ডঃ মুহাম্মাদ সাঈদুল ইসলাম
স্বাধীনতার পর থেকে নিয়ে অদ্যাবধি বাংলাদেশ বেশ কিছু অভিনব রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। সংস্কৃতিগুলো অনেক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করলেও গণতান্ত্রিক চর্চায় সেগুলো চরম বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সংস্কৃতিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সংকোচনবাদ (Reductionism)।
সংকোচনবাদ হলো মানব সভ্যতা এবং অস্তিত্বের অনিবার্য আর্থ-সামাজিক এবং ঐতিহাসিক যোগসূত্রগুলোকে (connections) অস্বীকার বা অবজ্ঞা করে স্বীয় স্বার্থ হাসিলের নিমিত্তে শুধু বিশেষ কতগুলো ঐতিহাসিক পথ-পরিক্রমাতে স্বীয় জাতির অস্তিত্ব এবং পরিচয়কে আবদ্ধ করা।
এরিক উলফ (Eric Wolf) তার সাড়া জাগানো বই Europe and the People without History তে এ বিষয়ের বিষদ বর্ণনা করেছেন। ইউরোপের উন্নয়নের মূলে ছিলো তাদের কলোনিগুলোর ধন সম্পদ। অথচ অনেক ইউরোপীয় লেখক এ অনিবার্য যোগসূত্রকে অবজ্ঞা বা অস্বীকার করে তাদের উন্নতির পেছনে শুধু তাদের স্বীয় অবদানকেই আলোকপাত করে থাকে। এরিক উলফের মতে এটা এক ধরনের সংকোচনবাদ। তিনি বলেন- কোন জাতি বা গোষ্ঠীই এককভাবে বেড়ে উঠতে পারে না, সকল উন্নয়নের পিছনে থাকে ঐতিহাসিক যোগসূত্র, পূর্ব সভ্যতাগুলোর অবদান এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের সংযুক্তি। এজন্য জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং ইতিহাসের সুবিশাল পথ পরিক্রমার মাঝে শুধুমাত্র বিশেষ কোন ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্যে কোন জাতির সমুদয় পরিচয় এবং সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশকে আবদ্ধ করাটা শুধু ঐতিহাসিক ভুলই ( historical blunder) নয়, বরং এক ধরনের অহমিকাও বটে যা সকল মানুষের সহবস্থানের জন্য চরম হুমকি স্বরূপ। ইউরোপ এবং আমেরিকায় যে বর্ণবাদের (Racism) উৎপত্তি হয়েছে- তার মূলেই রয়েছে সংকোচনবাদ।
বাঙালী জাতির পরিচিতিও হাজারো বছরের ইতিহাসের সমষ্টি। বাঙালীর রয়েছে অনেক অর্জন ও বিসর্জনের পথ পরিক্রমা, রয়েছে শাসন-শোষণ ও সংগ্রামের দীর্ঘ খতিয়ান, রয়েছে অন্যান্য সভ্যতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের সংমিশ্রণ। আর এসব নিয়েই আমরা বাঙালী বা বাংলাদেশী। স্বাধীনতার জন্য ১৯৭১ সাল যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তদ্রূপ ১৯৪৭ সালের ঘটনা প্রবাহও আমাদের জন্য আরো তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান এবং ভারত বিভক্ত না হলে ‘বাংলাদেশ’ নামক একটি দেশ কেবল স্বপ্নই রয়ে যেত। পাল বংশ, সেন বংশের শাসন, মুসলিম শাসকদের আগমন ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপন, শায়েস্তা খানের ‘সোনার’ যুগ-এসবই আমাদের ইতিহাস, অস্তিত্ব ও পরিচিতির (identity) সাথে একীভূত।
ইতিহাসের গলিপথে একটু নজর বুলালেই দেখতে পাই, সুলতান হাজী শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের সময় থেকে 'বাঙ্গালি' ও 'বাঙ্গালাহ' নামের ব্যাপক বিস্তৃতি পরিলক্ষিত হয় এবং সমগ্র বঙ্গদেশ সর্বপ্রথম 'বাঙ্গালাহ' নামে পরিচিত হয়। শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ বাংলায় স্বাধীন সুলতানী আমলের সূচনা করেন। তিনি এই অঞ্চলের অনেকগুলো এলাকাকে একত্রিত করে 'বাঙ্গালা' নামে এবং এর সকল অধিবাসীকে 'বাঙ্গালী' নামে অভিহিত করেন। সুলতান নিজে 'শাহ-ই-বাঙ্গালাহ' ও 'শাহ-ই-বাঙ্গালি' উপাধি ধারণ করেন। হিন্দু রাজাদের আচরণ থেকে এটা ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম একটি কাজ। বাংলার বৃহদাংশ এসব রাজাদের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলেও হিন্দু ও বৌদ্ধ রাজারা নিজেদেরকে গৌড়েশ্বর বা গৌড়রাজ বলতে গর্ববোধ করতেন। সংকোচনবাদের কারণে অধিকাংশ বাঙালীর কাছে এই পরম ঐতিহাসিক সত্যটাও আজ অজানা, অথচ "বাঙালী" হিসাবে আমরা গর্বে টইটুম্বুর!
বাংলাদেশীদের জন্য ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিঃসন্দেহে এক অতীব তাৎপর্যময় ঘটনা। আমাদের অস্তিত্ব এবং স্বত্তার জন্য এ সংগ্রামটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হলেও এটাই বাংলাদেশী বা বাঙালী জাতির প্রথম এবং শেষ ইতিহাস নয়। অনেকটা রাজনৈতিক কারণে আমাদের কৃষ্টি সভ্যতা এবং ইতিহাস ঐতিহ্যের হাজারো বছরের অর্জন ও সংগ্রামকে বাদ দিয়ে কিংবা অবজ্ঞা করে শুধু ১৯৭১ সালের সংগ্রামের মধ্যে আমাদের জাতিসত্ত্বার অস্তিত্বকে বিনির্মাণ করাটা সংকীর্ণতাবাদ বা সংকোচনবাদেরই বহিঃপ্রকাশ। বর্তমান ১৯৭১ সালের ঘটনা প্রবাহ এবং সংগ্রামকে এতটাই রোমান্টিক আবহ দিয়ে সার্বক্ষণিকভাবে আলোকপাত করা হয়েছে এবং হচ্ছে যে- মনে হয় ১৯৭১ সালের পূর্বে বাঙালী জাতি বলে কিছু ছিলো না। জাতি গঠন, জনগণের মধ্যে সমন্বয় সাধন, সহ-অবস্থান নিশ্চিতকরণ সহ সম্মুখে এগিয়ে চলার জন্য নিঃসন্দেহে জাতির গৌরবের ইতিহাসগুলোকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার প্রয়োজন হয়। কিন্তু ইতিহাসের অন্যসব পথ পরিক্রমা বাদ দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য শুধু একাত্তরের সংগ্রামকে ফোকাস করার ফলে প্রকারান্তে অনেক অপসংস্কৃতির জন্ম নিয়েছে। অনেক বুদ্ধিজীবী এই সংকোচনবাদকে দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকর মনে করলেও কিছু স্বার্থবাদী মহল ছাড়া কেউই কোন উপকার পাচ্ছে না, বরং দেশ তলিয়ে যাচ্ছে এক অবনতি, সংঘাত এবং অনিশ্চয়তার অতল গহ্বরে। বাংলাদেশের জন্য সংকোচনবাদের বর্তমান এবং সুদূর প্রসারী কয়েকটা প্রভাব নিম্নরূপ:
১. এটা আমাদের মন মগজকে এক সংকুচিত ফ্রেমে আবদ্ধ করছে। একটা জাতির উন্নতি এবং অগ্রগতির জন্য যে একটা উদার এবং প্রশস্ত মানসিকতা প্রয়োজন – সেটা বিনষ্ট করছে। আমাদের চিন্তা চেতনা শুধু একাত্তরের ঐতিহাসিক ফ্রেমে আবদ্ধ থাকায় বন্দিখানার মতো বন্দিদশা নিয়ে চেঁচামেচি করছি, কিন্তু এই ফ্রেমের বাইরে এসে মুক্ত বিহঙ্গের মতো উন্মুক্ত মন নিয়ে সুবিশাল পৃথিবীতে বিচরণ করতে পারছিনা; পারছিনা আমাদের সহোদর ভাইদেরকে আপন করে নিতে। এটা একটা চরম মানসিক বঞ্চনা (Mental trauma)!
২. এটা আমাদের চিন্তা চেতনাকে অতীতমুখী (Retrogressive) করে রাখছে। আবার অতীতমুখী করলেও তা কেবল ১৯৭১ সালে এসে থেমে যাচ্ছে। এটা আমাদের সামনে চলার পথকে বারে বারে রুদ্ধ করছে। এক পা সামনে চলতে চাইলেও পরক্ষণে দুই পা পিছিয়ে যাচ্ছে। ফলে আমরা হয় আমাদের পূর্বের জায়গায় পড়ে আছি অথবা একাত্তরের টানে বারে বারে পিছিয়ে যাচ্ছি; উন্নতি বা অগ্রগতির ভিশন নিয়ে সামনে এগুতে পারছিনা।
৩. যেহেতু রাজনৈতিক কারণে সংকীর্ণতাবাদ বা সংকোচনবাদকে তৈরী করা হয়েছে এবং নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়নের মাধ্যমে সেটা ছড়ানো হচ্ছে, এজন্য বিশেষ কিছু রাজনৈতিক দলের মধ্যে একাত্তরকে পৈত্রিক সম্পত্তি হিসাবে দখল রাখার প্রবণতা লক্ষণীয়। এটা নিয়েই শুরু হয়েছে –'স্বাধীনতার ঘোষক কে' সে দ্বন্দ্বের। গত পাঁচ দশকে এই একটা প্রশ্ন নিয়ে এতটাই বাড়াবাড়ি হয়েছে যে মনে হচ্ছে- এটা নিয়ে ঝগড়া করা ছাড়া বাংলাদেশীদের আর কোন কাজ নেই!
৪. একাত্তরে স্বাধীনতার কৃতিত্ব কোন ব্যক্তি বা দলের নয়; এটা সবার, আপামর জনসাধারণের, যারা এর জন্য লড়েছে বিভিন্নভাবে। এজন্য রাজনৈতিক কারণে যখনই স্বাধীনতার মালিকানা দাবী করা হয়, তখনই শুরু হয় সংঘাত। মালিকানা দাবীর প্রবণতাই আজ এতো সংঘাত, মিথ্যাচার, ঝগড়া-ফ্যাসাদ এবং বিভক্তি রচনা করেছে বাঙালী জাতির মাঝে। জেদ ও কপটতা পার হয়ে এই মালিকানা দাবী যেমন একদিকে জন্ম দিয়েছে অন্যদের (রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ) অবদানকে অস্বীকার করার সংস্কৃতি, অন্যদিকে দেশে বৃদ্ধি করেছে চরম রাজনৈতিক সংঘাত। অথচ ‘স্বাধীনতা’ কখনো মালিকানা দাবীর বিষয় নয়, বরং স্বাধীনতা অর্জন এবং রক্ষার জন্য কাজ করে দেখিয়ে দেওয়ার বিষয়।
৫. সংকোচনবাদের ফলে জন্ম হয়েছে বিভক্তির রাজনীতি যা উন্নয়নের রাজনীতিকে ঘরছাড়া করে পাকাপোক্ত করেছে ঝগড়া, দুর্নীতি ও লাঠিতন্ত্রের। ফলে উন্নতি-অগ্রগতি প্রভৃতি চিন্তার পরিবর্তে কারা স্বাধীনতা বিরোধী, কিভাবে তাদের শাস্তি দেয়া বা ঘায়েল করা যায়, কিভাবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে জোর করে স্বাধীনতা বিরোধী হিসাবে লেবেল দেওয়া যায় – এগুলোতেই কাটে নেতা নেত্রীর আসল সময়। দেশের উন্নতি অগ্রগতির বিষয়গুলো আর দিনের আলো দেখার সুযোগ পায়না।
৬. রাজনৈতিক সহ অবস্থানের পরিবর্তে জন্ম হয়েছে চরম ঘৃণা ও প্রত্যাখ্যানের রাজনীতি। এই ঘৃণাবোধের বিষবাষ্প ধীরে ধীরে পৌঁছে গেছে সমাজের সকল রন্ধ্রে। মানুষ হয়ে ওঠেছে পরশ্রীকাতর- হিংসুক- সন্ত্রাসী। ঘৃণাবোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বিভিন্নভাবে: চরম জেদ, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যা, প্রমাণের পূর্বেই ‘স্বাধীনতা বিরোধী’ বা ‘যুদ্ধ্বাপরাধী’ হিসাবে খেতাব দেয়া- ইত্যাদি। ইতিহাসে কখনো কোন জাতি তথাকথিত চেতনার নামে এই ঘৃণার রাজনীতি দিয়ে উন্নতির মুখ দেখেনি।
সংকোচনবাদের যে নমুনা বাংলাদেশে বিদ্যমান, তাতে পুরো জাতি ভোগান্তিতে শিকার হলেও কিছু দল বা গোষ্ঠী এতে লাভবান হয়েছে। এই সংকোচনবাদের উর্ধ্বে উঠে দেশ গঠন করা বেশ কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। আব্রাহাম লিংকন, নেলসন ম্যাণ্ডেলা সহ বিশ্বে অনেক নেতাই এই সংকীর্ণতাবাদের উর্ধ্বে থেকে জাতি গঠন করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও অনেকটা এই সংকোচনবাদের উর্ধ্বে ছিলেন, কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর দলের অনুসারীরাই সংকোচনবাদকেই রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের নিমিত্তে ব্যবহার করছেন এবং দেদারসে করে যাচ্ছেন।
লেখকঃ সহযোগী অধ্যাপক, নানইয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি, সিঙ্গাপুর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন