শিশির মনির
১। ২১ আগস্ট ২০০৬ তারিখে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হই। ১১ এপ্রিল ২০০৭ তারিখে ঢাকা বারের সদস্য হই। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আইনপেশায় আত্ম নিয়োগ করিনি। ১২ জুলাই ২০১২ তারিখে হাইকোর্ট বিভাগের আইনজীবী হিসেবে অনুমতি পাই। হাইকোর্ট বারের সদস্য হই ২ সেপ্টেম্বর ২০১৩ তারিখে। আমার অভিজ্ঞতা তেমন নয়। বারের অতীত আমার ভাল জানা নাই। আইন-কানুন-ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ নিয়েই সময় কেটে যায়। এর বাইরে তেমন মনোযোগ নাই। লিগ্যাল রিসার্চ আমার খুব প্রিয়। নতুন নতুন রায় পড়তে খুবই ভাল লাগে। একটি থেকে আরেকটির সুক্ষ পার্থক্য খুঁজে পেলে পুলকিত হই। এক ধরনের শিহরণ অনুভব করি। অনেকটা নেশার মত। untouched area of law নিয়ে কাজ করতে ভীষণ ভাল লাগে। যেমনঃ Defense Services এর সদস্যরা কেন রিট করতে পারবেন না? কখন সরকারী কর্মচারীগণ রিট করতে পারবেন? কোম্পানির বিরুদ্ধে রিট চলবে না কেন? কখন চলবে? মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রাপ্তদের জামিন হবে না কেন? বন্দিদের পারিবারিক/ব্যক্তিগত অধিকার হিসেবে একান্তে সাক্ষাৎ করতে দিবে না কেন? মৃত্যুর সেলে একা থাকবে কেন? জব্দকৃত মালামাল এইভাবে নষ্ট হবে কেন? পুলিশের তদন্ত পুলিশ করবে কেন? ১৬৪ ধারার জবানবন্দির কপি পাব না কেন? ইত্যাদি।
২। আমার/আমাদের এই ধরনের চিন্তার মূলসূত্র কি? কোথা থেকে আসে? উত্তর হল সিনিয়র বিজ্ঞ আইনজীবীদের উৎসাহ, কর্মতৎপরতা ও শিক্ষা। ছাত্র জীবনে জেনেছি অস্টম সংশোধনী মামলার আইনজীবীদের বীরত্বের কথা। মাজদার হোসেন মামলার আইনজীবীদের পরিশ্রমের কথা। Judges Case এর মামলায় সিনিয়রদের ক্ষুরধার যুক্তিতর্কের কথা। ETV'র মামলায় লিগ্যাল রিসার্চের কথা। কল্পনায় অবগাহন করেছি। তাঁদের বাস্তবে দেখে আরও বেশি আগ্রহ পেয়েছি। অবাক হয়েছি। তন্ময় হয়ে submission শুনেছি। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাকিয়ে রয়েছি। আজও তাঁদের submission শুনলে থমকে দাঁড়াই। উজ্জীবিত হই।
৩। এই রকম একজন সিনিয়র জনাব মনসুরুল হক চৌধুরী। স্যারের সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় ২০১৭ সালে। আমি এনেক্স ১৭ নম্বর কোর্টে বসে আছি একটি মোশন মামলা করার জন্য। মামলা কাছাকাছি তাই বেঞ্চের এই পাশে বসছি যেন তাড়াতাড়ি যেতে পারি। এই সময় স্যার ঢুকলেন এবং স্যারকে দেখে আমি উঠে দাঁড়িয়ে রাস্তা করে দিলাম। স্যার বসলেন। (অবশ্যই ঘটনা অনেক বড়) এরপর আরও অনেকবার স্যারের সাথে মামলা করার সৌভাগ্য হয়েছে। পক্ষে-বিপক্ষে। শুরুতে ফ্রি হয়ে কথা বলতে পারতাম না। সংকুচ বোধ করতাম। বার বার দেখা হওয়ার পর সংকোচ কেটে গেছে। স্যারের বাসায়ও বেশ কয়েকবার গিয়েছি। চা-নাস্তা খেয়েছি। কয়েকটি মামলায় স্যারকে সিনিয়র নিযুক্ত করেছি। স্যারকে ফোন করলেই স্নেহের সুরে বলেন 'শিশির মনির, বল। কি জন্য ফোন করছ? এই ব্যাপারে ডিসিশন দেখ? রায় আছে বাহির কর ইত্যাদি।' সব সময় আইনের বই সামনে রাখেন। পড়েন। আমাদের পড়তে বলেন। উৎসাহিত হই। নিজের বক্তব্য forcefully আদালতে তুলে ধরেন। তন্ময় হয়ে শুনতে ইচ্ছে করে।
৪। আমি একটি ছোট বই লিখেছিলাম Hundred Sensational Murder Cases of Bangladesh. উদ্বোধন অনুষ্ঠানে স্যারকে দাওয়াত দিলাম। রোযার মাস। বিকাল বেলা প্রোগ্রাম। স্যার ২ টার পর থাকতে পারেন না। মাঝে মাঝে Sugar low হয়ে যায়। আমি বার বার গেলাম। স্যার আপনাকে কিন্তু থাকতেই হবে। একঘন্টার মধ্যে ২/৩ বার রুমে গেলাম। স্যার মুচকি হেসে বললেন,' তুমি ত আমাকে ছাড়বা না। আমি অবশ্যই যাব। আমাকে একটু আগে ছেড়ে দিও।' আমি বললাম জি স্যার। স্যার সেই অনুষ্ঠানে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিলেন। আমি খুবই উৎসাহ বোধ করলাম। ঐ অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ, সিনিয়র আইনজীবী জনাব খন্দকার মাহবুব হোসেন, সিনিয়র আইনজীবী জনাব এস এম শাহজাহান প্রমুখ।
৫। সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচন কাছাকাছি আসল। নির্বাচন সাব-কমিটি ঘোষণার প্রশ্ন আসল। বর্তমান কমিটির একাংশ একটি সাব কমিটি ঘোষণা করলেন। অপর অংশ আরেকটি সাব-কমিটি ঘোষণা করলেন। বিষয়গুলো দেখে আমি বেশ মর্মাহত হলাম। ভাবলাম আবার কী শুরু হল? কী উদ্দেশ্যে এই গুলি করছে? দুই/একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম কেন করছেন এইগুলো? এরই মধ্যে শুনলাম মাননীয় প্রধান বিচারপতি মহোদয় একটি উদ্যোগ নিয়েছেন। শুনে যার পর নাই খুশি হলাম। সিনিয়র আইনজীবী জনাব হাসান আরিফ স্যার, অন্য একজন এবং জনাব মনসুরুল হক স্যারের নাম এসেছে সাব-কমিটির প্রধান হিসেবে। নামগুলো শুনে আশ্বস্ত হলাম। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। পরক্ষণেই শুনলাম জনাব হাসান আরিফ স্যার অপারগতা প্রকাশ করেছেন। একটু বিচলিত হলাম। আবার শুনলাম জনাব মনসুরুল হক স্যার দায়িত্ব নিয়েছেন। খুবই পুলকিত হলাম। আনন্দে নেচে উঠলাম। এইবার সুপ্রিম কোর্ট বারের সম্মান রক্ষা হবে। যেই পাশ/ফেল করুক স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে। কে পাশ করবে আর কে ফেল করবে এটা আনন্দের কারণ ছিল না। মূল কারণ ছিল স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে।
৬। সবাই আনন্দের সাথে নির্বাচন শুরু করলেন। নমিনেশন জমা দিলেন। বৈধতা ঘোষণা হল। উভয়পক্ষের মাঝে উৎসব উৎসব ভাব আসল। প্রচার-প্রচারণা চলল। শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত হল। রুমে এসে ভোট চাইলেন। ভোট
চাওয়ার ক্ষেত্রে প্রার্থীরা বেশ অভিনব কৌশল অবলম্বন করলেন। ফোনে, লাইনে দাঁড়িয়ে, বিমানে গিয়ে, পিকনিকে গিয়ে, ব্যক্তিগতভাবে, হাতে ধরে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, ভিডিও বার্তায়। মনে হচ্ছিল মতামত খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। True reflection of democracy.
৭। সকাল ১১ টায় ৩৪২ নং রুমে বসে আছি। একজন প্রার্থী দল-বল সহ রুমে আসলেন। এসেই জড়িয়ে ধরলেন। এই রুমের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত স্মৃতির কথা বললেন। উনার চোখ ছল ছল করছিল। আমিও আবেগপ্রবণ হয়ে গেলাম। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। তারপর এগিয়ে দিয়ে আসলাম। এ যেন সত্যিই learned দের নির্বাচন। কত বিনয়? কত স্মৃতি আর ভালবাসার মিশ্রণ? জীবন্ত Democracy. সত্যিই আমি অভিভূত।
৮। যারা নমিনেশন চেয়েছিলেন কিন্তু পান নাই তাঁরাও বেশ আগ্রহ দেখালেন। স্ব-স্ব প্যানেলের জন্য ভোট চাচ্ছেন। স্বশরীরে এসে মুচকি হাসি দিয়ে করমর্দন করছেন। অথচ ৩/৪ দিন আগে তিনিই ছিলেন প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থী। প্যানেল নমিনেশন ঘোষণা হওয়ার সাথে সাথে তিনি সব ভুলে গেলেন। প্যানেলের জন্য নেমে গেলেন। what a beauty of Supreme Court Bar Association! নিশ্চই জুনিয়রদের জন্য অনেক কিছু শেখার আছে। সকলের জন্যই আছে। এই পরিস্থিতি আমি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতাম। Heart এ এক ধরনের নাড়া অনুভব করতাম। প্রায় প্রতিদিনের ঘটনা নিয়ে Diary লিখেছি। অনেক ছোট ছোট বিষয় স্থান পেয়েছে। কারণ I was heavily moved by the democratic atmosphere of the Supreme Court Bar Association.
৯। ফেইসবুকে লাইভ দেখছিলাম projection meeting. বসে বসে প্রতিটি শব্দ চয়ন-বাচন ভঙ্গি, তত্ত্ব-তথ্য উপস্থাপন, বিপরীতপক্ষকে খুঁচা মারা, হাততালি আদায় করার কৌশল ইত্যাদি। মনে হচ্ছিল কি চমৎকার! অনেকটাই অস্টম সংশোধনী মামলার যুক্তিতর্কের মত। বিচারপতিবৃন্দ তাদের রায়ে লিখেছেন,' যখন এই পক্ষ শুনি তখন মনে হয় এটা সঠিক আর যখন অপর পক্ষ শুনি তখন মনে হয় সেটা সঠিক।' বস্তুতঃ এরাই learned. লাইভে দেখলাম সাব-কমিটির প্রধান হিসেবে জনাব মনসুরুল হক স্যার টেবিলে বসে আছেন। মাঝে মাঝে মুচকি হাসছিলেন। যেন বিচারকের মত আইনজীবীর submission শুনছেন আর পুলকিত অনুভব করছেন। বিএম ইলিয়াছ কচি ভাইকেও মুচকি হাসতে দেখলাম। বেশ মজাই পেলাম। পুরোটাই দেখলাম। বাসায় অন্যদের দেখালাম। বললাম দেখ আমাদের নির্বাচনে প্রার্থী পরিচিতি সভা চলছে। এটাই সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতি। Free and Fair নির্বাচন। যোগ্য প্রার্থী। যোগ্য নির্বাচন কমিশন। Developed Democratic Values. এক কথায় মনোমুগ্ধকর।
১০। শেষ হল projection meeting. শুরু হল স্বপ্ন ভঙ্গ। স্যারকে ডেকে নিয়ে একান্তে কথা বলা হল। কি কথা? কি বিষয়ে কথা? কে বলল কথা? কোথায় বসে বলল কথা? কথার পিটে স্যার কি বললেন? প্রতি উত্তরে স্যারকে কি বলা হল? পদত্যাগের সিদ্ধান্ত তিনি কখন নিলেন? স্বেচ্ছায় নিলেন? অভিমানে নিলেন? নাকি বাধ্য হয়ে নিলেন? যদি বাধ্য হয়ে থাকেন তাহলে কিভাবে বাধ্য করা হল? কথা দিয়ে? শক্তি দিয়ে? নির্দেশ দিয়ে? ভয় দেখিয়ে? চাপ প্রয়োগ করে? চাপ হলে কি ধরনের চাপ? ব্যক্তিগত? পারিবারিক? সামাজিক? রাজনৈতিক? এই কথোপকথন আমার জানা নেই। যারা হাজির ছিলেন তারাই হুবহু বলতে পারবেন। একজন আইনজীবী/বারের সদস্য/শুভাকাঙ্ক্ষী/ নাগরিক হিসেবে এই প্রশ্নগুলো বার বার উঠে আসে? কেউ হয়ত বলতে পারেন এত চিন্তা করতে আমাকে কে বলছে? উত্তরে শুধু বলব বিষয়গুলো মনের মধ্যে ঘুরপাক খায়। মনের উপর ত আমার নিয়ন্ত্রণ নাই। আসে তাই বললাম। ভাবলাম তাই প্রকাশ করলাম। এতে যদি দোষের কিছু হয়ে থাকে তাহলে আমি দোষী।
১১। শুরু হয় অনাস্থা। অবিশ্বাস। রাগ। ক্ষোভ। অগ্নিশর্মা। অগ্নিমূর্তি। তবুও দেখেছি স্যারকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অনেকেই করেছেন। কে কতটুকু চেষ্টা করেছেন? আরও চেষ্টা করলে তিনি রাজি হতেন কি না? এই আলোচনা গৌণ। স্যারের অবর্তমানে অন্য ব্যবস্থা করা যেত কি না? সেটি আমরা কেন পারলাম না? অন্যজন কিভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করলেন? কে দিল দায়িত্ব? নিয়ম অনুযায়ী দেয়া হয়েছে কি না? তিনিই বা কেন নিলেন এই দায়িত্ব? কে বা কারা তাকে নিতে বলেছেন? সেই resolution আছে কি না? যেখানে সিনিয়র সরে দাঁড়ালেন সেখান জুনিয়র কেন নিলেন? তিনি কি স্বেচ্ছায় নিলেন নাকি বিপদে পরে নিলেন? নাকি দরদী হয়ে নিলেন? নাকি ত্রানকর্তা হিসেবে দায়িত্ব নিলেন? নাকি নির্দেশে নিলেন? যিনি নিলেন তার মননে কি ছিল? তার মনের গহীনের ভাবনা কি? Justification কি? উত্তরগুলো তিনিই ভাল জানেন। তবে একটুকু বলতে পারি এই পরিস্থিতিতে অস্তিত্বের সংকট হলেও আমি এই দায়িত্ব নিতাম না। Rather I would prefer to die.
১২। দায়িত্ব নেয়া হয়ে গেল। নির্বাচন করতে হবে। অপরপক্ষ করবে না। বাধা দিবে। পুলিশ আসল। সাংবাদিক আসল। যারা বাধা দিলেন তাদের জোর করে সরাতে হল। মার খেল। সাংবাদিক আহত হল। লাইভ দেখানো হল। Lead News হল। টকশ হল। পক্ষে-বিপক্ষে কথা হল। কথা চলছে আরও চলবে। একপক্ষ পূর্ণ প্যানেলে বিজয়ী হয়ে মুচকি হাসল। ফুলের মালা গলায় দিল। অপরপক্ষ আন্দোলনের ঘোষণা দিল। জোর যার মুল্লুক তার আবার প্রতিষ্ঠিত হল।
১৩। সবই হল। এক পক্ষ জিতে গেল। কিন্তু আইনজীবীরা হেরে গেল। বার হেরে গেল। বিজ্ঞতা হেরে গেল। সম্মান ভূলুন্ঠিত হল। আবরু নষ্ট হল। সুপ্রিম কোর্ট অপমানিত হল।আইনের শাসন ক্ষতিগ্রস্ত হল। আমাদের পোশাক বিপন্ন হল। কলার-বেন্ড আক্তান্ত হল। পবিত্রতা নষ্ট হল। এগুলো নষ্ট হওয়ার পর থাকল কি? ক্ষমতা? চেয়ার? Designation? উপরের নির্দেশ পালনের সক্ষমতা? Bad Precedent? পোশাক বিহীন চেয়ারে কি মর্যাদা থাকবে! কলার বিহীন ক্ষমতায় কি তৃপ্তি আসবে! তাহলে হলটা কী! সবই গেল। সবার গেল।
অবশিষ্ট থাকল কেবল 'উপরের নির্দেশ'।
'শুনেছি আত্মহত্যা মহাপাপ। স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে আমরা সেই পথই বেছে নিলাম।'
শিশির মনির
২১ মার্চ ২০২৩
ল'ল্যাব
[বিঃদ্রঃ ভুল-ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল।]
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন