশন আছে।
ডেইলি স্টার গাছ কাটার সংবাদ প্রকাশের কারণে লিগাল নোটিশ পায়নি। বরং গাছ কাটা সংক্রান্ত বিষয়ে একটি রম্য রচনা লেখা ও প্রকাশ করার কারণে নোটিশ পেয়েছে।
একটা দেশে ক্ষমতাসীনদের নিয়ে পলিটিক্যাল স্যাটায়ার/কার্টুন ইত্যাদি প্রকাশ 'অপরাধ' হয়ে ওঠার বিষয়টি সে দেশের বাক ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ভয়াবহভাবে না থাকার নির্দেশ করে।
এভাবে প্রায় সব পত্রিকার রিপোর্টেই নোটিশ প্রদানকারী আইনজীবীর ভাষাটাই ('খবর' 'কলাম' 'গাছ কাটা', 'মেয়রের নাম বিকৃত', 'মনগড়া রিপোর্ট', 'মনগড়া উক্তি' ইত্যাদি) তুলে ধরা হয়েছে।
কিন্তু ডেইলি স্টারের লেখাটি আসলে কী ছিল, 'খবর' ছিল? নাকি সাধারণ 'কলাম' ছিল? নাকি একটি রম্য রচনা ছিল- এসব তথ্য এই সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টগুলোতে নেই।
একজন ব্যক্তির 'মনগড়া বক্তব্য' দিয়ে এবং 'নাম বিকৃত করে' 'খবর' বা সাধারণ 'কলাম' প্রকাশ করা আর একটি 'রম্য রচনা' প্রকাশ করা মোটেও একই পাল্লায় মাপার জিনিস নয়।
কিন্তু সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে সেটাই করা হয়েছে। ‘স্যাটায়ার আর্টিকেলকে‘ ‘খবর‘ বা ‘সংবাদ‘ বলে অভিহত করা হয়েছে, যা স্পষ্ট মিসইনফরমেশন।
এবং এই ধরনের বাকস্বাধীনতার চরম ঘাটতি থাকা আর মিডিয়াতে ক্ষমতাসীনদের এক পাক্ষিক ভাষ্য প্রকাশিত হওয়া পরিস্থিতির দেশে ডেইলি স্টার তাদের সেই 'রম্য রচনা'টি ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছে! এখন আর সেটির অস্তিত্ব অনলাইনে নেই!
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন