অলিউল্লাহ নোমান
ইসলামবিদ্বেষী ও জাতীয় ঐতিহ্য বিরোধী পাঠ্যপুস্তকের পক্ষে সাফাই গাইতে মাঠে নেমেছেন শাহরিয়ার কবির গংরা
ইসলাম ও মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো এবং ভারতীয় হিন্দুত্ববাদ চাপিয়ে দেওয়া পাঠ্যপুস্তকের পক্ষে এবার মাঠে নেমেছেন চিহ্নিত ভারতীয় দালালগোষ্ঠী। ‘সামাজিক প্রতিরোধ আন্দোলন’ নামে একটি ভূঁইফোড় সংগঠনের ব্যানারে চিহ্নিত দালালরা ২৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেন। এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় রাষ্ট্রীয় বেতনভুক্ত একজন কর্মচারী। এই কর্মচারী হলেন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য মো: মশিউজ্জামান।
তাঁর বক্তব্য পত্রিকায় যতটুকু এসেছে, সেটা পাঠ করলেই অনুমান করা যায়, বাংলাদেশের মানুষের টাকায় বেতন নিয়ে হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠায় তারা কতটা অপতৎপর। সমালোচনার চাপে প্রত্যাহার করা ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন বই দু’টি প্রসঙ্গে মশিউজ্জামান বলেছেন, এই দুই বইয়ে তথ্যগত ভুল আছে বলে তারা মনে করেন না। বানানে ভুল থাকতে পারে।
এনসিটিবি’র এই সদস্যের বক্তব্যের মাধ্যমেই স্পষ্ট রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানটি বোঝে-শোনেই মুসলিম শাসনকালকে কটাক্ষ করে এবং ইসলামবিদ্বেষ দিয়ে শিশুদের গড়ে তোলার অপচেষ্টায় লিপ্ত। তাঁর বক্তব্যে আরো স্পষ্ট, একটি আত্মপরিচয়হীন জাতি হিসাবে আগামী দিনের শিশুদের ভারতয় হিন্দুত্ববাদ মুখি করার অপচেষ্টা তারা চালিয়ে যাচ্ছেন ডা. দীপ মনির তত্ত্বাবধানে।
বই দু’টি প্রত্যাহার প্রসঙ্গে তিনি এই গোল টেবিলে আরো বলেছেন, নির্বাচনের বছরকে সামনে রেখে বিতর্ক এড়ানোর জন্য তারা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন। পাঠ্যপুস্তকে হিন্দুত্ববাদের সমালোচনাকে তিনি অপপ্রচার হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন বক্তব্যে। বলেছেন, ২০১৭ সালেও ‘অপপ্রচার হয়েছিল’। তাঁর ভাষায়-এবারের ‘অপপ্রচার মাত্রাহীন এবং মিথ্যা প্রচারণায় ভরপুর ছিল’। এর মানে হল-যারা হিন্দুত্ববাদি পাঠ্যপুস্তকের সমালোচনা করেছেন তারা সকলেই অপপ্রচারকারী।
বই প্রকাশনা ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এনসিটিবি। এই প্রতিষ্ঠানের সদস্য যখন এমন কথা বলেন, তখন এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, তারা ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্যই এখানে বসেছেন। বেতন নিচ্ছেন বাংলাদেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকায়। বাস্তবায়ন করছেন ভারতের চরমপন্থি হিন্দুত্ববাদি সংগঠন আরএসএস-এর চিন্তাপ্রসূত পরিকল্পনা। ভারতপন্থি প্রথম আলো এই গোল টেবিলের নিউজের শিরোনাম করেছে ‘দুই পাঠ্যবই প্রত্যাহারের বার্তা সবার জন্য অশনিসংকেত।’ অর্থাৎ হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠায় তাদের অগ্রযাত্রা সাময়িকভাবে বাধাগ্রস্ত হওয়াকে অশনিসংকেত হিসাবে দেখছেন তারা। এই পত্রিকাটির ভাষায় গোলটেবিল আয়োজনে যারা ছিলেন তারা সবাই বিশিষ্টজন। কিন্তু একটি বিষয় এখানে লক্ষণীয়। আওয়ামী ও ভারতপন্থি ছাড়া বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের পক্ষে কেউ কথা বললেই তাঁর নামের আগে ট্যাগ লাগানো হয় ‘বিএনপি ও জামায়াত’ পন্থি হিসাবে। এই পত্রিকাটির চরিত্র হচ্ছে ভারতের পক্ষে কথা বললে বিশিষ্টজন এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের পক্ষে কথা বললে বিএনপি-জামায়াত বা হেফাজত পন্থি। ভারতপন্থি এই পত্রিকাটি যে বাংলাদেশের মুসলমানদের সংস্কৃতিকে ভুলিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত সেটা বারবার প্রমান রাখছে।
বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নারী সন্ত্রাসীদের আক্রমণের ঘটনা গুলো নিয়ে দেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় চলছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক নিরীহ ছাত্রীকে ছাত্রলীগের চিহ্নিত নারী সন্ত্রাসীরা রাতভর পিটিয়ে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করেছে। এই ঘটনা আওয়ামী হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে। এসব ঘটনায় নীরবতা পালন করে ছাত্রলীগের নারী সন্ত্রাসীদের পক্ষে অবস্থানের জানান দিয়েছেন- বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফাওজিয়া মোসলেম, ওয়াইডব্লিউসি’র সাধারণ সম্পাদক হেলেন মনীষা সরকার, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর, এনজিও কর্মী রাশেদা কে চৌধুরী, কথিত ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবীর ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাষ্টি মফিদুল হক।
ছাত্রলীগের নারী সন্ত্রাসীদের সন্ত্রাস নিয়ে কোন বাক্য তাদের ব্যয় করতে দেখা যায়নি কখনো। ছাত্রলীগের নারী সন্ত্রাসীদের সন্ত্রাস নিয়ে যখন সর্বত্র আলোচনা, ঠিক এ সময়ে পাঠ্যবইয়ে হিন্দুত্ববাদের পক্ষে সাফাই গাইতে পরিকল্পিতভাবে মাঠে নেমেছেন তারা। বিভিন্ন ইস্যুতে ভারতের হিন্দুত্ববাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে এই গোষ্ঠী বরাবরই সক্রিয়।
স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে ভারতের মুসলমি শাসকদের কঠোর ভাষায় সমালোচনা, বিদেশী দখলদার হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অথচ, মুসলিম শাসকদের সুলতানি আমলেই ‘বাঙ্গাল’ নামে প্রথম কেন্দ্রীয় শাসনের রাষ্ট্র তৈরি হয়েছিল। এর আগে বাঙ্গাল নামে কোন নির্দিষ্ট ভূখণ্ড ছিল না। খণ্ড খণ্ড রাজ্য ছিল বিভিন্ন রাজার অধীনে। সুলতানি আমলেই এই রাজ্য গুলোকে একত্রিত করে বাঙ্গাল বা বাংলা নাম দেয়া হয়। এছাড়া বাংলা ভাষার স্বীকৃতিও দেওয়া হয় সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ’র আমলে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষার উন্নতিও হয়েছিল সুলতানি আমলেই। ইখয়িতার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বাংলা বিজয় ও সুলতানি আমলকে বিদেশীদের শাসন হিসাবে চিহ্নিত করে হিন্দুত্ববাদের তৈরি করা এই বই প্রত্যাহারকে অশনিসংকেত বলে চিহ্নিত করেছে এই দালালগোষ্ঠী। কঠোর সমালোচনার মুখে প্রত্যাহার করা বইয়ে পক্ষে পক্ষে সাফাই গেয়ে ভারতীয় দালালদের গোল টেবিলের ভাষা অনুযায়ী-অপ্রত্যাশিতভাবে আলোচনা ছাড়াই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দু’টি বই প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহন বিঘ্নিত হচ্ছে।
বই দু’টি প্রত্যাহারে ব্যথিত এনজিও কর্মী রাশেদা কে চৌধুরীর মনের ব্যথায় কাতর হয়ে বলেছেন,-‘আমাদের জীবদ্দশায় এ রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে ভাবি না। কি করে একটি অসাম্প্রদায়িক দেশকে আমরা পুরোপুরি উল্টো দিকে নিয়ে যাচ্ছি, বুঝতে পারছি না।’
ইসলাম ও মুসলমানদের কটাক্ষ করে বিকৃত ইতিহাসকে তারা বর্ণনা করছেন অসাম্প্রদায়িকতা হিসাবে। তাদের ভাষায় অসাম্প্রদায়িকতা হচ্ছে হিন্দুত্ববাদের জয়গান করা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো। চিহ্নিত ভারতীয় দালাল গোষ্ঠীর এই সদস্যরা বিকৃত ইতিহাস রচনার মাধ্যমে ৯০ শতাংশ মুসলমানের সন্তানদের টার্গেট করেছে। আগামী প্রজন্মকে হিন্দুত্ববাদ মুখি করে গড়ে তুলতে তারা মাঠে নেমেছেন ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে।
১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর থেকে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদ সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের জন্য এক শ্রেণীর দালাল তৈরি করেছিল এই ভূখণ্ডে। এই দালাল গোষ্ঠী সম্প্রসারিত হয়ে এখন রাষ্ট্রীয়ভাবে পাঠ্যপুস্তকে চুড়ান্ত আঘাত হেনেছে। স্কুলের পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে কোমলমতি শিশু-কিশোরদের মনে ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষ ছড়িয়ে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের চুড়ান্ত রূপ দিতে মরিয়া হিন্দুত্ববাদের পূজারিরা।
সুতরাং দু’টি বই প্রত্যাহারের ঘোষণা হচ্ছে এদের সূক্ষ্ম একটি অপকৌশলমাত্র। দু’টি বই শুধু নয়, পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকেই তারা গ্রাস করে ফেলেছে। দুই বই প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে সাময়িকভাবে তারা পরিস্থিতি সামাল দিতে চাচ্ছেন। এই প্রত্যাহারের ঘোষণায় খুশি হওয়ার কিছু নেই। চিহ্নিত ভারতীয় দালালরা মাঠে নেমে তাদের টার্গেটকে সামনে রেখে। এই আয়োজনের মাধ্যমে দেশের ৯০ শতাংশ মানুষকে ধোঁকা দেওয়াই হচ্ছে তাদের লক্ষ্য। বই দু’টি প্রত্যাহারে সরকারের সমালোচনা করে তারা দেখাতে চায় তাদের টার্গেট পূরণ হয়নি। সমালোচনাকারীরা নীরব হয়ে যাবে। এতে বাকী পাঠ্যপুস্তকে হিন্দুত্ববাদী প্রচারণা নিরাপদ হয়ে যাবে।
মূলত: শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ-এর সার্বভৌমত্বই শুধু ভারতের হাতে অর্পণ নয়, দেশের হাজার বছরের মুসলিম সংস্কৃতিকে হিন্দুত্ববাদ দ্বারা বদলে দেওয়ার একটি মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছেন এই চিহ্নিত দালালরা।
আমার দেশ সম্পাদক শ্রদ্ধেয় মাহমুদুর রহমান ২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল গ্রেফতার ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী আমার দেশ বন্ধ করে দেওয়ার আগের সপ্তাহে একটি সম্পাদকীয় মন্তব্য লিখেছিলেন সাংস্কৃতিক লড়াই নিয়ে। এই সাংস্কৃতিক লড়াইয়ে ভারতের পক্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছে প্রথম আলো-ডেইলিস্টারসহ ভারতপন্থি পত্রিকা এবং টেলিভিশন চ্যানেল গুলো। আর মাঠে নেতৃত্ব দিচ্ছে এই গোল টেবিল আয়োজনের সাথে সংশ্লিষ্ট চিহ্নিত ভারতীয় দালালরা। তারা স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে আগ্রাসনের মাধ্যমে এখন চুড়ান্ত বিজয়ের পথে। দু’টি বই প্রত্যাহারে আনন্দিত হয়ে তাদেরকে মাঠ ছেড়ে দিলে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম ভারতমুখি হবে। ১৯৪৭ সালে মুসলিম ভূ-খণ্ড হিসাবে আমরা যে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম সেটার কোন অস্তিত্ব থাকবে না।
লেখকঃ নির্বাহী সম্পাদক, আমার দেশ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন